পর্ব-১
ভীষণ ভয় আর উৎকণ্ঠায় সেদিন রাতে ছেলেকে নিয়ে ঘুমাতে আসে মজিদ খান ও তার স্ত্রী সায়রা বানু। মজিদ খান হাঁক দিয়ে স্ত্রী সায়রা বানুকে মশারির চারিপাশ ভালো করে গুঁজে দিতে বলে। সঙ্গে সঙ্গে উঁচু করে বিছানার চারপ্রান্তে বালিশও দিয়ে রাখে সায়রা বানু। ঘরের মাঝখানের রুমে আজ ঘুমাতে আসে তারা। রুমে প্রবেশ করার দরোজার খিল ভালো করে এঁটে দেয় মজিদ। সৈয়দকে তারা ঘুমাতে নেয় দুজনের মাঝখানে। সৈয়দের বয়স একুশ বছর, গায়ের রঙ হলুদাভ, বেশ চওড়া কপাল, খাড়া নাক, ডাগর কালো চোখ। যেই একবার তাকায়, মায়া পড়ে যায়। আর ব্যবহারও খুব অমায়িক। সায়রা বানু ছেলেকে বলে, বাজান তুমি ঘুমাও আমি হারা রাইত পাহারা দিই। স্বামী মজিদকে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে, আপনে কি সর্বনাশ কল্লেন? আমার বাজানের যদি কিছু অয়, আমি আপনেরে ছাড়মু না মনে রাইখখেন। মজিদ শ্লেষে উত্তর দেয়, চুপ কর চুতমারানি খানকি মাগী। আমি গরু কাইট্টা দিমু পীরের মাজারে। তুই এহন ঘুমা। আর মশারির চারপাশে কোনো ছেঁদা নাই। কোনহান দিয়া কী আইবে? তুই বাজে চিন্তা বাদ দিয়া আল্লাহর নাম নিয়া ঘুমা।
সায়রা বানু সারাটা রাত প্রায় জেগেই কাটিয়ে দেয়। সারাক্ষণ নিঃশব্দে আয়াতুল কুরসি পড়ে ছেলের গায়ে ফুঁ দিতে থাকে। আর দুহাত তুলে, প্রার্থনায় বলে, হে মাবুদে এলাহী, হে পরোয়ারদিগার, আমার বাজানরে আমি আপনের জিম্মায় রাখলাম। অই লোভী মানুষটার শাস্তি আপনে আমারে আর আমার বাজানরে দিয়েন না। এসব চিন্তা আর দোয়া-দরুদ পড়তে পড়তে কখন যে সায়রা ঘুমিয়ে পড়ে, সেটা নিজেও টের পায় না।
তখন রাত সম্ভবত তিনটা বাজে। ও মা বলে চিৎকার করে ওঠে সৈয়দ। সঙ্গে সঙ্গে সিথানে রাখা হারিকেনের আলো বাড়ায় মজিদ। ডাক দেয় সায়রা বানুকে। সায়রা তখন গভীর ঘুমে। মজিদের ডাক শুনে পড়িমরি করে উঠে বসে। ক্ষতস্থানে হারিকেন ধরে দেখে দুইটা বড় দাগ। কামড় দেওয়ার স্থানে দুই পাশে দুইটা দাঁতের চিহ্ন। মজিদ বলে, শিগগিরই পায়ে বান দে। বিষ জানি উফরে উটতে না পারে। সায়রা বানু পরার শাড়ি ছিঁড়ে এনে পায়ের মধ্যিখানে শক্ত করে বেঁধে দিতে নেয়।
মজিদ খান বলে, এই মাগী তুই আমার পোলা ধরিস না। তুই ওর মা। আর উনারা কামড় দিলে মায়ের পুত ছুঁইতে অয় না। তুই হুগনা মরিচ টাইল্লা আন শিগগিরই। আর আমি অই ঘরের পোলাগো ডাক পাড়ি। ইতোমধ্যে সৈয়দ শুরু করেছে চিৎকার। ওহ! মাহ খুব ব্যথা করছে! শুরু হয়েছে প্রচুর রক্তপাত, ঝাপসা হয়ে আসছে সৈয়দের চোখ। সায়রা বানু ভেজে নিয়ে এসেছে পাঁচটা শুকনো মরিচ। সৈয়দ মুখে নিয়ে চিবাতে শুরু করতেই চোখ বন্ধ হয়ে আসে তার। সায়রা বানু চিৎকার শুরু করে, স্বামীকে মিনতি করে বলে, আমনের পায় ধরি মুই। অই ঘরের পোলাগো ডাকেন, ওঝা ডাকতে পাডান, আমার বাজানরে বাঁচান।
ও নজরুল, ও আবুয়াল, ও হাবি তোগো মেভাইরে বাঁচা।
