প্রকৃতির স্কুলে রোজকার মতো পাখিদের ক্লাস চলছে। ওদের কিচিরমিচির ডাকে ঘুম ভাঙে। গ্রীষ্মের রাত খুব ছোট, চড়ুই পাখির মতো একেকটা রাত আসে আর ফুরুত করে উড়ে যায়। পরিচিত ঘর, জানালা, পর্দা, বিছানা, তবুও সবকিছু অন্যরকম, অপরিচিত লাগছে। নিয়মমাফিক বিছানা ছেড়ে এক গ্লাস জল খেয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াই, নিজেকে দেখতেও ইচ্ছে করছে না। কোনো কিছুই ভালো লাগছে না। আজকাল জীবন কেন জানি খুব এলোমেলো ঠেকছে। মধ্য জীবনের সংকট তো পার হয়ে এসেছি, তো এই কোন সংকটে ভুগছি, তাও বুঝি না।
বেশ কিছুদিন ধরে একদম নেতিয়ে আছি, বুঝতে পারি। মোমবাতি নিভে গেলে যেমন একটা ধোঁয়া উড়ে ঠিক সেরকম ধোঁয়া যেন উড়ছে আমার চারপাশে, সঙ্গে পোড়া গন্ধ। বুকের ভেতরটা কি তবে সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে? মামুনের বাজখাঁই শব্দ ভেসে আসে কানে। ও নেই আমার জীবনে, তবে কোথা থেকে এই সাতসকালে ওর স্বর এসে বিঁধছে কানে? হাওয়ার শরীরে কি শব্দ লেগে থাকে? সেসব শব্দরা কি হাওয়ায় উড়ে? না কি আমার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে? ঠিক বুঝতে পারি না। চোখজোড়া বুঁজে পুনরায় বিছানায় নিস্তেজ শরীর এলিয়ে দেই। তাতেও নিস্তার পাই না। বোজা চোখের পর্দায় ফুটে ওঠে ফেলে আসা অতীতের যন্ত্রণাদায়ক সব ছবি। যতই ভুলে থাকতে চাই, বন্ধ চোখে ফেলে আসা সময় ততই সহজ হয়ে ধরা দেয়।
‘বই পড়ার এই বাতিক ছাড়ো, এসব বই পড়ে কী হয়? পেটে খাবার জোটে? আমার বাড়িতে বই পড়া চলবে না।’ মামুনের সেদিনের কথাগুলো আমার মনের ভেতর পর্যন্ত পুড়িয়ে দেয়। প্রতিবাদ করতেও ইচ্ছে করেনি। নিস্তব্ধ আমি বড় বড় চোখ মেলে শূন্যে তাকিয়ে ছিলাম শুধু। ‘যদি সাহিত্য চর্চা করো তবে তোমার সঙ্গে আমি থাকবো না’ তোতাপাখির মতো রাতদিন ওই একটাই বুলি ছিল মামুনের মুখে। ওকে বলেছিলাম, বাচ্চারা বড় হয়ে গেছে, ঘরের সব কাজ সামলে লেখালেখি করি, পড়ি। আমার সাহিত্য চর্চা কি আমাদের যাপিত জীবনে কোনো সমস্যা তৈরি করছে? এই প্রশ্নের জবাবে ও বলেছিল, ‘বানিয়ে বানিয়ে কবিতা, গল্প, উপন্যাস লেখা মিথ্যাচারের সমান। মিথ্যাবাদীকে আল্লাহ অপছন্দ করেন। আমার ঘরে থেকে তোমার সাহিত্য চর্চার জন্য আমি দোজখে যাবো। সোজা কথা, আমার বাড়িতে থেকে সাহিত্য চর্চা করা যাবে না।’ ওর এমন উত্তর শুনে আমি পাথর হয়ে যাই। যে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা যায় না, তা বড় কষ্টের। নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হয়। আসলে দাম্পত্য জীবনে ছাড় দিতে দিতে ততদিনে আমি নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলাম। নিজের বলতে কিছুই ছিল না।
