০১.
রাতভর তুমুল বৃষ্টি হয়েছে। আঁধার কেটে গেলেও ভেজা ভাবটা কাটেনি পুরোপুরি। সদ্য গোসল সেরে বেরুনো নারীর মতো স্বচ্ছ লাগছে আকাশটাকে। চারপাশ সতেজ, স্নিগ্ধ, ঝকঝকে। বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণ। একটা পাখি কাতর স্বরে সেই তখন থেকে ডেকেই চলেছে। কী হারিয়েছে? সঙ্গী না কি ঘর? ঘর হারালে ঘর হবে, সঙ্গী হারালে? আঙুলে চুলে বিলি কাটে মৃত্তিকা। ভেজা বাতাসের ঝাঁপটায় ঠাণ্ডা অনুভব হয়। শালের মতো করে ওড়নাটা জড়িয়ে নেয় গায়ে। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা অনুভূতি ভালো লাগছে খুব। ডাল থেকে নেমে এসে একটা পাখি লাফিয়ে লাফিয়ে এটাসেটা খুঁটে খাচ্ছে। এটাই কি সেই পাখিটা, যেটা এতক্ষণ হারানো সঙ্গী বা ঘর খুঁজে পেতে আকুল হয়ে ডাকছিল? কী জানি!
যেখানে শারীরিক ব্যাপারটাই মুখ্য। শারীরিক সম্পর্ক করতে হলে মানসিক সম্পর্ক থাকতেই হবে—এমনটা জরুরি নয় তাদের কাছে। অন্যদিকে নারীরা শারীরিক সম্পর্কের আগে মানসিক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী। এতে তারা স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপদ বোধ করে।
আচমকা ফোনের শব্দে চমকে ওঠে মৃত্তিকা! রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গে আকুতি ঝরে পড়লো ফরহাদের কণ্ঠে!
প্লিজ, মৃত্তিকা, এক্ষুনি চলে এসো। কী সুন্দর ওয়েদার! তোমার কোনো কথাই আজ শুনবো না। মাঝপথে থামালো মৃত্তিকা, আহা, একটু শ্বাস ফেলো ফরহাদ। একনাগাড়ে এতটা বললে তো দম আটকে মারা পড়বে।
—সত্যি সত্যিই মারা পড়বো আজ, তুমি না এলে! হাসলো মৃত্তিকা। কেন এত জরুরি তলব, বলো তো?
—দেখছ না পানিভর্তি কিছু মেঘ এখনো রয়েছে। আবার ঝরবে। তোমাকে নিয়ে বৃষ্টি দেখবো।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়েও ফরহাদের মধ্যে ছেলেমানুষী রয়ে গেছে ষোলো আনা। মাঝেমাঝে এমন পাগলামি করে! কখনো কখনো বিপদেও পড়তে হয়। মৃত্তিকা না গেলে কিছুতেই মানবে না আজ। বয়স পয়ষট্টির কাছাকাছি হলেও কাণ্ডকারখানা দেখলে মনে হয় এখনো বুঝি পঁচিশ। এই সম্পর্কের নাম জানা নেই। জানা নেই কোনো মানেও। আস্থা আর আনন্দ শুধু মিলেমিশে একাকার। আজ ভার্সিটি যায়নি মৃত্তিকা। বৃষ্টিটা উপভোগ করছিল। ফরহাদ ওর ডিপার্টমেন্টেরই শিক্ষক। আজ ওর ক্লাস ছিল না। ফরহাদের ক্লাস সচরাচর মিস করে না ও। এত দারুণ পড়ায়। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনে। মাঝেমাঝে অপরাধবোধে ভুগলেও এই সম্পর্ক থেকে কিছুতে বেরুতে পারছে না মৃত্তিকা। ওকে হিপনোটাইজ করে রেখেছে যেন! ঘর-সংসারের বাইরে শুধু মৃত্তিকাই নাকি এসেছে ওর জীবনে। এ ধরনের সম্পর্ক গল্পে, সিনেমায় অনেক দেখেছে। নিজের জীবনে এমনটা হতে পারে, ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি। শারীরিকভাবেও এতটা ইনভলভ হয়ে গেছে যে, ওকে ছেড়ে থাকার কথা ভাবতেও পারে না। রোদ্দুরের মতো কমলারঙের শাড়ি পরে ঝটপট তৈরি হয়ে নিলো। আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো। তারপর, স্লিপারটা পায়ে গলিয়ে বেরিয়ে গেলো ফরহাদের ব্যক্তিগত গোপন ফ্ল্যাটের উদ্দেশে।
০২.
