ডজন ডজন চিন্তা মাথায় নিয়ে বাসে চড়েছে আলি রিয়াজ। তার চিন্তার ধরন একটু আলাদা। পেটে ভাত না থাকায় নয়, পত্রিকাটি প্রকাশ করতে পারবে কি-না, এ নিয়েই চিন্তার উদ্রেক। শরীর-মন ক্লান্ত হয়ে এসেছে। আর ভাবতে পারে না। বইমেলার মাসখানেক বাকি, এখনো তেমন বিজ্ঞাপন পায়নি। আর দুই-একটি যা পেয়েছে, তা পত্রিকা প্রকাশের পর পেইড করবে বলে প্রতিষ্ঠানের ওপরওয়ালারা জানিয়েছেন। ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে যেখানেই সিট পেয়েছে সেখানেই বসেছে। বসে ভাবছে। ভাবনায় হঠাৎ বাধা আসে এক স্লোগানে। স্লোগানটি এক হকারের, সে বই বিক্রি করছে আর টাকা ওঠাচ্ছে। এটিও এক ধরনের বিজ্ঞাপন। রিয়াজ দেখছে সেও তার মতো অন্যের দ্বারে ধরনা দিচ্ছে। বিজ্ঞাপন ছাপাবে আর টাকা পাবে, একেবারে যে সহজেই পেয়ে যাবে তা নয়, একটু ঘোরাবে আরেকটু বসিয়ে রাখবে, দেখাবে তার বিজ্ঞাপনের রকমারি ঝলক। হকারও তেমন অবস্থায় আছে। সে গলা ফাটিয়ে বয়ান দিচ্ছে, কারও কানে যাচ্ছে, কেউ হ্যালা করে শুনছে না, কেউ মজা নিচ্ছে, কেউ আবার কিনছে। সে তাদের দিকে তাকাচ্ছে না। সোজা বাসের শেষ মাথায় তাকিয়ে আছে। তাকিয়ে তাকিয়ে তার কথা, তার বিজ্ঞাপনের ভাষা জাহির করেই চলছে। আড়চোখে তাকাচ্ছে কেউ নড়ছে-চড়ছে কি-না মানিব্যাগ বের করার জন্য। সে বলেই যাচ্ছে ‘বইটাতে জমি-জমার রেকর্ড সম্পর্কে জানতে পাবেন। জমিনের মায়া দলিল, জমিনের নকশা সম্পর্কে জানতে পাবেন, সরকারি খাস জমির দখল সম্পর্কে জানতে পাবেন, জমিনের মামলা সম্পর্কে জানতে পাবেন, কত টাকার জমিনে কত টাকার ফি লাগে জানতে পাবেন, কত টাকার জমিতে কত টাকার স্ট্যাম্প লাগে জানতে পাবেন। বইটা দেখতে চাইলে দেখতে পারেন, নিতে চাইলে নিতে পারেন। দেখার অধিকার প্রত্যেকেরই আছে। বলতে পারেন ছোট ভাই বইটার দাম কত এবং কোথায় গেলে পাব? যেকোনো লাইব্রেরিতে গেলে পাবেন, দাম নিবে একশ পঞ্চাশ টাকা। আমার কাছে নিলে একশ পঞ্চাশ টাকা দিতে হবে না, মাত্র পঞ্চাশ টাকা, পঞ্চাশ টাকা করে পাচ্ছেন। বসে বসে বই পড়ে সময়টাকে মূল্যবান করেন। বই পড়লে হয় জ্ঞানী। এই বইটাতে শেখার আছে, বোঝার আছে। এ রকম ভালো কাগজ, ভালো লেখা, ভালো ছাপা, নির্ভুল একটা বই লেমেনেটিং করা কভার, একশ ষাট পেজের একটা বই আপনে নেন। দেখতে চাইলে দেখতে পারেন, পছন্দ হইলে নিতে চাইলে নিতে পারেন। এদিকে আর কে নিবেন? আছেন কেউ, দরকার পড়লে নিতে পারেন। এদিকে আর কেউ আছেন? নিবেন? এদিকে কারও দরকার পড়লে চেয়ে নিয়েন।
