সমস্যা কী চাচা মিয়া?
মাছিটা
মাছি আপনেরে কী করছে?
না মানে…মাছিপড়া জায়গাটা চুলকাচ্ছে।
কী? মাছিটা বসতেছে আপনের প্লাস্টারের ওপরে। এত্ত মোটা প্লাস্টারের মইধ্যে মাছি তার পা ঢুকাইয়া আপনেরে সুড়সুড়ি দিতেছে? মাছির তো ম্যালা শক্তি। হা…হা…হা।
হাওলাদার সাহেবের পুরো মনোযোগ দখল করেছিল মাছিটা। নার্সের এমন সস্তা রসিকতায় মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হলো। কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেলেন। তার মানে নার্স তার কথা বিশ্বাস করছে না? আবার সস্তা রসিকতাও করছে? শুধু তাই না, এই রসিকতায় তার অকালকুষ্মাণ্ড ছেলে আর তার একান্ত বাধ্যগত স্ত্রী যাকে রেগে গেলে হাওলাদার সাহেব একটাই গালি দেন, ‘অপদার্থ মেয়েমানুষ’,তার মুখেও হাসি। রাগে চিড়বিড় করে উঠলেন হাওলাদার সাহেব। মাথায় রক্ত উঠে যাচ্ছে। সবাই তাকে পাগল ভাবছে। অথচ সে দিব্যি টের পাচ্ছে মাছি বসা জায়গাটাই চুলকাচ্ছে। পিরপির করে বাড়তে বাড়তে অস্বস্তিটা এমন মাত্রায় বাড়ছে যে, বড় বড় নখ দিয়ে ঘ্যাঁস ঘ্যাঁস করে চুলকাবেন কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান তিনি। স্ত্রী তো এমনভাবে কেবিনময় ঘুরে ঘুরে সব দেখছে, ভাবখানা এমন, হাসপাতালে নয়, ছোট বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। আড়চোখে একবার ছেলের দিকে তাকাতেই ছেলের মুখে তখনো কৌতুকমাখা হাসিটা দেখতে পেলেন। হয়েছে কি এ প্রজন্মের, সিরিয়াস বিষয়ও হাসির মনে হয়? এত বড় একটা ঘটনা অথচ কি হালকা মেজাজে বলে বসলো, ‘বাবা তুমি যে কি! এই সামান্য ক’টি টাকার জন্যে এমন করলে? এখন বোঝো।’ টাকাকে টাকাই ভাবে না এরা। ভাবে তেজপাতা। ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাসা থেকে বের করে দিলে বুঝতো টাকা কী জিনিস। তার চেয়েও বড় ব্যাপার কিছু না জেনেই এরা হুট করে মন্তব্য করে। একটা মানুষও তাকে জিজ্ঞেস করল না কেন এমন হলো। আজব! সবাই ধরেই নিয়েছে টাকার জন্যই দুর্ঘটনাটা ঘটেছে। হাওলাদার সাহেব রাগ ঢাকতেই হোক আর এই দুই চিজের চেহারা আড়াল করার জন্যেই হোক, মুখের সামনে পেপার মেলে ধরলেন। ভাগ্যিস সূর্যের প্রতিফলন বা প্রতিসরণের মতো রাগেরও এমন কিছু নেই। থাকলে নিশ্চিত তার পত্রিকায় আগুন লেগে যেতো।
প্রত্যেক মানুষের অভিব্যক্তিতে কিছু মৌলিক উপাদান থাকে। হাওলাদার সাহেবের অভিব্যক্তি বিরক্তি নামক একমাত্র মৌল উপাদানে তৈরি। তাকে দেখলে যে কেউ অবলীলায় বলে দিতে পারবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ওপর কতটা বিরক্ত সে। নিয়ম মেনে চলা লোক তিনি। ত্রিশ বছরের সংসারজীবনে একান্ত বাধ্যগত স্ত্রীও নিয়মের ব্যতিক্রম হতে দেখেনি। প্রতি শনিবার বাজারে যাবেন। কোনো কিছুতেই ব্যত্যয় ঘটবে না। দুই হাজার বারো সালে ছেলের বিয়ের দিলেন। বৌভাতের অনুষ্ঠান পঁচিশে নভেম্বর। বাড়িভর্তি ছেলের শ্বশুরবাড়ির মেহমান। উনি নাস্তা সেরেই হাঁক দিলেন, ‘দুলালের মা বাজারের ব্যাগখান দাও’। দুলালের মা ব্যাগ দিলেন। দুলাল আমতা আমতা করে বলল, ‘বাবা আজ বাজারে না গেলে হয় না? বাসাভর্তি মেহমান।’ ছেলের দিকে এমনভাবে তাকালেন যে সে আর উচ্চবাচ্য করার সাহস পেলো না।
মাসের দুই শুক্রবার প্রচণ্ড ভিড়েও চুল কাটাতে যাবেন। আসা যাওয়া চুলকাটানো সব মিলিয়ে এক ঘণ্টার কাজ তিন ঘণ্টা বসে করবেন তবু শুক্রবারেই যাবেন। রোজ অফিস থেকে বাড়ি ফিরে জামাকাপড় পালটে সারাদিনের জমাখরচের হিসাব মেলাবেন। মিলে গেলে ভালো, না মিলে গেলে বাড়িসুদ্ধ সবাই আতঙ্কে ভোগেন। না মেলা পর্যন্ত তিনি অন্য কোনো কাজ তো করবেনই না উল্টো দাঁত মুখখিঁচিয়ে এমন আচরণ করবেন যে সবাই তাকে নিয়ে টেনশনে থাকেন কখন কী করে বসে। এক সন্ধ্যায় হিসাব মেলেনি বলে কলিগের মেয়ের বিয়েতে যাননি। স্ত্রী সাজগোজ করে টানা দুঘণ্টা বসে থেকে পরে বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে কেঁদেছে। কিন্তু সামনে এমন ভাব ধরেছে যে সাজগোজ করে বিয়েতে না যাওয়াটা চরম আনন্দের বিষয়। হিসাব অবশ্য পরে মিলেছিল কিন্তু ততক্ষণে রাত দশটা। হাওলাদার সাহেবের স্পষ্ট মনে আছে ভ্যান থেকে সবজি নিয়ে পাঁচ শ টাকার নোটটি দিয়েছিলেন। তিন শ আশি টাকার সবজি কিনেছেন। ফেরত পাবেন এক শ বিশ টাকা। তার মানিব্যাগে এক শ পঞ্চাশ টাকা আর ফেরত পাওয়া এক শ বিশ টাকা এ নিয়ে দু’শ সত্তর টাকা ছিল। খুব ঠাণ্ডা মাথায় পুরো হিসাবটা আর একবার মেলালেন। এরপর পঞ্চাশ টাকার নোট ভাঙিয়ে পান কিনলেন পাঁচ টাকায়, বাস ভাড়া দিলেন পনের টাকা, দুপুরে অফিস ক্যান্টিনে খেলেন পঞ্চান্ন টাকার। তখন একশ টাকার একটি নোট ভাঙিয়েছিলেন। ক্যান্টিনবয় তাকে চারটা দশ টাকার নোট আর একটা পাঁচ টাকার কয়েন দিয়েছিল। তার মানে তার মানিব্যাগে একটা একশ টাকার নোট, একটা বিশ টাকার নোট, সাতটা দশ টাকার নোট আর একটা পাঁচ টাকার কয়েন থাকার কথা।
আর এই বাক্যেই রোকন দুলালের মা তার পতিদেবের মেজাজের মাত্রা বুঝে ফেলতেন।
অফিস থেকে বের হয়ে রাস্তার উল্টোদিকে হাসেম মিয়ার পানের দোকানের দ্বিতীয় পানটি মুখে পুরে ফিরতি বাস ধরেন। গতকালও তার ব্যতিক্রম হয়নি। রাস্তা পার হওয়ার মুখে এক ভিখিরিকে দেখে মায়া হলো। ওকে দুটাকা দেওয়ার জন্য মানিব্যাগ খুলে দুটাকা পাওয়া গেলো না। তিনি মানিব্যাগের এ পকেট ও পকেট খুঁজলেন। নোট সরিয়ে মানিব্যাগের অলিগলি চিপাচাপা কোথাও দুটাকার নোট বা কয়েন খুঁজে না পেয়ে বেচারা ভিখিরিকে বিফল হয়ে ফিরতে হলো। সিগন্যাল ছেড়ে দেওয়ার ভয়ে টাকা ভাঙতি করে পুণ্য অর্জনে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না