পর্ব-॥৫॥
সোমা নিজে হাতে কাফির জন্য বিভিন্ন ধরনের খাবার রান্না করে। এত বড় বাসায় আজ রাতে শুধু তারা দুজনেই। এ রকম রাত তাদের জীবনে কখনোই আসেনি। আবু নাসেরের ঢাকায় যাওয়াতে সোমা মনে মনে খুশিই হয়। কাফির সঙ্গে নিজের মতো করে একটু সময় কাটাতে পারা—এ তো তার কতদিনের স্বপ্ন। তা যে বাস্তবে আসবে তা ভুল করেও ভাবেনি। আর কাফিও এত বছর পরে আবার ফিরে আসবে, তাও তার ভাবনায় ছিল না। সোমা অবশ্য নিজেও জানে না কাফির পছন্দের খাবার কী। কয়েকবার তার কাছে জানতে চেয়েও কোনো সদুত্তর মেলেনি। সে কারণেই সে তার নিজের মতো করেই শিং মাছ ঝোল ঝোল করে, সর্ষে ইলিশ, পাবদা ফ্রাই করে। মুরগি আর খাসির মাংস রান্না করে। সঙ্গে মিষ্টান্ন।
রান্না করার সময় কয়েকবার কাফিকে ডেকেছেও সোমা। কাফি গিয়ে একটু থেকেই আবার ফিরে এসে রুমে বসে টিভি দেখতে থাকে। এত রান্না দেখে বিরক্তই হয় কাফি। সোমা তাতে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে দীর্ঘসময় ধরে রান্না করে। কাফি একবার বলেই ফেললো, রান্নাবান্নার ভাব দেখে মনে হচ্ছে বাসায় নতুন জামাই এসেছে !
সোমা ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি টেনে বললো, তা তো এসেছেই। না এলে এত রান্নাবান্না কার জন্যে! জামাই যদি নিজেই নিজের কদর না বোঝে—তাতে আর কার ক্ষতি!
কাফি যে ব্যাপারটা বুঝলো না, তা নয়। সে আর উত্তর না করে টেলিভিশন দেখার দিকেই মনোযোগ দেয়।
খাবার টেবিলে যখন কাফির ডাক পড়লো, এসেই তো তার চোখ চড়কগাছের মতো বড় হয়ে গেলো। বললো, এসব কেন করেছ? এত কষ্ট করার কোনো মানে আছে?
আছে। বসে ভালো ছেলের মতো খেতে শুরু করো। এ কয়দিন তো আমি ওভাবে তুলে খাওয়াতে পারিনি। রান্নাও করিনি। বুয়া যা করে তাই।
কাফিকে খাবার তুলে দিতে দিতে সোমা আবার বললো, নাসেরের সামনে এসব করলে ওর মাথায় আগুন ধরে যাবে। ও কে যে একটা কিছু বুঝিয়ে তোমাকে এখানে রাখতে পারছি, এটাই অনেক কিছু।
এসবের দরকার কি ছিল! মন চাইলো। এলাম। দেখা হলো। বেশ তো। এখন গেলেই তো হলো। উটকো কোনো ঝামেলা আর থাকে না। আমি যতদিন থাকবো, এ নিয়ে তোমার টেনশন থাকবেই। দরকার কী! আমি তাড়াতাড়িই চলে যাবো।
কত সহজ করে কথাগুলো বলে ফেলো তুমি! পুরুষ মানুষ সব পারে। মন নিতেও পারে, ভাঙতেও পারে। এরা যে কখন কাকে মন দেয়, আর কখন কার কাছ থেকে যে মন উঠায়ে নেয়, নিজেরাও মনে হয় জানে না।
তাই বুঝি!
তাই-ই তো মনে হয়। তুলিকে মনে পড়ছে খুব?
না তো।
তাহলে কার জন্য মন পুড়ছে?
