তখন অতিথিদের নিস্তব্ধতা। তাদের হাতে স্টেইনলেস স্টিল চামচযুগল চিনামাটির প্লেটে ঘষা লেগে খটাখট শব্দের যুদ্ধ চলছিল। তার মানে ইফতার পর্ব শুরু হয়ে গেছে। একটু আগে একজন মাওলানা কিছু দোয়া-খায়ের করার পর মোনাজাত করেছেন। মোনাজাতে তিনি বলেছেন, হে আল্লাহ পাক-পরোয়ার দিগার—হাসমত আলী পাটোয়ারি সাহেব আজ যে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করেছেন, তুমি তার নেক মাকসুদ পূর্ণ করে দাও। মন্ত্রী মহোদয় এখনো এসে পৌঁছাননি, হে আল্লাহ তুমি তাকে সহিসালামতে আমাদের সাথে এসে শামিল হওয়ার তৌফিক দান করো। তুমি গাফুরুর রহিম আল্লাহ, তুমি সবার দিলের খবর জানো।
এত চমৎকার বর্ণনার একটি মোনাজাতের সময়ও হাসমত পাটোয়ারি উপস্থিত থাকতে পারলেন না। কারণ তিনি বাইরে সদর দরজার সামনে মন্ত্রী মহোদয়ের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কখন এসে পড়েন, ঠিক নেই। দুই মিনিটের পথ বাকি, কিন্তু জ্যামের কারণে কত মিনিট লাগে তার ঠিক নেই। ইফতার শুরু হয়ে গেছে। অথচ হাসমত সাহেব শুরু করতে পারছেন না। এই বুঝি মন্ত্রী মহোদয় এসে পড়েন। হাসমত সাহেব আসর নামাজ পড়ার পর থেকে পায়চারী শুরু করেছিলেন। অতিথিদের অভ্যর্থনা জানিয়ে ভেতরে নিয়েছেন। পাঁচতারা হোটেলে এত বড় ইফতার আয়োজনেরও একটা উদ্দেশ্য আছে। উদ্দেশ্য না থাকলে অবশ্যই গরিব-মিসকিনরা এর অংশীদার হতে পারতো। অথচ এখানে শুধু সমাজের উঁচু স্তর এবং ধনিক শ্রেণীর লোকদেরই নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। আত্মীয়-স্বজনের কেউ কেউ পুরো পরিবারসহ এসেছে। বেশ কিছু শিশুকেও দেখা গেছে, যাদের চঞ্চলতা চোখে পড়ার মতো। হাসমত সাহেবের কিছু চেলা-চামুন্ডা আছে তাকে সহযোগিতা করার জন্যে। মোনাজাত শুরুর আগে মাওলানা সাহেব যখন সংক্ষিপ্ত বয়ান দিচ্ছিলেন, তখন হাসমত সাহেবের একটি ছোটখাটো বিপদ হলো। তিনি আসরের সময় ওজু করেছিলেন এবং ভেবেছিলেন এই ওজুতেই মাগরিব পড়বেন। কিন্তু বাধ সাধল পেট থেকে এসে পশ্চাৎদেশ থেকে নির্গত গ্যাস। তিনি বেশ কিছু সময় চাপাচাপি করে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন, কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না।
একসময় ঠুস করে বের হয়ে গেলো। তখন নতুন করে ওজু করার সময়ও নেই। যদি মন্ত্রী মহোদয় এসে পড়েন! মন্ত্রী মহোদয় চিফ গেস্ট। তাকে অভ্যর্থনা জানাতে না পারলে পুরো আয়োজনটাই বৃথা হয়ে যাবে। অভ্যর্থনা জানানোর দৃশ্যটি অথবা মন্ত্রী মহোদয়ের আগমনের দৃশ্যটি ধারণ করার জন্যে কয়েকটি ক্যামেরা ট্রি-পয়েডের ওপর বসিয়ে রেখেছে মিডিয়া কর্মীরা। বন্দুকের মতো তাক করা যেন দেখামাত্র গুলি। হাসমত সাহেব ভেবে পান না তিনি কী করবেন। পাদ দিলে ওজু নষ্ট হবে এটাই বা কেমন কথা। ইসলাম ধর্ম শান্তির ধর্ম মাঝে মাঝে কোনো কারণে কত যে অশান্তি, বলে