তিনিও। তাই চট করে মানিব্যাগটা পকেটে ঢুকিয়ে রাস্তা পার হলেন। হাসেম মিয়ার পানের দোকানে যথারীতি পান কিনলেন। পান চিবুতে চিবুতেই ছোটখাটো একটা ধাক্কা খেলেন। ঘাড় ঘুরাতেই এক ললনাকে দেখে প্রায় ভিরমি খাবার জোগাড়। এত সুন্দর! হালকা জাম গোলাপি শাড়িতে মেয়েটাকে আফ্রোদিতির মতন লাগছে। ইস্! এই মেয়েগুলা তার বিয়ের সময় কই ছিল? মেয়েটার শরীর থেকে দারুণ এক নেশা নেশা ঘ্রাণ আসছে। না চাইতেও চোখ অবাধ্য হচ্ছে। অবাধ্য মনের অসামাজিক আচরণকে তবু ঢেকে রাখা যায় কিন্তু অবাধ্য চোখের অসামাজিক আচরণকে ঢাকা সহজ নয়। এই বয়সে হাওলাদার সাহেবের জন্য যা নিতান্তই বেমানান।
‘স্যার বাস তো আয়া পড়ছে। পানের টিয়া দেবেন না’? পানওয়ালার ডাকে হাওলাদার সাহেব স্বপ্নের গোলাপি জগৎ থেকে একেবারে ধূলিধূসর পল্টনের মোড়ে এসে নামেন। নেমেই অবাক হয়ে দেখেন তার সামনে সেই গোলাপি গোলাপ আর নেই। তাহলে এতক্ষণ কিসের ঘ্রাণ পাচ্ছিলেন? কিছুটা চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো কপালে। তার জীবনের বাকি সব ভালো কিছুর মতো এও দেখি চোখের পলকে হারায়। যাক ললনারা আসেই বোধহয় সৌরভ বিলাতে। এ নিয়ে ভাবালু হওয়ার সময় হাওলাদার সাহেবের নেই। বাস্তবতায় ফিরেই তাই হাসেম মিয়ার পানের দাম পরিশোধ করার জন্যে খুচরো দিতে গিয়ে মনে হলো, আরে! খুচরো কেন দিচ্ছি? আমার কাছে বিশ টাকার একটা নোট তো আছেই। ওটা খুচরো করলেই পান আর বাসভাড়া একসঙ্গে হয়ে যায়। হাওলাদার সাহেব বাস ভাড়াটা সব সময় খুচরো দিতেই চেষ্টা করেন। যতক্ষণ বাসকন্ডাক্টর ভাঙতি টাকা ফেরত না দেন ততক্ষণ এক ধরনের টেনশনে ভোগেন।
আর বাসের কন্ডাক্টরদেরও এমন অভ্যেস। একেবারে শেষ মুহূর্ত ছাড়া বাকি টাকা ফেরত দিতে ইচ্ছে করে না এদের। বাস ভাড়ার জন্যে বিশ টাকার নোটটি খুঁজতে গিয়েই বিপত্তিটা টের পেলেন। মানিব্যাগের যে পকেটটায় তিনি সবজিওয়ালার ফেরত দেওয়া এক শ বিশ টাকা রেখেছিলেন সেখানে এক শ টাকা ঠিকই আছে কিন্তু বিশ টাকার নোটটি উধাও। তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন। গেলো কোথায় টাকাটা? খুব বেশি খোঁজারও সময় পেলেন না। ওদিকে বাস এসে গেছে। এই বাস মিস করলে আবার বিশ মিনিট ঠায় দাঁড়িয়ে থাকো। তাছাড়া প্রতিদিন এই বাসে যায় বলে অন্য বাসে যেতে ইচ্ছে করে না।