কারও জন্যেই নয়।
তাহলে চলে যাওয়া যাওয়া করছ কেন? আমার কাছে থাকতে ইচ্ছে করে না? আমাকে দেখে মন ভরে না? দেখো, নাসের আজ বাসায় নেই। বাসায় শুধু তুমি আর আমি। ভাবতে পারো এমন একটা রাত কতকালের স্বপ্ন আমার! তোমাকে নিজে হাতে হাতে তুলে মন ভরে খাওয়াবো। গল্প করবো। কতকিছুর ইচ্ছে ফড়িংয়ের মতো আমার মনের ভেতর উড়ছে। অথচ তোমাকে কেমন যেন শুকনো মাঠের মতো খসখসে লাগছে।
কাফি তেমন কোনো উত্তর না দিয়ে খাবার খেয়ে সোফায় এসে বসে। কিছুক্ষণ পরে সোমা এসে বললো, কফি খাবে?
কাফি ইচ্ছে প্রকাশ করলো।
সোমার কফি আনতে বেশ খানিকটা দেরি দেখে কাফি ভাবলো, আমার কোনো কথায় বোধহয় সে মন খারাপ করেছে। কিছু একটা ভেবে সোমার রুমে যাবার কথা ভাবে। আবার ভাবে যাওয়াটা কি ঠিক হবে! কী মনে করবে! সাত-পাঁচ চিন্তা তার মাথায় ঝড়োনদীর এলোমেলো ঢেউয়ের মতো হতে থাকে। তারপরও রুমের কাছে যায় সে। রুমটা বন্ধ। ভাবলো, কফি দেওয়ার কথা বলে রুমে গিয়ে কি ঘুমিয়ে পড়লো! পড়তেই পারে সারাদিনে শরীরে দখলটা কম যায়নি। লালনের মাজারে গিয়ে অত ঘুরাঘুরি! বাসায় ফিরে শখ করে নিজের হাতে এতকিছু রান্নাবান্না! বড়লোকের বউয়ের সুখের শরীরে এতটা কি সয়! নাসের সাহেব যে যত্নআত্তি করে রাখে, তাকে পানিটা পর্যন্ত ভরে খেতে হয় না। মেয়েমানুষ সুন্দরী হলে আর কোনো গুণের দরকার পড়ে না, এমনিই কদর পায়। এসব মুহূর্তে তার ভাবনায় মাকড়সার জালের মতো জড়িয়ে যায়। নীরবে আবার সোফায় এসে বসে টিভি দেখতে থাকে। জি বাংলায় নোবেলের গান শেষ হতেই উঠে নিজের রুমে গিয়ে বিছানায় শরীরটা ছেড়ে দেয়।
সোমা গোসল করে হালকা নীল রঙের শাড়ি পরে পরিপাটি হয়ে কফি নিয়ে ড্রয়িং রুমে এসে দেখে, কাফি নেই। টিভি চলছেই। সোমা টিভি বন্ধ করে কাফির রুমে যায়।
কী ব্যাপার রুমে চলে এসেছ যে ! অবশ্য আমার একটু দেরি হয়ে গেছে। ফ্রেশ হতে গিয়েই দেরি হলো।
কাফি কিছু না বলে সোমার দিকে পলকহীনভাবে তাকিয়ে থাকে।
সোমা একটু বিব্রত হওয়ার মতো করে বলে, এভাবে তাকিয়ে কী দেখো? মনে হচ্ছে আগে দেখোনি কোনোদিন?
এভাবে আগে সত্যি কোনোদিন দেখিনি। তুমি এত সুন্দর! খুব সুন্দর—চোখ উপচানো সুন্দর। যেন এক অপ্সরী!
হয়েছে! আর বলতে হবে না। পামপট্টি ভালোই মারতে পারো।
তোমার যে সুন্দরতা তা প্রকাশের ভাষা থাকলে তো আরও বলতাম! পামপট্টি মারবো কেন! আমি কবি হলে তোমাকে সহস্র কবিতা বানিয়ে ফেলতাম। নাসের সাহেব সত্যি ভাগ্যবান পুরুষ।
ওপর থেকে সব এরকমই মনে হয়!
