ধীরে ধীরে জেগে উঠছে চরণ।
সুখের জালে আছন্ন এক জগতের দুয়ার ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে, আর সন্তর্পণে পা ফেলে ফেলে এগুচ্ছে চরণ। মনে হচ্ছে জীবন এক মায়া। জীবন অলৌকিক সত্তার জাগ্রত রূপ। জীবনের গোপন অভিসারে এত সুখ, এত মোহ, এত যাদু জানা ছিল না চরণের। অদ্ভুত এক মায়ার জালে আচ্ছন্ন চরণ ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায়। শুরুতে কিছুই দেখে না সে। দেখে কালো পাথরের জমাট অন্ধকার। অন্ধকার দেয়াল ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে না শুয়ে আছে চরণ বুঝতে পারছে না। শরীরের নিচে চাপা পড়া ডান হাতটা ঝিম ঝিম করছে। হাতটা অনেক কষ্টে টেনে বের করার চেষ্টা করছে। কিন্তু শরীরের চেয়ে হাতটাকে আরও ভারী মনে হয়। কেউ কি আছে আশেপাশে? হাতটা একটু বের করে দেবে? কিন্তু কাউকে তো দেখতে পাচ্ছে না চরণ।
কী করবে এখন? কাঁদবে? ডাক দেবে কাউকে? আব্বাকে ডাক দেবে? যা রাগ আব্বার। ডাকলে নির্ঘাৎ রেগে যাবেন আব্বা। কী করা যায়? হাতটা বের করা দরকার। রক্ত চলাচল হওয়া দরকার হাতে। দেরি হলে হাতটা অকেজো হতে পারে। চরণ উঠে বসে। সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পায়, জানালা দিয়ে রোদ আসছে। মাথার ভেতরে, করোটির মিহি দানায় একটা চাকুর ক্ষত আবিষ্কার করে চরণ। তাহলে সে বেঁচে আছে? এতক্ষণ কোথায় ছিলাম আমি? ভাবে চরণ।
উঠেছিস তাহলে? একটা উদ্ভেগাকুল গলার শব্দ পায় সে। যা ভয় পেয়েছিলাম। ওঠ ওঠ—বাসায় যা। কাঁধে হাতের স্পর্শ অনুভব করতে পারে।
আমি এখানে কেন?
কী বোধাইর মতো কথা বলছিস চরণ? তুইতো আমার বড় দুলাভাইয়ের বাসায়।
বড় দুলাভাইয়ের বাসায়?
হ্যাঁ।
তুমি কে?
কী হয়েছে তোর? তুই এমন করছিস কেন? তুইতো নতুন খাস না। আগেও খেয়েছিস।
খেয়েছি?
হ্যাঁ খেয়েছিস?
কী খেয়েছি?
মারবো এক থাপ্পড়।
গালটা এগিয়ে দেয় চরণ, থাপ্পড় দিতে চাইলে দে থাপ্পড়। কিন্তু তুই কে?
আমি আলম। তোর সঙ্গে এক সঙ্গে কলেজে পড়ি।
ও! আবার শুয়ে পড়ে মেঝেতে চরণ। মনে হচ্ছে শরীর মন প্রাণ নিয়ে কোনো দোলনায় দুলছে। প্রচুর বাতাস। দুলছে, দুলছে আর দুলছে। এবং চরণ বাতাসে বাসতে থাকে। ভাসতে-ভাসতে সে বমি উগড়ে দেয়। সাদা ও হলুদ পদার্থের থকথকে বমির ওপর আবার শরীরটাকে লেপ্টে দেয়। সঙ্গে-সঙ্গে চিৎকার করে ওঠে আলম—হারামজাদা, তুই এইডা কী করলি? তোর এই বমি কে ফেলবে?
আমাকে একটু পানি দিবি?
তোকে শালা লাত্থি দেওয়া উচিত।
পানি দে, পানি…শ্বাস টেনে টেনে বলছে চরণ।
রাগে গজগজ করতে করতে আলম ড্রয়িংরুম ছেড়ে ভেতরের ঘরে যায়। শালার পোদে লাত্থি দিয়ে তিনতলা দিয়ে নিচে ফেলে দরকার। এই বমি কে ফেলবে? ফালানির মা আজতো আসবে না। বাসায় মদ খাওয়ার মচ্ছব হবে, তাই আসতে নিষেধ করেছে আলম। কলের নিচে গ্লাস রেখে পানি ছেড়ে মোবাইল করে ইমরুলকে।
হ্যালো? ইমরুল খাটো গলায় প্রশ্ন করছে, চরণ শালার নেশা কাটছে?
নেশা কাটবে কী, শালায়তো বমি করে ড্রয়িংরুম ভাসিয়ে দিয়েছে।
বলিস কী?
জি চাচা। এখন এই বমি ফেলবে কে?
কেন চরণ ফেলবে।
শালারতো হুস নাই। তুই আয়—আমি একা এই ঝামেলা সামলাতে পারব না।
দোস্ত, বাসা থেকে ফোন দিছে। জানিসতো,আমার বাসার অবস্থা? তুই আইউবকে ফোন দে—কথা শেষ করেই লাইন কেটে দেয় ইমরুল।
রাগে গজরায় আলম, শালা এখন ফোন কেটে দিস। অথচ তুই আজকের মদ মচ্ছবের জন্য দায়ী। পালান দিয়েছিস তুই। টাকা বেশি দিয়েছিস তুই। আর তুই কিনা—পানি এনে দাঁড়ায় সামনে, নে।
খুব কষ্টে চোখ মেলে তাকায় চরণ, কি রে?
তোর মাথা, পানি নে।
বমি মাখা হাত বাড়িয়ে ধরে পানির গ্লাস। মুখের কাছে গ্লাস নিয়ে পানি পান করে চরণ। পানি পান করার সঙ্গে-সঙ্গে হাত থেকে গ্লাসটা পরে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। আলমের মাথায় রক্ত চড়ে। চট করে একটা লাথি লাগায় চরণের ঘাড়ে। কিন্তু চরণের ঘুরে যাওয়ার কারণে লাথিটা লাগে মুখে।
ওযাক! বিমূর্ত শব্দ উদগীরণ করে সটান মেঝেতে শুয়ে পড়ে। ভাঙা গ্লাসের টুকরোর ওপর পা পড়ে কেটে গেছে আলমের বাম পায়ের বেশ খানিকটা।
শালা শুয়োরের বাচ্চা, খাইতে পারে না এক পেগ ফুটায় নব্বই গ্লাস, মেঝেতে চরণের পাশে বসে যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে আপন মনে বকে আলম। আমার এখন বাসায় যেতে হবে—অথচ শালার চরণ এখন শুয়ে-শুয়ে মজমা মারছে। কি যে করি—নিজের রক্তাক্ত পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে আলম নিজেকে এক গিলেটিনের সামনে দেখতে পায়। পুরো ঘটনার জন্য দায়ী কেনান খান। কিন্তু ওই শালাই ভেগেছে সবার আগে। কেনান এক আজব জিনিস। আস্ত এক গাঁজাখোর। শুধু কি গাঁজাখোর? নেশার এমন কোনো এলাকা নেই, যেখানে ও বসবাস করেনি। পরিচয় কলেজে, ফার্স্ট ইয়ারেই। প্রাইভেট কলেজ। বেশি কড়াকড়ি, আবার বেশি খোলামেলা। অল্প কয়েক দিনের মধ্যে আলম, কেনান, চরণ, আইউব আর ইমরুল মিলে একটা দল হয়ে গেলো। কেনান শুরু থেকেই ডাকাত। পারে না এমন কোনো কাজ নেই। আর সাহস? বলা যায় অবিশ্বাস্য।
ব্যাগের ভেতরে বোতলে সবাই আনে পানি, কেনান আনে ফেনিসিডিল। কাউকে ওর ব্যাগ ধরতে দেয় না। কাউকে বোতলের পানি খেতে দেয় না। কেউ খেতে চাইলে জবাব দেয়, আমি নষ্ট হচ্ছি, তোরা কেন হবি? বোতলের পানি খেতে চাইলে এমন আজগুবি কথা বললে প্রতিক্রিয়া হয় দুই রকমের। এক. ও কি আমাদের ওর পানি খেতে দিতে চায় না? দুই. কেনান কি আমাদের ঘৃণা করে? ওর ভেতরে কি বর্ণবাদ কাজ করে? কারণ, ওর বাবা প্রচুর টাকার মালিক। কিন্তু আচারে ব্যবহারে তো মনে হয় না। তাহলে কী আছে ওর বোতলে?