যাত্রী থেকে মাজন বিক্রেতা, বাসের সবাইকেই আপন মনে হয়। তড়িঘড়ি করে মানিব্যাগ থেকে পাঁচ টাকার কয়েনটা হাসেম মিয়াকে দিয়ে বাসে উঠে পড়লেন। উঠে পড়ার আগ মুহূর্তে দুটো দশ টাকার নোট শার্টের বাম পকেটে রেখে মানিব্যাগটা প্যান্টের সামনের চোরা পকেটে ঢুকিয়ে দিলেন। হাওলাদার সাহেবের আর একটা অভ্যেস আছে। বাসে বসে কখনোই মানিব্যাগ ও মোবাইল পকেট থেকে বের করেন না। অবশ্য এ জন্যে তিক্ত অভিজ্ঞতাই দায়ী। একবার মানিব্যাগ বের করে বাসভাড়া দিচ্ছেন মুহূর্তেই জানালা দিয়ে ছোঁ মেরে মানিব্যাগ নিয়ে উধাও। কোনো ম্যাজিশিয়ানের পক্ষেও এত দ্রুত কোনো কিছু গায়েব করা সম্ভব কি না, কে জানে, তাও চলন্ত বাস থেকে। আর একবার প্যান্টের পেছনের পকেট থেকে কেটে এত দারুণভাবে মানিব্যাগটা নিয়েছে যে হাওলাদার সাহেব বাড়ি ফিরে প্যান্ট পাল্টানোর আগ পর্যন্ত টের পাননি তার মানিব্যাগ হারানোর বিষয়টা। নিজেকে এতটা বোধহীন ভেবে নিজের ওপর যেমন রাগ হচ্ছিল সঙ্গে সঙ্গে একটা বিষয় তাকে অবাকও করছিল। কত নিপুণভাবে এরা কাজ করে যে মানুষের উপলব্ধিকেও হার মানায়। এ তো রীতিমতো শিল্পের পর্যায়ে পড়ে।
বাসের পুরোটা সময় চাপা টেনশন বয়ে বেড়ালেন। বাড়ি ফিরেই কারও সঙ্গেই কথা না বলে সোজা নিজের রুমে ঢুকে মানিব্যাগ নিয়ে বসলেন। আগাগোড়া পুরো হিসাবটা আর একবার ঝালাই করে নিলেন। মানিব্যাগ পুরো উল্টেপাল্টেও বিশ টাকার সন্ধান পেলেন না। একটা একশ আর পাঁচটা দশ টাকার নোট ছাড়া আর কিছুই পাওয়া গেলো না। অবশ্য দুটাকার একটা পুরনো নোট ভিখিরিকে দিতে চেয়েছিলেন সেটা খুঁজে পাওয়া গেলো। একবার দুবার না বেশ কয়েকবার হিসাব মেলানোর চেষ্টা ব্যর্থ হলো। নাহ, কোথাও গরমিল নেই। শুধু একটা জায়গা ছাড়া। সকালবেলা সবজিওয়ালার কাছে থেকে টাকা ফেরত নেওয়ার সময়কার ঘটনা ঠিক মনে করতে পারছেন না। সবজিওয়ালা এক শ বিশ টাকা ফেরত দিয়েছিল তো? অই সময়টার কথা যতই মনে করার চেষ্টা করছে ততই এক কুয়াশা চিত্র মনে জায়গা করে নিচ্ছে। কিছুতেই মনে পড়ছে না কেন? তবে কি কোনো সমস্যা? হয় সবজিওয়ালা তাকে বিশ টাকা কম দিয়েছে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত, নয়তো অই সময়ের কোনো কিছু কেনার স্মৃতি তার মন থেকে একেবারে মুছে গেছে। দ্বিতীয়টি মানা তার জন্যে কষ্টকর। টাকা খরচের কোনো খাত তার মন থেকে সরে না। প্রতিদিন এর চেয়ে বেশি খরচ করেন তিনি। সব মনে থাকে। আর আজ সামান্য কটা টাকার হিসাব মেলাতে পারছেন না।
নিজের ওপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে তার। হাওলাদার সাহেবের স্ত্রী কিছুটা অপ্রস্তুত। রুটিন অনুযায়ী যখন অফিস থেকে ফেরেন, তখন চেহারায় স্বাভাবিক বিরক্তির রেখা ছাড়া আর কোনো অভিব্যক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। অফিসের পোশাক পাল্টে, খাওয়া সেরে এক কাপ চা নিয়ে বসেন তখন পর্যন্ত বেশ স্বাভাবিক মুডেই থাকেন। সংসারজীবনের শুরু থেকে এই রুটিনেরও ব্যত্যয় হতে দেখেননি। পতিদেব ঘরে ঢুকলেই টেবিলে খাবার সাজিয়ে দেন। কিন্তু আজ স্বামীকে অন্যদিনের সঙ্গে মেলাতে পারছেন না। অফিস থেকে ফিরে পোশাক না পাল্টিয়ে মানিব্যাগ নিয়ে বসেছেন। কোনো