জগতটাকে জগতের মতো ভাবতে গিয়ে অজাগতিক ভাবনাগুলো গুলিয়ে যাচ্ছে। পুরোটাই যেন সার্কাস। কে কত বেশি চমকপ্রদ কসরত দেখাতে পারে তার মহড়া চলছে প্রতিদিন। আমার কোনো কসরত নেই। নেই সার্কাস পার্টি। টিকিট কাটা দর্শকের মতো তাকিয়ে আছি। মনের আনন্দে হাসি। উল্লাসে লাফিয়ে উঠি।
বলছিলাম সার্কাসের কথা। বাড়ির পাশেই খাসেরহাট বন্দর। মাসব্যাপী সার্কাসের আয়োজন করেছে কে বা কারা। পনেরো দিন অতিবাহিত হয়েছে। পনেরো দিনের সাতদিনই কোনো না কোনো কারণে গিয়েছি সার্কাস দেখতে। বন্ধুদের পাল্লায়, আত্মীয়-স্বজনের অনুরোধে। কোনোদিনই টিকিটের টাকা আমার পকেট থেকে যায়নি। উল্টো চা-বিস্কুট, সেদ্ধ ডিম, গলা ভেজানোর জন্য বাংলা মদ—কোনো কিছুরই কমতি নেই। তো ক্ষতি কিসের? লোকে যে আমাকে সমীহ করে! ‘শিক্ষিত রংবাজ’ বলে আলাদা খাতির করে। ইউনিয়নের চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে উপজেলার ইউএনও পর্যন্ত একনামে চেনেন আমাকে।
ক্ষতি তেমন ছিল না, লাভ ছিল বেশি। এক সার্কাসসুন্দরী আমার মন কেড়েছে। চোখের ঘুম কেড়েছে। কোনো কোনো রাতে কোল বালিশসহ গড়াতে গড়াতে পড়ে গেছি নিচে। কখনোবা ঘর্মাক্ত শরীরে ভেজা লুঙ্গি নিয়ে মাঝরাতে লাফিয়ে উঠেছি। ঘরময় সুন্দরীর ঘ্রাণময় উপস্থিতি টের পেয়েছি। অশরীরী কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছি। শুনেছি সেই ভুবনকাঁপানো হাসি।
আজও যেন অনিচ্ছাস্বত্ত্বেও বন্দরে চলে এলাম। কোনো কাজ নেই। তবু কে যেন ভেতর থেকে বলে ওঠে—‘তুমি কোথায় হে প্রেমকুমার? আসো না কেন? সুন্দরীতো তোমার জন্যই অপেক্ষা করছে।’ সুন্দরী! হ্যাঁ, সুন্দরী। আমার সুন্দরী। ওকে তো আমার চা-ই চাই। লোক আমি বেশি সুবিধার নই। পাড়ার সবাই তা জানে। কত মেয়ের ওড়না-শাড়ি, অন্তর্বাস এখনো আমার আলনায় দুলছে। ভাড়াটে সুন্দরীরা প্রায় রাতেই মেতে ওঠে আমার শরীর নিয়ে। তবুও মহল্লার সবাই যেন অন্যরকম সমীহ করে আমাকে। অথচ না জানা, না চেনা এক সুন্দরী আমাকে মোহাবিষ্ট করে ফেলেছে। কীই বা আছে ওর মধ্যে? মিথিলার মতো এই সার্কাসসুন্দরীও আমাকে পাত্তা দিচ্ছে না। রূপের ঝলকে আমাকে রোজ রোজ অঙ্গার করে দিচ্ছে।
সুন্দরীর মুখে আমি আমার প্রথম প্রেমের ছায়া দেখেছি। সেই ঠোঁট, সেই হাসি, কপালের ভাঁজ, ধবধবে দন্তবিকশিত হাসি। মিথিলাকে পেয়েও ধরে রাখতে পারিনি। সে না হয় আমারই ব্যর্থতা। কিন্তু এ কোন মিথিলা? হুবহু মিলে যাচ্ছে মিথিলার সঙ্গে। না, ওকে মিথিলা বলব না। ও আমার সুন্দরী। সার্কাসসুন্দরী। মিথিলা ভিন্ন নারী। সুন্দরীর কসরতের মাঝে কেন মিথিলার মুখ ভেসে ওঠে। সেই বাঁকানো পিঠ, নিখাদ কোমর, প্রস্ফুটিত নাভিদেশ, কম্পমান বুক—যেন মিথিলার প্রতিচ্ছবি।
বাহ দারুণ দেখালে সুন্দরী। তোমাকে জীবনসঙ্গী বানাব।
এইমাত্র কসরত শেষ করে অন্দরে যাচ্ছিল সুন্দরী। তাকে দেখেই মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলো কথাটা। একটা তিরস্কারের হাসি কানকে ভেদ করে ওপাশ দিয়ে মিলিয়ে গেল শূন্যে। বুকের ভেতর বেজে উঠল হাহাকার। আমিও পিছু নিলাম তার। বাধা দেওয়ার কেউ ছিল না। প্রহরীরা আমাকে ভালোই জানে।
সুন্দরী, আমি তোমার সঙ্গে যাবে। নেবে আমাকে?