কে ভাগ্যবান আর কে দুর্ভাগা তা কি মানুষ নিজে বোঝে! বোঝে না।
কথায় কথায় রাত গড়ায়। রাত বাড়তে থাকে। হঠাৎ আবু নাসেরের কল। সোমা এত রাতে আবু নাসেরের কল দেখে বেশ অবাকই হয়। ঈশারা করে কাফিকে কথা না বলার জন্য। ভাবে কলটা রিসিভ করবে কী করবে না! ভাবতে ভাবতেই কলটা কেটে যায়। আবার কল আসে। সোমা মোবাইলটা হাতে নিয়ে দ্রুত নিজের রুমে যায়। কিন্তু এবারও কল রিসিভ করে না।
আবারও আবু নাসেরের কল। সোমা এবার ঘুমজড়ানো কণ্ঠের ভাব করে কল রিসিভ করে।
আবু নাসের বললো, ঘুমিয়ে গেছ! রাতও তো অনেক। বুঝতে পারিনি। এমনিই কল করেছি। ঘুমাও। সারাদিন মিটিং-সিটিং নিয়ে কী যে অবস্থা! টাকার পেছনে ঘুরতে ঘুরতেই দিন যে কখন কিভাবে চলে যায়, টেরও পাই না। টাকা ছাড়া মানুষের কোনো দাম নাই, বুঝছো। টাকার পেছনে পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটতে ছুটতে তোমারে পর্যন্ত ভুলে গেছি। চোখ ভেঙে ঘুম আসতেছে। আমিও ঘুমিয়ে পড়বো এখন। তুমিও ঘুমিয়ে পড়ো। কাল হয়তো চলে আসবো। কাজটা প্রায় হয়েই গেছে।
কথা না বাড়িয়ে সোমা শুধু বললো, ঠিকমতো খেয়েছ তো?
খাইছি তো আরও আগেই। খাতি-টাতি ভালো লাগে না। পেটটা দেখো না ব্যাঙ ফোলার মতো ফুলে উঠতেছে। খাওয়া-দাওয়া বাদ দিতে হবি।
নায়ক হবা নাকি?
হতিও তো পারি। টাকা হলি এই দেশে সব হওয়া যায়। দেখো না কতজন নিজের টাকায় সিনেমা বানায়ে নিজেই নায়ক হয়। একদিন আমিও তো হতি পারি।
তুমি তা পারবা। এখন ঘুমাও। না ঘুমালে শরীর খারাপ করবে।
হ। খুব ঘুম আসতেছে। কাফি কী ঘুমায়? বেচারার একটা কামে লাগা দিতে হবে। আসি দেখি! আচ্ছা অনেক রাত হইছে ঘুমাও।
আমি তো ঘুমিয়েই গেছিলাম। তোমার ফোনেই তো ঘুমটা গেলো। ঘুমাও বলেই সোমা মোবাইলটা রেখে বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, বাপরে বাপ! বেচারা এত রাতেও ঘুমাইনি! কাফিকে আর আমাকে নিয়ে কী যে ভাবতেছে! আচ্ছা, কাফিকে নিয়ে উল্টাপাল্টা ভাবছে না তো! ভাবলে ভাবুক গে। ভাবনার ধার ধারলে তো! আবার ভাবে, ও বুঝতে পারেনি তো আমার কণ্ঠটা আসলে ঘুমের না, ঘুমের ভান! না, ও বুঝতে পারবে না। টাকা থাকলেই তো আর সব হয় না। মনের হিসাব ও কী করে বুঝবে! ও ঠিকই মনে করবে আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। তবে টাকা-পয়সার হিসাবটা কড়ায়গণ্ডায় বোঝে—ষোল আনাই জানে। একটু গরমিল হলেই