এই বিজ্ঞাপন কাজ প্রচারের জন্য সে সহজ অনুমতি পায়নি, হেল্পারের সঙ্গে বোঝাপড়া করেই চড়তে হয়েছে বাসে। মাঝে মাঝে ঝাড়ি খেতে হয় যাত্রীদের। সে নেমে গেলে আরেকজন আসে, সেও নিজের বিজ্ঞাপন কাজ চালানোতে ব্যস্ত। বই নয়, ম্যানিব্যাগ বিক্রির কাজে এসেছে। বলছে একটা মানিব্যাগ আছে পঞ্চাশ টাকা দাম, একটা মানিব্যাগ আছে একশ টাকা দাম। একটা চামড়ার পার্স আছে দুইশ টাকা দাম। ভাই আপনাদের একটা কথা জানাতে চাই গাবতলীতে সাতশ পঞ্চাশ কইরা কিছু ব্যাগ আছে অটবিতে বিক্রি হইছে একশ পঞ্চাশ টাকা, ভাই আপনাদের একটা কথা জানাইলাম। মামা ন্যান, জিনিসটা মোটা, ওটার জন্য সমস্যা না, ন্যান মামা। মামা আপনারা কিছু কিনবেন মামা? আপনারা যদি ম্যামো দেখতে চান, ম্যামো আছে। একশ টাকার ব্যাগ কোনটা জানেন, যেটা হাতে লইলে আমার হাত-পা জ্বলে। গাড়িটা শাহবাগের ওপর দিয়া আইছে, মাইন কইরেন না। শাহবাগে এমন অনেক পাপী আছে যারা ব্যাগ ব্যাচে। ওদের ব্যাগের সাথে আমার ব্যাগ বনবে না। আমার ব্যাগ সব খানদানি ব্যাগ। মামা কিছু লাগবে?
যে যার মতো করে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে ব্যস্ত। লক্ষ্য একটিই কিভাবে মাল বিক্রি করা যায়। এবার ওষুধ বিক্রি করতে আসে একজন। আপনাদের দাঁতে যত ব্যথা আছে, দাঁতের গোড়ায় যত ব্যথা আছে এই ওষুধটা লাগাবেন, এক মিনিটের মধ্যে আপনার দাঁতের ব্যথাকে কারেন্টের মতো দূর করিয়া দেবে। দাঁতে যত রকমের দাগ, লাল-কালো-হলুদ, পান খাইতে খাইতে ময়লা ধরাইয়া ফেলাইছেন, মাজন দিয়া সকাল বিকাল দাঁত মাজিবেন, আর ওষুধটা ব্যবহার করবেন। দাঁত নষ্ট হয়ে গেছে, কেউ বলেন ক্যালসিয়ামের অভাব। ঠাণ্ডা পানি মুখে দিতে পারেন না, কোনো কিছু খেতে পারেন না, আবার মিষ্টি জাতীয় কোনো খাবার খেলে আপনার দাঁতের গোড়ায় শিরশির করে, আবার দাঁত ঘড়ির কাটার মতো টিকটিক করে, দাঁতের গোড়া থেকে রক্ত পড়ে, পুঁজ পড়ে, মুখ থেকে দুর্গন্ধ বের হয়। দোকান, ফার্মেসিতে এই ওষুধটা আপনি পাবেন মাত্র চব্বিশ টাকায়, আমাকে চব্বিশ টাকা দিতে হবে না, মাত্র বিশ টাকায় ওষুধগুলো পাচ্ছেন। এটি আপনি ব্যবহার করেন, পাশাপাশি আপনার ছেলেমেয়ে, বাবা, মা ব্যবহার করতে পাবেন। বাসায় নিয়া রাইখা দিয়েন দুই বছরে নষ্ট হবে না। হাতে নিয়া দেখতে চাইলে আপনারা দেখতে পারেন, কোনো সমস্যা নাই। যাদের দাঁতে স্পট আছে, পাথর আছে, যাদের দাঁতের গোড়ায় ব্যথা আছে, দুর্গন্ধ হয় জন্ম থেকে, তারা চার-পাঁচ ফোঁটা দাঁতের গোড়ায় দিবেন। যারা সারাদিন পান খান, অতিরিক্ত পান খান, তারা রাতে ঘুমানোর আগে একবার ব্রাশ করবেন দাঁতে কোনো স্পট থাকবে না। দেইখা যান, পরে প্রয়োজন অনুযায়ী ফার্মেসি থাইকা কিইনা নিয়েন। বাংলাদেশের ফার্মেসিগুলোতে এই ওষুধ পাওয়া যায়।
