বুকে প্রচণ্ড ব্যথা, গলা শুকিয়ে গেছে, জিহ্বাটা ভেতরে চলে যেতে চাইছে। থুতু গেলার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হলো না, গলার ভেতরটা শুকনো কাঠ হয়ে আছে। জিহ্বা টেনে রাখার চেষ্টাও ব্যর্থ হলো। পানি, পানি করে যে চিৎকারটা বের হয়ে আসতে চাইছে, তা ঠোঁট পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই পেটের মধ্য হারিয়ে যাচ্ছে। একটি শব্দও বের হচ্ছে না। বুকের বাম পাশটায় কাঁটা দিয়ে আঘাত করে যাচ্ছে যেন কেউ। শরীর শূন্যে ভাসছে। আঁকড়ে ধরার মাটিটুকু পর্যন্ত নেই। হাত বাড়াতেই শূন্যতা গিলে খাচ্ছে সে হাত। হাত ধরার মতো একটা হাতও নেই পাশে। কেউ একজন মুখের কাছে পানি এনেও কী মনে করে ফিরিয়ে নিয়ে গেলো। চারপাশে নিকষ কালো অন্ধকার। আলো জ্বালানোর জন্য দিয়াশলাইয়ের একটা কাঠিও আর অবশিষ্ট নেই। মাথাটা উঁচু করার চেষ্টা করছে দোয়েল, পারছে না, খুব ভারী হয়ে আছে। জোর করে তোলার চেষ্টা করতেই মনে হলো, কেউ একজন লোহা দিয়ে সজোরে আঘাত করলো মাথায়। নিথর হয়ে পড়ে রইল সে। ব্যথা নেই। মনে হচ্ছে মাথার ওপর কেউ একটা পাহাড় কেটে বসিয়ে দিয়েছে। সে পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে বসে আছে দোয়েলের প্রিয় মুখগুলো। করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। তবে কি এটা মৃত্যুর পূর্ব-মুহূর্ত! মরে যাচ্ছে দোয়েল?
না না। মরে যাওয়া কি এত সহজ! কতই বা বয়স হবে তার? ২৯/৩০ বছর? সবাই যে বলে জীবনের এখনো কত কী বাকি! তাহলে মরে যাচ্ছে কেন সে?
মার মুখটা খুব মনে পড়ছে দোয়েলের। মার চেহারা এত বিষণ্ন লাগছে কেন? মার কি মন খারাপ? এত মায়া ওই মুখে! দেখলেই বাঁচতে ইচ্ছে করে। দোয়েল মরে গেলে মার কী হবে! মা তো অনেক কষ্ট পাবে। কাঁদবে খুব। মা কাঁদলে এত অসহায় লাগে দোয়েলের নিজেকে! সেই মাকে কাঁদিয়ে চলে যাবে দোয়েল! বাবার পরে দোয়েলও যদি চলে যায়, মা এত আঘাত সহ্য করতে পারবে তো! কী করবে দোয়েল এখন? মরে যাওয়ার আগে মাকে একবার ছুঁতে পারবে না? মার শরীরের ঘ্রাণটা আর নিতে পারবে না?
ভাইয়ের কথা মনে পড়ছে, ছোট বোন দুটির মুখ, বোনের ছেলের কথা মনে পড়ছে। বোনের ছেলেটা দোয়েলকে মা ডাকে। মাত্র ৩ বছর বয়স ওর। অথচ এত অল্প সময়ে সবার সবটাজুড়ে রয়েছে ও। মরে গেলে দোয়েলকে মনে থাকবে ওর? মনে পড়ছে কবিতার কথা, না দেখা ভালো লাগার কথা, কারও সঙ্গে কথা বলার তৃষ্ণার কথা। মনে পড়ছে বাবার কবর, কবরের ওপরে পাতাবাহার গাছটার কথা। কবরের পাশে আমলকির চারাটা, মায়ের হাতের একফালি সবজি ক্ষেত, নদীর তীর, নতুন টিনের ঘর; সব মনে পড়ছে। টিনের ঘরের সেই বইয়ের আলমারি, আলমারিতে সাজানো শরৎ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, বঙ্কিম, সমরেশ আরও কত জীবন! আলমারির ওপরের ফুলদানিটাও মনে পড়ছে। খুব শখ করে মা প্লাস্টিকের ওয়ারড্রব কিনে দিয়েছিল একটা, মনে পড়ছে। ওয়ারড্রবে জামাকাপড় রাখতে এসে দোয়েলকে ছুঁয়ে দেখবে কি কেউ ওর মৃত্যুর পরে?নদীর পাড়ের পেঁপে গাছটার কথা মনে পড়ছে খুব, ভারি মিষ্টি খেতে। মা যখন পাকা পেঁপে গাছ থেকে তুলে এনে কাটবে, দোয়েলের কথা ভেবে কি একটা অংশ তুলে রাখবে রান্নাঘরের এক কোণে? লেমিনেটিং করা সার্টিফিকেটগুলো কি কোনো কাজে আসবে আর? মনে পড়ছে সেই গ্রাম, বর্ষার যৌবনা নদী, নৌকায় ঘুরে বেড়ানোর সব স্মৃতি।
শাপলা ফুল তুলতে যাওয়া দল বেঁধে, সেই শাপলার সঙ্গে চিংড়ি মাছের ঝোল, মায়ের হাতের পিঠা, করলা ভাজি, সব মনে পড়ছে। মরতে চায় না দোয়েল।
দুই.