শেষ করার নয়। এই যে পাদ দেওয়ার ব্যাপারটা—এটাতে ওজু ভাঙার কারণ থাকবে কেন? নাক দিয়ে সর্দি ঝরলে, হাঁচি-কাশি দিলে যদি ওজু না ভাঙে, এটাতে ভাঙবে কেন? পেশাব-পায়খানা করলে ওজু ভাঙে সেটা আলাদা কথা, কারণ তাতে শৌচের প্রয়োজন হয়। পাদে তো শৌচের প্রয়োজন হয় না। এসব নানা চিন্তায় অস্থির হাসমত সাহেব না ওজু করতে যেতে পারছেন, না দোয়া মাহফিলে যেতে পারছেন। এছাড়া তার বড় একটা অস্বস্তি, তিনি আজ গর্জিয়াস ধরনের পাঞ্জাবি পরেছেন।
পাজামা-পাঞ্জাবিতে অভ্যস্ত নন বলে কিছুটা বিরক্তিও প্রকাশ করছেন মনে মনে। একেকবার পাঞ্জাবির কলার ধরে টেনে ঝাঁকি মেরে দেখছেন, একেকবার মাথায় হাত দিয়ে টুপি ছুঁয়ে দেখছেন পড়ে গেছে কি না। ইতোমধ্যে হাসমত সাহেবের এক চেলা এসে পানি আর খেজুর দিয়ে ইফতার করাতে সাহায্য করলো। তাকে বললেন, তোমরাও ইফতার করে নাও।
হাসমত সাহেবকে ঘিরে থাকা বেশ কয়েকজন চেলা-চামচার ভেতর থেকে একজন বললো, স্যার আপনি না গেলে আমরা যাই কী করে? তাছাড়া আমরা সবাই পানি মুখে দিয়েছি।
অন্য একজন বললো, ঠিক আছে স্যার, আগে মন্ত্রী স্যার আসুক তারপর একসাথে ইফতার করবো।
তখন ক্যামেরা ধরে রাখা একটি ছেলের মুখে খেজুর তুলে দিলো একটি মেয়ে। মেয়েটি সাংবাদিক তা বোঝা গেলো, তার হাতে ধরা বেসরকারি একটি টিভি চ্যানেলের লোগো সংবলিত বুম দেখে। সাংবাদিকেরা এভাবেই একে অন্যকে ইফতার করতে সাহায্য করছে। অবশ্য ভেতরে তাদের জন্য আলাদাভাবে বসার জায়গা করা হয়েছে এবং সেখানে সাংবাদিক শব্দটি স্ট্যান্ডের সঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তারাও সুষ্ঠুভাবে ইফতার করতে পারছে না, মন্ত্রী মহোদয়ের বিলম্বের কারণে। আবারও ফোন করলেন হাসমত সাহেব। মন্ত্রী মহোদয়ের পিএস বললেন, আমরা হোটেলের সামনেই আছি, এই তো এক মিনিট লাগবে।
ওদিকে বড় হলরুমে চামচ আর প্লেটের খটাখট শব্দ হচ্ছেই। মনে হচ্ছে কতদিন না-খাওয়া বুভুক্ষরা হামলিয়ে পড়েছে খাবারের ওপর। কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়, নীরবতার মধ্যে এমনটা হয়ে থাকে। কিছু লোক আছেন চামচে অভ্যস্ত নন, তারা হাত লাগিয়েছেন। এই ইফতারের পর মাগরিবের নামাজ হবে, তারপর মন্ত্রী মহোদয় কিছু কথাবার্তা বলবেন এবং তারপর ডিনার। তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। কারণ অনেকেই আবার গিয়ে তারাবির নামাজ পড়বেন। যেহেতু মন্ত্রী মহোদয় দোয়া মাহফিলের পূর্বে এসে পৌঁছাননি এবং কিছু বলতে পারেননি, সেহেতু ধারণা করা হচ্ছে চিফ গেস্ট হিসেবে তিনি বাদ মাগরিব বক্তৃতা করবেন।
ডিক্লিয়ার দেবেন নিশ্চয়ই। হাসমত সাহেব দাঁড়িয়ে মাইকে ফুঁ দিলেন দুবার। তরপর বললেন, প্রিয় অতিথিগণ, আজ আমাদের ইফতার মাহফিলে উপস্থিত হয়েছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় মন্ত্রী।
