‘এক হাজার আয়নার ঘর’ নামে একটা গল্প পড়েছিল রবিন। গল্পের মোরাল ছিল, জীবনটা একটা আয়নার মতো। যে যেভাবে জীবনকে দেখবে, জীবন ঠিক সেভাবেই তার কাছে ধরা দেবে। যারা সাহসিকতা, ভালোবাসা, উৎসাহ আর জয় করার অদম্য ইচ্ছা নিয়ে সামনে এগিয়ে যায়, জীবন তাদের কাছে অনেক সহজ ও আনন্দময় হয়ে ধরা দেয়। কিন্তু যারা হতাশা, ভয়, মানসিক অবসাদ নিয়ে সামনে এগুতে চায়, তাদের চোখে সাফল্য যেন মরীচিকা, জীবন হয়ে ওঠে ক্লান্তিকর, বিষণ্ন।
কথাটা সত্য। তবে এসব গালভরা কথা শুনতে মধুর শোনালেও বাস্তব অনেক কঠিন। ভয় না থাকলেও হতাশা আর অবসাদ রবিনেরনিত্যসঙ্গী। হয়তো সে সামনে এগুতে চায় না। সাফল্যও তাই মরীচিকা। তবে সাফল্যের ব্যাপারটা আপেক্ষিক। একেকজনের কাছে এর সংজ্ঞা একেকরকম। রবিন যে সফল হতে পারেনি, এটা নিয়ে তার মাথাব্যথা আছে বলেও মনে হয় না। কিছু কিছু মানুষের কাছে সফল হওয়া এতটাই জরুরি যে সারা জীবন শুধু এর পেছনেই ঘুরে মরে।
রবিন তো তখন থেকেইনিজের ভবিতব্য জানে যখন পঁচিশ বছর ধরে ভালোবেসেও সে কথা জানাতে পারেনি রাত্রিকে। ‘পুরো দুনিয়াটাই একটা রঙ্গমঞ্চ, আর প্রতিটি নারী ও পুরুষ সে মঞ্চের অভিনেতা, এই মঞ্চে প্রবেশ পথও আছে আবার বহির্গমন পথও আছে, জীবনে একজন মানুষ এই মঞ্চে অসংখ্য চরিত্রে অভিনয় করে’ শেক্সপিয়ারের এই উক্তির প্রবেশ পথটিই শুধু খুঁজে পেয়েছে রবিন। বের হবার পথটি খুঁজে পাচ্ছে না। ‘যন্ত্রণা নাও,নিখুঁত হয়ে ওঠো’- যন্ত্রণাকে সঙ্গী করেওনিখুঁত হয়ে উঠতে পারেনি রবিন। কথায় আছে, ‘উন্মত্ততাতেই জীবনের মহিমা’। উন্মত্ত হতে পারলো না সারা জীবনে! মহিমান্বিত হওয়াও বুঝি তাই আর হলো না।
একাকিত্বটা উপভোগ করে রবিন। এজন্যেই হয়ত সে একা।নিজের একান্ত কথাগুলো কাউকে বলতে ইচ্ছে করে না রবিনের।নিজের ভেতর রাখতেই ভালোবাসে। একা থাকলে মায়ের মুখটা মনে পড়ে। ঝাপসা। মায়ের সঙ্গে খুব বেশি মধুর স্মৃতি নেই রবিনের। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে মাকে কখনো সুস্থ থাকতে দেখেনি। এটা সেটা অসুস্থতা লেগেই থাকতো। রোজ গোসলের আগে ঘষে ঘষে সরিষার তেল মেখে দিতেন রবিনকে। বুকে, পিঠে। রবিনের সুড়সুড়ি লাগত। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তো। মা হাসতেন, ছেলে মানুষের আবার এত সুড়সুড়ি কেন রে! অর্ধেক তেল মাখা নিয়েই গোসল করতে চলে যেতো। তিন ভাইয়ের মধ্যে রবিন সবার ছোট। বড় দুই ভাই সাঁতার জানলেও সে জানতো না। বাবা অনেক চেষ্টা করেও রবিনকে সাঁতার শেখাতে পারেননি। পড়ালেখা ছাড়া প্রায় সব ব্যাপারেই বড় দুই ভাইয়ের চেয়ে পিছিয়ে ছিল রবিন। মা খুব আফসোস করতেন। তিনি একটু বেশিই ভালোবাসতেন রবিনকে। আদর করে রবিন পাখি ডাকতেন। সব সন্তানদের বাবা-মা সমান ভালোবাসেন কথাটা প্রচলিত হলেও রবিনের ধারণা কথাটা আসলে ঠিক নয়। মা যখন মারা যান রবিনের বয়স তখন মাত্র নয় বছর। ছোট হলেও রবিন বুঝতো, মা অন্য দুই ভাইয়ের চেয়ে তাকে বেশি আদর করেন। প্রশ্রয় দেন। হতে পারে রবিন সবার ছোট এবং তার ভাইদের চেয়ে একটু বোকাসোকা, সেজন্যেই হয়তো ওর প্রতি মায়ের পক্ষপাত ছিল। দুর্বল সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের বেশি মায়া থাকে। কারণ যাই হোক না কেন, মা তাকে একটু বেশিই ভালোবাসতেন। মারা যাওয়ার পরে একেকদিন দুপুরে হঠাৎ করেই মা-র কাছে যেতে ইচ্ছে করতো। মায়ের বুকটা ছিল নরম, পাখির পালকের মতো। মায়ের ঘরেও কেমন যেন একটা মা মা গন্ধ। ছয় মাসের মাথায় বাবা যখন ছোট খালাকে বিয়ে করে ঘরে আনলেন, তখন থেকে মায়ের ঘরে আর কখনো ঢোকেনি রবিন। ছোট খালা রবিনকে কাছে ডাকতেন, আদর করতে চাইতেন। কিন্তু মায়ের ঘরে খালার থাকাকে কখনোই সহজভাবেনিতে পারেনি।
অন্তত এ ধরনের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের দেশে তো বটেই! বহুক্ষেত্রে শুধু সন্তানের জন্য সংসার টিকিয়ে রাখতে দেখেছে রবিন। তার অভিজ্ঞতাও তো কম হলো না! তবেনিজে এসব বিশ্বাস করে না। কারুর জন্য জীবন থেমে থাকে না। জীবন তারনিজের মতো করেই পথ খুঁজে নেয়।
আজ চেম্বারে যাবে না রবিন। মাঝে মাঝেই এমন করে। মন না চাইলে কিছুই করতে ইচ্ছে করে না। সিগারেট ধরায়। ঠোঁট গোল করে ধোঁয়া ছাড়ে। এই সময়গুলোতে রাত্রির কথা ভাবতে ইচ্ছে করে। একই মেডিক্যালে পড়েছে দু’জন। রবিন সি ব্যাচে আর রাত্রি ছিল ডি ব্যাচে। রাত্রিকে ওর প্রথম চোখে পড়ে সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার পর। টিউটোরিয়াল ক্লাসে। প্রথম দিন দেখেই বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠেছিল। মায়ের মুখটা মনে পড়েছিল একঝলক। হালকা-পাতলা, লাজুক, নম্র একটা মেয়ে। পাকা গমের মতো গায়ের রঙ। অগ্রহায়ণের রোদের মতো নরম। ঠোঁট আর নাকের মধ্যবর্তী অংশটা কী ভীষণ মায়াবী। বিন্দু বিন্দু ঘামে ভেজা। চোখের ভেতর গভীর বিষাদ। কোমর-ছাপানো চুল। জলোচ্ছ্বাস টের পেল শরীরে। এই প্রথম কোনো মেয়েকে দেখে এরকম অনুভূতি হয়েছিল রবিনের। ক্লাস শেষে কিছুদূর রাত্রির পিছু