ধরতে পারে। কিন্তু ঘরের বউয়ের মনের হিসাব ধরার মতো ঘেলু ওর নেই। ওর হিসাব সব মোটা দাগের। বউটা সুন্দরী— বউটাকে নিয়ে শুতে পারলেই হলো—এতেই ওর সুখ। মনের যে একটা ব্যাপার আছে—তার ধারের কাছে দিয়েও হাঁটে না। ঘরের হিসাব ঠিক রাখার জন্য যে যোগ্যতা লাগে, এ জনমেও ওর তা হবে না। এক একজনের হিসাব এক একরকম, নাসেরের টাকা আছে, ওর ধারণা টাকা দিয়েই সব হয়। ও জানে না ওর সাথে আমার যা তা অভ্যস্ততা ছাড়া মনের কোনো ব্যাপার নেই। অথচ কাফির টাকা নেই, আর সেই কাফিই আমাকে পাগলের মতো কাছে টানে। আমার প্রতিটি নিঃশ্বাস যেন ওর জন্যে।
সোমা বিছানায় বসে কিছু একটা ভাবে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। নিজেকে দেখে। নদীর ঢেউয়ের মতো নিজের লাবণ্যভরা শরীর আঁকাবাঁকা করে দেখে। নিজেকে দেখে নিজেই মুগ্ধ হয়। কাফির জন্য এক গ্লাস হালকা গরম দুধ নিয়ে তার রুমে যায়।
কাফি বিছানায় একপেশে কাত হয়ে প্রতিভা বসুর ‘জীবনের জলছবি’ পড়ছিল। সোমা ঢুকেই বললো, মাস্টার মশাই, পড়তে পড়তেই তো জীবন শেষ হয়ে গেলো! আর কত পড়বা! একজন দৌড়াচ্ছে টাকার পেছনে, আর একজন মহাপণ্ডিত বনে যাচ্ছেন! ঘরে যে চোখ ঝলসানো সুন্দরী একটা নারী আছে— চোখেই পড়ে না। কাফি পাশ ফিরে সোমার দিকে বিস্ময়ভাবে তাকায়।
ও রকম করে তাকাচ্ছ কেন? ওরকম করে তাকানোর কী আছে! যা দেখছি তাই বলছি। নাও, দুধটুকু খেয়ে নাও। ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। আর এমনিই তো তুমি বেশি ঠাণ্ডা!
খেতে ইচ্ছে নেই।
ইচ্ছে নেই তা তো আগেই জানি। ইচ্ছে না হলেও অনেক সময় খেতে হয়। নাও, খেয়ে নাও। হালকা শাসনের স্বরে গ্লাসটা কাফির হাতে দেয়। কাফি আর আপত্তি করে না। ঢক ঢক করে দুধটা খেয়ে গ্লাস টি-টেবিলের ওপর রাখে। তারপর সোমার দিকে তাকিয়ে বললো, খুশি তো!
তার আগে শুনি দুধটা গেলো কার পেটে!
পেটে আমার গেলেও মনটা তো ভরলো তোমার।
সবই বোঝো তাহলে!
রাত তো ঢের হলো। ঘুমাবা না?
না, ঘুমাবো না। তোমার সাথে জেগে থেকে গল্প করে ভালোবেসে এ রাতটা কাটিয়ে দেবো।
তা কিভাবে হয়! এটা ঠিক হবে না। তুমি রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।
কাপুরুষের মতো কথা বলো কেন? শরীরে কি তোমার টিকটিকের রক্ত? আমি তোমার সাথে চলে যেতে চাই। একদম চলে যেতে চাই। পারবা নিয়ে যেতে?
তুমি বিবাহিতা—এটা কি তোমার মাথায় আছে?