প্রশ্ন থেকেই ঘটে আসলে ঘটনা। আইউব, চরণ, আলম আর ইমরুল এক জোট হয়ে কেনানের ব্যাগ ছিনতাই করে বোতল দখলে নেয়। বোতলের পানি পান করে অনুভব করে বোতলে পানি নয়। এক ধরনের তরল পদার্থ, পদার্থটার স্বাদ স্বাভাবিক না, মিষ্টি, অন্যরকম। প্রথম পান করেছিল ইমরুল। খেয়ে মুখ বিকৃত করে প্রশ্ন করে, কেনান তোর পানির বোতলে এসব কী?
নেশা! নির্বিকার উত্তর কেনানের।
নেশা? হতবম্ভ চরণ, কিসের নেশা?
তোরা আমাকে যত স্বাভাবিক, হাসিখুশি আর মারদাঙ্গা দেখিস, আসলে আমি ওসবের কিছুই না। আমি চব্বিশ ঘণ্টা নেশায় ডুবে থাকি। আমার মাকে ডির্ভোস দিয়ে আমার ছোট খালাকে নিয়ে থাকেন আমার বাবা। বাসাটা আমার কাছে নরক। সেই নরক থেকে মুক্তির জন্য আমি সব সময়ে ডাইলে ডুবে থাকি। নিজের ভেতরে আটকে থাকা কথারা এবং অব্যক্ত ব্যথারা বের হতে থাকে কেনানের মুখ থেকে। আমি নেশা ছাড়া এখন একদম স্বাভাবিক থাকতে পারি না। স্বাভাবিকতাই আমার নেশা পান।
এতদিনের চেনা জানা মারদাঙ্গা বন্ধু কলেজের ছাদে একেবারে অন্য নির্মোকে ধরা পরে সবার সামনে। সুন্দর দোহারা গড়নের কেনান সংকটের কপাট নিয়ে চলাফেরা করে সবসময়ে। অথচ ধরা যেত না কিছুতেই। যদি সবাই মিলে ওর ব্যাগ না খুলত।
ডাইল খাওয়াতো ঠিক না—মমতার সঙ্গে বলে ইমরুল। অনেক দিন খেলে তোর পাকস্থলী নষ্ট হয়ে যাবে। আমি পত্রিকায় পড়েছি।
এ ছাড়া আমার কোনো উপাই নেই বন্ধু।
ডাইল জিনিষটা কী? বেমক্কা প্রশ্ন করে আলম।
আলমের প্রশ্নের উত্তর দেয় আইউব, ডাইল মানে ফেনসিডিল। সর্দি কাশির একটা ওষুধ। ইন্ডিয়া থেকে প্রায় প্রতিদিন বাংলাদেশে আসে গোপনে পাছার হয়ে। ত্রিশ টাকা দামের ফেন্সির দাম একশো, দেড়শো, দুইশত টাকা। কখনো কখনো পাঁচশত টাকায়ও বিক্রি হয়।
কি না কি বলিস? অবিশ্বাসের প্রশ্ন আইউবের। ত্রিশ টাকার বোতল পাঁচ শ টাকা?
মুখের কোনে কৃত্রিম হাসি কেনানের, বন্ধু, পাঁচ শ টাকা কেন, আমি তো এক বোতল ডাইল এক হাজার টাকায়ও কিনি। শরীর মন আর প্রাণকে ঠিক রাখতে কখনো কখানো এক হাজার টাকাও দিয়ে কিনেত হয়। বুঝলে, না হলে এর নাম নেশা! নেশায় পেলে মানুষ করতে পারে না এমন কিছু নেই।
যদি এতই বুঝিস, খাস কেন?