ছোট্ট একটা কামরা। তিন তলা বিল্ডিংয়ের নিচতলার একটা ঘর। কোনো জানালা নেই। সঙ্গেই একটু জায়গা নিয়ে টয়লেট আর বাথরুম। একটা দরজা থাকা বাধ্যতামূলক। তাই আছে, দরজার পাশে দুটো হ্যাঙ্গার ঝুলছে। সিঙ্গেল রুম। ছোট একটা বেড, মাথার কাছে পুরনো আমলের চৌদ্দ ইঞ্চি কালার টিভি। টিভির ওপরে রাজ্যের ধুলোর গড়াগড়ি। বাথরুমের দেয়ালের ওপর সারিবদ্ধ দুই লাইনে আটটি ছিদ্র আছে। আলো বাতাস ঢোকার এই একমাত্র সম্বল এই ঘরের। সেখান দিয়েই ভোরের প্রথম সূর্যের আলো এসে পড়েছে দোয়েলের মুখে। ধীরে ধীরে আলোতে ভরে উঠছে কামরাটা, অন্ধকার পালাতে শুরু করেছে। সে আলো দোয়েলের গায়ে লুটোপুটি খাচ্ছে, হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। একলাফে বিছানায় উঠে বসে সে। হাঁপাতে থাকে। কোথায় সে? বুঝতে একটু সময় লাগে। নিজেকে কোনো রকম স্বাভাবিক করে বিছানা থেকে দ্রুত নেমে যায়, যেখানে পানির একটা বড় জার রাখা আছে, গতকালই হোটেল থেকে ৫০ রুপি দিয়ে নিয়েছে, সেখানে। প্লাস্টিকের ওয়ান টাইম গ্লাস ভরে পানি ঢেলে দেয় গলায়। একবার, দুই বার, তিন বার। গলাটা ভিজিয়েই জারের পাশেই বসে পড়ে। তাড়াহুড়োয় মেঝেতে পানি পড়ে একাকার।
স্বপ্ন দেখছিল দোয়েল। এত ভয়ঙ্কর আর জীবন্ত হয় স্বপ্ন? মাথাটা এখনো ভারী হয়ে আছে ওর। আস্তে আস্তে উঠে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ে। ক্লান্তি লাগছে খুব, রাতের স্বপ্নটা কষ্ট ছড়িয়ে রেখেছে সারা দেহমনে। জানালা নেই বলে আকাশ দেখা যায় না। দিনেও লাইট জ্বালিয়ে রাখতে হয়। আকাশ না দেখে থাকা যে কত যন্ত্রণার, তা এই প্রথম বুঝতে পেরেছে দোয়েল।
ক্রিশ্চিয়ান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ভেলোর, তামিলনাড়ু। এর সামনের গলি দিয়ে ৫ মিনিট হেঁটে গেলে এ হোঁটেলে পৌঁছানো যায়। একা আছে বলে এখানে থাকতে হচ্ছে। কারণ এ হোটেলে দোয়েলের ঠিক পাশের রুমে ওর পরিচিত এক বাঙালি পরিবার আছে। একদম একা থাকার চেয়ে পাশের রুমে পরিচিত কোনো মানুষ আছে, এই অনুভূতিটার জন্যও নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়া যায়। তাই আকাশ দেখার কষ্টটা মেনে নিয়েই উঠে পড়েছে এ হোটেলে। রুমটাতে একটা আয়নাও নেই। না আকাশ দেখা যায় না, দেখা যায় নিজেকে। গতকাল খুব টিপ পরতে ইচ্ছে করছিল, বাজারে গিয়ে ৫ রুপি দিয়ে একপাতা টিপ কিনে এনেছিল। সেটাও আয়নার অভাবে আর পরা হয়নি।