পুলিশের গাড়িতে হর্ন শোনা গেলো। তার মানে মন্ত্রী মহোদয় এসে পড়েছেন। হাসমত আলী পাটোয়ারি সাহেব চেলা-চামচা নিয়ে গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। একসঙ্গে চারটি গাড়ি এসে থামলো। দুটি পুলিশের, দুটি দুজন মন্ত্রীর। প্রতিমন্ত্রী যিনি এসেছেন, তিনি হিন্দু গোত্রীয় হলেও ইফতার পার্টি ছাড়াও মুসলিমদের অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পছন্দ করেন। অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি। মন্ত্রী মহোদয় নামার সঙ্গে-সঙ্গেই হাসমত সাহেবের চেলা-চামুন্ডারা চেঁচিয়ে স্লোগান দিতে থাকলো—মন্ত্রী মহোদয়ের আগমন—শুভেচ্ছা স্বাগতম। এই কমন স্লোগানের বাইরে কেউ যেতে পারলো না। মন্ত্রী মহোদয় স্বয়ং বিষয়টা নিয়ে একটু ভাবলেন এবং আগেও অনেকবার ভেবে তিনি একটি স্লোগান ঠিক করে রেখেছেন। মন্ত্রী মহোদয় এসেছেন—ধন্য মোদের করেছেন। স্লোগান হিসেবে এটা খারাপ হবে না। ‘মোদের’ শব্দটি একটু ব্যাকডেটেড হলেও ধাক্কা দেবে নিজস্ব চেতনায়। তিনি এই স্লোগানটি সবাইকে শিখিয়ে দিতে চান। কিন্তু নিজের বিষয় নিজের কাছে একটু কেমন লাগে।
মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে সালাম বিনিময় এবং করমর্দন শেষ করেই দ্রুত তাদের নিয়ে হাসমত সাহেব হলরুমের দিকে এগোতে থাকেন। চেলাদের উদ্দেশে বললেন, তোমরা পুলিশ ভাইদের নিয়ে গিয়ে ইফতার করানোর ব্যবস্থা করো। ইতোমধ্যে ক্যামেরাম্যানরা তাদের ক্যামেরা ট্রিপয়েড থেকে সরিয়ে হাতে ধরেছেন।
হাসমত সাহেব মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং সঙ্গে থাকা পিএসদের নিয়ে নির্ধারিত স্থানে চলে যান। ততক্ষণে ৭ মিনিট বিলম্ব হয়ে গেছে ইফতারে। ইফতার করতে করতে হাসমত সাহেব ভাবলেন, মাগরিবের নামাজ পড়তে হলে ওজু করা জরুরি। কিন্তু মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গ না দিয়ে ওজু করতে যাওয়া কি ঠিক হবে? এছাড়া আরেকটি জরুরি বিষয় তার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকল। মন্ত্রী মহোদয় তো ইফতারের আগে বক্তব্য রাখতে পারেননি, মাগরিবের পর কি তিনি কথা বলতে রাজি হবেন? আজই কি তিনি ডিক্লিয়ার দেবেন? শুধু ঢাকা শহরের রাজনৈতিক নেতারা নয়, হাসমত সাহেবের এলাকা থেকেও বেশ কিছু নেতা ও গণ্যমান্য ব্যক্তিকে আনা হয়েছে। কেউ কেউ প্রাইভেট কারে এলেও বেশিরভাগ লোককেই মাইক্রোতে আনা হয়েছে।
হাসমত সাহেব ব্যবসায়ী মানুষ। হিসেবেও পাকা। এত ব্যয় করার পেছনে মুনাফা লুকিয়ে থাকে। মুনাফাই ব্যবসার মূল শক্তি। কিন্তু ইফতার পার্টি করে মুনাফা খোঁজার লোক নন হাসমত সাহেব। তার চাওয়াটা ছিল অন্যভাবে। কিন্তু স্বয়ং মন্ত্রী মাহোদয়ই পরামর্শ দিয়েছেন ইফতার পার্টি দেবার জন্যে। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে লোকে নাকি রাজনীতির গন্ধ খুঁজে পাবে না। রাজনীতি এমন একটা বিষয়, কখন কার মধ্যে ঢুকানো হবে তা রাজনীতিবিদ ছাড়া সাধারণ মানুষও এখন তা বুঝতে পারে। সেজন্য টেকনিক খাটাতে হবে যেন তারা না বুঝতে পারে।
