ঘুমের ঘোরেই বাঁহাত দিয়ে হাতড়ে হাতড়ে বেডসাইড টেবিলের ওপর থেকে মোবাইল ফোনটা নিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। ‘কয়টা বাজে? উরে বাস! ১১টা বেজে গেছে?’ পাশ ফিরে ইমরানকে দিনের ফার্স্টহাগ দেব ভেবেছিলাম। কিন্তু বিছানায় ওকে পেলাম না। হয়তো ওয়াশরুমে গেছে। আরেকটু চোখ বুজতেই আবারও ঘুমিয়ে পড়লাম। এবার ফাইনালি উঠতেই হলো। দুপুর আড়াইটা বেজে গেছে। ওয়াশরুমে যেতে হবে। অবাক হলাম। ওয়াশরুম খালি, বিছানায়ও সে নেই। তো গেলোটা কোথায়? বাইরে গেছে? এই সাতদিনে তো একবারও আমাকে ছাড়া কোথাও এক মুহূর্তের জন্যও যায়নি। কী জানি আজ হয়তো খুব জরুরি কোনো প্রয়োজন পড়েছে, তাই বের হয়েছে।
আজকে ১৩ অগাস্ট! আমার জন্মদিন। মাত্র সাতদিন আগে আমি ও ইমরান একই ফ্লাইটে সিডনি থেকে বাংলাদেশে এসেছি। নান্নুর মুমূর্ষু অবস্থার খবর পেয়ে মাম্মি তিনমাস হয়েছে ঢাকায় এসেছে। আমিও গত ৩৬ বছরে দেশে আসিনি বলে আত্মীয়স্বজনরা চাইছিল দেশে আসি। মাম্মিও বারবার রিকোয়েস্ট করলো। ভাবলাম, যাই একবার নিজের দেশটাকে দেখে আসি। পাপাকে বললাম আমার সঙ্গে যাওয়ার জন্য। কিন্তু পাপার সময় হলো না। অগত্যা একাই রওয়ানা হলাম।
পোর্টহোল উইন্ডো সিটটা আমি নেটে আগেই বুকিং দিয়েছিলাম। ভারী মেঘের ভেতর দিয়ে দ্রুত প্লেনটা সিডনির আকাশ ছাড়িয়ে যেতে লাগলো। অভ্যাসবশত উইন্ডোর দিকে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে নিচের দিকে তাকাই। অবাক হয়ে দেখতে থাকি চোখের সামনে আস্তে আস্তে ছোট হয়ে আসছে বিস্তীর্ণ পশ্চিম মালভূমি ও গ্রেট ডিভাইডিং রেঞ্জের উঁচুনিচু সবুজ পর্বতমালা। শাপের মতো একেবেঁকে ছোট হতে হতে হারিয়ে গেলো মারি ও ডার্লিং নদী। এভাবে অনেক অনেক উঁচুতে উঠে গেলো প্লেনটি। এবার নিচে শুধু উঁচু উঁচু পাহাড়ের মতো মেঘের স্তূপ। চেনা পৃথিবী ছেড়ে চলে এসেছি যেন কোনো এক অচেনা মেঘের রাজ্যে। সিটবেল্ট খুলে রিল্যাক্স হয়ে বসলাম। আমার পাশের সিটটাতেই ইমরান বসেছিল। ওকে দেখেই আমার প্রতিটি ইন্দ্রিয়ের ভেতর কেমন এক অচেনা অনুভূতি বোধ করলাম। ওর চোস্ত ইংলিশ প্রোনাউন্সেশন। গমগমে ভয়েজ। এমন গভীর ব্লু আইস আগে কখনো এভাবে খেয়াল করেছি বলে মনে পড়ে না। এমন হালকা টেনড স্কিনের গ্রিক দেবতার মতো পেটানো শরীর! আহা! যখন-তখন প্রেমে পড়ার মতো নারী আমি নই, অথচ ইমরানকে দেখে মনে হলো যেন প্রেমে পড়ার জন্যই মুখিয়ে ছিলাম।
