এক.
সকাল থেকে ছোটাছুটি করে হাঁপিয়ে উঠেছে প্রত্যয়। এত বড় ইভেন্ট আয়োজনে এই প্রথম। তবু শেষপর্যন্ত হল বুকিং, খাওয়া-দাওয়া, প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথিদের রাজি করিয়ে সবকিছু ঠিকঠাক করা গেছে সময়মতো। ঠিক চারটায় হল খুলে দেওয়া হবে। তারপর ধীরে ধীরে অতিথিরা আসবেন।
প্রত্যয় ইভেন্ট ম্যানেজার। নানা ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন করে সে। কিন্তু এবারের অনুষ্ঠান একটু ভিন্ন ধরনের। প্রথমে রাজি হতে চায়নি সে। কিন্তু আয়োজক ব্যক্তি স্থানীয় একটি রাজনৈতিক দলের উঠতি নেতা। সেন্ট্রাল কমিটিতে একটি পদ পাওয়ার চেষ্টা তদ্বির করছেন। সূক্ষ্ণবুদ্ধিতে মনে হয়েছে, সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে ক্যান্ডিডেট তুলনামূলক কম থাকে। তাই অনেক ভেবেচিন্তে নেতা আকমল আখন্দ চিন্তা করলেন, শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করবেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে তিনি নিজেই সভাপতি হবেন।
তার স্বপ্ন—টক শো-তে যারা উপস্থিত থাকেন, তাদের অতিথি হিসেবে রেখে অনুষ্ঠান আয়োজন করবেন। এরপর দৈনিক ও অনলাইনসহ বিভিন্ন পত্রিকার সংবাদ শিরোনাম হবেন। আর তার কিছু অনুগত শিষ্য ফেসবুকে প্রচারণা তো করবেই। ট্যাগ করে ইনবক্সে ইচ্ছেমতো অনুষ্ঠানের ভিডিও ছেড়ে দিলেই তো কেল্লা ফতে। সবাই জানবে এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আকমল আখন্দের পৃষ্ঠপোষকতার খবর।
আখন্দ সাহেবের আজকের অনুষ্ঠানের মূল লক্ষ্য একজন পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখককে সংর্বধনা দেওয়া। যদিও তারও অন্য একটি ইচ্ছেও ছিল। সেটি হলো, সামাজিক অবদানের জন্য নিজেও একটা পদক নেবেন। কিন্তু পরে তার বিশ্বস্ত উপদেষ্টা আরেফিন তালুকদারের পরামর্শে সেই চিন্তা থেকে আপাতত সরে এসেছেন। অনুষ্ঠানে তিনি আজ দেশের সব মিডিয়াকর্মীকে আমন্ত্রণ করেছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ তার অন্ধ অনুসারী, দুই-একজন তার ঘোরবিরোধীও আছে। কিন্তু কী আর করা, বেছে বেছে দাওয়াত দিলে তো আর বেশি প্রচারণা হবে না। তাই অনিচ্ছায় হলেও সবাইকে বলতে হয়েছে।
দুই.
অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে ঠিক পাঁচটা পঁয়ত্রিশ মিনিটে। টেবিলের পেছনে পাঁচটি চেয়ার। মাঝখানে বসে আছেন সভাপতি আকমল আখন্দ। প্রধান অতিথি হিসেবে একজন মন্ত্রী, বিশেষ অতিথি হিসেবে আছেন দুজন অবসরপ্রাপ্ত আমলা। সাহিত্য বিষয়ে তাদের তেমন কোনো ধারণা আছে বলে মনে হয় না। কারণ, তাদের বক্তব্যে আজকের অনুষ্ঠানের বিষয় নিয়ে কোনো কথাই ছিল না। সাহিত্যবিষয়ক আলোচনার পরিবর্তে মন্ত্রীর বক্তব্যে বিরোধী দলের সমালোচনা ছিল। তাও কদর্য ভাষায়। অবসরপ্রাপ্ত দুই আমলা তাদের কর্মজীবনের প্রাপ্তি-ক্ষমতার আলোচনাই করেছেন বেশি।
অথচ পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক ড. হায়দার খানকে যে সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে, সে বিষয়ে তারা কেউ-ই কিছু বলেননি। পুরো অনুষ্ঠানের বক্তব্যের সময়টাতে ড. হায়দার খান চোখ বন্ধ করে ঝিমুচ্ছিলেন। তাকে বক্তব্য রাখতে বললে তিনি বলেন, সাংবাদিকদের কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দেবেন, যদি তারা কিছু জানতে চান। কারণ বক্তব্য রাখার মতো কিছু নেই তার। ঠিক হলো—সভাপতির বক্তব্যের শেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর তিনিও দেবেন।
হালকা চা-নাস্তা পর্ব চলছে। অতিথিদের মধ্যে গুঞ্জন চলছে। ড. হায়দার খান গা ঝেড়ে চোখ খুলে ফেলছেন। ঘড়ি দেখছেন বারবার। সভাপতিকে বললেন, তার হাতে বেশি সময় নেই। টেলিভিশনের একটি লাইভ টক শোতে যেতে হবে তার। সন্ধ্যার পর পরই। সভাপতিকে তিনি অনুরোধ জানান, তার সম্পর্কে কিছু বলার জন্য। এর মধ্য সাংবাদিকরা প্রশ্ন করতে শুরু করেন।
—ড. হায়দার খান আপনি এই বইটিতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ঘটনা নিয়ে লিখেছেন?
