দুই.
কাফিকে দেখে সোমার যতটা খুশি হওয়ার কথা, বিস্মিত হয় তার থেকে বেশি। চেহারার এ কী হাল! চেহারায় ক্লান্তিভরা। পুরো শরীরে অযত্নের ছাপ। এরকম কেন হয়েছে—সোমার জানতে ইচ্ছে করলেও, তাকে কিছুই জিজ্ঞেস করে না। এতগুলো দিন পরে কাফিকে পেয়ে মনে মনে খুশি হলেও আবু নাসেরের সামনে বাড়তি একবিন্দু আবেগও দেখায় না সে। একরকম বিরক্ত হওয়ারই ভাব করে। বরং আবু নাসেরই কাফির প্রতি বেশি আগ্রহ দেখায়। সোমা তাতে খুশিই হয়, কিন্তু প্রকাশ করে না। সোমাকে বাইরে থেকে দেখে মনে হয় কাফি আসাতে তার কোনো আনন্দ নেই বা আগ্রহ কিছুই নেই। বরং বিরক্তিই প্রকাশ পায়। কাফির মন খারাপ হয়। তার ধারণা ছিল তাকে দেখে সোমা খুশি হবে। তার চোখেমুখে আঁধার মেঘের জ্যোৎস্নার মতো আনন্দ উছলে উঠবে, কতো কিছু জানতে চাইবে! কিন্তু সোমার এমন নিরুত্তাপ আচরণে সে নিজের মনের সাথে নিজেই ভালো রকমের ধাক্কা খায়। ভাবে, এখানে থাকা নয়, অন্য কোথাও চলে যাবে। কিন্তু কোথায় যাবে, তাও অজানা। কাফি এটুকু বোঝে সোমার চোখেমুখে বিরক্ত থাকলেও যত্নআত্তিতে কম নেই। আবু নাসেরও আগের থেকে বেশি যত্নশীল। পকেটে জোর করে দুহাজার টাকা ঢুকিয়ে দিয়ে বললো, সেলুনেতে গিয়ে ছাপটাপ হয়ে আসো। পুরো মুখে-মাথায় তো জঙ্গল বাঁধিয়ে ফেলেছ।আবু নাসেরের আচরণে খুশি হয় সোমা। কাফি ভাবে, কী আশ্চর্য! আগে মনে হতো সোমা আমাকে অনেক পছন্দ করে, ভালোবাসে। আর সে বিশ্বাসেই তো এতদিন পরে এখানে ফেরা। অথচ এখন মনে হচ্ছে তা পুরোই ভুল। তাহলে সোমার চোখের সেই ভাষা আমি কি ভুল পড়েছিলাম! বরং আবু নাসের সাহেবকেই আমি উল্টো ভাবতাম। যিনি আগে আমার সাথে ওভাবে ভালো করে কথাও বলতেন না। সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন নাকি নিজের বোঝার ভুল—হিসাব মেলাতে পারে না কাফি।
সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই। কাফি রুমে বসে চলে যাওয়ার কথা ভাবে।
কাফির আপাতত যাওয়া হলো না। আবু নাসের সকালে নাস্তার টেবিলে কাফিকে বললো, তুমি আমার সাথে অফিসে ফ্যাক্টরিতে কয়েকদিন গিয়ে দেখো। বোঝার চেষ্টা করো। তারপর এক জায়গায় বসিয়ে দেবো। আরে ভাই তোমার তো সার্টিফিকেটের জোর আছে। আমার তো ওসবের জোর নেই। আমি পারলে তুমিও পারবে।
সোমা বললো, ভালোই হবে। তুমিও একটা ভালো ছেলে পাবে। যাকে বিশ্বাস করে তুমি ব্যবসা-বাণিজ্যে অনেকটা নির্ভার হতে পারবে।
কাফিকে আমার আগে থেকেই ভালো লাগে। মাঝে যে কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিল! আর তুমি তো ওকে ভাই বানিয়েছ। ও তো এখন আর বাইরের কেউ নয়, বাড়ির মানুষ।
কাফি অনেকটা চুপ করেই থাকলো। কিছুই বললো না। চিন্তা করতে থাকে, নাসের সাহেবের কাছে আমাকে ভাই পরিচয় কেন দিয়েছে সোমা! সম্পর্কটা তো তা নয়। কিন্তু সে তো আমাকে নাসের সাহেবের শ্যালক বাবু বানিয়ে দিল! কাফির মাথায় ব্যাপারটা কেমন যেন ঘোলাটে ঠেকে।
আবু নাসের নাস্তা সেরে ওঠার সময় আবারও বললো, কাফি, জীবনে হতাশা বলে কিছু রাখবা না।এখানে থাকো। একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আর সোমা যখন তোমাকে ভাই ডেকেছে, আর কিসের অভাব! সব হয়ে যাবে। কারখানায় যাবো—যাবা নাকি!
