ঘড়িতে চারটা বাজে। সম্ভবত রাতের শেষ। সচরাচর এ সময়ে আমি প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠি না।
এখন রমজান চলছে। আজ রমজানের বারো। আমি হাতের আঙুল গুনে হিসাব করার চেষ্টা করি। শেষ পর্যন্ত হিসাব আর হয়ে ওঠে না।
রুম ছেড়ে দাঁড়িয়ে আছি বাইরে। খোলা রাস্তায়। এ রাস্তা আমার পরিচিতি আজ এক যুগেরও বেশি। তাই বারবার হাজারো অচেনা রাস্তার ভিড়েও আমি দেখতে পাই এর মুখ।
একতলা বাড়ির ছাদ। স্বাধীনতার আগের আমলের বাড়ি। এখন সিলিংয়ের অনেক জায়গায় পলেস্তারা খসে-খসে পড়ছে। জমি নিয়ে সরকারের সঙ্গে মামলা চলছে। দখলদারও ভাঙা বাড়িটির কোনো গতি করছেন না। বেশ কয়েকবার শুনেছি মামলায় সরকার পক্ষ হেরে গেছে। তারপরও কি এক অজ্ঞাত কারণে কোথায় যেন বিষয়টি ঝুলে আছে।
এতক্ষণ বাইরে আলো জ্বলছিল। বাড়ির ভেতর থেকে কে যেন সেটি নিভিয়ে দিয়েছে। আমি বাথরুমে ঢুকলে এ সমস্যা বেশি হয়।
আমি বাথরুমে ঢুকতে না ঢুকতেই রুমমেট শামীম দুষ্টুমি করে বাথরুমের আলো নিভিয়ে দেবে। আমি তখন পড়িমরি করে বাথরুম থেকে বের হয়ে জিজ্ঞেস করি, মিসকল দিল কে রে? (দুষ্টুমি করে কেউ বাথরুমের লাইট নিভিয়ে দেওয়াকে আমরা মিসকল বলি)
শামীম তখন আল্লার কসম দিয়ে ‘আমি মিসকল দেইনি’ বলে ভালো মানুষ সাজার চেষ্টা করে। যদিও তখন আমার আর বুঝতে বাকি থাকে না এই কাজটি কে করেছে। তারপরও নীরব থাকি। কারণ রাতদুপুরে চিল্লিয়ে বে-রোজদারের ঘুমের সমস্যা করতে চাই না।
এই ক’দিনে আজই আমি টুথব্রাশ নিয়ে বাড়ির বাইরে বেরোই। এতদিন তা রুমের ভেতরেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্ত এখন মনে হচ্ছে কার যেন অলৌকিক ইশারা রয়েছে।
আমি চারপাশে তাকাই। বছর কয়েক আগে যেখানে শিউলি ফুলের গাছটি ছিল এখন সেখানে একটি কুকুর বসে আছে। বাড়ির দারোয়ান কী কারণে যেন একদিন দেখি গাছটি কেটে ফেলছে। সেদিন থেকে রমজান মাসে আমি ফজরের নামাজ পড়ে বাড়ি ফেরার সময় মৃদুলার জন্য দুই হাত ভরে ফুল আনতে পারি না। দু’হাত ভর্তি ফুলের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে ঘরে ফিরতে পারি না।
তথাপিও আজকের রাতের এই সময়টুকু আমার কাছে অন্যান্য হাজার রাতের থেকে অত্যন্ত অনন্য মনে হচ্ছে। আকাশটাকে কী রকম দীর্ঘ আর বিশাল মনে হচ্ছে। পাশের রুমের ছোট মেয়েটাকে ছোটবেলা থেকেই যে ভালো লাগত, ইচ্ছে করছে তাকে ডেকে এখনই আমার মনের কথা বলি- তোমাকে আমি অনেক অনেক ভালোবাসি। এখন বললে হয়তো বুঝবে। ও নিশ্চই মেনে নেবে। মেনে নেওয়ার মতো বয়স তার হয়েছে।
আমার ভেতর সন্দেহ জাগে। আমার ভেতর ভয় বাড়ে। মনে হচ্ছে মেয়েটা মেনে নেবে না। মুহূর্তে চাঁদটাকে কেমন কর্পূর মনে হয়। একহ্রাস কালির প্রলেপ নিমিষে কে যেন ঢেলে দেয় ওর শরীরে। আমি খুব নিখুঁতভাবে দেখার চেষ্টা করি। দেখি একখণ্ড দীর্ঘ মেঘ তার সমস্ত অবয়ব নিয়ে দূরে কোথায় যেন চলে যাচ্ছে। কবিগুরু বলেছেন- যে চলে যেতে চায় তাকে ধরে রাখা ঠিক নয়। দেবীকে আমি ধরে রাখিনি।