কোনো দিন রাগ রাগ চেহারা থাকলে হাওলাদার সাহেবের স্ত্রী তাকে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘রোকন দুলালের আব্বা, আপনে রাগ হইছুইন’, আর মেজাজে ধার দিয়ে তিনি বলেন, ‘না হইয়া কী করব? ডুগডুগি নিয়া ওভারব্রিজের উপর গীত গাবো’? এ পর্যন্ত বলার পরই জাতীয় কোনো সমস্যা নিয়া ঝেড়ে মিনিট দশেক লেকচার শুরু করতেন। আর এই বাক্যেই রোকন দুলালের মা তার পতিদেবের মেজাজের মাত্রা বুঝে ফেলতেন। খুশি মনে তখন ‘হ, ঠিক কইছুইন’, ‘দেখছনি কারবারডা’ জাতীয় কিছু শব্দ বাক্য ব্যবহার করেন যার প্রতিটিতে স্বামীকে সমর্থনের ইঙ্গিত থাকে। কিন্তু আজ পরিস্থিতি কিছুটা অন্যরকম। তাই স্বামীকে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহসও সঞ্চয় করতে পারছিলেন না তিনি।
বললেও কি কেউ বুঝতে বা মানতে চাইতো? কাকে বোঝাবেন তিনি সবজিওয়ালা দেখতে হুবহু কাল রাতের স্বপ্নে দেখা অদ্ভুতদর্শন লোকটির মতো।
হাওলাদার সাহেব নিশ্চিত হলেন গরমিলটা সবজিওয়ালার সঙ্গেই হয়েছে। তার মানে দুশ্চিন্তাটা সকাল পর্যন্ত বয়ে বেড়াতে হবে। উফ! কি এক অশান্তি। রাতে ঘুমও ঠিকমত হবে না। তিনি খুব চেষ্টা করছেন নিজেকে শান্ত রাখতে। কিন্তু পারছেন না। আর পারবেনই বা কী করে। এই জগৎ সংসারে তার কোনো শেয়ারিং পার্টনার নাই। বিয়ের পর খুব আশায় ছিলেন স্ত্রী মর্মকথা বুঝবে। তিনিও স্ত্রীকে বোঝার চেষ্টা করবেন। কিন্তু বিয়ের পর বছর ঘুরতেই একটা ব্যাপার তিনি খুব স্পষ্ট করে বুঝেছেন স্ত্রী তার সোলমেট নয়। স্বামীকে বোঝার বা বোঝানোর ক্ষমতা তার নাই। জীবনকে স্বইচ্ছায় বন্দি করেছে রান্নাঘরের চার দেয়ালে। রান্না করা আর তোষামোদ ছাড়া মহিলা আর কিছু পারে বলে মনে হয় না।
মানুষ যখন শাসন বা আদর কোনোটাই কাছের মানুষটির কাছ থেকে পায় না তখন নিজেকে শামুকের মতো গুটিয়ে নেওয়া ছাড়া কিছুই করার থাকে না। শামুকের খোলসেই সে পৃথিবী আঁকে। খুব রেগে গেলে হাওলাদার সাহেব স্ত্রীকে গালি দেন মনে মনে। মনে মনে বলার সুবিধা একটাই। কেউ শুনছে না আবার রাগও পড়ে যাচ্ছে। পরদিন ঘুম ভাঙলো বিচ্ছিরি রকম তিক্ততা নিয়ে। ঘুম হয়নি ভালো, তার ওপর কি সব স্বপ্ন দেখলেন। জেগে উঠে ঠিকমতো মনেও করতে পারছেন না। একবার দেখলেন বাতাসে উড়ছেন। এক লোক তাকে পরিপাটি ভাঁজ করে মানিব্যাগে রাখলো। মানিব্যাগটা পকেটে ঢোকাতেই গাঢ় অন্ধকার। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে তার। গলা থেকে আওয়াজ বের হচ্ছে না। চিৎকার দিতে গিয়ে ফ্যাসফ্যাসে শব্দ বের হচ্ছে গলা থেকে। ধড়মড় করে লাফিয়ে উঠে বসলেন। ঘুম ভেঙে ঘরের অন্ধকারকেও তার অনেকক্ষণ সেই মানিব্যাগের অন্ধকার মনে হয়েছে। এক গ্লাস পানি খেয়ে আবারও শুয়ে পড়লেন তিনি। একটু পরেই আবার স্বপ্ন শুরু। এক অদ্ভুত দর্শন লোক বিশ টাকার নোটটি টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে এক গ্লাস পানিতে গুলে খেতে বলছে। কিছু না ভেবেই গ্লাসটি হাতে নিয়ে আঁতকে উঠলেন। গ্লাসভরা ঘন নীল রঙ, বিষ। লোকটি জোর করে তাকে ওই পানি পান করাতে চাচ্ছে। লোকটি ঠা ঠা করে হাসছে আর বলছে, ‘বিশ না বিষ…বিশ না বিষ…বিশ না বিষ…খা…খা…খা।’