আরেকজন এসেছে কাশি, ঠাণ্ডা, সর্দি, গলাব্যথার ওষুধ নিয়ে। সে দুই টাকার বিনিময়ে বিক্রি করছে ওষুধ। তিনটা পাঁচ টাকা, ছয়টা দশ টাকায় দিচ্ছে। অথচ ফার্মিসিতেও এমন সস্তা দামে বিক্রি হয় না। জবান খরচ করছে, আবার সস্তায় ছাড়ছে ওষুধ, কতই বা লাভ হয় তাদের? সংসার চলে এভাবে? রিয়াজ নিজের ভেতরে ভাবনাকে খেলায়। সিদ্ধান্ত পেতে না পেতেই আরেকজন এসেছে ম্যাজিক বল বিক্রি করতে, তার বিক্রিতে রয়েছে ডিজিটাল পদ্ধতির ব্যবহার। যাত্রীমহোদয় আসসালামু আলাইকুম, চলন্ত পথে চলছেন, আল্লাহর নাম স্মরণ রাখবেন। আপনাদের আসা যাওয়ার মাঝে আমার কাছে পাচ্ছেন ছোট্ট একটি ম্যাজিক বল। যাদের কাছে টাকা নাই, তাদের কোনো চিন্তা নাই। সরকার করেছে ডিজিটাল বাংলাদেশ, আমার করতে কী? দুইটা বাকি নিবেন তিনদিন পর টাকা দিবেন। পানিতে ভিজালেই বড় হবে। বাকি পাচ্ছেন বলেই বেশি করে নিবেন সেটা হওয়ার নয়, সর্বোচ্চ দশ টাকা পাবেন। বাকি নিবেন জোড়া দশ, আর নগদ নিবেন তিনটা দশ, পানি দিলেই বড় হবে। অন্য কোথাও কিনবেন একশ পঞ্চাশ টাকা নিবে। এখানে পাচ্ছেন মাত্র দশ টাকায়, অনেকেই ভাবছেন বাকি নিবেন টাকা ক্যামনে দিবেন? না পাবেন আমারে খুঁইজা, না পাইবো আপনারে খুঁইজা। আপনে খুঁজতে গেলে লাগব চারশ থেকে পাঁচশ টাকা, আমি খুঁজতে গেলে লাগবো সাড়ে তিনশ টাকা। এত ঝামেলার দরকার নাই, আমার মোবাইল নাম্বার নেবেন, ফ্লেক্সি করে পাঠিয়ে দিবেন। আমার সুবিধা, আপনারও সুবিধা। আজকে নিচ্ছেন তিনদিন পর টাকা দিবেন। বাকি নিবেন এমন কেউ আছেন? বাচ্চাদের খেলনা, পানি দিলেই বড় হয়। পপকন, এই ভাজা পপকন চিপস, পপকন চিপস ভাজা, এই ভাজা লন পপকন চিপস, এই ভাজা টাটকা ভাজা। পরিষ্কার বাদামটা খায়া দেখেন, বাছাই করা বাদামটা খায়া দেখেন। রাজশাহীর পাকা লিচু, মুখে পুড়ে রস নিবেন, দাম মাত্র আটানা। চকলেট লন দাম মাত্র আটানা। কোম্পানির প্রচারের জন্য এই দাম করা হইছে। আপনারা বাসা-বাড়ি যাচ্ছেন বিশ টাকা প্যাকেট নিয়ে যাবেন। পেপার লইবেন পেপার, কালের কণ্ঠ, প্রথম আলো, সমকাল, বাংলাদেশ প্রতিদিন…, লইবেন পেপার।