—হ্যাঁ। আমার এই বইটি ইতিহাস ও গবেষণার সমন্বয়ে লিখিত হয়েছে। কিছু তথ্য আমি প্রান্তিক মানুষের কাছে গিয়ে সংগ্রহ করেছি।
—এ বইটি লিখতে আপনি কতদিন সময় নিয়েছেন?
—একটানা লিখিনি। এটা আমার সারা জীবনের স্বপ্ন। আমি কৈশোরে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। সেই সময়ের ঘটনা আমাকে এতবছর পর্যন্ত অনুপ্রাণিত করেছে। মানসিকভাবে দায়বদ্ধ রেখেছে বইটি লিখতে। সুতরাং বলতে পারেন এটি একদিনের কাজ নয়।
এর মধ্য থেকে এক সাংবাদিক উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ড. হায়দার খান, আপনি বলেছেন, আপনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। এখন আমার প্রশ্ন হলো—যদি আপনি একজন যোদ্ধা হন, তাহলে আজ সংবর্ধনা নিতে আপনি এই মঞ্চে কেন?
এই প্রশ্নের জন্য মঞ্চের কেউ প্রস্তুত ছিলেন না। হঠাৎ যেন রোদঝলমল আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেলো। চারিদিকে শুরু হলো মৃদু গুঞ্জন। কেউ কেউ রীতিমতো হৈ চৈ শুরু করে দিলেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে উঠে দাঁড়ালেন সভাপতি আকমল আখন্দ। প্রশ্নকর্তা সাংবাদিকের দিকে আঙুল তুলে গর্জে উঠলেন—খামোশ!
তারা যে শক্তি নিয়ে গর্জন করে উঠেছিলেন, শ্রোতাদের কান পর্যন্ত পৌঁছাতে পৌঁছাতে তা বিড়ালের ম্যাঁওতে মিলিয়ে গেলো। সেই ম্যাঁও শুনে হলভর্তি শ্রোতাদের ভেতর থেকে কে একজন বলে উঠলো, ‘ধর রাজাকার’।
আকমল আখন্দ নিজেকে সিংহরূপে কল্পনা করে যতই গর্জন করে উঠলেও সেই আওয়াজ সাংবাদিকটির কানের কাছে বিড়ালের ম্যাওয়ের মতোই শোনালো। তাই সাংবাদিকটি এবার সোজা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন আকমল আখন্দের দিকেই—আপনি এই বইটি পড়েছেন?
আকমল আখন্দ থতমত খেয়ে উত্তর দেন, অবশ্যই পড়েছি।
—না পড়েননি। বইটি প্রায় দেড় হাজার পৃষ্ঠার।এই পুরস্কারের জন্য বই জমা পড়েছিল তিন শতাধিক। এরমধ্যে থেকে বিশ বই নিয়ে শর্টলিস্ট করা হয়েছিল। আমাদের ধারণা, কোনো বইয়েরই পৃষ্ঠা সংখ্যা ৫০০-এর কম নয়। আপনাদের হাতে সময় ছিল মাত্র পনেরো দিন। মাত্র পনের দিনে বিশটি বই কিভাবে পড়ে শেষ করলেন?
—আমি প্রতিটি বই পড়েছি মনোযোগ দিয়ে। আমাকে বিশ্বাস করুন।
—এত অল্পসময়ে এত বিশাল বিশাল সাইজের বই পড়ে শেষ করা কিভাবে সম্ভব? অভিযোগ আছে, মুক্তিযুদ্ধে আপনাদের দুজনেরই একই ভূমিকা ছিল। দুজনেই রাজাকার ছিলেন। পুরনো সম্পর্কের মর্যাদা দিতেই বইটি পুরস্কারের জন্য আপনি মনোনীত করেছিলেন। বলুন, কথাটা ঠিক কি না?
—কে বলেছে আপনাকে এসব আজব কথা? এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমি বইটি পড়েছি। পড়েই বইটির গুরুত্ব বিবেচনায় পুরস্কারের জন্য বিবেচিত করেছি। আমার সহজুরিরাও আমার সঙ্গে একমত হয়েছিলেন?