মন খারাপের গল্প শুনতে শুনতে অবসাদগ্রস্ত লাগছে। ভণ্ডামি আর প্রতারণা কি বেড়ে গেছে আজকাল? গত কয়েকদিনে যে কয়টি কেস হ্যান্ডেল করেছে, তার মধ্যে শতকরা পঁচাত্তর ভাগই ছিল সম্পর্কের প্রতারণা সংক্রান্ত। মাথাটা পেছনে হেলিয়ে চোখ বন্ধ করে ইশরাত। একটু রিল্যাক্স হওয়ার চেষ্টা করে। সাইকিয়াট্রিতে পোস্টগ্র্যাজুয়েশন করতে চাইলে মা সন্দেহ প্রকাশ করেছিল—আদৌ রোগী পাবে কি না। খুব তাড়াতাড়িই পাস করে বিশেষজ্ঞ হিসেবে প্র্যাকটিস করছে প্রায় পাঁচ বছর হতে চললো। একদিনের জন্যেও রোগীর অভাব হয়নি। গত দুই বছর ধরে রোগীর সংখ্যা এত বেড়েছে যে, নিজের জন্য একটু সময় বের করা মুশকিল হয়ে পড়ছে। অল্পসময়েই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে দারুণ খ্যাতি হয়েছে ইশরাতের। আসলে, ইশরাত বরাবরই ওর কাজের প্রতি আন্তরিক। যতক্ষণ রোগী দেখে, ওর পুরোটাই সে রোগীর জন্য ব্যয় করে। অন্য কোনোদিকে মন দেয় না মুহূর্তের জন্যও!
গত কয়েকদিনের কেস সিরিজগুলোর দিকে চোখ বোলালো। কেমন যেন খটকা লাগছে ইশরাতের। আজকাল উচ্চশিক্ষিত, গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও শারীরিক প্রতারণার ফাঁদে ফেলছে মেয়েদের। বরং তাদের সুযোগ যেন একটু বেশিই এক্ষেত্রে। কারণ, মেয়েদের আস্থার জায়গাটা দখলে নেওয়া তুলনামূলক সহজ তাদের কাছে। শারীরিক সম্পর্কটাই মুখ্য এখানে। বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কেও এরা একজনকে ছেড়ে আরেকজনকে ধরে। এটাও এক ধরনের মানসিক বিকার। তবে সম্পর্কে জড়ানোর ব্যাপারে মেয়েদেরও আরও দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন। ভালোবাসার কথা শোনামাত্র গদগদ না হয়ে একটু বুদ্ধি খাটানো প্রয়োজন। সমাজ যে সম্পর্ককে বৈধতা দেয় না, তেমন সম্পর্কে জড়িয়ে গেলে, তার কাছে কিছু প্রত্যাশা করাটাও অমূলক।
বাসায় ফেরামাত্রই শরীর ভেঙে আসে ইশরাতের। কিচ্ছু করতে মন চায় না। চেম্বারের পর ওই সময়টুকু একান্তই ওর নিজের। কিন্তু না! আড়মোড়া ভেঙে আলসেমি ঝেড়ে ফেলে ও। এই কেসগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। একেবারে শুরুর দিন থেকেই সমস্ত পেশেন্টের ইনফরমেশন ওর তথ্যভাণ্ডারে আছে। মূলত গবেষণার জন্যই, আর খানিকটা সেলফ ইন্টারেস্টে! গত পাঁচ ছয়মাসে বেশ কয়েকজন নারী এক্সপ্লয়েট হয়েছেন শিক্ষিত লোকেদের দ্বারা। প্রথমে লক্ষ করেনি, কিন্তু একটু ডিটেইলসে হিস্ট্রি নিয়ে আর সব তথ্য অ্যানালাইসিস করে দেখা যাচ্ছে, ব্যক্তিগুলো বিষয়গুলো কমন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তথ্যগুলো নাড়াচাড়া করতে গিয়ে হঠাৎ অনেকটা কাকতালীয়ভাবেই আবিষ্কার করে ইশরাত, এই মেয়েগুলোর প্রতারকদের মধ্যে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাহিত্যিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও রয়েছেন।
এইটুকুই তো শহর। ছোট তার গণ্ডি। শিক্ষিতজনের গণ্ডি তারও ছোট। এর মধ্যে ডাক্তার, শিক্ষক, সাহিত্যিক—এজাতীয় লোকগুলোকে ট্রেস করা খুব একটা কঠিন হওয়ার কথা নয়।
০৩.
