—১ মাস =৩০ দিন ধরে অঙ্ক করতে হয় কেন?
৩ মাস ২ দিনকে ঘণ্টায় প্রকাশ করো। এমন একটা অঙ্ক বোঝাতে গিয়ে রোববার রাতে মেধা বললো, আচ্ছা বাবা। এই অঙ্কটা করতে গিয়ে লিখতে হচ্ছে, আমরা জানি, ১ মাস =৩০ দিন। কিন্তু বিষয়টা কী ভেবে দেখছ, ১ মাস =৩১ দিনও আছে! পাশ থেকে রীতা বললো, শুধু পাকনামি! তুই না ছোটবেলা থেকে জেনে আসছিস, ১ মাস =৩০ দিন!
আমি বললাম, সেটা জানে ঠিক আছে; কিন্তু এই প্রশ্নটা তার মাথায় আসছে, এটা দোষের নয়! বরং বুদ্ধি খুলছে!
রীতার উত্তর—ওর যত দুষ্টুমি বুদ্ধি।
আজ বিকাল ঠিক ৫টায় রীতার ফোন, তোমার মেয়ে তো ক্লাস থেকে বের হয়নি এখনো!
—বলো কী! স্কুল ছুটি হয় ৪টা ১৫ মিনিটে। এতক্ষণও…। স্কুলের মাসি বা দারোয়ান কাউকে বলো ভেতরে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানাক।
—কাউকে দেখছি না, আমার খুব বিরক্ত লাগছে; অসুস্থ ছেলেটাকে রাব্বির মায়ের বাসায় রেখে এসেছি। একঘণ্টা হয়ে গেলো স্কুল মাঠে দাঁড়িয়ে আছি!
—দেখো কাউকে বলো, না হলে তুমি ভেতরে ঢুকে যাও, কোনো বাড়তি কাজের জন্য ক্লাসে দেরি হতে পারে। সকালে তো তুমিই ওকে বোঝাচ্ছিলে প্লাস্টিকের বিকল্প ব্যবহার কিভাবে করা যায়! মনে হয় পরিবেশ ক্লাবে আটকা পড়েছে।
—স্কুলের ভেতরে কাউকে ঢুকতে দেবে না তো!
—কী যে বলো না, যে ঢুকতে দেবে না; তাকে বলো, আমার মেয়ে ভেতরে, তাকে এনে দেন। দরকার হলে ঝাড়ি দাও; স্কুল ছুটির পরও মেয়ে (আটতলা ভবনের ৩য় তলায় ক্লাসরুম) বাইরে আসছে না কেন!
—আমি পারছি না, আর একটু দেখবো, না আসলে বাসায় চলে যাবো। থাকুক ও স্কুলে; আগে জানাবে না ক্লাসে দেরি হবে।
—আচ্ছা হয়েছে। ভেতরে ঢুকে খোঁজ নাও, মেধাকে নিয়েই বাসায় যাও।
—হু; আজকে ওর কপালে মাইর আছে। এমন মাইর দেবো কালকে স্কুলে আসতে পারবে না।
—দূর রাখো এসব কথা। আমি বাসায় ফেরার পরে ওকে মারবে কি না, সেটা দেখা যাবে, খবরদার তার আগে গায়ে হাত দিবা না।
—অতক্ষণ রাগ ধরে রাখতে পারব না আমি।
—পারতে হবে, মারবে না অবশ্যই।
নিউজরুমে বসে ফোনে এতক্ষণ আলাপ করতে এক ধরনের দ্বিধা কাজ করছিল। একটা ফ্লোরে একপাশে ডেস্ক, মাঝখানে সম্পাদকের টেবিল, অন্য পাশে রিপোর্টিং ডেস্ক। বিকাল ৪টার পর পুরো নিউজরুম সম্পাদকসহ সবার উপস্থিতিতে কর্মব্যস্ত। হুট করে মনে হলো, আমি এখান থেকে একটু খোঁজ নেই; স্কুলে একটা ফোন করি। তারপর রীতাকে জানাবো আপডেট। গেলাম গুগল মামার কাছে। স্কুলের নাম লিখে সার্চ দিতেই; গ্রিন রোডের ঠিকানা; সঙ্গে একটা মোবাইলফোন নম্বর ও টিঅ্যান্ডটি নম্বর। মোবাইল বেজে চললো কেউ ধরলো না। জিরো টু যোগ করে টিঅ্যান্ডটি নাম্বারটা মোবাইলে টাইপ করে ডায়াল করলাম। রিসিভ হলো—স্বয়ংক্রিয় নারীকণ্ঠ বলে যেতে লাগলো…স্কুলে আপনাকে স্বাগতম। আপনি যদি প্রভাতী শাখায় কথা বলতে চান তো শূন্য ডায়াল করুন, আর দিবা শাখায় কথা বলতে চাইলে এক চাপুন। অপারেটরের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে দুই চাপুন। আমি শুধু শুনে গেলাম, ১ বা শূন্য চাপ দিলে কিছুই হলো না।
রান্না ঘরে রীতার টুকটাক কাজের শব্দ কানে ভেসে এলো। ‘দ’ হয়ে বসে থাকি আরেকটা সকালের অপেক্ষায়!