—তাই? দেখুন, এই বইয়ের একাত্তর পৃষ্ঠায় লেখা আছে, আপনি মুক্তিযুদ্ধের সময় স্থানীয় রাজাকার কমিটির সভাপতি ছিলেন। আপনার নাম ছিল আকমইল্যা। আপনি গ্রামের বাড়িতে-বাড়িতে আগুন ধরিয়ে লুটপাট করেছেন, পাক বাহিনীর ক্যাম্পে যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে ধর্ষণ করেছেন পাক সেনাদের সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া ছেলেদের পরিবারের সদস্যদের ধরে নিয়ে গেছেন চোখ বেঁধে। পরে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দিয়েছেন। বলুন এসব কথা সত্যি? জবাব দিন আকমল সাহেব!
আকমল আখন্দ ঘামতে শুরু করেন। কোনো কথা বের হয় না তার কণ্ঠ দিয়ে। কেবল অস্ফুটস্বরে বললেন, পানি খাব। সঙ্গে সঙ্গে পুরো হলে যেন কয়েক লাখ ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটলো। আকমল আখন্দের মনে হলো, পুরো হলে সমস্বরে সহস্রকণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে—জবাব চাই, জবাব দিন।
তিন.
টেবিলে রাখা টিস্যু পেপার বক্স থেকে টিস্যু নিয়ে কপালের ঘাম মুছলেন ড. হায়দার খান। তার বুকের ভেতর ঢিপ ঢিপ করছে। অনুষ্ঠানে সাংবাদিকরা আসবেন শুনে তিনি ভেবেছিলেন মিডিয়ার কিছু উঠতি বয়সী ছেলে-মেয়ে হয়তো আসবে। কিন্তু এখানে প্রিন্ট মিডিয়ার কিছু দক্ষ সাংবাদিক থাকতে পারে, এটা তিনি চিন্তাও করতে পারেননি।
সাংবাদিক স ম ফিরোজ একালের একজন সাহসী সাংবাদিক। তিন্নি সেন, উদয় বড়ুয়াও আছেন। ড. হায়দার খানের ঘাড়ে ব্যথা শুরু হয়েছে। বুকে চিনেচিনে ব্যথাটাও বেড়েছে। গ্রুপিং-লবিংয়ের জোরে পুরস্কারটা তিনি বাগিয়ে ছিলেন বটে। ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ লিখেছিলেন একজন আমলার ইঙ্গিতে। নিজেকে তিনি কিশোর মুক্তিযোদ্ধা দাবি করলেও আসলে তো ছিলেন রাজাকার আকমল আখন্দেরই গুপ্তচর।
স্বাধীনতার অনেক পর দুজনের দেখা একদিন। দেশে তখন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির নেতারাও সংসদে। তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে হায়দার খান দুই-তিন বছরের মধ্যে বনে গেলেন ড. হায়দার আলী খান। দলের সহযোগিতায় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছেন। ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ গবেষণা গ্রন্থটির জন্য পুরস্কার পাওয়ায় পুরনো বন্ধু আকমল আখন্দ তাকে সংর্বধনা দেওয়ার আয়োজনও করে।
হায়দার খানকে উত্তরীয় পরাতে যাবেন আকমল আখন্দ, ঠিক এই সময়ে একজন সাংবাদিক উঠে দাঁড়ালেন।
—আপনারা তো দুজনেই রাজাকার ছিলেন। একজন এখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখছেন, আরেকজন তাকে পুরস্কার দিচ্ছেন। অথচ আপনাদের বইতেই একজনেরসমস্ত অপকর্মের ঘটনা বর্ণনা করেছেন আরেকজন। বলুন, কিভাবে এমনটা হলো?
সাংবাদিকের প্রশ্ন শুনে হায়দার খান ও আকমল আখন্দের গা বেয়ে দর দর করে ঘাম ঝরতে থাকে। হঠাৎ দুজনই একসঙ্গ গর্জে ওঠেন—খামোশ। কিন্তু তারা যে শক্তি নিয়ে গর্জন করে উঠেছিলেন, শ্রোতাদের কান পর্যন্ত পৌঁছাতে পৌঁছাতে তা বিড়ালের ম্যাঁওতে মিলিয়ে গেলো। সেই ম্যাঁও শুনে হলভর্তি শ্রোতাদের ভেতর থেকে কে একজন বলে উঠলো, ‘ধর রাজাকার’। হলভর্তি শ্রোতার রুদ্ররোষে চেয়ারে বসে থাকতে পারলেন না তারা। টলতে টলতে প্রায় পড়ে যাবেন, এমন সময় তাকালেন দরোজার দিকে। নাহ! কিছুই চোখে পড়ছে না। কিন্তু মনে পড়ছে, ১৯৭১ সাল। বাঙালির ঘরে ঘরে দাউ দাউ আগুনের শিখা। পালাচ্ছে শিশু বৃদ্ধ নারীরা। সেখান থেকে নারীদের ধরে ধরে আকমল আখন্দ ও হায়দার খান নিয়ে যাচ্ছেন পাকিস্তানি ক্যাম্পে। চারিদিকে চিৎকার—আগুন আগুন, পালাও পালাও।