কাফি কিছু বলার আগেই সোমা বললো, এটা আবার জিজ্ঞেস করার কী আছে! নিয়ে যাও সাথে করে। এখানে বসে থেকে কী করবে! তোমার সাথে যেয়েদেখুক, শিখুক।
কাফির মনের কাছে সোমার কথাগুলো ভালো লাগলো না। কিন্তু নিজের কিছুই বলার থাকে না। ভাবে, জীবনের হিসাবটা কোন দিকে যাচ্ছে! অংকটা কোন সূত্রে কিভাবে মিলবে! আদৌ কি মিলবে!
কারখানায় গিয়ে অবাক হয় কাফি। এত বড় কারখানা! এত এত লোক কাজ করে! আবু নাসের কাফিকে নিয়ে পুরো কারখানা ঘুরে নিজের রুমে এসে বসে। কাফিকে বললো, জানো কাফি, এ রকম কারখানা কিন্তু আমার আরও দুটো আছে। সব মিলে প্রায় দু হাজার লোক আমার তিন কারখানায় কাজ করে। আমি নিজেও একসময় অন্যের কারখানায় কাজ করতাম। আমি একদিন রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবছি, অন্য কেউ যদি এত বড় কারখানার মালিক হতে পারে, তাহলে আমি পারবো না কেন! আমার বাবাও পরিশ্রমী মানুষ ছিলেন, কিন্তু ও রকম কিছু করে যেতে পারেন নি।আমি ভাববলাম, পড়ালেখা শেষ করে চাকরিবাকরি খোঁজার চেয়ে পড়ালেখা বাদ দিয়ে নিজেই কিছু করবো। তাই-ই করলাম। তখন অনেকেই অনেক কথা বলেছে। আমি শুনিনি। আজ যা দেখছো সবই পরিশ্রমের ফসল।
সোমা নিজেও তোমার জন্য আমাকে কইছে। ও তো তোমারে ভাই বানাইছে। আমারে সব কইছে। আর শোনো তোমারেও আমার পছন্দ হইছে। ভালো ছেলে তুমি।
কাফি মন্ত্রমুগ্ধের মতো আবু নাসেরের জীবনের গল্প শুনতে থাকে। চায়ে চুমুক দিয়ে আবু নাসের আবার বলে, পড়ালেখার প্রতি আমার দুর্বলতা ছিল। লেখাপড়া যে শিখিনি, এ জন্য আমার ভেতর একটা কষ্ট আছে। ভাবলাম, এমন মেয়ে বিয়ে করবো সাত জেলায় ওরকম সুন্দরী মেয়ে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এর জন্য যতো টাকা লাগে লাগুক। তাই করেছি। তুমি সাত শহর না হয় চৌদ্দ শহর ঘুরে আসো, তোমার বোনের মতো সুন্দর মেয়ে আর একটাও খুঁজে পাবা না।
আবু নাসের যখনি সোমাকে কাফির বোন উচ্চারণ করে, কাফির ভেতর তখন কেমন যেন কাঁটার একটা খোঁচা লাগে। দারুণ একটা মিথ্যের ছায়া বেড়ে উঠতে থাকে। সোমাকে সে কখনোই বোন ভাবেনি। হয়তো সোমা সম্পর্কটাকে নিরাপদ রাখার জন্য আবু নাসেরের কাছে এরকম একটা গল্প সাজিয়েছে।