পিছু হেঁটেছিল। এই মেয়েটিকে না পেলে বাঁচবে না রবিন। এমনই মনে হয়েছিল সেদিন। অথচ রবিন আজও দিব্যি বেঁচে রয়েছে। কেন বেঁচে আছে? বেঁচে থাকবার কো্নো কারণ খুঁজে পায় না। অবশ্য এটাকে ঠিক বেঁচে থাকা বলে কি’না সে ব্যাপারেনিশ্চিত নয় ও। খাওয়া-পরা, ঘুমানো আর চেম্বারে রোগী দেখা যদি বেঁচে থাকার সংজ্ঞা হয়, তবে মানতেই হবে বেঁচে আছে।
খুব করে কিছু চাইলে কেন যেন সেটা হারিয়ে ফেলে রবিন। চেয়েছিল, মা তাকে অনেকদিন পর্যন্ত গায়ে তেল মাখিয়ে দিক। হারিয়ে ফেলল মা’কে। খালাকে ঘরে আনার পর বাবাকেও হারিয়ে ফেলেছে। বড় দু’ভাই বরাবরের মতোই সবদিকে এগিয়ে গিয়েছে। রবিন একাকী। আজকাল কেউ এমবিবিএস ডাক্তার হয়ে বসে থাকে না। রবিন থেকেছে।
যেদিন বুঝেছে রাত্রিকে কিছুতেই পাবে না, সেদিন থেকেই দ্বিতীয় এবং শেষবারের মতো জীবনের প্রতি অনাসক্ত হয়ে পড়েছে। প্রথমবার হয়েছিল মাকে হারানোর পর। এরপরেও যে শেষ পর্যন্ত মেডিক্যাল পাস করেছে, বিয়ে করেছে, একটি সন্তানের বাবা হয়েছে, এতেই হতবাক রবিন। বেশিরভাগ সময়েই অপরাধবোধে ভোগে। তারনির্লিপ্ত,নিস্পৃহ জীবনের সঙ্গে একটি মেয়েকে জড়ানো ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ বলে মনে হয়। এরমধ্যে আবার আরেকটি জীবনের প্রতিধ্বনি। ওদের মেয়ে মাশিয়াত। ওর মুখের দিকে চেয়েই হয়ত এতটা কাল বেঁচে রয়েছে রবিন। অচল জীবনকে চালিয়ে নেওয়ার, অধারণকৃত জীবনকে ধারণ করানোর পক্ষে মোক্ষম অস্ত্র হচ্ছে সন্তান। অন্তত এ ধরনের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের দেশে তো বটেই! বহুক্ষেত্রে শুধু সন্তানের জন্য সংসার টিকিয়ে রাখতে দেখেছে রবিন। তার অভিজ্ঞতাও তো কম হলো না! তবেনিজে এসব বিশ্বাস করে না। কারুর জন্য জীবন থেমে থাকে না। জীবন তারনিজের মতো করেই পথ খুঁজে নেয়।
রবিন যেদিন শুনেছিল, রাত্রি বিবাহিতা এবং এক সদ্যজাত সন্তানের মা, সেদিনও ঘূণাক্ষরে মনে হয়নি, এরকম একজনকে পেতে চাওয়া বারণ। কাছের দু-একজন বন্ধুদের কাছে শেয়ার করেছিল ব্যাপারটা। ওরা কেউ হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিল, কেউ বা ধর্তব্যের মধ্যেই নেয়নি। বিবাহিত একটা মেয়েকে কেন ভালো লাগবে! এ যেন বিরাট অন্যায়! মাথাটা এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল রবিনের। কী করে বোঝাবে, হিসাব করে কী এসব ভালো লাগা হয়! কে বোঝাবে কাকে! একটিবার, শুধু একটিবারের জন্য রাত্রিকে জানাতে চেয়েছিল রবিনের ভালো লাগার