এই নিয়ে তৃতীয়বার ডাক্তার রিয়াদের কাছে এলো মহিমা। প্রথম দু’বার চিকিৎসা নিয়ে বেশ উপকার পেয়েছে। কদিন ধরে আবার একটু বুক ধড়ফড়ের সমস্যাটা দেখা যাচ্ছে। ভাবতে ভাবতে ডাক পড়লো মহিমার। ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই পরের রোগীটা একটু দেরি করে ঢোকানোর জন্য বলে দিলো পিয়নটাকে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত চেম্বারে বসেও ঘামতে লাগলো মহিমা। ডাক্তারটা একটু কেমন যেন! চোখের দিকে চাইতে কিছুটা অস্বস্তি হয়। তবে ভালো লাগে। চৈতী তো সেদিন ঠেশ মেরে ক্যাম্পাসের সবার সামনে বলেই ফেললো, তুই নির্ঘাৎ ডাক্তারের প্রেমে পড়েছিস। মহিমাও বোঝে তার দুর্বলতা। কিন্তু দায় কি তার একার? ডাক্তার রিয়াদ কি তাকে প্রেমে ফেলতে ফ্লার্ট করেনি? চেস্ট এক্সামিন করার নাম করে তার বুক অস্বাভাবিকভাবে ছুঁয়ে দেয়নি? অন্য রোগীদের চেয়ে তাকে অনেক বেশি সময় নিয়ে দেখে। দ্বিতীয়বার চেকআপের সময় রুমের অ্যাটেনডেন্টকেও বের করে দিয়েছিল। প্রথমে অস্বস্তি লাগলেও পরে আর লাগেনি। এত বড় একজন ডাক্তার, সে নিশ্চয় লম্পট হবে না।
—হ্যালো মিস, কেমন আছেন? পালপিটিশন কমেছে? মাথাব্যথা? দেখি, একটু শ্বাস নিন তো! কলের পুতুলের মতো ডাক্তারের নির্দেশ পালন করলো মহিমা। একটু অস্বস্তিকর হলেও ডাক্তারটা খুব ভালো। রোগীদের প্রতি যথেষ্ট আন্তরিক। আমি বলি কী, আপনি একজন বন্ধু তৈরি করুন। ডোন্ট টেক ইট আদারওয়াইজ। লাইফ ইজ সো টাফ অ্যান্ড ক্রিটিকাল। মেইক আ বয়ফ্রেন্ড, সো দ্যাট ইউ ক্যান ব্রিদ! মহিমার কান লাল হয়ে গেলো। তবে মনে মনে বোধহয় খুশিই হলো। সত্যিই তো, একজন পুরুষ বন্ধু দরকার ওর। ডিপ্রেসিভ ইলনেস থেকে মুক্তি পেতে এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে অনেক দিন ধরেই! কিন্তু এসব কি বলে-কয়ে হয়? এগুলো তো নিজে নিজে হওয়ার ব্যাপার। নীরব থেকেই যেন একমত প্রকাশ করলো ডাক্তার রিয়াদের সঙ্গে। মুহূর্তেই ওয়ালেট থেকে বের করে একটা কার্ড এগিয়ে দিলো মহিমার দিকে। সুন্দর করে আস্থাপূর্ণ একটা হাসি দিলো মহিমার চোখে চেয়ে। কোনো কথা না বলে হাত বাড়িয়ে কার্ডটা নিলো মহিমা।
নিশ্চিন্তে যোগাযোগ করতে পারবেন। গোপনীয়তা বজায় থাকবে, এ ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিচ্ছি। খসখস করে লিখে প্রেসক্রিপশনটা এগিয়ে দিলেন। শুনুন মিস মহিমা, পাস সাম গ্রেট, কোয়ালিটিফুল টাইম উইথ সামওয়ান ইউ ক্যান ট্রাস্ট। লেট মি সি ইউ আফটার আ উইক। স্টে ফাইন।
০৪.