তাদের কথা শুনতে শুনতে ঘুম ঘুম ভাব একটু কাটতেই রিয়াজ দেখতে পায় বাস ফার্মগেটে থেমেছে। এই জ্যামটা একটু দীর্ঘ হয়। যাত্রীরা বিরক্ত হয়ে কি যেন বলছে। আরও জোরে হেইয়ো, জোরছে বলো হেইয়ো, জোর হলো না হেইয়ো। রিয়াজ দেখতে পায় লম্বা জ্যামে বাসে থাকতে থাকতে যাত্রীদের হাত-পা অবশ হয়ে কর্মহীন অবস্থায় চলে গেলে যাত্রীদের একদল নিজেদের সক্রিয় রাখতে বাসের পেছনে গিয়ে ধাক্কাতে থাকে, মুখে থাকে সেই স্লোগান। জ্যামে কেন গাড়ির চাকা ঘুরবে না? এ তারা আর মানতে পারে না। সেই ‘না চলা’ চাকাকে চালাতেই এমন উদ্যোগ নেয় ও কর্মঠ দল।
আরেক দল একটু ভিন্ন কিসিমের চিন্তা করে, তাদের চিন্তাটি হলো বাস ধাক্কা দিয়ে নয়, বাসের পাছায় এমন লাত্থি দেবে সেই লাত্থিতে এ বাস যেমন চলবে, সেই গতি গিয়ে লাগবে আরেক বাসে, ও বাস থেকে সামনের বাসে, এভাবে চলতে থাকবে অন্যান্য বাসও, ফলে জ্যামও কাটবে।
তবে ওপরের দুই দলের মানুষের থেকে একটু আলাদা ভাবনা করার চেষ্টা করে তৃতীয় দলটি, ভাবনার চাকা ঘোরাতে থাকে গাড়ির চাকা না ঘুরলেও। ঘূর্ণায়মান ভাবনায় ভাসে অনেক চিত্র, তবে কোনোটারই রূপ দিতে পারে না, এর মাঝে ভাবনাকে মাথায় নিয়ে এদিক ওদিকের পরিস্থিতিকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। দেখা মেলে ট্র্যাফিক পুলিশের। দৌড়ে গিয়ে তারা সেই পুলিশের পাছায় কষে লাত্থি বসাতে বসাতে তাকে রাস্তার মাঝে দাঁড় করায়। এতে যে লাভ হয় তা হলো: ফার্মগেটের দক্ষিণ দিক থেকে আসা প্রাইভেটকারগুলোর চাকা থেমে যায়, আর রাস্তা ফাঁকা হলে জ্যামে আটকে থাকা পাবলিক বাসগুলো চলতে থাকে।
বাস চলতে থাকলেও পিচ্চি নাবিলার বাসে বসে জ্যাম দেখার দৃশ্যটির রেশ রয়েই যায়। সে যেভাবে জ্যামকে ভক্ষণ করছিল তাতে শিল্প ছিল, শিল্পটি হলো দুই কাচের দুই সাইডে হাত দিয়ে মাঝখানের ফাঁক দিয়ে ছোট্ট মাথাটি বাড়িয়ে দিয়ে জ্যামকে গিলছিল, তা দেখে রিয়াজের মনে হলো সে যেন আজব দুনিয়ার রঙিন কীর্তিকাণ্ড জন্মের পর এই প্রথম দেখার সুযোগ পায়, তাই তা হাতছাড়া না করে লুফে নিচ্ছে।
রিয়াজ বুঝতে পারে জ্যাম নাবিলার জন্য মজার হলেও দীপ্তির জন্য তা অশুভকর। দীপ্তি বাসে বসে ‘কোঁকাতে’ থাকে, তবে এই ‘কোঁকানি’ পুরুষের যৌন আদর পাওয়ার সময়কার নয়, এ জ্যাম আর গরমের মিশ্রিত ফলের উৎসজাত। জ্যাম ও গরমে চরম মাথা ব্যথায় সে ‘কোঁকাচ্ছে’। কালো পোশাকে গরম বেশি এ আমাদের সবারই জানা। কিন্তু তার অজানা কি-না সে বিষয়টি স্পষ্ট নয়, কারণ তার সঙ্গে রিয়াজের কথা বলার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। আপসা-আপসা যদি বলা যায় তাতে বলতে হয়, এখানে তার অজ্ঞতা রয়েছে, তা অবশ্য আরোপিতও হতে পারে। বিষয়টি হলো তার পুরা শরীর কালো কাপড়ে মোড়ানো, পায়ে এবং হাতে কালো মোজা, কেবল ছোট্ট ছোট্ট চোখ দুটি খোলা রয়েছে। সে এমন পরিস্থিতিকে না সামলাতে পেরে কোঁকাতে থাকে।
অবশ্য রিয়াজের একটি উপকার হয়, সে উপকারটি হলো এমন অবস্থার থেকে কিছুটা স্বস্তি পাওয়ার পর অথবা না পাওয়ার পর তার পেছনের ছিটে বসে থাকা দীপ্তি নিজের অজান্তেই রিয়াজের চুল সিটের সঙ্গে হাতের আঙুলে চেপে ধরে। রিয়াজ হাতের আঙুলে আটকে থাকা চুলটি সরাতে সরাতে যে সময়টুকু পায় তাতে সে রোমাঞ্চিত হয়, যার পূর্ণতা আসে দীপ্তির বাস থেকে নামার সময় দুজনের চোখাচোখিতে।
বাস শাহবাগ হয়ে মতিঝিলের পথে, আলি রিয়াজ বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের কাছে নামে। যায় বিজ্ঞাপন অফিসে। তাদের সঙ্গে কথা বলে, বিজ্ঞাপন দেবে, দেবে না এমন ভাব দেখায়। যায় আরেক প্রতিষ্ঠানে, সেখানে চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করবে। অপেক্ষা চলছে। সময় যায় কিন্তু তার দেখা মেলে না। যদিও একবার এদিকে আসে, তবু বলে লাঞ্চ করবেন এখন, দেখা করা যাবে না। একজন ব্রাহ্মণের জন্য কয়েক শ শূদ্রের অপেক্ষা। ব্রাহ্মণের ক্ষুধা লাগে কিন্তু তাদের ক্ষুধা লাগে না। তাদের লাঞ্চের দরকার নেই। তারা কেবল অপেক্ষা করবে। বিরক্তি লাগলে সর্বোচ্চ পায়চারী করবে, এর বেশি কিছু করার অনুমতি নেই। অপেক্ষা চলে, চলতে চলতে এক ঝলক তিনি দেখা দিলেন, সবাই গেলেন তার কাছে তিরিশ সেকেন্ড করে সময় নিয়ে একেকজন তাদের আরজি পেশ করতে থাকেন। কী পেশ করল? আর কী পাবে? সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো বলেছে সবাই তাদের কথা, যা বলার জন্য তাদের এত অপেক্ষা, তার শেষ হলো, এটাই আপাতত শান্তি। সেই শান্তি আরও দীর্ঘায়িত হবে যদি সেই টাকা পায়। না পেলে করার কিছুই থাকবে না, থাকবে একটু কষ্ট, এটাও কম কিসে? এত অপেক্ষার পর এটুকু অর্জন ফেলে দেওয়ার নয়।
আলি রিয়াজ এবার হোটেলে ঢোকে, ক্ষুধা পেটে নিয়ে আর কতক্ষণই বা থাকা যায়? পকেটে টাকা নেই, কিন্তু খেতে তো হবে। খোঁজে সবচেয়ে সস্তা মেনু কী আছে। সস্তা বলতে কেবল তেহেরিই রয়েছে। খেতে থাকে আর ভাবে। ভাবনা চলে যায় এক লেখকের কাছে, আপন ভেবে যার লেখা সে এডিট করেছিল। যতটা আপন ভেবে এডিট করেছে, পরিণামটা তত আপন ছিল না। এজন্য তাকে খেতে হয়েছে কঠিন ঝাড়ি, লিখতে হয়েছে এক প্রেমপত্র, ঠিক প্রেম না, মান ভাঙানোর পত্র :