বন্ধু! চরণের কাঁধে হাত রাখে কেনান, মা আমার বাপের বাড়ি। ছোটবেলার আদরের খালা যখন প্রতিরাতে বাপের সঙ্গে শুইতে যায় আমার চোখের সামনে দিয়ে, আমার মায়ের সাজানো সংসারে সব কিছু সরিয়ে নতুন জিনিস কেনা হয়, আমাকে মাযের সঙ্গে দেখা বা যোগাযোগ করতে দেওয়া হতো না, আমার ভেতরে কি কষ্ট পাথরের মতো জমত না? সেই জমানো পাথর সরাতে চেষ্টা করছি নিজেকে ভুলে থেকে। নিজেকে যেন ভুলে থাকতে পারি—সেজন্য চাই নেশা। নেশা তোর কষ্ট, তোর ব্যথা একেবারে ভুলিয়ে দেবে। নেশা তোকে স্বর্গে নিয়ে যায়— বুঝলি! বলতে বলতে ইমরুলের হাত থেকে বোতলাটা নিয়ে এক নিশ্বাসে শেষ করে কেনান।
তোরা খাবি?
না না—আইউব, ইমরুল, চরণ, আলম—সবাই এক সঙ্গে অস্বীকার করে।
হাসে কেনান, এক মায়াবী জগত। খেয়ে দেখতে পারিস। জীবনে সব কিছু একবার চেখে দেখা উচিত—খেতে চাইলে বলিস, সব খরচ আমার।
কলেজের ছাদে চারজনে মিলে একজনকে আবিষ্কার করে। পাঁচজনে একটি গ্রন্থিতে আবদ্ধ ছিল। এক সঙ্গে নোট নিত, আরবডা দিত। চারজনে—আইউব, চরণ, আলম, ইমরুল একটি সুত্রে গেঁথে যায়। কেনান ছাদে ঝিমাতে থাকে। ওর ঝিমানো দেখে চারজনে ভয় পায়, যদি কেউ দেখে ফেলে? কলেজ কর্তৃপক্ষ জানলে একেবারে প্রতপাঠ বিদায়। চরণ আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনজনের কানে কানে। সঙ্গে সঙ্গে চঞ্চল হয়ে ওঠে সবাই।
কেনান? চল নিচে যাই—বলে আলম।
কেনান হাসে—তোরা আজ থেকে আমাকে আর বন্ধু হিসেবে নিবি না, তাই আমি এতোদিন গোপানে খেতাম। এখন থেকে তোরা আমাকে ঘৃণা করবি—
আড়াল করার চেষ্টা করে ইমরুল—কি যে বলিস না? কেন তোকে ঘৃণা করব?
আমি জানি তোরা করবি, বলতে বলতে ওদের সঙ্গে নিচে নামে। সাত বিল্ডিংয়ের ছাদ। নামতে নামতে কেনান আবার বলে, তোদের যদি খেতে ইচ্ছে করে আমাকে জানাবি। আমি সব সময়ের জন্য রেডি। জীবনে একবার খেয়ে দেখিস, এক রূপালি জগতে হারিয়ে যাবি। সাদাকে মনে হবে লাল রঙ। কালোকে হলুদ। ফুলকে মনে হবে বন্দুকের গুলি, নেশা, নেশা এক স্পিরিট।
নেশা এক স্পিরিট—তিনটি শব্দের বাক্যটি ইমরুল, আলম আর চরণের করোটিতে গেঁথে যায়। কেনান আজকাল কলেজে কম আসে। কেনানের জন্য দুঃখ পায় চারজন—ইমরুল, চরণ, আলম আর আইউব। আলোচনা চলে নিজেদের মধ্যে। আলোচনার ভেতরে আলমই একদনি বলে, চল, কেনানকে দেখে আসি। ও কেন কলেজে আসে না?
চল।
চারজনকে নিজের বাসায় দেখে কেনান আত্মহারা। প্রাথমিক কথাবার্তার পর কেনান নিয়ে আসে স্পেনের হেইক বোতল। সঙ্গে ছোলা ভাজা, গরুর মাংস ভুনা। চারজনের মধ্যে ইমরুল শুরুতে আগ্রহ দেখায়—এটা কী?