হাসমত আলী পাটোয়ারি রাজনীতিতে অতটা অভিজ্ঞ নন। সারাজীবন শ্রম দিয়েছেন ব্যবসার পেছনে। এখন তাঁর টাকার অভাব নেই। টাকা হলে জনমত পাওয়া কোনো ব্যাপার নয়। জনমত পাওয়ার আগে অবশ্য নেতার মত লাগবে। নেতার মত না পেলে যেমন জনমত পাওয়া যাবে না, আবার জনমত না পেলে রাজনীতি করা যাবে না। তাছাড়া রাজনীতিতে আরেকটি বিষয় খুব জরুরি তা হালো ক্ষমতা। ক্ষমতা যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ স্বাধীনতা, বলা যায় স্বেচ্ছাচারিতা। যখন ক্ষমতা নেই তখন স্বাধীনতা নেই। সবাই কমবেশি স্বাধীনতা খোঁজে। আর সে-কারণেই বেশির ভাগ রাজনীতিবিদ দল পরিবর্তন করে, নীতি ও আদর্শ পরিবর্তন করে। কারণ একদলের আদর্শ-নীতি থেকে আরেক দলের আদর্শ-নীতি ভিন্ন। যখন কেউ ভিন্ন আদর্শে যায় তখন বুঝে-শুনেই যায় এবং সে বোঝে এটা স্বার্থের জন্য। এই স্বার্থই এখন স্বাধীনতা। এসব কথা মন্ত্রী মহোদয় হাসমত সাহেবকে বলেননি। হাসমত সাহেব নিজে থেকেই উপলব্ধি করতে পেরেছেন। তবু তাঁর অনেক ইচ্ছে মানুষের জন্য কিছু করা, দেশের জন্য কিছু করা। নিজের জন্য তো অনেক করেছেন, আর প্রয়োজন নেই। এমন একটি ভাবনার কথা জানালে মন্ত্রী মহোদয়ই শিখিয়েছেন অর্থ ব্যয় করলে সেটা প্রোফিট সহ রিটার্ন আনার বিকল্প নেই। এসব কথা কখনো হাসমত সাহেবের বুকে বর্শার ফলার মতো বিঁধেছে, আবার চারপাশের প্রেক্ষিত বিবেচনায় হঠাৎ করেই ফলা খসে পড়েছে। সুতরাং তার মধ্যেও ইচ্ছের দানা জট পাকিয়ে পাকিয়ে অনেক শক্তিশালী হয়েছে।
এখন তিনি নিজেই শক্তিশালী হতে চান। আরও শক্তিশালী। না হলে এত বড় আয়োজনের কোনো মানে নেই। তিনি নিজেও বুঝেছেন এটা সোয়াব কামানোর আয়োজন নয়, অর্থ কামানোর আয়োজন। সুতরাং মন্ত্রী মহোদয় এখন মুখ তুলে তাকালেই হয়। ইফতার করতে করতে মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে দুচার কথা হলো। সেটা যানজট নিয়েই বেশি। ঢাকা শহর থেকে এই জট কবে যে ছুটবে তার ঠিক নেই। মেট্রোরেল চালু হলে হয়ত জট আর থাকবে না। কিন্তু সেটাও তো সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। একটু ধৈর্য তো ধরতেই হবে। তবে একটা আজব ব্যাপার ঘটল। সারাপথ জ্যাম, পুলিশের হুইসেলেও কোনো কাজ হচ্ছে না। কিন্তু যখনই ইফতারের সময় হলো—রাস্তায় আর গাড়ি নেই, একেবারে ফাঁকা। মানুষ বেশ ধর্মকর্ম করে মনে হচ্ছে। বলে মন্ত্রী নিজেই হাসেন। তার মুখ থেকে একটা মুড়ি ছিটকে পড়ে। তার হাসির সঙ্গে তাল মেলাতে প্রতিমন্ত্রী মহোদয় হাসেন, হাসমত সাহেবও একটু হাসেন। হাসমত সাহেব হেসে ততটা জুত করতে পারেন না। কারণ তিনি ভেতরে ভেতরে ঘামছেন, মন্ত্রী মহোদয় ডিক্লিয়ার দেবেন তো আজ?