—ওর মুখোশ আমি খুলেই ছাড়বো। বলতে বলতে সিগারেটের কেসটা রেহানের দিকে এগিয়ে দেয় রোদেলা। লেখালেখি করে বেশ নামডাক হয়েছে রেহানের। কথাসাহত্যিক রায়হান রেহান। ক্ষোভ ঝাড়তে ঝাড়তে রোদেলাও একটা সিগারেট ঠোঁটে পুরে নেয়। ফাক ইউ প্রফেসর ফরহাদ! আখেরে পস্তাতে হবে তোমাকে। একে একে তোমার রাধিকাদের সংখ্যা সবাইকে জানানো হবে। সবার আগে জানবে তোমার মেয়ে ডা. ইশরাত, বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। ক্রোধে ফেটে পড়ে রোদেলা। তোমার কন্যাকে দিয়েই তোমার চিকিৎসা করানো হবে। ইউ সন অব বিচ! পার্ভার্ট!
—শান্ত হও রোদেলা। হাত ছাড়িয়ে নিতে গেলে রোদেলার ঠোঁটদুটো জোর করে মুখে পুরে নেয় রেহান। সেকেন্ডের মধ্যে রোদেলা নির্ভার হয়ে লুটিয়ে পড়ে রেহানের বুকে।
—ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটে ওঠে রেহানের। আসলে লেখালেখির জন্য নিয়মিত নতুন নতুন প্রেম প্রয়োজন হয় কথাসাহিত্যিক রায়হান রেহানের। আর প্রেম বলতে ওর কাছে শরীর। শরীর আর প্রেমকে আলাদা করতে পারে না সে। ডা. রিয়াদ, ফরহাদ আর সে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধু। মাসে অন্তত এক-দু’বার তো বৈঠক হবেই তিন বন্ধুর। পারস্পরিক বোঝাপড়াটাও চমৎকার ওদের। নারীসঙ্গ ওদের তিনজনেরই প্যাশন। কায়দা করে একই নারীকে হাতবদল করে চলে আসছে বহুদিন। সংসার জীবনে ওরা প্রত্যেকেই আপাতদৃষ্টিতে সুখী এবং সফল কর্তা। সন্তানের বাবা।
মেয়ে আর মদ ছাড়া জীবনটা পানসে মনে হয়। নিত্যনতুন নারী ম্যানেজ করা তিনবন্ধুর মধ্যে রেহানের জন্য তুলনামূলক সুবিধাজনক। রেহানের সাহিত্যের পাঠক মূলত নারীরাই। এর প্রথম কারণ নারী-পুরুষের সম্পর্কের রসায়ন রেহানের লেখার মূল বিষয়। দ্বিতীয় কারণ, লেখক রায়হান রেহান বেশ সুদর্শন। রেহানের ফাঁদে পা দেওয়ার পর কয়েকদিনের সম্পর্ক শেষে মেয়েদের কায়দা করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ফরহাদ বা রিয়াদের কাছে। অনেকদিন ধরে চলে এলেও কখনো কোনো সমস্যা হয়নি। সম্প্রতি রোদেলার কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ে যায় ফরহাদ। এতেই কেঁচে যায় ব্যাপারটা।
মানুষ স্বভাবগতভাবে বহুগামী হলেও একইসঙ্গে একাধিক সম্পর্ক কেন যেন মেনে নিতে পারে না! আসলে এই লেভেলে শারীরিক সম্পর্কে একধরনের মানসিক সম্পৃক্ততাও থাকে। জীবনের এই পর্যায়ে যে সম্পর্কগুলো হয়, তাতে একধরনের নির্ভরশীলতা থাকে। অবিশ্বস্ততায় গড়ে ওঠা এই সম্পর্কে অলিখিতভাবেই বিশ্বস্ততা কামনা করে। কোনো কোনো সময় দুপক্ষই। কোনো সময় মেয়েটি, আবার কখনোবা ছেলেটি। তবে মেয়েদের দিক থেকেই প্রবণতাটি বেশি থাকে। একজন মেয়ে কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে গেলে একে বৈধ করতে বা অপরাধবোধের মাত্রা কমাতে নিজে বিশ্বস্ত থাকার চেষ্টা করে। একইভাবে অন্যদিক থেকেও তাই আশা করে। কিন্তু ছেলেদের মধ্যে এরকম চিন্তাটা তুলনামূলক কম। যেখানে শারীরিক ব্যাপারটাই মুখ্য। শারীরিক সম্পর্ক করতে হলে মানসিক সম্পর্ক থাকতেই হবে—এমনটা জরুরি নয় তাদের কাছে। অন্যদিকে নারীরা শারীরিক সম্পর্কের আগে মানসিক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী। এতে তারা স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপদ বোধ করে।
ফরহাদের ওপর ক্রোধে ফেটে পড়া রোদেলাকে বাগে আনতে একটু সময় লাগবে। যেকোনোভাবে ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে হবে। কান টানলে মাথা আসার মতো ফরহাদের সঙ্গে-সঙ্গে রিয়াদ আর রেহানের নামও চলে আসবে। এটা কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না।
ফ্লাশের মতো ঝলকে উঠলো গতকালের অ্যানালাইসিস করা সব হিস্ট্রিগুলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। অধ্যাপক ড. ফরহাদ আলম।
ব্যাপারটি হয়ে যাওয়ার পর, রোদেলাকে কাপড় পরতে সহযোগিতা করে রেহান। রোদেলা আজ একটু বেশিই তাড়াহুড়ো করে। রেহানের বাসায় ড্রপ দেওয়ার প্রস্তাবও নাকচ করে দেয়।
—শয়তানের বাচ্চাটার ফ্ল্যাটে যাবে আজ, এক্ষুনি!