জনাব,
স্যরি বলেই শুরু করছি। আপনার লেখা এডিট, আবার না জানানোর অপরাধটুকু আমার ঘাড়েই নিচ্ছি। গত দুই-তিন দিন আপনার সঙ্গে দেখা হয়নি, দেখা হলে বিষয়টি জানাতাম; ইচ্ছে ছিল। যেদিন লেখাটি আপনাকে লিখে দেই, তারপর থেকেই প্রেসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি, বিজ্ঞাপন জোগাড়ের চেষ্টায় ঢাকাতে ছুটতে ছুটতে সবই ভুলে গেছি। মন ভালো নেই। আপনি একটু মার্জনা করেন, আর এমন হবে না কক্খনো। আপনার লেখাটি ভালো হয়েছে; যদি লেখাটি না দেন তাহলে পত্রিকাটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে; সঙ্গে পাঠকও ভুগবে। এই অপরাধটুকু কি ক্ষমারযোগ্য করে লেখাটি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত বদল করা যায় না? প্লিজ, এত বেশি কঠোর হবেন না। আপনার প্রতি অনেক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আছে বলেই আপনার কাছে লেখা চেয়েছি। ভালো থাকবেন।
আলি রিয়াজ
সে খাওয়া শেষ করে ভাবে, এখন সে কোথায় যাবে? তার বাসায় ঢোকা একপ্রকারের নিষিদ্ধ। একটি গল্প লিখেছিল সেখানে পরিপার্শ্বকে খুঁচিয়েছে, সেজন্য সে জায়গায় যাওয়া অসুবিধে। গল্প লিখবে আবার নিষিদ্ধও থাকতে হবে? দেশকে, ব্যক্তিকে আনবে, তাদের ঠিকঠাক করার পরামর্শ দেবে, তাদের নোংরামি তুলে ধরবে, সেজন্য কি তাকে এমন শাস্তি পেতে হবে? ভেতরের সত্তা আনবে, দেখাবে তাদের ভণ্ডামি, সেজন্য তার এই কষ্টের দিন কাটাতে হবে? মনে মনেই লিখে ফেলে :
তোমার বিকারগ্রস্ততা তাড়িত করে সুস্থতাকে,
তোমার অনুৎপাদনশীলতা স্তব্ধ করে দেয় সৃষ্টিশীলতাকে,
তোমার অসত্যের খোলস উন্মোচনে চিরসত্যকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে বলে,
তোমার ভেতরকে টেনে এনে বাইরের কাঁচি দিয়ে কেটেছে বলে,
পুড়িয়েছে চেতনার শিখায় তোমার অবচেতনকে-সেজন্য,
আগাগোড়া এক শয়তানকে শুদ্ধ করতে চেয়েছে বলেই
তোমার পাগলামি ছড়াচ্ছো, আঁতলামিকে করেছ মূল সেনাপতি
তাড়িত করছো তার স্বপ্নকে,
তোমার দুঃস্বপ্নকে গেঁথে দিচ্ছো চরাচরের সমস্ত জীবের মাঝে
হিসেবের মাপকাঠি তো অনেক প্রসারিত করা শিখেছ?
নিজেকে কখনো সেই হিসেবের ধারায় ফেলে দেখেছো তার সের কত? তার পোয়া কত?
সেই সাহস তোমার নেই, আছে কেবল কিছু গোয়ার্তুমি!
