কিশোর বয়সে মিথিলার দুরন্তপনার সঙ্গী ছিল বাবার সাইকেলটি। সঙ্গী হতে গিয়ে ওটার আয়ু দ্রুত কমে যাচ্ছিল। তাই দেখে বাবা খুব করে হাসতেন আর বলতেন, এটাকে যদি ভাঙতে পারিস, তবে নতুন সাইকেল কিনে দেবো।
মিথিলাও বনবাঁদাড় মাঠ পেরিয়ে তেপান্তরে চলে যেতো সাইকেল নিয়ে। এটাই একমাত্র জিনিস যা মিথিলাকে কটাক্ষ করে না। প্রাণখোলা আনন্দ দেয়। গ্রামে সাইকেল চালালে মোল্লা মাতব্বররা চোখ টাটাতো। বাবার রোষানলে পড়ার ভয়ে মুখে কিছু বলতো না। তখন পাড়ার ভাবিরা মিথিলাকে হিজড়া বলতো। বলতো, দেখিস, তোর বিয়ে হবে না।
তাই দুরের মাঠের রাস্তায় চলে যেতো সাইকেল নিয়ে। যশোর রোডে তখন তেমন গাড়ি চলতো না। আধাঘণ্টা পর দুটি গাড়ি পরপর আসতো। তবু বাবার কড়া নিষেধ ছিল রাস্তায় ওঠা যাবে না। দুপুরে যখন সবাই ঘুমোতো মিথিলা সাইকেল নিয়ে চুপটি করে পালিয়ে যেতো। তখন মধ্য দুপুর রাস্তাগুলো খা খা করতো। দুই-একটি শিয়াল খাবারের সন্ধানে এপার-ওপার করতো। আর মিথিলা দুহাত ছেড়ে দিয়ে বাতাসের বেগে উড়ে যেতো দক্ষিণ দিকে। আহা! সেসব দিন যে কী স্বপ্নময় ছিল! মাঝে-মাঝে চৈত্রদিনে মধ্যদুপুরে সাইকেল নিয়ে কালি পুকুরে নেমে পড়তো। দুষ্টু ছেলের দল সাইকেলটি লুকিয়ে ফেলবে বলে।
দাপিয়ে-ঝাঁপিয়ে যখন পুকুর থেকে উঠতো, তখন সাইকেলটা ভীষণ রাগ করতো। আর চলবে না বলে জিদ ধরতো। কিছু দূর গেলেই চেইন পড়ে যেতো। তখন অনেক রাগ করে সাইকেলটাকে মাঠের মাঝখানে ফেলে চলে যেতো মিথিলা। বাবাকে এসে বলতো। বাবা বলতেন, ওটাকে আর আনার দরকার নেই। কালই তো আবার ভেঙে ফেলবি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলেই সাইকেলটার জন্য কেমন মায়া লাগতো তার। বাবার সঙ্গে ঘ্যান ঘ্যান করতো। বাবা আর মিথিলা গিয়ে সেটাকে কানাইদার দোকানে দিতো। কানাইদা চোখ কটমট করে তাকাতো। ধুর মাস্টার! ও আমি আর ঠিক করবান্ না। ওর পিণ্ডি চটকে দিয়েছে তোমার ওই ছাওয়াল। কানাই দাও জানতো না, মিথিলা ছেলে না মেয়ে। নাম ধরে বাবাও কোনোদিন ডাকতেন না মিথিলাকে। আদর করে ‘বাপ’ বলতেন।
এলাকায় নতুন কেউ এলেই মিথিলাকে ছেলে ভাবতো। কারণ মেয়েলি পোষাক তখনো সে পরেনি কোনোদিন। সবার চুলে বরাবর ব্লেড চললেও মিথিলার চুল কাটতো বাজারের একমাত্র নাপিত দানিয়েল। শ্যামলা রঙা চামড়ায় ছেলেদের প্যান্ট ও ছোট গেঞ্জি দেখে না বলে দিলে কেউ বুঝতো না, সে মেয়ে না ছেলে। এই নিয়ে মিথিলার আর ওর বাবার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। তখন কারও অসুস্থতা, কারও বাড়ি থেকে কোনো জিনিস আনা, বাজারে প্যাকেট নিয়ে যাওয়া; এসব এই ছাওয়ালটাই করতো। এমনকী ডাক্তার ডাকতেও দরকার পড়তো মিথিলাকে। দিনশেষে মায়ের চোখ ছলছল করে উঠতো। সত্যি, ও যদি ছেলে হতো! তবে এত সম্পত্তি, বাবা ধমক দিয়ে থামিয়ে দিতেন।