খাটি স্পেনের পানীয়। তোরা আসবি বলে ইনট্যাক রেখেছি। হাসে কেনান।
ফেনসিডিল খাস না তুই? প্রশ্ন করে আইউব।
আইউব! আমি সব খাই। আমার বাপে খায়। আমার খালা আর মায় খায়। তোদের শুরুটা বিদেশি স্পেশাল মাল দিয়ে হোক—আয়, বলতে বলতে মেঝেতে বসে গ্লাসে ঢালতে থাকে কেনান।
এসব খেলে নাকি বুক জ্বলে?
বুক থাকলে তো একটু জ্বলবেই। নে, গ্লাস নে—বুকটাকে ঝাঁজরা করে দে—বলতে বলতে মাংসে কামড় দিয়ে কেনান গ্লাসে চুমুক দেয়। পুরো ঘরটা ভাজা মাংসের টাটকা ঘ্রাণে ভরে গেছে। চারজনের ভেতরে এক ধরনের ট্যাবু ছিল—ছিল দ্বিধা, সংকোচ, খাবে কি খাবে না? সব দ্বিধা আর সংকোচ ঝেড়ে আলম গ্লাস হাতে নেয়, সঙ্গে-সঙ্গে নেয় চরণ, চরণের নেওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে আইউব আর ইমরুল।
চিয়ার্স! পাঁচটি গ্লাস একটি বিন্দুতে মেলে। শুরু হলো পানের খেলা। পাঁচজনের চারজনের বুক জ্বলুক আর না জ্বলুক সবাই মাংস আর হেইক খেয়ে জীবনে পানীয় পানের প্রথম স্বাদ নেয়। শুরুতে যে দ্বিধা সংকোচ ছিল পানে, কয়েক মিনিট পর সব সরে গিয়ে নতুন একটা উদ্যোম ও জোশ তৈরি হয় নিজেদের মধ্যে। পান পর্বটা শুরু হয়েছিল বিকেলের দিকে। চারজনের মধ্যে চরণই নিয়েছিল দ্বিতীয় গ্লাস। বাকিরা এক গ্লাস। খেয়ে সবাই জিম মেরে ছিল কেনানের ঘরে। ফাঁকে ফাঁকে চলছিল যৌনতায় সমৃদ্ধ জোকস আর একের পর এক সিগারেট টানা। ঘরটা ভরে উঠেছিল ধোঁয়ায়।
সন্ধ্যার পর কেনানের রুম থেকে বাইরে আসে সবাই। পানের পর এক নতুন অভিজ্ঞতায় তাড়িত ইমরুল, আলম, চরণ আর আইউব নিজেদের আবিষ্কার করে পাখির মতো উড়ন্ত এক আন্তঃঅনুভূতির ভেতরে। নির্ভার, হালকা আর উচ্ছ্বল লাগছিল শরীর কাঠামো। মনের ভেতর নেই কোনো গ্লানি, হাহাকার, অতৃপ্তি। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তাদের মনে হচ্ছিল তারা ইট সিমেন্টের রাস্তায় হাঁটছে না, তারা উড়ছে।
আমার কিন্তু ভালোই লাগছে—হাঁটতে হাঁটতে বলে ইমরুল।
লাফ দেয় চরণ, আমিতো এখন ইচ্ছে করলে উড়তে পারি পাখির মতন। আজ বুঝতে পারলাম, কেন মানুষ এসব খায়। আমি আমার ভেতর কোনো দুঃখ খুঁজে পাচ্ছি না। মনে দুঃখরা বৃষ্টির সঙ্গে পালিয়ে গেছে অনেক দূরে।
আইউব! ডাকে আলম, আমাকে ধর।
কেন? আইউব কাছে আসে। কী হয়েছে তোর?