কথা। কিন্তু বন্ধুরা এমনভাবে বাগড়া দিলো, এমনভাবে ওর দিকে তাকাল, যেন এত অদ্ভুত, অবাস্তব, অস্বাভাবিক কথা জীবনে কখনো শোনেনি। রাত্রিকে কখনোই বলা হয়ে ওঠেনি রবিনের। কিন্তু তাতে কিছুই এসে যায় না। রবিনের ভালোবাসা উত্তরোত্তর বেড়েছে বৈ কমেনি। আগের চেয়েও বেশিমাত্রায় ভালোবেসে গেছে রবিন। কারুর সঙ্গে মিলে না ওর। কাউকে বুঝে উঠতে পারে না। ভালোবাসার মানুষকে নাকি অবিবাহিত হতে হবে, বয়সে ছেলের চেয়ে মেয়ে বড় হওয়া যাবে না, ধর্ম মিলতে হবে আবার স্ট্যাটাসও নাকি খুব বেশি অসমান হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। এতসব শর্ত নিয়ে নাকি ভালোবাসতে হয়। অদ্ভুত এই জীবন, অদ্ভুত এই পৃথিবীকে বুঝে ওঠা হলো না রবিনের। আজও ভালোবাসে রাত্রিকে। পঁচিশ বছর আগের চেয়ে আরও বেশি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভালোবেসে যাবে। পাস করার পর বাড়ি ফিরে গেলে রাত্রির কোনো খবর আর পায়নি রবিন। কিন্তু সারাজীবনেও এমন ভালো আর কাউকে বাসতে পারেনি। ‘চাতক পাখির এমনি ধারা, তৃষ্ণায় জীবন যায় গো মারা। অন্য বারি খায় না তারা, মেঘের জল বিনে।’
মাঝে কেটে গেছে দশটি বছর। হঠাতই একদিন ফেসবুকে রাত্রিকে খুঁজে পাওয়া। এর মধ্যে একটি দিনের জন্যেও ভোলেনি রাত্রিকে। কিন্তু ফেসবুকে যোগাযোগ হওয়ার পর শুরু হলো নতুন তোলপাড়। ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে, আমরা ভেবে করব কী!’
পাস করার পর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন চাকরি করলেও কোথাও থিতু হতে পারেনি রবিন। গাজীপুরের চেম্বারটাই ওর ভরসা। বাঁধাধরানিয়মে জড়াতে ইচ্ছে করেনি কোনোদিন।
সকাল থেকেই মেঘ জমতে শুরু করেছিল। বিকেল থেকে শুরু হয়ে গেল ঝড় বৃষ্টি। রোগী যে কয়জন এসেছিল দেখা হয়ে গেছে। এরকম আবহাওয়ায় নতুন রোগী আসার সম্ভাবনা কম। একের পর এক বজ্রপাত হচ্ছে। দূরে কোথাও বিকট শব্দ হল। ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে। মোবাইলে ফেসবুক অন করল। রাত্রি নতুন ছবি আপলোড করেছে। সেই শান্ত, জড়তাগ্রস্ত, দ্বিধান্বিত, লাজুক মেয়েটি এখন অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী, চৌকস আর পুরোমাত্রায় দ্বিধাহীন। আগেকার সেই হালকা পাতলা ভাবটা নেই। ভরাট শরীর। একটা ছবিতে ঠোঁট আর নাকের মাঝে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আঙুলের ডগা দিয়ে ছুঁয়ে দিলো। এই ঘামটা স্পর্শ করতে কত রাতনির্ঘুম থেকেছে রবিন!