রাত তখন চারটার কিছু কম। ফাল্গুন মাসের হালকা বৃষ্টি শেষে আকাশ পরিষ্কার হয়ে চাঁদ উঠেছে। রাতকে মনে হচ্ছে সদ্য প্রসূত যুবতী মায়ের মতো কমনীয় আর মোহনীয়।
মজিদ খানের ডাকে ঘুম ভেঙে আসে তার ভাইয়ের ছেলে আবুয়াল আর হাবিব। এসেই উৎকণ্ঠ নিয়ে জিজ্ঞেস করে, দুদু কী অইছে? মজিদ কপাল চাপড়ে বলে, কপাল পোড়ছে! আমার সৈয়দরে সাপে কামড়াইছে। শিগগিরই কাশেম ওঝারে ডাইক্কা লইয়ায়।
মুখে দিচ্ছে না কুটোটিও। তার মন শুধু একই কথা জপ করে বারবার; হাজেরা আর আমেনা এই দুই মেয়ের পরে আল্লাহ তাকে দিয়েছিল অমন সোনার বরণের রাজপুত্র। তার লোভী, দুষ্ট স্বামীর জন্যই তাকে হারাতে হলো।
কশেম ওঝারে ডাকতে যায় আবুয়াল আর হাবিব। কাশেম ওঝা আবুয়ালের ডাকে ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে বলে, কী অইছে? চার ফিট আট ইঞ্চি উচ্চতার কাশেম ওঝার পেট অব্দি দাড়ি, কিন্তু মাথায় টাক, চোখগুলো অসম্ভব রকমের ছোট আর ভেতরে ঢোকানো। কাশেম ওঝা সব শুনে বলে, রোগীর অবস্থা ভালো না। এইরকম রোগী চিকিৎসা করতে ওস্তাদজির মানা আছে। আমি যাইতে পারমু না। আবুয়াল আর হাবিব খুব অনুরোধ করে বলে, কাশেম চাচা চলো, সৈয়দ ভাইরে বাঁচাও। দুদু তোমারে অনেক টাহা দেবে। কাশেম ওঝা অনড় হয়ে বসে রইলো। হাবিব আর আবুয়াল হন্যে হয়ে ছোটে পাশের গ্রাম লামচরী। অইখানে আছে বিখ্যাত ওঝা সুবিনয় কর্মকার। আবুয়াল আর হাবিব গিয়ে সুবিনয়ের বাড়িতে পৌঁছায়। সকাল সাড়ে ছয়টা। সুবিনয় তখন যোগাসনে ধ্যানে ব্যস্ত। সুবিনয়ের বয়স মাত্র পঁয়তাল্লিশ। কিন্তু কণ্ঠ বেশ রাশভারী, আর চাহনি খুব গভীর। সুবিনয়ের স্ত্রী সুরবালা এসে ওদের ঘরের বাইরে বসার পিড়া দেয়। একটা লাল প্লাস্টিকের বাটিতে নিয়ে আসে নারকেল এর নাড়ু ও চিড়া ভাজা। আবুয়াল আর হাবিব দুজনেই সুরবালাকে খুব অনুরোধ করে বলে, বৌদি সৈয়দ দাদাকে সাপে কাটছে, দুদুর একমাত্র পোলা। তুমি সুবিনয় দাদারে কও না আমাগো লগে যাইতে। টাকা-পয়সা যা চায়, দুদু দেবে। সাতটার সময় সুবিনয়ের ধ্যান শেষ হয়। সুবিনয় যখন কথা বলা শুরু করে, মনে হয় যেন সমুদ্রের গর্জন শুরু হয়েছে। গমগমে গলায় সুবিনয় শুধায়, কী রে সুরবালা কারা আইছে সকাল সকাল? সুরবালা বলে, বড় বিপদে পড়ে আইছে গো। তুমি এট্টু দেহ না কী করতে পারো! সুবিনয় আগন্তুকদের তার কাছে পাঠাতে বলে।
ওইদিকে দুই ঘণ্টা পর্যন্ত সৈয়দের চোখ বিভিন্নভাবে খোলা রাখা সম্ভব হয়েছিল। তারপর আর কোনোভাবেই চোখ খোলা রাখতে পারছে না সৈয়দ। ক্ষতস্থান ফুলে উঠেছে। ধীরে ধীরে ফুলতে আরম্ভ করেছে সমস্ত ডান পা। সায়রা বানু মূর্ছা যাচ্ছে বারবার। বিলাপ করছে, আমার বাজানরে ওই হারামি ব্যাটা মাইরা ফালাইলো। গ্রামের সমস্ত মহিলা চোখের জলে বলে, আল্লাহরে ডাকো বুজি। আল্লাহই সবকিছুর মালিক।
সুবিনয় আবুয়ালকে জিজ্ঞেস করে রোগীর বয়স কত?