দেবী যেদিন শিলাইদহে চলে গেল তার মামার সঙ্গে সেদিন নদীতে মৃদু ঢেউ ছিল। আকাশে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি ছিল। রাস্তা ছিল পিচ্ছিল। খুব একটা গাড়ি-টাড়ি পাওয়া যাচ্ছিল না। তার মধ্যেই সে তার মামার হাত ধরে মেইন রোড পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। আর ওর পিছু পিছু বৃষ্টিকে সঙ্গী করে ছুটে গিয়েছিলাম আমি। গাড়িতে ওঠার পর যতদূর আমাকে দেখা গেছে ততদূর পর্যন্ত হাত নেড়ে আমাকে টা-টা জানিয়েছে। একবার শুধু বলেছিল, বাড়ি পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই কুশল জানিয়ে আমাকে চিঠি লিখবে। চিঠির সঙ্গে শেষ বিকেলের আলোয় পাহাড়ের উপত্যকায় দাঁড়িয়ে তোলা একখানা স্টিল ছবিও দেবে বলেছিল।
সেও বছর চারেক আগের কথা। আজ অবধি দেবীর কোনো খবর পাইনি। সপ্তাহখানেক পরে লোকমুখে শুনেছিলাম- যে সপ্তাহে ওরা গেল, সেই সপ্তাহেই কোথায় যেন একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল। তার ভেতরে দেবী নামের কেউ ছিল কি না, হাতে বালা পরা কোনো সুন্দরী কন্যা ছিল কি না, কেউ বলতে পারেনি।
আজকের রাতে প্রথম দিকে চাঁদটা যেভাবে আলো ছড়িয়েছিল, তাতে মনে হয়েছিল দেবী-ই বুঝি হাসছে। ওই তো চাঁদের বুড়ির পাশেই দেবী বসে আছে। বসে বসে বুড়ির সঙ্গে ভালোবাসার মিথ্যে গল্প বলছে। আমাকে যে দেবী মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেই গল্প করছে। আমাকে যে দেবী ঠকিয়েছে সেই গল্প করছে।
দেবী হয়তো জানে না যে, আমি কখনো ঠকিনা। আমাকে ঠকানো অত সহজ নয়। অন্যের বৃক্ষে টসটসে পাঁকা ফল দেখে যে লোভ সংবরন করতে পারে, সে কখনো ঠকে না। ঠকতে পারে না।
একটু একটু করে আমার আরও অনেক কিছু মনে পড়তে থাকে। মাথাটাকে সামান্য ঝাঁকুনি দেই। যেন চুলের গোঁড়ায় লেপ্টে থাকা দুঃস্বপ্নগুলো ঝরে যায়। আজ এতদিন পরে সেই পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে আমি আর নতুন করে কোনো দুঃখের আগুনে পুড়ে অঙ্গার হতে চাই না। কবি জীবনানন্দ তার কবিতায় বলেছেন- ‘আবার তাহারে কেন ডাকো, কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে?’
সেহরির সময় শেষ হতে চলেছে। মসজিদের মাইকে শেষবারের মতো ঘোষণা করা হয়েছে—আর মাত্র পাঁচমিনিট বাকি আছে। ব্যস চলবে। এক জীবনে এই পাঁচ মিনিট সময়ই তো অনেক গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া কোনো কোনো মানুষ তো পাঁচ মিনিটেরও কম সময় বাঁচে। মাতৃজঠর থেকে তারা পৃথিবীর আলো বাতাস পুরোপুরি অনুভব করতে না করতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। আমি বরং এই পাঁচ মিনিট কোনো মহান কাজে ব্যয় করতে পারি। আকাশের বুক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আমি দ্রুত গেটের ভেতরে প্রবেশ করি।
মন্তব্য