পরিচয় পর্বের ধার না ধেরেই শুরু থেকেই ক্রিকেট নিয়ে কথা বলা বলতে লাগলো ও। বর্তমান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে নিয়ে কথা হচ্ছিল। আমি খেয়াল করলাম আমাদের দুজনেই প্রিয় বিষয় স্পোর্টস, সিনামা ও ট্রাভেলিং। প্রিয় লেখক মপাসাঁ, হুগো, মিলান কুন্ডেরা, সালমান রুশদি, গ্যাব্রিয়াল গারসিয়া মার্কেস, বোর্হেস, কোর্তেজসহ অনেকেই। ল্যাটিন অ্যামেরিকার কোথায় কোথায় ট্র্যাভেল করে ইমরানের কেমন লেগেছে, কলাম্বিয়ায় মার্কেসের ‘কাসা ডি গ্যাব্রিয়াল গারসিয়া মার্কেস’ বাড়িটিতে বেড়াতে গিয়ে ওর অনুভূতি! চিলিতে ব্ল্যাক আইল্যান্ডে নেরুদার প্রিয় বাড়ি ইস্লা নেগ্রা দেখতে গিয়ে নীল সাগরের অজস্র ঢেউয়ের সঙ্গে ভেসে যাওয়ার তীব্র আকুতি। পেরুতে লস্ট সিটি অব ইনকাস বা ইনকা সভ্যতার মাচ্চুপিচ্চু দেখতে গিয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলা আর পুরনো শহরের গন্ধ মাখা শহর মেক্সিকোর রাস্তায় টো টো করে ঘুরে বেড়ানো। এই সবই ছিল আমাদের সিমিলার অনুভূতির জায়গা। আমাদের সিংক্রোনাইজেশন এক কথায় দারুণ ছিল! ওর নাম যে ইমরান খান আর ও যে পাকিস্তানি সেটা ও সরাসরি না বলে আমাকে বেশ কিছু পাজল দিয়েছিল এবং আমি একসময় আবিষ্কার করি ওর নাম ও পরিচয়। ও পাকিস্তানি শুনে আমার একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। কিন্তু আমি বাংলাদেশি শুনে ইমরান খান রীতিমত ক্ষুব্ধ হয়েছে মনে হলো। মনে হলো ওর চোখের কোণায় এক মুহূর্তের জন্য তীব্র ঘৃণা আর বিষাদের এক তীক্ষ্ণ হিংস্র ছায়া দেখলাম। যদিও পর মুহূর্তেই সেটা উচ্ছ্বাসে পরিণত হলো। আমি নিজেকে একটু গুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। আমরা দুজনই বিজনেস ক্লাসে ট্র্যাভেল করছিলাম। ওর কথা শেষ হয়ে গিয়েছে মনে করে এবারের দ্য ম্যান বুকার পাওয়া উপন্যাস ‘মিল্কম্যান’ খুলে পাতা উলটাচ্ছিলাম। বইটি পড়া শুরু করবো এমন সময় ইমরান দাঁড়িয়ে গেলো। হাত বাড়িয়ে দিয়ে অফিসিয়ালি হ্যান্ডশেক করে বললো, আমি ইমরান খান, আই এম রানিং ৩৮ ইয়ার্স ওল্ড। অ্যান্ড আই ফিল সো লাকি টু ইন্ট্রডিউস মাইসেলফ উইথ ইউ।
—সেইম হেয়ার, আই এম এফ্রোদিতি।
—দ্য গডেস অব বিউটি, ডেসায়ার, অ্যান্ড লাভ? ওয়াও, নাইস টু গেট ইউ বিসাইড মি, গডেস।
এইসব ছোট ছোট্ট ব্যাপারকে কী করে এতটা আর্টিস্টিক করা যায়, সেটা দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আর এ কারণেই বোধহয় আমি ইমরানের প্রতি টেম্পটেড ফিল করি।