০৫.
ডোরবেল বাজিয়ে খুব একটা অপেক্ষা করতে হয় না মহিমাকে। রিয়াদই দরজা খুলে দিলো। ওপরের বোতাম খোলা শাদা শার্ট আর আকাশনীল রঙের ট্রাউজারে অসামান্য সুন্দর দেখাচ্ছিল রিয়াদকে। মহিমা জানে, রিয়াদের মতো অতটা সুন্দর নয় সে। রিয়াদের আকুলতাই তাকে আজ এখানে আসতে বাধ্য করেছে। ড্রয়িংরুমে ঢুকে অস্বস্তি নিয়ে চারদিকে তাকাতে লাগলে অভয় দেয় রিয়াদ। এখানে শুধু তুমি আর আমি। আর কেউ নেই, ডিয়ার প্রিন্সেস, বলেই হাঁটু মুড়ে বসে আলতো করে চুমু খেলো হাতে। মহিমার ডান হাতটা ধরে বামহাতে মৃদু চাপ দিয়ে বললো, বিশ্বাস রাখো, কেউ আসবে না। রিল্যাক্স হয়ে বসো। আমি কফি নিয়ে আসছি। কিচেনে যাওয়ার সময়, সিডি প্লেয়ারে গান চালিয়ে দিয়ে গেল রিয়াদ। ‘ইউ ফিল আপ মাই সেন্সেস…, জন ডেনভার! ভালো লাগায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলো মহিমার মন।
নতুন শিকারটা রীতিমতো একটা মাল! কফিতে চিনি মেশাতে মেশাতে ভাবলো রিয়াদ। রেহান আর ফরহাদও খুব এনজয় করবে। তবে মেয়েটা একটু চাপা স্বভাবের। চঞ্চল স্বভাবের মেয়েদের পটানো কিছুটা সহজ। চাপা স্বভাবের মেয়েগুলো ভেতরে ভেতরে কী ভাবছে, অনেক সময় আন্দাজ করা ডিফিকাল্ট হয়। তবে স্বভাব যাই হোক, চেহারাও মোটামুটি হলে কী হবে, শারীরিক গঠন বেশ সুন্দর। একটু নাদুসনুদুস হলেও পারফেক্ট ফর এনজয়মেন্ট।
মহিমার একটু স্পেস প্রয়োজন ছিল। একটু নিশ্বাস নেওয়ার জায়গা। দরকার ছিল কিছুটা সময় সব কিছু ভুলে থাকার উপায়। কিছুটা ভিন্নতা, কিছুটা অগতানুগতিক। গত দুই দিন রেস্টুরেন্টে ডেট করে আজ রিয়াদের বাসায় এসেছে। রিয়াদের দিক থেকে প্রকাশটা বেশি থাকলেও মহিমারও কিন্তু ইচ্ছে হচ্ছিল অন্তরঙ্গ কিছু সময় কাটাতে। রিয়াদের আকর্ষণ যেন চুম্বকের মতো টানছে ওকে। মহিমা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো। প্রতিটি রুম খুব সুন্দর করে সাজানো। বেলকনিতে একটা দোলনা রয়েছে। বসে একটু দোলও খেয়ে নিলো মহিমা। গল্প করতে করতে কফি খেতে ভালো লাগছিল মহিমার। চমৎকার কথা বলতে পারে রিয়াদ। দুর্দান্ত গল্পবাজ।
চমকে দিয়ে অতর্কিতে মহিমাকে কোলে তুলে নেয় রিয়াদ। পরম সুখানুভূতিতে চোখ বোজে মহিমা। এমন একটি ক্ষণ আসতে পারে কখনো ভাবেনি মহিমা। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে চুমোয় চুমোয় মহিমাকে ভরিয়ে দেয় রিয়াদ। অস্ফুট কণ্ঠে রিয়াদের নাম ধরে ডাকে মহিমা। মুহূর্তেই যেন তলিয়ে যেতে থাকে অজানা নেশার আহবানে। শক্ত করে রিয়াদকে জড়িয়ে ধরে মহিমা। ফিসফিস করে কানেকানে বলে, আমাকে একটু সঙ্গ দিয়ো। কপট নয়, বিশ্বস্ত কিছু সঙ্গ। জড়ানো অবস্থাতেই মুখ কুচকালো রিয়াদ, ড্যাম ইট! আবার বিশ্বস্ততা!