মেবি মোবাইলফোনে এগুলো চাপার কোনো আলাদা নিয়ম আছে, যেটা আমার জানা নেই। অন্য কিছু মাথায় আসছে না! তো লাইনটা কেটে গেলো! আর সঙ্গে সঙ্গে যেন মাথাটাও খুলে গেলো! ওয়ান জিরো ওয়ান চাপ দিয়ে পিএবিএক্সে অফিসের অপারেটরকে বললাম, নাইন সিক্স টু ফাইভ… নম্বরে কল দিয়ে স্কুলটির দিবা শাখায় ধরে তবে আমাকে লাইনটা দিয়েন। ব্যস; পেয়ে গেলাম স্কুলের এক ম্যাডামকে। বললাম, ক্লাস থ্রি’র ছুটি বিকাল সোয়া ৪টায়, এখন পাঁচটা প্লাস বাজে, আমার মেয়ের মা স্কুলমাঠে অপেক্ষা করছে, মেয়ে সে পাচ্ছে না। বাড়তি সময় ক্লাস চলার কোনো ইনফরমেশন আছে আপনার কাছে?
—না বাড়তি সময় ক্লাসের তথ্য আমাদের কাছে নেই। এক কাজ করুন; আপনার ওয়াইফকে স্কুলের ভেতরে যেতে বলুন, হয়তো আপনাদের মেয়ের ক্লাস এখনো শেষ হয়নি।
—আচ্ছা ধন্যবাদ আপনাকে। বলে লাইনটা কাটলাম।
০২.
—খেলার নিউজের হেডলাইনে খেলোয়াড়ের নাম রাখলা না, এইডা কোনো কিছু হইলো?
—ভাই, তিন জনের নাম দিয়ে হেডিং করলে তো শব্দ বেশি হয়ে যাবে, সিঙ্গেলে ধরানো মুশকিল!
—এই, বেশি বুঝো কেন? যা বলছি, তাই করো। পাঠকের সঙ্গে মশকরা কইরো না।
—না, ভাই এখনকার পাঠকরাও আগের চেয়ে স্মার্ট হয়ে উঠছে, অন্যরকম হেডলাইন পছন্দ করে, আগ্রহী হয়ে ভেতরে গিয়ে খবর পড়ে।
—এই কাগজের সম্পাদক তুমি না, আমি। যাও, যা বলছি তাই করো।
সম্পাদকের কাছে একটা ধমক খেয়ে কিছুটা দমে যাই। খেলার রিপোর্টের হেডলাইন বদলিয়ে দিয়ে অন্য একটা রিপোর্ট নিয়ে বসি।
রীতার চোখমুখ ভীষণ লাল! রাগলে তাকে দেখতে কিছুটা আপেল-আপেল মনে হয়! একবার এ কথা বলেছিলাম; ওহ্ সেকি আহ্লাদ! মনে হচ্ছিল আপেলটা কামড়িয়ে খেয়ে ফেলি। কিন্তু আজকের রাগত চেহারা দেখে নিজেই ভড়কে গেলাম! রসিকতার মুড হারালাম! সে বললো, তোমার মেয়ে তো একটা কথাও সত্যি বলে না! ওকে নিয়ে আমি কী করবো বলো?
—নতুন করে আবার কী করলো? আমার ডান পাশে সোফাই বসা মেধার দিকে তাকালাম, সে মাথা নিচু করে আছে। বামে বসা রীতা এবার যেন ফুঁসে উঠলো।
—সে তো প্রেম করতেছে। বদমাইশ পোলাডার সঙ্গে আবার সেল্ফিও তুলছে।
—কী বলো এইসব? এই মেধা ঘটনা সত্যি? কঠিন চোখে মেধার দিকে তাকালাম। সে মাথা নিচু করে আছে, চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। এরকম দেখে মাথাটা আরও গরম হয়ে গেলো।
—চুপ করে আছ কেন? এ-ই-ই কথা বলছ না কেন?
মেধার মুখ বন্ধ, চোখ দিয়ে পানি গড়িয়েই যাচ্ছে। এবার আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না। সোফার সামনের দিকে একটু এগিয়ে সামান্য ঘুরেই মেধার বাম গালে সজোরে থাপ্পড় বসিয়ে দিলাম। এরপর উঠে দাঁড়িয়ে বাম হাত দিয়ে ওর ডান গালে দিলাম আরেকটা থাপ্পড়। ‘ও মাগো’ বলে কঁকিয়ে উঠলো। ডান হাত দিয়ে ওর বাম হাতটা ধরে খুব জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে টেনে দাঁড় করালাম। মাথা নিচু করে আছে, দু’গাল চোখের পানিতে ভেসে যাচ্ছে। চিৎকার দিয়ে উঠলাম, কী হলো কথা বলছ না কেন? তার কোনো উত্তর নেই। মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়লো, ক্ষিপ্র গতিতে বাম হাতটা দিয়ে ওর ডান হাতটাও ধরলাম। এরপর সারা শরীরের শক্তি দু’হাতে এনে হ্যাঁচকা টানে সামনের ফ্লোরে ছুড়ে ফেললাম। নিমিষে ওর শরীরটা যেন ৫/৬ বছর বয়সী শিশুর মতো হয়ে লুটিয়ে পড়লো। প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে সারা শরীর ঘেমে গেছে, শ্বাস-প্রশ্বাস বেড়ে গেলো, চোখগুলোও স্বাভাবিকের চেয়ে বড়।
এবার আমার ঘুমকাতুরে দু’চোখ আস্তে আস্তে খুলে গেলো!…আবছা অন্ধকারে দেখি—বিছানার এককোণে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে মেধা। রান্না ঘরে রীতার টুকটাক কাজের শব্দ কানে ভেসে এলো। ‘দ’ হয়ে বসে থাকি আরেকটা সকালের অপেক্ষায়!