আমি যে কখনো আমার সোলমেট খুঁজে পাবো ভাবতেই পারিনি। ধরেই নিয়েছিলাম আমাকে সারাজীবন একাই থাকতে হবে। শুধু জৈবিক প্রয়োজনে বিয়ে করা বা কারও সঙ্গে থাকার কথা আমি কল্পনাও করতে পারি না। আসলে বিয়ে নামক এই বাতিল কনস্টিটিউশনের প্রতি আমার প্রবল আপত্তি আছে। আমার মাম্মি-পাপা ব্যারিস্টারি পড়তে যখন প্রথম মেলবোর্নে যান, আমার বয়স মাত্র একবছর। পরে আমরা সিডনিতে স্যাটলড করি। এখন আমি ৩৭। আমি নিজেও একজন ক্রিমিনাল লয়্যার। ২০ বছর বয়সে প্রথম আমি বাসা থেকে বের হয়ে স্টিভের সঙ্গে শিফট করি। কিন্তু সেটা মাত্র ছয় মাসের জন্য। এরপর একদিন এপ্রিলের এক বিকেলে, শরতের অপরূপা আকাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছিল সেদিন। মিষ্টি রোদে ছেয়ে গেছে প্রকৃতি। হাল্কা শীতের ছোঁয়া বাতাসে। আমরা দুজন ব্লু মাউন্টে ট্র্যাকিং করতে বের হলাম। মনে আছে দুজনেই ম্যাচ করে ব্লু পোলো ভেস্ট আর জিন্স পরেছিলাম। আসলে আমরা সবসময় একই কালারের ড্রেস পরতাম। আমাদের সবাই মেইড ফর ইচ আদার মনে করতো। আমরাও নিজেদের তাই ভাবতাম। গত ছয় মাসে আমরা কখনো কোনো ব্যাপার নিয়ে ফাইট করিনি। আমরা দুজন দুজনকে গভীরভাবে বুঝতে পারতাম। আমি স্টিভকে নিয়ে ভীষণ হ্যাপি ছিলাম।
অপরূপ এক অপরাহ্ণে ব্লু মাউন্টেন পাহাড়ের ওপর মাখনের মতো গলে পড়ছে রোদ। ওপর থেকে নিচের লেক দেখা যায়, এমন একটি জায়গায় আমরা হাত ধরে বসে থাকি। চারদিকের অলৌকিক সৌন্দর্য ও প্রকৃতি কেমন যেন আমাদের বিষণ্ন করে তোলে। আমি ওর কাঁধে মাথা রেখে উদাস হয়ে লেকের দিকে তাকিয়ে থাকি। জানি না কী হয়েছিল, তবে হঠাৎ আমি স্টিভের চোখে চোখ রেখে জানতে চাই, ‘ডু ইউ রিয়েলি থিংক উই আর মেইড ফর ইচ আদার?’ স্টিভ কোনো সময় না নিয়েই সরাসরি বলে, ‘নো’।
বিকেল হলে যখন ওই আদিম সূর্যটা ক্রিমসন আভা নিয়ে অস্ত যেতো, আমরা দুজন বারোতলার ওপরের বারান্দায় হাতের ওপর হাত দিয়ে ইজি চেয়ারে বসে বসে ইনানি বিচ দেখতাম। পৃথিবীর প্রায় সব বিচ ঘুরে এসেও এই ছোট্ট বিচটা আমাদের কাছে সবচেয়ে সুন্দর হয়ে উঠলো
পর দিন আমি বাসা থেকে আমার জিনিসপত্র নিয়ে বের হয়ে আসি। এরপরের কয়েক বছর বার এট ল’ শেষ করে নতুন ল’ ফার্মে কাজ শুরু করি। পাপা বলেছিল তার সঙ্গে জয়েন করতে কিন্তু আমি একাই কিছু করতে চেয়েছিলাম। আসলে একার লাইফ আমি এনজয় করছিলাম। বন্ধুদের সঙ্গে রোড ট্রিপে যেতাম, ট্র্যাকিংয়ে যেতাম। ডিস্কো, আড্ডা, মুভি দেখা, লং ড্রাইভ এসব নিয়ে ছিলাম। ছোটবেলা থেকেই ব্যালে ডান্স আর বই পড়ার নেশা আমাকে ঘিরে আছে। ব্যালে ড্যান্সের প্রোগ্রাম তো আছেই। এছাড়া মাঝে-মাঝে নাইট ক্লাবে গিয়ে ক্যাজুয়ালি ডেটিং করতাম। খুব বিজি স্ক্যাজুয়েলের মধ্যে সময় কাটছিল। এদিকে প্রফেশনালিও খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। নতুন নতুন সব ক্লায়েন্ট ডিল করতে শুরু করলাম। তাদের নানা বিচিত্র সমস্যা আর সমাধান করা নিয়েও প্রফেশনালি ইনভল্ভড হয়ে পড়েছিলাম।