একটাই তো জীবন! হাজার আয়নার ঘরের মতো এই জীবনে ভালোবাসা প্রকাশ না করে পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে না। রাত্রির কাছে যাবে রবিন।
আকণ্ঠ প্রেমে পড়ে রবিনের সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। একটা জিনিসও ঠিকমত করে উঠতে পারেনি। রাত্রি ঠিকই এগিয়ে গেছে। থেমে থাকেনি।
ঝড়-বৃষ্টি দাপটের সঙ্গে দাবড়ে বেড়াচ্ছে। জানালার কাচে ধাক্কা লেগে বড় বড় ফোটাগুলো কুচি কুচি হয়ে যাচ্ছে। রবিনও যদি এমন করে মাথা কুটে কাঁদতে পারতো! ভেঙে চুর চুর হয়ে যেতে পারতো! প্রচণ্ড শক্তিতে মাটিতে পা দাবিয়ে চিৎকার করতে পারতো যদি! বুকের ভেতর উথালপাতাল। রবিনের মতো অসম্পূর্ণ একজন মানুষের বেঁচে থাকা কতটা যুক্তিযুক্ত? বেশিরভাগ মানুষই কি কোনো না কোনো ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী? রবিনের ছেলেবেলার বন্ধু রাসেলের ছেলেটা অটিস্টিক। বড় কষ্ট। ওর কাছেই শুনেছে, নিউরোটিপিক্যাল মানুষদের পক্ষে সমাজ সংসারে বসবাসের উপযোগিতা বেশি। এদের হাতেই রয়েছে পৃথিবী। সবকিছুতে ভারসাম্য করতে এরা সিদ্ধহস্ত। স্বার্থের ব্যাপারে সচেতন। তবে পৃথিবীর লাবণ্যের লালিমাতে প্রতিবন্ধীদের অবদানও ফেলনা নয়। সৃজনশীলতার সঙ্গে পাগলামির কিছুটা হলেও যোগাযোগ আছে। পাগলামি ছাড়া সুন্দরতম কিছু সৃষ্টি করা অসম্ভব! এজন্যেই কি সৃষ্টিশীল মানুষেরা একটু আধটু পাগল কিসিমের হয়!নিজেকে হালকা পাতলা অটিস্টিক মনে হয় রবিনের। মানুষের সঙ্গে খুব একটা ভালো করে মিশতে পারে না। জমিয়ে আড্ডা দিতে পারে না। হৈ-হুল্লোড়ও পারতপক্ষে এড়িয়ে চলে।নিজেকে ঠিকমত প্রকাশেও অপারগ। বিয়ের প্রথম রাতেই সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। সারা রাত রাস্তায় রাস্তায় হেঁটেছে। মনে হয়েছিল, উদ্দেশ্যহীন হাঁটার জন্যেই জন্ম হয়েছে ওর। কোজাগরী পূর্ণিমা ছিল সেদিন। থালার মতো মস্ত বড়ো চাঁদ আকাশে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের লক্ষ্মী পূজার দিন। ঢাকের শব্দে মুখরিত মন্দির। বিক্ষিপ্তভাবে কিছু কিছু জায়গায় ছিল মানুষের জটলা। এই দিনে দেবী লক্ষ্মী ঘরে ঘরে ঘুরে ঘুরে খোঁজ করেন, কারা রাত জেগে তার বন্দনা করছে। চাঁদে-পাওয়া মানুষের মতো পরপর দুই রাত শুধুই হেঁটেছে রবিন। কাছ থেকে দূরের পথে। এ পাড়া থেকে ও পাড়া। ঘরে ফিরে দিনের পুরোটা সময় ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। সেই তখন থেকেই আইরিন সম্ভবত তার দুর্ভাগ্যের কথা জেনে গিয়েছিল। রবিনকে ঘাটায়নি কখনো।নিজের চাকরি আর চেম্বার নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে। একই ছাদের নিচে থেকেও ওরা ভিন্ন ভিন্ন জগতের বাসিন্দার মতো কাটিয়ে দিয়েছে এতোটা কাল। কখনো ঝগড়া বা মনোমালিন্যও হয়নি। অনেকটা সন্ধিচুক্তির মতো জীবন।