সুন্দরী পেছন ফিরে তাকায়। চোখে রাগ এবং ভালোবাসার মিশ্রণ। ঠিক যেন আমার বিগত যৌবনের মিথিলা। কিশোরীর অনভ্যস্ত প্রেম। ভয়ার্ত সঙ্গমের ভীত চাহনি।
কোথায় যাবেন আপনি?
তোমার সঙ্গে।
আমার তো কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই।
এই আকাশের নিচে তোমার আঁচল তলে ছায়া পেতে চাই।
কেন?
জানি না।
যার কোনো লক্ষ্য নেই, তাকে আমি নেই না।
তোমাকে ভালো লাগে তাই।
কেন ভালো লাগে?
তুমি সুন্দর।
সেটা আমার বাইরের রূপ। ভেতরটা কুৎসিত। ক্লেদাক্ত।
তোমার ঠোটের কোণে সর্বদাই হাসি লেগে থাকে। ভেতরটা সুন্দর না হলে কেউ এভাবে হাসতে পারে?
আপনি মূর্খ। আপনি জানেন না কার সাথে কথা বলছেন। এ রূপ-যৌবন, শরীর কোনোটাই আমার নয়। আর ওই হাসিটাও অভিনয়। প্রতি রাতে আমাকে বিছানা বদল করতে হয়। আমি কারও নির্দিষ্ট নই।
কী বলছে তুমি? তুমি চলে এসো সব ছেড়ে।
বনের গহীনে একবার ঢুকে গেলে অতো সহজেই ফিরে আসা যায় না। পদে পদে ভয়। জানোয়ারগুলো ওঁৎ পেতে আছে। প্রতিনিয়ত ওরা আমাকে খুবলে খুবলে খায়। হাতছাড়া হতে চাইলে দেহটাই প্রাণছাড়া হয়ে যাবে যে।
আমি অতোশতো বুঝি না। চলো আমরা পালিয়ে যাই।
কোথায় পালাব আমি। আপনিও পুরুষ। জগতের সব পুরুষ এক। সবাই মাংসলোভী। শরীরের স্বাদ খোঁজে। মনের বন্দর ছুঁতে পারে না। তাই বলছি, ফিরে যান আপনি। এক মুহূর্তও আর দাঁড়াবেন না এখানে। আমার বিশ্রাম দরকার। পরের শো’তে উঠতে হবে।
সুন্দরী চলে গেল অন্দরে। একটা ঘা দিয়ে গেল অন্তরে। ‘তুমি কী আমার হবে না? পাড়ার রেশমা, সানি, মল্লিকার চেয়েও তোমাকেই বেশি ভালোবেসে ফেলেছি। সত্যিই। কিন্তু কেমন করে বোঝাই?’ কথাগুলো শূন্যে মিলিয়ে গেল।
সেই রাতে আর ঘুম এলো না। চোখ বন্ধ করলেই সেই লাস্যময়ী হাসি, কোমড়ের ভাজ, গ্রীবার কার্নিশ বেয়ে নেমে আসা জোছনা, বুকের কাঁপন, শরীরের শিহরণ আমাকে উন্মাদ করে তোলে। নিদ্রাহীন একটি রাত যেন কোনোভাবেই কাটতে চায় না।
আমি তোমাকে নিয়ে পালাবোই।
অমন বোকামো করতে যাবেন না। বাপের দেওয়া অমূল্য জীবনটা হারাবেন। তার চেয়ে বরং বাড়ির পাশের কোনো সুন্দরী ঘোমটাপরা মেয়ে দেখে বিয়ে করে নিন।
ঘোমটাপরা মেয়ে আমার পছন্দ নয়। আমার চাই তোমার প্রেম, উন্মুক্ত আহ্বান।
তৃষ্ণায় কাতর হলেও একফোটা জল পাবেন না। উগড়ে দিতে পারি বিষ। সে বিষ হজম করার পরিপাকতন্ত্র নেই আপনার।
তুমি যাবে আমার সাথে? না হলে জীবনে এখানেই সমাপ্তির রেখা টেনে দিতে বাধ্য হব। যাকে আমি পাই না, তাকে আর কারও হতে দেই না।
সুন্দরী লক্ষ করে তার তলপেট জুড়ে তীক্ষ্ম ফলার অস্তিত্ব। দম বন্ধ হয়ে আসে। ভালোবাসার জন্য মানুষ পাগল হতে পারে। না পেলে খুন করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে—এমন প্রেমিক তার জীবনে এই প্রথম। সুন্দরী ভাবে, জীবনের মায়ায় শরীরের সবই তো বন্দক দিয়েছি তাবৎ পুরুষের কাছে। তারা সুখটুকু নিংড়ে নিয়ে ক্লান্ত আমাকে ফেলে গেছে পথের ধারে। সাহায্যের জন্য যার কাছেই হাত বাড়িয়েছি হাতড়ে দেখেছে ব্যবহারের উপযুক্ত আছি কিনা। আর আজ কিনা ভালোবাসার দোহাই দিয়ে অপহৃত শরীর নিয়ে মেতে উঠতে চায় উন্মাদ তরুণ।
তুমিও আমায় ছুড়ে ফেলবে?