আবারো আতঙ্কে ঘুম ভেঙে গেলো আর বাকি রাত মোটামুটি নির্ঘুমই কাটলো। সকালে উঠে সিদ্ধান্ত নিলেন, বিশ টাকা নিয়ে ভাববেন না। যা হওয়ার হয়েছে। বিশ টাকার জন্যে এত ভাবা বোধহয় ঠিক নয়। বিশ টাকার জন্য রাতের ঘুম হারাম করা বেহুদা কাজ। শুধু তাই নয়, কি সব ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখলেন যা ভুলে যেতে চাইলেও বারবার মনের কোণে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে।
সকালে উঠে প্রাতরাশ সেরে অফিসে যাবার জন্যে প্রস্তুত হলেন। টাকা ও স্বপ্নের কথা মাথায় আসতেই ওটা ঝেড়ে ফেলে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে রোকন দুলালের মাকে ডেকে একটু গল্প করার চেষ্টাও করলেন। লাভ হয়নি তেমন। বরং রোকন দুলালের মাকে না ডাকাই ভালো ছিল। গল্প করার সময় সে এমনভাবে তাকাচ্ছিল যেন হাওলাদার সাহেব একজন যমদূত। নরকে তার শাস্তির তালিকা পড়ে শোনাচ্ছেন। কাঁটায় কাঁটায় আটটায় হাওলাদার সাহেব অফিসের বাস ধরার জন্যে বাসা থেকে বের হলেন। আটটা পনেরোতে বাস আসবে। মন তীব্রভাবে চাইছে পাশেই সবজিবাজারে গিয়ে খোঁজ করতে। বাস আসতে এখনো দশ মিনিট দেরি। উনি চাইলেই পারেন। কিন্তু না সিদ্ধান্ত নিলেন যাবেন না। ভেতরের উসখুসে ভাবটাকে পাত্তা না দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন। দশটা বিশে বাস এলো। বাসে পা রাখতে যাবেন ঠিক সেই মুহূর্তে সবজিওয়ালাকে দেখতে পেলেন।
বাসে না উঠে দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে সবজিওয়ালার ভ্যানের কাছে যেতে চাইলেন। বিপরীত দিক থেকে আসা টেম্পো গতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। তার পা টেম্পুর চাকার নিচে চলে গেলো। ফল এই হাসপাতাল। পরিবারের সবাই ধরে নিয়েছে গতকালের টাকার জন্যেই এই দুর্ঘটনা।
শুধু হাওলাদার সাহেব জানেন টাকার জন্যে নয়। স্বাচ্ছন্দ্যেই রাস্তা পার হতে পারতেন তিনি। কিন্তু অর্ধেক পথ যাওয়ার পর সবজিওয়ালা তার দিকে তাকাতেই থমকে গেলেন। শিরদাঁড়া বেয়ে ভয় আর আতঙ্কের তীব্র স্রোত নেমে গেলো। তিনি সবজিওয়ালার কাছে না গিয়ে উল্টো ফেরত আসতে গিয়েই দুর্ঘটনা ঘটেছে। কাউকেই বলতে পারেননি ভয়, অস্বস্তি আর আতঙ্কের কথা। বললেও কি কেউ বুঝতে বা মানতে চাইতো? কাকে বোঝাবেন তিনি সবজিওয়ালা দেখতে হুবহু কাল রাতের স্বপ্নে দেখা অদ্ভুতদর্শন লোকটির মতো।