খাওয়া শেষ হলে বিল নেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছে ওয়েটার, খাওয়ার বিল দেয়, কিন্তু সে সরে না। কারণ সে আরও কিছু চায়, কিছু টাকা চায়। যে টাকা সে খায়নি, সে পরিমাণ টাকা এখন দিতে হবে তাকে। ঢংয়ে বাঁচে না। এদিকে পেট চলে না, আর ওদিকে তারা আছে বাড়তি রং-এ। টাকা দাও, টাকা দাও, বকশিস দাও। ব্যাটারা তোরা মূল বেতন পাছ, আবার খাড়োয়াও থাহস। মনে মনেই এমন গজগজ করে হোটেল ছাড়ে আলি রিয়াজ।
সে মতিঝিল থেকে আবার বাসে চড়ে। বাস এগোতে থাকে। শাহবাগ, নিউমার্কেট, সায়েন্সল্যাব ছেড়ে শ্যামলির পথে, আবার সে দেখতে পায় তার মতো কিছু অভাগা বাসে উঠেছে। তারা তাদের প্রচার কাজ চালাচ্ছে। সে ঝিম মেরে কেবল শুনতে থাকে কিছু না বলে। তারা ছাড়ছে তাদের কাজের ভাষা। চাইছে সাহায্য, ভাইজান, আমার ছেলেটার চোখটা অপারেশন করার জন্য ভাইয়া, ভাইয়া আপনারা চলন্ত অবস্থায় দয়া করে যে যা পারেন আমার ছেলের চোখটা অপারেশনের জন্য আমারে কিছু সাহায্য করে যান ভাইয়া। আছেন কোনো ভাইয়া আমার ছেলের চোখটা অপারেশন করার জন্য, দয়া করে কিছু সাহায্য করেন ভাইয়া, আছেন কোনো ভাইয়া আমার ছেলের অপারেশন করার জন্য…। ভাইজান দেখেন আমি একটা প্রতিবন্ধী। ভাইজান, আমার চোখ নাই, পা নাই, আমাকে সাহায্য করেন। ভাইজান আর কেউ আছেন? ভাইজান দেখছেন আমার দুইটা চক্ষু নাই, এই চক্ষু বিনে দুনিয়াটা অন্ধকার। অন্ধকার কবরের সমান। দুনিয়াটা দেখার কোনো সুযোগ নাই ভাই, দেখেন আমার কোনো কাজ করার শক্তি নাই। আপনারা যে যা পারেন অন্ধ মানুষটারে সাহায্য করে যান। বিসমিল্লা হিররাহমানির রাহিম, আলহামদুল্লিাহ্ আল্লাহ্ তোমার বান্দারা তোমার অন্ধরে দান করে যায়। আল্লাহ্ তোমার বান্দার দান কবুল করে নিয়ো। পবিত্র নামাজের আগে যে যা পারেন টাকা দিয়ে একটা ইটের শরিক হয়ে যান। আলহামদুলিল্লাহ্, আছেন আল্লাহর বান্দা আপনার সম্মুখে থানাস্ট্যান্ড। আনন্দপুর মসজিদের কাজ চলতাছে আপনাদের পয়সা দিয়া। খুশি মনে সহি নিয়তে মসজিদের জন্য পয়সা দান করে যান। নেকি আল্লাহ্পাক আপনাদের আমলনামায় তুলে দিবেন। পবিত্র ঘরে নামাজের আগে কিছু দান করে যান। আলহামদুলিল্লাহ্ মাবুদ গো তোমার এই বান্দার জিন্দেগির গুণাহ্গুলো মাফ করে দিও! দীর্ঘদিনের হায়াত দান করে দিও! মাবুদ গো অনেকের বাবা নাই, যারা অন্ধকার কবরে শুয়ে আছে তাদের কবরের আজাব মাফ করে দিও!
গন্তব্যে এসে গেলে আলি রিয়াজ বাস থেকে নামে। পথ চলতে থাকে। রিকশা নেওয়া দরকার, পকেটে টাকা নেই, তাই হেঁটেই চলছে। হাঁটছে আর ভাবনা দোলা দিচ্ছে। ভাবে সে হয়তো পত্রিকা বের করতে পারবে এ বছর ধরাধরি করে, বিজ্ঞাপন নিয়ে, সামনের বছর এভাবেই ছুটতে হবে। হয়তো বিজ্ঞাপন পাবে অথবা পাবে না। পত্রিকার বের হবে, বা হবে না। তাদের জীবনও কি চলবে এমনি করেই?