কিন্তু ডেভের (ডেভিট) সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর সবকিছু চেঞ্জ হয়ে গেলো। আমার সঙ্গে ডেট করে ডেভ এতই পাগল হলো যে দুদিনের মধ্যেই নিজের বাসা ছেড়ে আমার স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টে এসে উঠলো। স্টিভকে ভোলা আমার জন্য বেশ কঠিন ছিল। ওকে আমি মিস করতাম। কতবার মনে হয়েছে ওর কাছেই ফিরে যাবো। কিন্তু জানতাম না ও কোথায় আছে। আসলে জানতেও চাইনি। আর ও নিজে থেকে আমার সঙ্গে কখনো যোগাযোগ করেনি। তবে ডেভ আমার সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে চলেছিল বলেই আমরা চার বছর একসঙ্গে থাকতে পেরেছিলাম হয়তো। প্রায়ই ফাইট হতো ওর সঙ্গে। তবে এরইমাঝে আমরা সারা ইউরোপ, অ্যামেরিকা, ল্যাটিন অ্যামেরিকা একসঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছি। আমরা ভালোই ছিলাম কিন্তু একসময় ডেভ আমাকে বিয়ে করার জন্য প্রেসার করতে থাকে। এরপর আমার পক্ষে কোনোভাবেই আর ডেভের সঙ্গে একই ছাদের নিচে, সেম বেড শেয়ার সম্ভব হচ্ছিল না। ডেভ আসলে ঠিক আমার সোলমেট না। আমি আমার সোলমেট খুঁজছিলাম। ডেভ চলে যাওয়ার পর আমি ডিসিশন নেই একা থাকার।
ইনফেক্ট, আই ওয়াজ এক্সেলেন্ট বিইয়িং অ্যালোন। কাজ, জিম, জগিং, হ্যাংগিং আউট, ওয়াচিং মুভিস, রোম এরাউন্ড। আরও কত কী নিয়ে যে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমার কোনো সময় ছিল না কারও জন্য। ভাবছিলাম বাংলাদেশ থেকে ফিরে লাইফের পারপাস খুঁজতে ওয়ার্ল্ড ট্যুরে বের হবো। আর ঠিক এ সময়ই দেখা হয়ে গেলো ইমরানের সঙ্গে।
ঢাকা এয়ারপোর্টে নেমেই আমরা ডিসিশন নিলাম কক্সবাজার যাওয়ার। আগস্টের ছয় তারিখ সন্ধ্যা ৭.১০ মিনিটে ঢাকায় ল্যান্ড করলাম কিন্তু সেদিনের শেষ ফ্লাইট কক্সবাজারের উদ্দেশে ছেড়ে গেছে বিকেল ৫.৩০মিনিটে। এদিকে ফ্লাইট টাইম জেনে আমাকে রিসিভ করতে মাম্মি লোক পাঠিয়েছে। ওরা বারবার ফোন দিচ্ছে বলে ফোনটা সুইচ অফ করে দিলাম। একজনকে রিকোয়েস্ট করে মাম্মিকে ফোন দিয়ে বললাম আমি জরুরি কাজে কক্সবাজার যাচ্ছি। কবে ফিরবো এখনো জানি না। মাম্মির গলা শুনেই বুঝলাম সে খুব মাইন্ড করেছে। নানা ঝামেলার মধ্যে সেই রাতটা উত্তরার কাছাকাছি একটি হোটেলে কাটিয়েই সকাল ১১টার ফ্লাইটে কক্সবাজার পৌঁছলাম। ইমরান রয়েল টিউলিপ কক্সবাজার নামের যে হোটেলে হানিমুন স্যুইট বুক করেছিল, তাদেরই একটি প্রাইভেট কারে করে আমরা যখন হোটেলে পৌঁছলাম, তখন দুপুর দেড়টা বেজে গেছে।