কী ভাবো, কাফি? শোনো, বড় হতে চাইলে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে শিখবা। এই যে কয়দিন ধরে আমার সাথে ঘুরতেছ—দেখতেছো, বুঝতে পারছো কিছু! খালি পরিশ্রম আর বুদ্ধি।এটা থাকলেই পারবা। আর নিজের সাথে জিদ রাখবা। সৎ থাকবা। কারও জিনিস অন্যায়ভাবে নিবা না। আমি যা করেছি পরিশ্রম করে করেছি। কারও জিনিস অন্যায়ভাবে নেইনি। কত কষ্ট করেছি। কত দিন না খেয়ে থাকছি। ছোট্ট একটা খুপরির ভেতর কাজ শুরু করেছিলাম। সেখানেই রাতে শুতাম। খেতাম। থাকতাম। নিজের তৈরি মাল নিজেই মাথায় করে দোকানে দোকানে দিয়েছি, বিক্রি করেছি। কত জনের কাছে টাকা ধার চেয়েছি, দেয়নি। ব্যাংকে গিয়েছি, তারাও প্রথমে দেয়নি। আগ্রহ দেখায়নি। যখন দেখেছে আমার ভেতর একটা সম্ভাবনা আছে, তখন তারা এগিয়ে এসেছে, ঋণ দিয়েছে। এসব তো বেশি দিনের কথা না। এখন ব্যাংকগুলো ঋণ দেওয়ার জন্য আমার কাছে লাইন ধরে বসে থাকে। আমার পড়ালেখাও ছিল না, চেহারাও ছিল না। যা ছিল তা হলো সততা আর পরিশ্রম। পাগলের মতো পরিশ্রম করেছি। তোমার পড়ালেখা আছে, চেহারা আছে, তুমি যদি চেষ্টা করো, তুমি যে কত বড় হতে পারবা, তা তুমিও হিসাব করতে পারবা না। আমি যদি এমএ পাশ হতাম, দেখতা আরও কত ওপরে উঠতাম। অনেক সময় চেহারাও কাজে লাগে। তুমি চেষ্টা করলে অনেক ওপরে উঠতে পারবা। আর আমি তো তোমার জন্য আছিই। আমার তো কেউ ছিল না। যা করেছি আমি একাই করেছি। আরে মিয়া আমি তো এখন তোমার দুলাভাই লাগি। তুমি তো তর তর কইরা ওপরে উঠে যাবা—শুধু একটা লাইন ধইরা দেবো। দেখবা টাকা ক্যামনে আসে!
কাফির কাছে মনে হয় এ যেন ক্লাসে সবচেয়ে দামি অধ্যাপকের বক্তৃতা শুনছে সে। পৃথিবীর সব কিছু ভুলিয়ে দিয়ে পৃথিবীকেই জয় করার এক মন্ত্র বুনে দিচ্ছে তার ভেতর।
বুঝছ কাফি! একদিন দেখো আমি এখানকার এমপি হবো। এটা আমি হতে চাই। এটা আমার মনের কথা।
কাফি বিস্ময় চোখে আবু নাসেরের দিকে তাকিয়ে বললো, আপনি তো কোনো দল করেন না, এমপি হবেন কিভাবে!
আরে একসময় দলই আমার কাছে এসে বলবে আবু নাসের আপনি আমার দল থেকে নমিনেশন নেন, এমপিতে খাড়ান। এখন তো খালি দল করলেই হয় না। টাকা না থাকলে রাজনীতি-ফাজনীতি করে লাভ নেই। তুমি জানো না, এখানে যারা রাজনীতি করে, আমি টাকা না দিলে তাদের ধবধবে চেহারা থাকতো না। শুকা যাতোনে। আমি যদি নিজেও কখনো কই, আমি এমপি দাঁড়াতে চাই, তখন কে কথা বলবে আমার বিরুদ্ধে! দুই চার দশ কোটি ছেড়ে দেবো। এখন সবার রাজনীতি নামেমাত্র রাজনীতি। কয়জন নেতা কাজ করে খায়, তুমি আমারে কও! তো আমিই যখন টাকা দেবো, এমপিও আমিই হবো। তার আগে আরও দুই-তিনটে কারখানা বানা নেই। তারপর দেখো কি করি!