আমার এখানে ঘুমাতে ইচ্ছে করছে।
শালা একদম মাতলামি করবি না—রেগে যায় আইউব। কেউ দেখলে আর বাসায় ফিরতে হবে না। মেরে তক্তা বানিয়ে রেখে দেবে।
চারজনে বাস স্টপিজে এসে যার যার মতো বাসায় যায়। বাসায় যায় ঠিকই কিন্তু পানের সূত্রটা তৈরি হয়ে যায় প্রত্যেকের মধ্যে। সবাই পরের দিন কলেজে এসে রাতের নির্ভার ঘুমের অভিজ্ঞতা বিনিময় করে চারজনে। এমন মসৃণ ঘুম, সুনসান ঘুম জীবনে হয়নি। নতুন একটা আনন্দ ট্যানেল দেখতে পায় চারজনে। জীবনের দুয়ারে দুয়ারে এত সুখ উপভোগের উপকরণ ছড়িয়ে আছে, জানতেই পারেনি। সেই জানার ট্যানলে একটা ঘোরের ভেতরে চারজনের যাত্রা। যাত্রার শেষে দুয়ার খুলে বসে থাকে একজন কেনান। যার জীবন আকণ্ঠ দুঃখে তাড়িত। দুঃখে তাড়িত একজনের সঙ্গে পাঁচজনে মিলে তৈরি হয় পান পাঠশালা। যখনই সময় পায়, সময় না পেলেও তৈরি করে বসে যায় পাখি হওয়ার উৎসবে। কয়েকদিন যাওয়ার পর কেনান তার রুমের দরজা বন্ধ করে দেয়—বাবা রাগ করছে।
একটা বন্ধ দরজা হলে অনেক দরজা খুলে যায়। খুলেই গেল দরজা—আইউবের বাসায়। আইউব থাকে একটা রুমে, বাসা বাড়িতে। যদিও টিনশেড কিন্তু আলাদা রুম। সেখানেই জমে মজবা। চাদার টাকায় কেনা হয় কেরু কোম্পানির বোতল। সস্তা, গলা বুকের ভেতর দিয়ে পাথরের নদী নামে—সঙ্গে চানাচুর, চিপস। হোক সস্তা—কিন্তু জমেছে। জমাটাই এখন আসল ব্যাপার। কলেজের ছাত্র—বাবা মা টাকা দেয় নির্দিষ্ট পরিমানে। সেই টাকায় পান চলে না। কিন্তু পানের নেশায় বুঁদ এখন চার আরোহী।
চরণ পেয়েছে সব চেয়ে বেশি মজা। পানের নেশা মানে নিজেকে প্রতিবার নতুন করে আবিষ্কার করে সে। আবিষ্কারে চরণ সবাইকে ছাড়িয়ে যায়। আবিষ্কারের নেশায় আজ এসেছে আলমের দুলাভাইযের বাসায়। আলম থাকে দুলা ভাইয়ের সঙ্গে। বোন আর দুলাভাই গেছে আজমীর শরীফ, মাজার জিয়ারতে। বাসা ফাঁকা পেয়ে পানের নেশায় মেতে ওঠে আইউব, চরণ, আলম, ইমরুল।
পান শুরু হয়েছে দুপুরে। এখন বিকেল। আইউব আর ইমরুল কেটে পড়েছে একটু আগে। নেশায় ডুবে গেছে চরণ। আর আজকের পার্টির টাকা দিয়েছে সে। প্রায় চার হাজার টাকা। মাংস আছে, বিদেশি বোতল আছে—সঙ্গে টিভিতে নাংটো মেয়েদের নাচ। সবাই নেশার টাকা দিলেও এখন পর্যন্ত একবারও দেয়নি ইমরুল।
ওর প্রসঙ্গ এলেই উত্তর দেয়—দোস্ত, এইবার চালা। আগামীবার আমি দেব।
আশায়-আশায় প্রত্যেকে তিনবার চারবার টাকা দিয়েছ ইমরুল কেবল নেশা করে গেছে। মাঝে-মাঝে কেনানও থাকে ওদের আসরে। থাকবে না কেন? আসরের প্রথম ইট রেখেছে তো কেনানই। সম্প্রতি কেনান বিদেশে গেছে ওর বাবার সঙ্গে। ফিরবে কি ফিবরে না—কেউ জানে না। কিন্তু নেশার একটি কারখানা তৈরি করে দিয়ে গেছে চার তরুণের তরঙ্গহীন জীবনে।