রুমে ঢুকে ইমরান বাইরের দরজার হাতলে ডু নট ডিস্টার্ব ট্যাগ ঝুলিয়ে দিলো। এরপর এই মহাবিশ্ব থেকে কী করে সাতটা দিন, (ঘণ্টা বা সেকেন্ডের হিসাব আর করতে চাই না) কেটে গেছে, বলা ভালো উধাও হয়ে গেছে, সেটা কেউ জানে না। রাতে হয়তো কালেভদ্রে আমরা দুই-এক ঘণ্টা ঘুমাতাম। মাঝে মাঝে দিনের বেলাতেও এক আধটু ঘুমিয়ে নিয়েছি। ব্যস এটুকুই। এরমাঝে দুই চার বার যে ব্যালকনিতে যাইনি, তা নয়। বিকেল হলে যখন ওই আদিম সূর্যটা ক্রিমসন আভা নিয়ে অস্ত যেতো, আমরা দুজন বারোতলার ওপরের বারান্দায় হাতের ওপর হাত দিয়ে ইজি চেয়ারে বসে বসে ইনানি বিচ দেখতাম। পৃথিবীর প্রায় সব বিচ ঘুরে এসেও এই ছোট্ট বিচটা আমাদের কাছে সবচেয়ে সুন্দর হয়ে উঠলো। আমরা এমনভাবে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম, যেন ডোভার বিচের কাছে দাঁড়িয়ে আছি। ইমরান তার ভরাট গলায় আবৃত্তি করতো—
Ah, love, let us be true
To one another! for the world, which seems
To lie before us like a land of dreams,
So various, so beautiful, so new,
Hath really neither joy, nor love, nor light,
Nor certitude, nor peace, nor help for pain;
And we are here as on a darkling plain
Swept with confused alarms of struggle and flight,
Where ignorant armies clash by night.
( Dover Beach BY MATTHEW ARNOLD)
আমাদের জীবনের আদি-অন্ত আমরা জেনে গেছি এরইমাঝে—প্রথম স্মৃতি থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যা যা হয়েছে, যতটুকু মনে আছে, আমার বা ওর, সবকিছু। আমাদের পছন্দ অপছন্দ, জীবনবোধ, কল্পনা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা থেকে শুরু করে শিল্পসাহিত্য, সিনেমা, স্পোরস, ওয়ার্ল্ড পলেটিক্স—সব আলোচনা শেষ হয়ে গেলো। ওর জীবনের সবচেয়ে কষ্টকর স্মৃতির কথা ও জানালো। ওর বাবা-মার ডিভোর্সের কথা! বহুবছর আগে এক বাঙালি নারী সেলিনা হোসেন দুচোখভরা স্বপ্ন নিয়ে ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির ট্রিনিটি কলেজে ইকোনমিক্স পড়তে গিয়েছিলেন। ওখানেই পাকিস্তানি সুদর্শন যুবক নাদিম খানের সঙ্গে পরিচয়। ইকোনমিক্সের ফার্স্ট ইয়ারের সেলিনার সঙ্গে ফাইনাল ইয়ারের নাদিম খানের দেখা হওয়া মাত্রই ক্যামেস্ট্রি গড়ে উঠলো। যাকে বলে লাভ এট ফার্স্ট সাইট। পরিচয়, প্রণয়, বিয়ে পরপর হয়ে গেলো। শুধু একটাই সমস্যা দেখা দিলো—তা হলো মুক্তিযুদ্ধে নিজের দুই পুত্রসন্তান হারানো সেলিনার বাবার পক্ষে কিছুতেই একজন পাকিস্তানি ছেলেকে নিজের মেয়েজামাই হিসেবে মেনে নেওয়া সম্ভব