পাঞ্জাবিটা বেশ অস্বস্তি বৃদ্ধি করে চলেছে। আজকের দিনে কোট-প্যান্ট পরা যুক্তিসংগত হতো না। মন্ত্রী মহোদয়ও পাজামা-পাঞ্জাবি পরে এসেছেন। টুপি পরেননি, পকেটে আছে কি না কে জানে। ততক্ষণে চামচ-প্লেটের সংঘর্ষ অনেকটা শিথিল হয়েছে। অনেকেই ইফতার শেষ করে উঠে গেছেন পাশের লম্বা লবিতে, যেখানে কার্পেটের ওপর সাদা কাপড় পেতে নামাজের ব্যবস্থা করা হয়েছে। জামাতে নামাজ পড়ানোর জন্য তৈরি হয়েছেন মাওলানা সাহেব। তাঁর দুজন সহযোগী ব্যস্ততার সাথে একটি জায়নামাজ পেতে দিল তাঁর অবস্থানে। মাওলানা সাহেব হালকা ঢেকুর তুললেন। একটু পরই নামাজ আরম্ভ হবে।
হাসমত আলী সাহেব হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন যখন মন্ত্রী মহোদয় জানতে চাইলেন এখানে ওজুর ব্যবস্থা আছে কি না। হাসমত সাহেব প্রতিমন্ত্রী মহোদয়কে বললেন, স্যার আপনি একটু বসুন প্লিজ, আমরা নামাজ পড়ে আসছি। ওদিকে নামাজ শুরু হয়ে গেছে। হাসমত সাহেব এবং মন্ত্রী মহোদয় ওজু করে আসতে আসতে দুই রাকাত শেষ। তারা ব্যস্ততার সঙ্গে এসে জামাতে এক রাকাত নামাজ ধরতে পারলেন।
নামাজ শেষে কেউ কেউ সিগারেট ফুঁকতে বাইরে বের হলেন। এটা অনেকের অভ্যেস সারাদিন সিগারেট না খেয়ে থাকা মানে যেন কতদিন কী যেন খাওয়া হয়নি। আর বাকি সবাই এসে আবার রাউন্ড টেবিলগুলো দখল করলেন। ইফতারের আগে বিকালে যিনি এই অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেছিলেন তার নাম জাহিদ মাহমুদ। তিনি হাসমত সাহেবের অফিসের বিপণন কর্মকর্তা। ইংরেজির পাশাপাশি খুব ভালো বাংলা জানেন এবং চমৎকার উচ্চারণ। হাসমত সাহেব খুব পছন্দ করেন জাহিদ মাহমুদকে। জাহিদ সাহেব জানতে এলেন হাসমত সাহেবের কাছে—কিভাবে শুরু করবেন, মন্ত্রী মহোদয়কে আগে ডাকবেন না কি প্রতিমন্ত্রী মহোদয়কে, না কি হাসমত সাহেবকে? হাসমত সাহেব তাকে কিছু না বলে নিজেই উঠে গেলেন মাইকের কাছে। তার ভেতরে আবেগ কাজ করছিল। মন্ত্রী মহোদয়কে এখানে পেয়ে তিনি ভীষণ খুশি। ডিক্লিয়ার দেবেন নিশ্চয়ই। হাসমত সাহেব দাঁড়িয়ে মাইকে ফুঁ দিলেন দুবার। তরপর বললেন, প্রিয় অতিথিগণ, আজ আমাদের ইফতার মাহফিলে উপস্থিত হয়েছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় মন্ত্রী।
সঙ্গে সঙ্গেই চেঁচিয়ে স্লোগান শুরু করে দিলো হাসমত সাহেবের চেলা-চামুন্ডারা—মন্ত্রী মহোদয়ের আগমন শুভেচ্ছা স্বাগতম। হাসমত সাহেব হাত ইশারায় তাদের থামিয়ে দিয়ে বললেন, আমি এখন জনদরদি-দেশদরদি আমাদের প্রিয় মন্ত্রী মহোদয়কে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করছি।
তার স্ত্রী বললেন, নমিনেশন অত সোজা নয়। টাকা ঢালছ, আরও ঢালো—দেখা যাক কী হয়। রাজনীতি খুব জটিল। হাসমত সাহেবও সেটাই ভাবছেন রাজনীতি কতটা জটিল, কেমন জটিল। রাজনীতিটা মূলত পাদ দেওয়ার মতো, শব্দ যেমনই হোক—ঠুস অথবা ফুঁস।