ছুড়ে ফেলার জন্য তোমাকে ছুঁইনি।
আমিতো বাঘের খাঁচায়। চাইলেই মুক্তি সম্ভব নয়। তুমি পালিয়ে যাও। রক্ষীরা এসে যাবে।
তুমি চাইলেই তোমাকে কেবল মুক্ত করতে পারি।
এমন মুক্তি আমার কাম্য নয়, সেখানে পরাধীনতার শিকল। যে কৃতিত্ব আপনার। তাতে আমার কোনো বীরত্ব নেই।
কেমন বীরত্ব চাই তোমার? রাতের পর রাত হাত বদলে তোমার কেমন বীরত্ব?
বীরত্ব নেই ঠিক। তবে একটা মোহ আছে। রানী হওয়ার খেয়াল আছে। পুরুষগুলোকে যখন কুকুরের মতো আমার পা চাটতে দেখি তখন নিজেকে রানী ভিক্টোরিয়া মনে হয়। পুরুষ আমার কাছে নত হয়। একে অন্যের উচ্ছ্বিষ্ট নিয়ে কাড়াকাড়ি করে। মেতে ওঠে। এইবা কম কিসের?
এমন ভাবনাই তোমাকে সারাজীবন ক্রীতদাসী করে রেখেছে। মুক্তির কোনো উপায় খোঁজোনি তুমি। ভাগ্যের হাতে সপে দিয়েছো নিজেকে।
ভাগ্য আমাকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারলে আমি কেন নিজেকে উপভোগ করতে পারব না?
তোমার বোধ-লজ্জা কিছুই অবশিষ্ট নেই। তোমার ভেতরটা পুরোই নগ্ন হয়ে আছে। পোশাকটা খোলসমাত্র।
সে তো সবাই জানে। তবু অন্ধকারে দু’হাত ধরে কাছে টানে। এই যে তুমি কেন ধরে আছ অমন করে? কাম জেগেছে?
না, কাম জাগেনি, প্রেম জেগেছে। কাম জাগলে তোমার কাছে প্রেম নিবেদন করতাম না। কামের শরীর তোমার কাছে বন্দি হয়নি। মনটাকেই বেঁধে রেখেছ। এবার চলো!
না গেলে কী করবে? আমি বললাম তো, এমন মুক্তি আমার কাম্য নয়। আমি নিজের মতো বাঁচতে চাই। আমার মতো থাকতে চাই।
তবে যে নিথর দেহ পড়ে থাকবে। নিঃশ্বাসের সব দরজা বন্ধ হবে। উপভোগের সকল আয়োজন এক নিমিষেই বাতাসে উড়ে যাবে।
সেই ভালো। তবে তা-ই করো। আমি যাচ্ছি না। যে লোকালয় আমাকে গণিকালয়ে পাঠিয়েছে, আমি আর সে লোকালয়ে ফিরে যেতে চাই না।
ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে আমার। তীক্ষ্ম ফলাটা তখনো তুলতুলে তলপেটে ঠাসা। সুন্দরী ঘুরে আমার দিকে তাকায়। ঠোঁটের কোণে সেই পাগলকরা হাসি। কোনো আওয়াজ নেই। তবে বোধহয় মুক্তির বাসনা জেগেছে।
মুক্তি দেবে আমায়? তবে দাওনা। আমি এমন মুক্তিই চেয়েছি। তুমি আমাকে কৃতার্থ করো।
হ্যাঁ, দেব বলেই তো রোজ ছুটে আসি। তুমিই তো ফিরিয়ে দাও। আজ আর খালি হাতে ফিরছি না।
তো দেরি করছ কেন? মুক্তির চাবিকাঠি তো তোমারই হাতে।
বলতে বলতেই আমার ফলা ধরা হাতে সজোরে চাপ দিলে একটা। চামড়া ভেদ করে ঢুকে গেল চার ইঞ্চি। কোনো চিৎকার নেই। সুন্দরীর মুখে স্বর্গের হাসি। আমি হতবাক। সুন্দরীর দেহটা এলিয়ে পড়ছে আমার কোলে। আমি নির্বোধ সহকারীর মতো সাহায্য করে যাচ্ছি তার সার্কাসে।