হলো না। ফলে জীবিত দুই মেয়ের মধ্যে ছোটমেয়ে সেলিনার সঙ্গে বাবা-মা ও পরিবারের সবার যোগাযোগ চিরদিনের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। এর প্রভাব এসে পড়লো সেলিনা-নাদিমের সংসারেও। নাদিম কিছুতেই শ্বশুরবাড়ি থেকে মেনে না নেওয়ার এই অপমান ভুলতে পারলো না। এসব নিয়ে অশান্তির চূড়ায় অবস্থানকালে দম্পতিটি জানতে পারলো যে তারা বাবা-মা হতে যাচ্ছে। শিশু ইমরানকে কোলে নিয়েই সেলিনা মাস্টার্স শেষ করলো। এরপর পিএইচডি করার কথা স্বামীকে বলামাত্র নাদিম ঘোর আপত্তি জানালো। এভাবেই কয়েক বছর কেটে গেলো। ইমরানের বয়স যখন আড়াই বছর, একদিন সেলিনা ঘোষণা করলো, সে অ্যামেরিকার ম্যাসাচুসেট্স ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি)-তে পিএইচডি করতে যাচ্ছে। নাদিম এই ব্যাপারে বিন্ধুমাত্র আগ্রহ না দেখিয়ে জানিয়ে দিলো, ইমরানকে নিজের কাছে রাখবে, সেলিনাকে যেতে হলে একা এবং একেবারেই যেতে হবে। এরপর সেলিনা হোসেনের শারীরিক ও মানষিক পরিস্থিতি তখন বা পরবর্তী সময়ে কী হয়েছিল, তার কোনো খবরই ইমরান জানে না। তার মা জীবিত না মৃত, সেই খবরটিও ইমরানের জানার কোনো আগ্রহ কখনো হয়নি। সেলিনা হোসেন অ্যামেরিকায় চলে গেলো, আর নাদিম খান পাকিস্তানে গিয়ে আবারও বিয়ে করে শিশু ইমরানকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার পার্থে বসবাস শুরু করলো। ইমরানের সেই বাঙালি মা সম্পর্কে আর কোনো কথা জিজ্ঞেস করার মতো সাহস আমার হলো না। কারণ এরইমাঝে আমি বুঝে গেছি, ইমারান তার নিজের সেই বাঙালি মাকে ভীষণ ঘৃণা করে। ওর বারবার ‘আই হেইট হার, আই হেইট হার ফ্রম বোটম অব মাই হার্ট! শুনেই আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আমি বাংলাদেশি শুনে ও কেন প্রথম পরিচয়ের সময় এত বিস্মিত হয়েছিল, সেটা আমি বুঝতে পারলাম।
জানি, হয়তো তোমার রেট এর চেয়ে অনেক বেশি কিন্তু বিশ্বাস করো এই মুহূর্তে আমার এরচেয়ে বেশি সামর্থ্য নেই। তাই ৭০০০ টাকা রেখে গেলাম
যাহোক, এসব পারিবারিক কোনো ব্যাপারেই আমাদের দুজনের কোনোরকম কোনো ইন্টারেস্ট ছিল না। আমরা নিজেদের জগতে হারিয়ে গেলাম। আমরা নাচলাম, গান গাইলাম, খেলাম, একসঙ্গে গোসল করলাম, ভেসে গেলাম সুখের বন্যায়। পৃথিবীতে কেউ কখনো এর আগে বা পরে এত সুখী ছিল কি না, কে জানে! নো ডাউট উই আর সোলমেট।