একদিন সকালে আইরিন যখন ওর মুখের ওপর ঝুঁকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘রাত্রিটা কে’, সেদিনও বিন্দুমাত্র চমকায়নি রবিন। ওর তো সারাদিন রাত্রিতেই বসবাস। হয়ত চরম কোনো মুহূর্তে মুখ ফসকে রাত্রির নাম বেরিয়ে এসেছিল। হালকা পাতলা প্রতিবন্ধী হলেও এই উত্তরটা খুব কায়দা করে দিয়েছিল, ‘পৃথিবীর যা কিছু ভালোবাসি তার সবটাই আমার কাছে রাত্রির মতো।’ নিজেকে নিউরোটিপিক্যালদের মতো বুদ্ধিমান ভেবে মনে মনে হেসেছিল রবিন। সেই মাসেই পিরিয়ড মিস করেছিল আইরিন। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, রবিনের শুধু প্রতিবন্ধকতাই আছে। সৃষ্টিশীল কিছু করতে পারেনি কোনো কালে।
‘লাইফ ইজ আ জার্নি, দ্য পিপল মিট হিয়ার জাস্ট ফর আ মোমেন্ট। নাথিং টু বি হোল্ড অর টু বি এটাচড’। নো, নেভার এভার! মানে না রবিন। আজই ফোন করবে রাত্রিকে। সব বলবে ওকে। স-ব। স-ব কিছু। ওদের দুজনের জীবনেরই কি অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে! কই? রবিনের বুকে তো আগের মতোই হাহাকার! সময় চলে যায়, এ কথা ভুল। যে সময়টা চেয়েছিল তা তো আসেইনি এখনো! তাহলে সময় যায় কী করে?
-হ্যালো, রাত্রি! রাত্রি, শুনছ? শুনতে পাচ্ছো? আমি রবিন। সি ব্যাচের রবিন। তুমি ছিলে ডি ব্যাচে!
-ও রবিন। কেমন আছ তুমি?
-একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার আছে তোমাকে।
-বলো রবিন। আমি শুনছি।
-আমি তোমাকে ভালোবাসি রাত্রি! সে-ই সেকেন্ড ইয়ার থেকে। খুব ভালোবাসি। পঁচিশ বছর ধরে ভালোবাসি। এখনো…
-এতদিন বলোনি কেন রবিন?
-বললে কী হতো রাত্রি?
-আমি তোমার কাছে থাকতাম।
-তবে ওরা যে সবাই বললো…
-জীবনটা আয়নার মতো, রবিন। তুমি যেভাবে জীবনকে দেখবে সে ঠিক সেভাবেই ধরা দেবে।
ঘুম ভেঙে গেলো রবিনের। সারা রাত ঝড় বৃষ্টি হয়ে প্রকৃতি এখন শান্ত। বাইরে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। ঘরের ভেতরটাও শীতল। এর মধ্যেও দরদর করে ঘামছে রবিন। পূবের আকাশে সবে আলো ফুটতে শুরু করেছে। ভোর হচ্ছে। অপূর্ব সুন্দর চারপাশ। বহুদিন সূর্যোদয় দেখা হয় না। টি-শার্ট আর ট্রাউজারটা ভরে নিয়ে ব্যাকপ্যাকটা কাঁধে ফেলে বেরিয়ে পড়লো। একটাই তো জীবন! হাজার আয়নার ঘরের মতো এই জীবনে ভালোবাসা প্রকাশ না করে পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে না। রাত্রির কাছে যাবে রবিন।
হাজার আয়নার ঘর
ফরিদা ইয়াসমিন সুনি
প্রকাশক: অনন্যা
মূল্য: ১৫০ টাকা
বইমেলা, প্যাভিলিয়ন নং ৫