এখানকার হোটেলগুলোয় এক কিলো করে গ্যাস আর হাঁড়িপাতিল পাওয়া যায় ভাড়ায়। ডাক্তার দেখাতে আসে যারা, তারা রান্না করে খায়। এর দুটো কারণ আছে। এক, অনেকদিন সময় লাগে চিকিৎসা করাতে, তাই রান্না করে খেলে খরচ কম পড়ে। দুই, এখানকার খাবার বাঙালিরা খেয়ে স্বাদ পায় না। আলাদা একটা গন্ধ আছে এখানকার মসলায়। এছাড়া প্রায় সব খাবারে কারি পাতা ব্যবহার করে। এটা দেখতে অনেকটা বাংলাদেশের কামিনী ফুলের পাতার মতো। এ পাতার উপকারিতা অনেক বেশি বলে এখানকার খুব প্রিয় এটা।
একা আছে বলে রান্নার ঝামেলায় যায়নি দোয়েল। ফল কিনে এনেছে, মাঝে মাঝে খেয়ে নেয় বাইরে।
তিন.
ভেলোরে এসে দোয়েল একা। একা থাকাটা একদম খারাপ লাগছে না তার। একাকিত্বটা উপভোগ করে। পুরো সময়টা একাকিত্বে ডুবে থাকতে চায়। নিজেকে জানার এক অমোঘ সুযোগ করে দিয়েছে এই একাকিত্ব। সবার ভিড়ে, ব্যস্ততায় হৃদয়ের ভেতরটা দেখা হয় না কতকাল! নিজের জন্য নিজের সময় হয় না বহুদিন। আজ সময় হয়েছে নিজেকে নিজের সামনে দাঁড় করানোর। নিজের মধ্যে ডুবে থাকার। হারিয়ে যাওয়া সত্তাকে খুঁজে ফেরার। তাই এই একাকিত্ব বড় আনন্দের। হৃদয়ের প্রতিটি ভাঁজ খুলে খুলে পুরনো স্মৃতির গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে অতীতে হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ আর হবে কি না, সে জানে না। তাই পরম মমতায় ধুলোপড়া, আধখাওয়া স্মৃতিগুলোকে রাঙিয়ে তুলতে ব্যস্ত আজ দোয়েল।
চার.
সিএমসি হাসপাতাল, গাইনি বিভাগ, দোতলা, ২৪ নম্বর রুমের সামনে বসে আছে দোয়েল। সিরিয়াল নম্বর ১২। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে হাসপাতাল। নিয়ম মেনে সব কাজ চলে এখানে। নিয়মের বাইরে কিছু করে না এরা। একেক জন রোগী ভেতরে গিয়ে ফিরে আসছে প্রায় ৪০ থেকে ৫০মিনিট পর। কারণ ২৪ নম্বর রুমের ভেতরে যিনি আছেন, তিনি খুব যত্ন করে সময় নিয়ে রোগী দেখছেন। খুব ভয় হচ্ছে দোয়েলের। কী বলবে ডাক্তার, ভাবতে ভাবতে ঘেমে যাচ্ছে দোয়েল। বাংলাদেশে যত ডাক্তার দেখিয়েছে, সবাই একই কথা বলেছে তাকে। জরায়ুতে বাসা বেঁধেছে ভয়ঙ্কর টিউমার। শরীর থেকে কেটে আলাদা করতে হবে জরায়ু। ডাক্তারের মুখে এমন কথা শুনে ভেতরে ভেতরে দোয়েল মরে গেছে কত বার, তা সে নিজেও বলতে পারবে না। মা দুঃখ পাবে বলে নিজেকে আড়াল করতে ব্যস্ত থেকেছে সবসময়। আজ হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে বসে এসব ভাবতে ভাবতে অতীতে হারিয়ে যায় সে।তার ভাবনায় ছেদ পড়ে ১২ নম্বর ডাক শুনে। দোয়েল সব রিপোর্টের ফাইল হাতে নিয়ে ২৪ নম্বর রুমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে উঠে দাঁড়ায়। দোয়েলের বুক কাঁপছে, দুই পায়ের ওপর ভর দিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছে না, পা দুটি ঠক ঠক করে কাঁপছে।