আছে। সবই মাথায় আছে। আমি যা বলি তার সরাসরি উত্তর দাও।
আমাকে নিয়ে যাবে কি না? আমি তোমাকে চাই। নাসেরের সাহেবের টাকা আমি চাই না। আমি নাসের সাহেবের সম্মান নিয়ে মানুষের সালাম চাই না। আমি তোমাকে চাই—তোমার জন্য দুর্নাম বদনাম কলঙ্ক যা কছু আছে সব নেবো আমি। এতে আমার কোনো দুঃখ থাকবে না।
তুমি পাগল হয়ে গেছো।
সে তো কবেই। যেদিন তুমি তুলিকে প্রথম পড়াতে এসেছিলে, সেদিনই তো আমি পাগল হয়েছি।
সোমা সোফা থেকে কাফির বিছানায় উঠে এসে বসে। কাফির দুটি হাত একস সাথে মুঠোবন্দি করে বলে, কাফি, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। বিশ্বাস করো, নাসেরের সাহেবের এত টাকা-পয়সা, গাড়ি-বাড়ি কিচ্ছু আমার ভালোলাগে না। আমার মনের ভেতরে তুমি যে কিভাবে গেঁথে আছো, তুমি নিজে তার কিছুই জানো না।
কাফি কী করবে, কী বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। বললো, আমিও তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু সমাজ ধর্ম সবই তো আমাদের বিপক্ষে।
এসব তো দুর্বল লোকের কথা। এসব তো কাপুরুষের কথা। তুমি তোমার ভালোবাসার শক্তি দিয়ে সবকিছু তোমার পক্ষে করে নাও।
বৈশাখের চারদিক অন্ধকার হয়ে আসা প্রচণ্ড ঝড়ের গতিতে বুকের ভেতর সোমাকে টেনে নেয় কাফি। সোমাও তাতে সাড়া দিয়ে প্রবল প্রমত্ত পদ্মার ঢেউয়ের মতো ভেঙে পড়ে কাফির বুকে।
ইচ্ছে করলেই সবকিছু করা যায় না, সোমা। আর তুমি তো নাসের সাহেবকে বলেছো, আমাদের মধ্যে ভাইবোনের একটা সম্পর্ক। যখন উনি জানবেন এটা ভুয়া, তখন কি মানুষের প্রতি উনার কোনো বিশ্বাস থাকবে?
এসব বলো না। এসব কেন নাসেরকে বলেছি, তা তুমি ভালো করেই জানো। তোমার সাথে আমার সম্পর্ক কী, তা তুমিও জানো, আমিও জানি। ওটা একটা লেবাস। না হলে তুমি এখানে এক মুহূর্তও থাকতে পারতে না। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখো তো আগুনের কোনো মেঘ চোখ পড়ে কিনা!
খুব ভুল হচ্ছে, সোমা।
হ্যাঁ, ভুল হচ্ছে-এটা ঠিকই বলেছো। ভুলটা আমি করবো। আমার সাথে তুমিও করবে। তোমাকে আমি ছাড়বো না। আমাকে ছেড়ে তুমি কোথাও যেতে পারবে না। আমাকে নিয়ে যেতে হবে। ফাঁকি দিয়ে যদি চলে যাও, যেখানে যাবে, তা দেশেই হোক আর বিদেশেই হোক আমি তোমার কাছে যাবোই।
কাফি বললো, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখো কয়টা বাজে?
যে কয়টা বাজে বাজুক। সেটা দেখা এখন জরুরি না।
ঘুমোবে না? তোমার রুমে গিয়ে ঘুমাও।
আমি এ রুমে তোমার সাথেই ঘুমাবো। আচ্ছা, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি!
করো।
আমার এই রূপ লাবণ্য যৌবনা শরীর দেখে তোমার কিছু ইচ্ছে করে না?
করে।
তাহলে এভাবে আচরণ করছ কেন? তোমার শরীরে রক্ত আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। আমি তো বলেছি আমি তোমার সাথে চলে যাবো। আমি কোনোভাবেই তোমাকে ছাড়বো না। আমি তোমাকে ভালোবাসি কাফি।
কাফি ঠিক ভেবে পাই না কী করবে! খাট থেকে নেমে সোফায় উঠে আসতেই সোমা বললো, উঠে যাচ্ছো কেন?
কাফি কোনো উত্তর না দিয়ে ফিরে আবার বিছানাতেই বসে।
ভয় পাও বুঝি?