০৬.
সাত নম্বর সিরিয়ালে ডাক পড়ল মৃত্তিকার। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে ভীষণ। মহিলা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে সবকিছু খুলে বলা স্বস্তিদায়ক হবে ভেবেই এখানে আসা। এই ডাক্তারের অনেক সুনাম শুনেছে। শুধু খসখস করে ওষুধ লিখে না দিয়ে তার কথা মন দিয়ে শুনবে এমন ডাক্তার খুঁজছিল। কিছুটা অপ্রস্তুতভাবেই ঢুকে পড়লো ডা. ইশরাতের চেম্বারে। হাসিমুখে ডাক্তারের অভিবাদনে অপ্রস্তুতভাব খানিকটা কমে এলো। হাতের ইশারায় ডা. ইশরাতের সামনের চেয়ারে বসে। কিভাবে শুরু করবে, তা নিয়ে দোটানায় ছিল মৃত্তিকা। ইশরাতই সহজ করে দিল ব্যাপারটা। নিজের বোকামিসহ, বারবার ট্র্যাপে পড়ে মানসিক বিপর্যস্ততার কথা বলে হালকা হয় কিছুটা। গত এক সপ্তাহ ধরে কিছুতে স্থির হতে পারছিল না। এখনো বিশ্বাস করতে পারছিল না যে, এতদিন শুধু ব্যবহৃতই হয়েছে ও। কোথাও কোনো ভালোবাসা ছিল না। বিন্দুমাত্র আস্থা ছিল না। শ্রদ্ধা ছিল না। সে নিজেও এতটা অন্ধ ছিল যে, মস্তিষ্কও কাজ করেনি ঠিকঠাক। কী করে এমনটা হতে পারে? মানুষ কী করে এতটা ভণ্ড, প্রতারক হতে পারে? কী করে এত নিখুঁত অভিনয় করতে পারে। নিজের ওপর ঘেন্না হচ্ছে। আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠেছে মন। শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে সবকিছু। এজন্যই মূলত এখানে আসা।
ওর প্রতিটি কথাই মন দিয়ে শুনলেন ডক্টর। যত্ন করে হিস্ট্রি লিখলেন। সহমর্মিতা দেখালেন। ভালো লাগলো মহিমার। আজকালকার ডাক্তাররা তো রোগীর কথাই শুনতে চান না। ইনি এর ব্যতিক্রম। অনেকক্ষণ কথা বললেন। তার চেয়েও বেশি সময় নিয়ে মৃত্তিকার প্রতিটি কথা শুনলেন। বহুদিন ঘুমাতে পারছে না, না দিনে, না রাতে! আজ হয়তো কিছুটা ঘুমাতে পারবে।
ডা. ইশরাত বামপাশে ঘুরে ডেস্কটপে ডেটা এন্ট্রি করতে ঘোরামাত্র অস্ফুটে চিৎকার করে ওঠে মহিমা! ওটা কার ছবি? ওর ছবি এখানে কেন? কী হয় ও আপনার? ডেস্কটপের পাশে রাখা ফটোফ্রেমটার দিকে তাকালো ইশরাত। বাবা, মা, ইশরাত আর ওর ভাই আদিল। তাজমহলের সামনে তোলা ওদের ফ্যামিলি ফটো।
ফ্লাশের মতো ঝলকে উঠলো গতকালের অ্যানালাইসিস করা সব হিস্ট্রিগুলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। অধ্যাপক ড. ফরহাদ আলম।
বাবা…
অধ্যাপক…
লম্পট…
শব্দগুলো মাথার ভেতর তীব্র গতিতে ঘুরতে লাগলো।