মন্ত্রী মহোদয় উঠে মাইকের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন আর হাসমত সাহেব একটু সরে গিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন, যেন ক্যামেরায় তার ছবি দেখা যায়। মন্ত্রী মহোদয়ের পাশে তাকে সহজেই চিহ্নিত করা যাবে। রাজনীতিতে এটাও একটা কৌশল। শহীদ মিনারে, স্মৃতিসৌধে বা কবরে ফুল দেওয়ার সময় যেমন মুখ দেখানো জরুরি হয়ে পড়ে, তেমনই। মন্ত্রী মহোদয় বলতে শুরু করলেন, উপস্থিত ভাই ও বোনেরা, আমি প্রথমেই দুঃখ প্রকাশ করছি বিলম্বে পৌঁছানোর কারণে। আপনারা জানেন, আমার দাপ্তরিক কাজ অনেক, তবু সভা-সমিতিতে যেতে হয়। মন্ত্রণালয় থেকে রওনা দিতে একটু বিলম্ব হয়েছে, সেই সঙ্গে যানজটের হ্যাপা তো আছেই। তবু আজকের এই ইফতার পার্টিতে আসতে পেরে আমার ভীষণ ভালো লাগছে। এজন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি আয়োজক জনাব হাসমত আলী পাটোয়ারি সাহেবকে।
নাম বলার সঙ্গে সঙ্গে হাসমত সাহেবের চেলা-চামুন্ডারা স্লোগান ধরলো—হাসমত ভাই, যেখানে আমরা আছি সেখানে।
তাদের কোনোমতো থামিয়ে মন্ত্রী মাহোদয় বলতে শুরু করলেন, প্রিয় ভাইয়েরা আমার, আপনারা জানেন যে, বর্তমান সরকার দেশের উন্নতিতে অনেকগুলো প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। এইসব প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে আমাদের জিডিপি গ্রোথ বৃদ্ধি পাবে। আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হবো। ইত্যাদি ইত্যাদি।
হাসমত সাহেব যেন এসব কথা শোনার জন্য কোনোভাবেই প্রস্তুত ছিলেন না। মন্ত্রী মহোদয়ের কোনো কথা যেন তার কানে প্রবেশ করছে না। শুধু একবারই তার নাম উচ্চারিত হয়েছে, পুরো ভাষণজুড়ে দ্বিতীয়বারের জন্য হাসমত নামটি আর উচ্চরিত হলো না। কোথায় ডিক্লিয়ার?
মনের ভেতরে অসম্ভব ক্ষোভ জমা হয় বলেই তো মানুষ এসব মন্ত্রী-টন্ত্রীকে শালা-বাঞ্চৎ বলে গালাগাল করে। হাসমত সাহেব ভেতর থেকে কোনো গালি দিচ্ছেন কি না, কে জানে। তবে মন্ত্রীদের সামনে সবাই আদাব-সালাম দেয়—এটাই নিয়ম।
ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটলো বাসায় গিয়ে টিভির সামনে বসে। খুব আগ্রহ নিয়ে খবর শুনছিলেন হাসমত আলী পাটোয়ারি। ফুটেজে তাকে অতটা দেখা গেল কি গেলেঅ না বোঝা গেলো না। তিনি মন্ত্রীর খুব নিকটে দাঁড়িয়ে ছিলেন কিন্তু ক্যামেরাম্যান ক্লোজ করে শুধু মন্ত্রীর ছবি নিয়েছে। খবরে শুধু বলা হলো—দেশের সার্বিক উন্নয়নে বর্তমান সরকার অনেকগুলো প্রকল্প হাতে নিয়েছেন তার মধ্যে আছে রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালর্ভাট, ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল ইত্যাদি। পদ্মাসেতুর কাজও দ্রুত এগিয়ে চলেছে। রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে আজ একটি ইফতার পার্টিতে মাননীয় মন্ত্রী এসব কথা বলেন।
খবরেও হাসমত সাহেবের নাম উচ্চারিত হলো না। কার ইফতার পার্টি, কিসের ইফতার পার্টি কিছুই বলা হলো না। রাগে-দুঃখে তার নিজের চুল টেনে ছিঁড়তে ইচ্ছে করলো, না কি স্ত্রীকে দিয়ে ছিঁড়াবেন বুঝতে পারছিলেন না। তার স্ত্রী বললেন, নমিনেশন অত সোজা নয়। টাকা ঢালছ, আরও ঢালো—দেখা যাক কী হয়। রাজনীতি খুব জটিল। হাসমত সাহেবও সেটাই ভাবছেন রাজনীতি কতটা জটিল, কেমন জটিল। রাজনীতিটা মূলত পাদ দেওয়ার মতো, শব্দ যেমনই হোক—ঠুস অথবা ফুঁস।