না। ভয় পাবো কেন? তোমার সম্মানের কথা ভাবছি। নাসের সাহেবের সম্মানের কথা চিন্তা করছি। তোমাদের সামাজিক অবস্থানের কথাও ভাবছি। আমাকে কে চেনে! আমার সম্মান-অসম্মানের কী যায় আসে! তোমাকে পেলে তা তে আমার পুরোটাই লাভ। কিন্তু এতে তোমার ক্ষতি কতোটা তা কি একবারও ভেবেছো? কাফির কোলের ওপর মাথা রেখে মলিন কণ্ঠে সোমা বললো, আমি তোমাকে ভালোবাসি, কাফি—এর বেশি কিছু আমি আর ভাবিনি। লাভ-লোকসান, মান-সম্মান কিছুই চিন্তা করিনি। তোমাকে আমি নিজের করে চাই—শুধু এটুকুই ভেবেছি। তুমি তো নিশ্চয় ভরা পদ্মার মাতাল ঢেউ দেখেছো। কিভাবে তা আছড়ে পড়ে তার দুকূল-ঘরবাড়ি-গাছপালা নিজের বুকে বিলীন করে নেয়! সে কি হিসাব করে তার এই ব্যাকুল ও উন্মত্ততায় কার কতোটা ক্ষতি বা সর্বনাশ হলো! আমিও তোমাকে আমার বুকে মাতাল ঢেউয়ের মতোই বিলিন করে নিতে চাই। তাতে কার কতোটা ক্ষতি বা সর্বনাশ হলো তা ভাবতে চাইনে। আমার যা বেদনা বা কষ্ট তা হলো তোমার নির্জীবতা। কেমন যেন তুমি প্রাণহীনের মতো চুপচাপ হয়ে থাকো। তোমার ভেতর আমি সেই আগের কাফিকে খুঁজে পাইনে।
কাফির ভেতরে পরিবর্তন হতে থাকে। নিজের ভেতর একরকম জিদ তৈরি হতে থাকে। ভাবে, যে আমাকে এত করে চায়, যে আমাকে নিজেকে নিঃস্ব করে ভালোবাসতে চায়, যে এত অর্থবিত্ত রাজপ্রাসাদ সম্মান সব পায়ে ঠেলে আমাকে চায়, আমি কেন তাকে দূরে ঠেলে দেই! কাফির রক্তে আগুন ধরতে থাকে। মনের ভেতর একটা কালো মেঘ জমে প্রবল ঝড় হয়ে উঠতে থাকে।
সোমা নিজের শরীর কাফির শরীরে আঁকাবাঁকা পথের রেখার মতো করে তাকে জড়িয়ে ধরে মাদকতাভরা কণ্ঠে বললো, কাফি, তুমি বৈশাখের ঝড় দেখোনি? কেমন করে ঘরবাড়ি গাছপালা ভেঙেচুরে চূর্ণবিচূর্ণ করে মাটিতে সবকিছু আছড়ে ফেলে! তুমি সেই রকম করে এই সমাজটাকে আছড়ে ভেঙে ফেলে আমাকে নিয়ে নিতে পারো না? সোমার কণ্ঠে অসহায়ত্ব—চোখে রঙধনু—পলিমাটির মতো শরীর—উছলে পড়া শরীরী লাবণ্য—বিছানায় লুটিয়ে পড়া একমেঘ কালো চুল— কাফির দুচোখে আটকে যায়। বৈশাখের পাগলা ঝড় অনুভব করে সে। রক্তে ভয়াবহ আগুন জ্বলে ওঠে। কাফি সোমার মেঘভর্তি কুচকুচে কালো চুলের ভেতর আঙ্গুল ঢুকিয়ে মুঠোবন্দি করে নেয়। তারপর তার মুখটা নিজের মুখের কাছে আলগোছে টেনে নেয়। কাফি গভীর চোখে তাকে দেখে—সোমাও তার চোখে চোখ রাখে। তারপর সোমা শান্ত অথচ আগুনের পরশমাখা কণ্ঠে বললো, কাফি, তোমাকে আমি ভালোবাসি। দুচোখ বন্ধ করে ফেলে সোমা। চোখের ভেতরে নীরব বৃষ্টি নেমে আসে।
বৈশাখের চারদিক অন্ধকার হয়ে আসা প্রচণ্ড ঝড়ের গতিতে বুকের ভেতর সোমাকে টেনে নেয় কাফি। সোমাও তাতে সাড়া দিয়ে প্রবল প্রমত্ত পদ্মার ঢেউয়ের মতো ভেঙে পড়ে কাফির বুকে।
মধ্যরাত তখন দুপুরের রোদ্দুর হয়ে ওঠে।
চলবে…
সম্পর্কের আড়ালে-৪॥ রকিবুল হাসান