মিথিলারা দৌড়ায় আর দৌড়ায়। যতক্ষণ জীবন থাকে, ষড়যন্ত্র পিছু ছাড়ে না। দৌড়ানোও থামে না। তবু মিথিলারা যুদ্ধ করে যায় প্রেরণার ভাঙা সাইকেল নিয়ে।
তবে, পৃথিবীর সব নিরাপত্তা মা অনুভব করতেন হয়তো। আবার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বারবার বলতেন, মেয়েই যখন হলো, তখন গায়ের রঙটা কেন ফর্সা হলো না? কোথায় বিয়ে দেবো, কে নেবে ওকে? বাবা রেগে যেতেন খুব। সন্তান লেখাপড়া শিখে মানুষ হবে, নিজের পায়ে দাঁড়াবে এই স্বপ্নই মিথিলার বাবার ছিল। তবে কালো রঙের কারণে যে বর্ণ বৈষম্য মিথিলার ওপর হতো সেজন্যই বাবা মিথিলাকেই সব চেয়ে বেশি ভালবাসতেন। আর এমন দুরন্ত হয়ে উঠতে এগিয়ে দিতেন। বাবার প্রেরণাই মিথিলাকে প্রতিমুহুর্তে বাঁচতে শিখিয়েছে। সেই বাবা যেদিন রোড অ্যাক্সিডেন্টে সাইকেলসহ মর্মান্তিকভাবে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন, সেদিন থেকে মিথিলার মেয়ে হয়ে ওঠার যুদ্ধ শুরু হলো। সাইকেল আর চালানো হলো না। লম্বা চুল রাখা শুরু হলো। বোরখার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে নির্দেশ এলো। রঙ ফর্সা করার চেষ্টা, কলেজ বন্ধ হলো। গান শেখা চলবে না ওটা বিদা’ত। আরও কত কত নিয়ম!
সেই প্রথম মিথিলার জন্য মেয়ের জামা কেনা হলো আয়োজন করে। কিন্তু সেসব কোনো কাজে লাগেনি। ততদিনে মিথিলার ঘাঢ় খুব বাঁকা হয়ে গিয়েছিল। তাই সব নিয়মের বেড়া ভেঙে সে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। বাবার দেখানো পথে চলতে গিয়ে বারবার আঘাত পেয়েছে, শরীর, মন জর্জরিত হয়েছে। তবু দাঁড়িয়েছে। আজও এতবছর পর বাবার সেই আদূরে কিশোরীটি নারী হতে পারেনি বোধ হয়। কারণ সে শুধু মানুষ হতে চেয়েছিল। তবু মেয়েটি এখনো সাইকেল দেখলেই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে, আর ছুটতে চায় দুরন্ত স্বপ্নের মধ্য দিয়ে। যেখানে দুহাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তার প্রিয় বাবা।
এত বাধা পেরিয়ে মিথিলাদের বেশিদূর যাওয়াই হয় না। ততদিনে সময় বহুদূর গড়িয়ে যায়। মিথিলারা দৌড়ায় আর দৌড়ায়। যতক্ষণ জীবন থাকে, ষড়যন্ত্র পিছু ছাড়ে না। দৌড়ানোও থামে না। তবু মিথিলারা যুদ্ধ করে যায় প্রেরণার ভাঙা সাইকেল নিয়ে।