আর কখন কামড়েছে? আবুয়াল যখন জানায় সৈয়দেরর বয়স একুশ বছর আর সাপে কামড়েছে আনুমানিক রাত তিনটায়। কিন্তু মশারি চারিদিক দিয়ে খুব ভালো করে গোঁজা ছিল। সুবিনয় বলে, তোমরা একটু ওইদিকে গিয়া বসো। আমি দশ মিনিট পরে তোমাগো জানাইতেছি যামু কি না। দশ মিনিট পরে সুবিনয় জানায়, সাপ ডান পায়ে কামড় দিছে। এই সাপ কোনো সাধারণ সাপ না। সাপের গায়ের রঙ কমলা। মাথায় সবুজ মুকুট আছে। এই রোগীকে সারিয়ে তোলা সম্ভব না। আর ধ্যানে আমার গুরু আইনুদ্দিন ওঝা আমারে মানা করছে এই রোগী দ্যাকতে।
ততক্ষণে সৈয়দ গভীর ঘুমে। শ্বাস- প্রশ্বাস হয়তো বা আছে, কিন্তু কোনো চেতন নেই। অবশেষে প্রতিবশী রব হাওলাদার রওয়ানা দেয় ফরিদপুরের দিকে বিখ্যাত ওঝা মাইনুদ্দিনের খোঁজে। এলাকার মানুষ বলাবলি করতে লাগলো। মাইনুদ্দিন ওঝা মরণের মুখ দিয়া রোগী ফেরত আনতে পারে। আর সাপে কাটলে তিনদিন ধরে পরান থাহে। আউক মাইনুদ্দিন ওঝা। মাইনুদ্দিন ওঝা এসে পৌঁছালো আসরের সময়। মাইনুদ্দিন এসে দেখেই বলে, চেহারা তো কালা অইয়া গ্যাছে! রোগী তো নাই! দাফন করে দেন। মজিদ খান মাইনুদ্দিন ওঝাকে লাঠি নিয়া মারতে আসে। কুতকুতে কালো মাইনুদ্দিন হাসতে হাসতে বলে ঘটনা তাইলে এই! উনি কি অন এই রোগীর?
সমবেত জনতা বলে বাপ। মাইনুদ্দিন বলে, ও আল্লার মাইর আলমের বাইর। এই বলে মাইনুদ্দিন বের হয়ে যায়। তাকে খাওয়া দাওয়া করতে বললে, মাইনুদ্দিন জানায় এই বাড়িতে সে একটা দানাও স্পর্শ করবে না।
চরবাড়িয়া গ্রামের খুব কম মানুষই বাকি আছে মজিদ খানের গালি খেতে। মজিদ বাড়ি বাড়ি দুধ ফেরি করে বেশ উপার্জন করে। এলাকার কোনো বিধবা নারী দুধ রোজ করলে বলে, এহ রাঢ়ী মাগির আবার দুধ খাওয়া লাগে! তারপরও এলাকার মানুষ রান্না করে দিয়ে যাচ্ছে ডাল-ভাত, মাছ- তরকারি। আজ আর উনুনে আগুন ধরানো হয়নি। সায়রা বানুর চোখ কোটরে ঢুকে গেছে। মুখে দিচ্ছে না কুটোটিও। তার মন শুধু একই কথা জপ করে বারবার; হাজেরা আর আমেনা এই দুই মেয়ের পরে আল্লাহ তাকে দিয়েছিল অমন সোনার বরণের রাজপুত্র। তার লোভী, দুষ্ট স্বামীর জন্যই তাকে হারাতে হলো।
চলবে…