আপনি পারবেন। আপনার কাছ থেকে দিন দিন যা শিখছি, তা আমার জীবনের সঞ্জীবনী এক শক্তি।
শেখার দেখলে কী! এ কয়দিনে কী শিখবা! দশ পনের ঘুরেই যদি শেখা যেত, তাহলে তো আমার এত বছর লাগতো না। তোমার শেখার তো শুরু মাত্র।
ঠিকই। কিন্তু আপনি যা পারেন আমি তো তা পারবো না।
পারবা পারবা। তুমি আমার থেকেও বেশি পারবা। তোমার তো বিএ এমএ-এর সার্টিফিকেট আছে। সময়মতো এসব সাটিফিকেটের মেলা দাম। তোমার আছে, তুমি বুঝবা না, আমি বুঝি, কারণ আমার নেই।
কাফি খুব অবাক হয়ে শোনে আবু নাসেরের কথা।
তুমি আমাকে কও তো কাফি, এই যে, আমাদের এই এলাকায় এ পর্যন্ত যারা এমপি হয়েছে, তারা কেউ সুনামের সাথে এমগিরি করতে পারছে? সবাই টাকার জন্য দুর্নাম বদনাম কুড়াইছে। আমার তো টাকার দরকার নেই। আমি তো ধাপ্পাবাজি করে লোকজনের কাছ থেকে টাকা নেবো না। আমিই আরও দেবো। মানুষের জন্য আমি করে যাবো। সৎ ইচ্ছে থাকলে মানুষ সব পারে। কী কও কাফি, পারবো না?
আপনি আসলে অন্যরকম মানুষ। আপনি নিশ্চয় পারবেন।
তুমিও পারবা। শুধু নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখো, তুমি পারো। আর নিজে সবসময় সৎ থাকবা, জান-পরান দিয়ে খাটবা। বুদ্ধি করে চলবা। তাহলেই হবে। কাফি, আজ যেন আমার কী হয়েছে! তোমাকে ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করে, নিজের জীবনের অনেক কথা বলে ফেললাম। তুমি বিরক্ত হওনি তো ভাই!
বিরক্ত হবো কেন? আপনার কথাগুলো অনেক মূল্যবান।
সত্যি বলছ কাফি?
সত্যি বলছি, আপনার কথাগুলো অনেক মূল্যবান।
মূল্যবান কি না, জানি না কাফি। তবে কথাগুলো আমার নিজের—নিজের জীবনের কথা—স্বপ্নের কথা।
আপনার সাথে এই দশ বারো দিন ঘুরে-ফিরে যা শিখেছি, এত বছরেও এর বিন্দুমাত্র আমি শিখিনি। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া আর বাস্তবে নিজের জীবন দিয়ে শেখার মধ্যে কত পার্থক্য! আমার কাছে আপনি নিজেই যেন একটা বিশ্ববিদ্যালয়—বিরাট এক বিস্ময়!
আরে কী যে কও তুমি! চলো বাসায় যাই। আজ বিকেলে আবার ঢাকায় রওয়ানা দেবো। তুমি যেও না। আমি আসি তোমার একটা ব্যবস্থা করে দেবো। সোমা নিজেও তোমার জন্য আমাকে কইছে। ও তো তোমারে ভাই বানাইছে। আমারে সব কইছে। আর শোনো তোমারেও আমার পছন্দ হইছে। ভালো ছেলে তুমি।
কী উত্তর দেবে কাফি কিছুই খুঁজে পায় না।
চলবে…
সম্পর্কের আড়ালে ॥ রকিবুল হাসান