আলমের ভয় হচ্ছে, কাজের মেয়ে বাসায় ঘটে যাওয়া দেখে যদি দুলাভাইকে বলে, ঢাকার জীবনের তালাচাবি এক্কেবারে শেষ করে ছাড়বে। দুলাভাই গিয়াসউদ্দিন বড় কড়া মেজাজের মানুষ। দুলাভাইয়ের বাবা হাজী শরিফউদ্দিন রাজাকার ছিল একাত্তর সালে, সেটা দুলাভাই খুব গর্বের সঙ্গে বলে বেড়ায়। এই হেন দুলাভাইয়ের বাসায় বোতলের মজমা বসাইছে—জানতে পারলে একাত্তরের মতো ঈমানের সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়বে শ্যালকের গর্দানের ওপর। নইলে একেবারে গ্রামে গিয়ে বাপের সঙ্গে হালচাষ করতে হবে। আলম মনে মনে তওবা পড়তে থাকে—এই বার রেহাই পেলে আর কোনোদিন দুলাভাইয়ের বাসায় বোতলের মজমা বসাবে না। কখনো না। আল্লাহ মাফ করো। মাফ করো। শালার চরণ ওঠ, তোর চরণে পড়ি।
সন্ধ্যার একটু আগে চরণ উঠে বসে। বাথরুমে যায়। সাফসুতেরো হয়ে আলমের বাসায় তিন গ্লাস পানি খেয়ে রাস্তায় নামে। রাস্তায় নেমে চরণ দোকান থেকে এক প্যাকেট বিদেশি দামি সিগারেট কেনে। থেকে একটি সিগারেট বের করে ঠোঁটে লাগায়। ধীরে সুস্থে সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে চমৎকার ধোঁয়া ছাড়ে সে, তাকায় আকাশের দিকে, আকাশে অনেক কয়টা বাঘ সাপ লুডু খেলছে। কয়েকটা জিরাফ নৌকা বসে গান গাইছে। চরণ জিরাফের সঙ্গে গান ধরে—এই যে দুনিয়া খোদা বানাইছে কিসেরও লাগিয়া….।
পড়ে যায় রাস্তার মাঝখানে।
গভীর রাতে চরণের ঘুম ভাঙলে সে নিজেকে আবিষ্কার করে ঠাণ্ডা মেঝেতে শুয়ে আছে। ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় তাকে অশুভ বার্তা দেয়। ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায়। চারপাশটা দেখে সে বুঝতে পারে—এটা গারদ। থানার গারদ। মানে সে লকআপে। লকআপে কেন? মনে করার চেষ্টা করে চরণ। হ্যাঁ, সে মনে করতে পারছে—তার বাবা অধ্যাপক হারুণ অর রশিদের চেক বইটা নিয়ে গত পনেরো বিশ দিন ধরে সই নকলের মশকো করেছে। মশকো করকে করতে আজ সেই চেক থেকে খুবই সাফল্যের সঙ্গে বিশ হাজার টাকা তুলেছে। সঙ্গে ছিল আইউব।
যখন একের পর নেশার বোতল খেয়ে যাচ্ছে চরণ বন্ধুদের কাছ থেকে কিন্তু নিজে খাওয়াতে পারছে না, কী করবে কোত্থেকে টাকা আসবে বুঝতে পারছিল না, তখন প্রিয় বন্ধুর মতো বাবার অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তোলার বুদ্ধিটা বাতলে দিয়েছিল আইউব। টাকা তুলে ব্যাংক থেকে বের হওয়ার পরপরই বুদ্ধিদাতা হিসেবে আইউব পায় নগদ পাঁচ হাজার টাকা বকশিশ। কারণ, বাপের সই যখন নকল করতে ব্যর্থ হচ্ছিল, তখন সঠিক পরামর্শ দিয়েছিল আইউব। বাকি টাকা নিয়ে ঢাকা ক্লাব থেকে বোতল নিয়ে, মাংস নিয়ে উঠেছিল আলমের দুলাভাইয়ের বাসায়। খাওয়া-দাওয়া গান-বাজনা—সবইতো সেখানে হয়েছিল, তাহলে থানার লকআপে কেন?