কালকে গভীর রাত পর্যন্ত আমরা তিনতলার বলরুমে কাটালাম। ফাইভ স্টার হোটেলের ব্যুফেতে থরে থরে খাবার সাজানো। আমরা দুজনই রাতে বলতে গেলে কিছুই খাই না। তবু অল্পকিছু এপিটাইজার, স্যুপ খেয়ে রুমে যাওয়ার জন্য রওনা হতেই এই প্রথমবারের মতো ইমরান আমাকে রাতের বেলায় বিচে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলো। বিচের কাছে এসে আমরা নিজেদের বয়স ভুলে গেলাম। একেবারেই যেন কিশোরকিশোরী হয়ে উঠলাম। কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে খুনসুটি করে, একজন আরেকজনকে পানি ছিটিয়ে, ছোঁয়াছুঁয়ি খেলে আমরা গিয়ে জুটলাম আমাদেরই মতো কিছু ট্যুরিস্টের সঙ্গে। ওরা সবাই মিলে ফুটবল খেলছিল। আমরা ওদের সঙ্গে ফুটবল খেললাম। খেয়াল করলাম, ইমরান বারবার রিস্ট ওয়াচে সময় দেখছে। রাত পৌনে বারোটার দিকে হোটেলে ব্যাক করে ও আমাকে রুমে যেতে না দিয়ে বলরুমে নিয়ে গেলো। কী বিশাল সারপ্রাইজ আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো ভাবতেই পারিনি। রুমে ঢুকতেই এক দঙ্গল ওয়েল ড্রেসড লোক হ্যাপি বার্থডে বলে চেঁচিয়ে উঠে জড়িয়ে ধরলো আমাকে। এদিকে আমরা তো একেবারেই ক্যাজুয়েল ড্রেসে তখন। বিচ থেকে ঘেমে নেয়ে এসেছি। ইমরানের সেসব দিকে খেয়াল নেই। প্রথমেই সে শ্যাম্পেইন সেব্রেইজ করলো তারপর আমরা সবাই গ্লাস টোস্ট করার পর সে তার ডান পকেট থেকে ডাইমন্ড রিং বের করে সিনেমার নায়কদের মতো হাঁটু গেড়ে বসে আমাকে, ‘উইল ইউ মেরি মি’ বলে প্রপোজ করলো! ওহ ফাইনালি উই হ্যাভ ফাইন্ড আওয়ার সোলমেট! এরপর কেক কেটে, অনেক রাত পর্যন্ত ড্যান্স করে মাঝরাতে রুমে এসেছিলাম। আদরে আদরে কেটে গেলো বাকি রাতটুকু। সকাল হতেই ক্লান্ত হয়ে দুজন কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না।
বেলা এগারোটায় ঘুম ভেঙেছিল একবার। কিন্তু ক্লান্তিতে দুচোখ ভেঙে পড়তেই আবারও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। দুপুর আড়াইটায় উঠে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিংয়ে এলাম পানি খেতে। টেবিলের ওপর দেখি ফ্লাওয়ার ভাসের নিচে চাপা দেওয়া একটি চিরকুট সঙ্গে ৭০০০ টাকা। মাত্র কয়েকটি লাইন লেখা ছিল তাতে। যার বাংলা করলে অনেকটা এমন হয়, পৃথিবীর বহু দেশে ঘুরেছি। সেরা সেরা ডাকসাইটে সুন্দরীদের সঙ্গে শুয়েছি কিন্তু সেটা কখনোই এক/দুদিনের বেশি নয়। অথচ একজন বাংলাদেশি নারীর সঙ্গে একনাগাড়ে সাতদিন এক ছাদের নিচে কাটালাম। বিছানায় যার অসাধারণ পারফর্মেন্সের কথা কখনো ভুলবো না। জানি, হয়তো তোমার রেট এর চেয়ে অনেক বেশি কিন্তু বিশ্বাস করো এই মুহূর্তে আমার এরচেয়ে বেশি সামর্থ্য নেই। তাই ৭০০০ টাকা রেখে গেলাম। তুমি বাংলাদেশি না হলে তোমার সঙ্গে হয়তো একটা জীবন কাটিয়ে দেওয়ার কথা ভাবতাম। কিন্তু আমি বাংলাদেশিদের ঘৃণা করি। বিদায়।