আপনাকে নিতে লোক এসেছে—দেখে সামনে দাঁড়ানো দারোগা। একজন কনস্টেবল গারদের দরজা খোলে। আর একটু ভালো করে তাকালে চরণ দেখতে পায়, গারদের সামনে দাঁড়ানো তার দুলাভাই, শাহেদ আহমেদ। লকআপের বাইরে আসে চরণ। মাথা নিচু।
চলো—দুলাভাইয়ের নিরুত্তাপ কণ্ঠ।
থানার বাইরে এসে দেখে একটা অটোরিকশা দাঁড়িয়ে। শাহেদের সঙ্গে ওঠে অটোতে। অটোতে একেবারে নিশ্চুপ দুলাভাই। অথচ প্রতি সেকেন্ডে যার গলা থেকে একশোটির মতো শব্দ বের হয়, বুঝে উঠতে পারছে না চরণ, সেই কণ্ঠ কেন এত নিশ্চুপ। কিছু জিজ্ঞেস করবে, তাও পারছে না ভয়ে, অনুশোচনায় আর সংকোচে। থানার লকআপ থেকে আসা একজন মানুষ কীইবা বলতে পারে? চলতে চলতে অটো থামে বাসার সামনে। দূর থেকেই দেখতে পায়, যদিও অনেক রাত কিন্তু বেশ মানুষ বাড়ির চারপাশে। ঘটনা কী? সবাই কি ওর জন্য অপেক্ষা করছে? মাথাটা কেমন ভন-ভন করে ঘুরতে শুরু করেছে দিকবিদিক। কেন এত মানুষ এত রাতে?
দুলাভাই?
বলো।
বাসার সামনে এত মানুষ কেন?
মানুষ মরলে মানুষ আসবে না?
মানুষ মরলে!—থমকে যায় চরণ। কে মারা গেছে? মা? বড় আপা? ভাইয়া? ভাবী? এতক্ষণে চারপাশের বাতাসে একটা কটু গন্ধ পাচ্ছিল চরণ, এ বার বুঝতে পারল গন্ধটা আসলে মৃতের গন্ধ। মানুষ মারা কি চুকা হয়ে যায়? কিন্তু কে মরল? কিভাবে মরল?
বাসার সামনে অটো থামলে নামে চরণ। ভাইয়াসহ অনেক আত্মীয় ওকে ঘিরে ধরে। কিন্তু কারও মুখে কোনো কথা নেই। বাসার ঢুকেই সামনে দেখতে পায় একটি লাশ। সাদা কাপড়ে ঢাকা। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে চরণ? কে? কে এখানে শুয়ে আছে?
একটা লোক মুখ থেকে কাপড় সরায়। লোকটা অধ্যাপক হারুণ অর রশিদ। বিকেলে চেক খুঁজতে গিয়ে না পেয়ে হারুণ হতবাক হয়েছিলেন। অনেক খুঁজেছেন্ চেক বই। নেই, কোথাও নেই। শেষে চেক বই পাওয়া গেলো চরণের পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে। তখন আর ব্যাংকে খোঁজ নেওয়ার সময় নেই, বিকেল সাড়ে পাঁচটা। সন্ধ্যার পরে খবর এলো—নেশামগ্ন চরণ পড়ে আছে রাস্তার ওপর। তার পকেটে সাড়ে ছয় হাজার টাকা। আগে দুই বার স্টোক করা অধ্যাপক হারুণ অর রশিদ নিজেকে সামলাতে পারলেন না। তিনি শেষ ও তৃতীয়বারের মতো স্ট্রোকে আক্রান্ত হলেন, এবং না ফেরার দেশে চলে গেলেন।
অধ্যাপক হারুণ অর রশিদের ছোট ছেলে মামুনুর রশিদ চরণ নির্বাক নিশ্চুপ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে । পাশে কেনান, আইউব, ইমরুল বা আলম কেউ নেই।