সন্তানরা যার যার কর্মস্থলে প্রতিষ্ঠিত, ব্যস্ত। মামুন ব্যবসায়িক কাজে সকাল থেকে মাঝরাত অবধি বাইরে থাকে। ওর একদণ্ড সময় নেই আমার জন্য। কবে দুজনে একসঙ্গে বসে খেয়েছি, সময় কাটিয়েছি, চোখে চোখ রেখেছি, চেষ্টা করেও মনে করতে পারিনি। একাকী জীবনে আমি লেখা-পড়ার বুকে আশ্রয় খুঁজেছিলাম। নিঃস্ব জীবনে লেখালেখি, পড়া, আমার আনন্দ, আশ্রয় হয়ে উঠেছিল। অনেক ভেবে, এবং নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করে দেখেছিলাম, আমার হারানোর আর কিছু নেই। স্রষ্টা প্রদত্ত একটাই জীবন। এই জীবনের শেষাংশে এসে একটু প্রাণভরে মুক্ত হাওয়ায় শ্বাস নেওয়ার জন্য সবকিছু থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে এই নির্জন বাস বেছে নেই। এই জীবনে একা একা দিন কাটলেও মানসিক স্বস্তি আছে, ভরাট লাগে চারপাশ, ভয়ে কুঁকড়ে থাকি না, যখন তখন বিনা কারণে চিৎকার, চেঁচামেচি নেই, দোষারোপ নেই। মানুষ হয়ে জন্মেছি বলে স্মৃতির হাত থেকে রেহাই পাই না, সমস্যা এটাই। স্মৃতির ঝাপি কোন কারণে খুলে গেলে ক্লান্ত লাগে, অদ্ভুত এক বিষণ্নতা পেয়ে বসে, কখনো বা চোখে কয়েক ফোঁটা জল জমে, সময় থমকে যায়, এই যা।
গ্রীষ্মের ছুটিতে ছেলে-মেয়েরা একেকজন একেক দেশে বেড়াতে গেছে বন্ধুদের সঙ্গে। ওরা বড় হয়েছে, নিজেদের নৌকায় ভাসছে। এমনিতে ওরা আমার খুব যত্ন নেয়, বেড়াতে আসে, গল্প করে পাশে বসে, মনোযোগ দিয়ে কথা শোনে। আমার নতুন কবিতা, গল্প, উপন্যাস ওদের পড়ে শোনাই। বাংলা পড়তে না পারলেও আমার বই সাজিয়ে রাখে ওদের বুক শেলফে। আমার নতুন বই বের হলে, পত্রপত্রিকায় লেখা প্রকাশ পেলে, ওরা আনন্দ প্রকাশ করে, শুভেচ্ছা জানায়। বন্ধুদের কাছে গর্ব করে লেখক মায়ের কথা বলে। ওদের বাঁধনহারা আনন্দ দেখে আমি যারপরনাই খুশি হই। ওদের মা হতে পেরে সৃষ্টিকর্তার কাছে অবনত মস্তকে নত হই। কিন্তু আজ সকাল হতেই যে কী হয়েছে আমার, এত এত সুখে থেকেও পুরনো দিনের কষ্টগুলো সমুদ্রের ফেনার মতো বারবার ফিরে আসছে মনের পর্দায়। চোখ বুঁজেও সেসব থেকে রেহাই পাই না। নাহ, স্মৃতি ঘরের দরজা বন্ধ করতে হবে, মন অন্যদিকে ঘোরাতে হবে।
চারদেয়ালের মাঝে নিজেকে বন্দি করে কত কী যে ভুলতে বসেছি, হিসাব নেই। সোনার থালার মতো চাঁদটাও আমাদের সঙ্গ দিচ্ছিল, সঙ্গে হাঁটছিল, ছোটবেলার মতো।
বিছানা ছেড়ে বিভূতিভূষণের সঙ্গে বারান্দায় গিয়ে বসি। দেশ ছেড়ে, গ্রাম ফেলে বহুদিন আগে প্রবাসে এলেও দেশ, গ্রাম সদা কড়ে আঙুল দিয়ে আমাকে কাছে টানে। আমার সমস্ত অনুভূতির ডাকনাম, বাংলাদেশ। বোধের সবটুকুজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আমার বেড়ে উঠার গ্রামখানি। প্রিয় লেখক বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় যেভাবে গ্রাম বাংলাকে লেখায় তুলে এনেছেন, সেটি আমার খুব প্রিয়। প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ উনি, একমাত্র উনিই পারবেন আমার মন ভালো করে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে। তিনি আমার মন ভালো করার বটিকা, এটি বহু আগ হতে পরীক্ষিত। কিছু সময় তাঁর ছায়ায় মায়ায় ডুবে থেকে মনটা ফুরফুরে হয়ে ওঠে। তাঁর ‘একটি ভ্রমণ কাহিনী’ গল্পটি পুনরায় পড়লাম। পড়া শেষে কী এক উদাসী হাওয়ায় প্রকৃতি যেন আমার হাত ধরে সমস্ত কোলাহল ঠেলে ছুটে চলছে এই প্রান্ত হতে ওই প্রান্তে, চরাচরজুড়ে। ‘একটি ভ্রমণকাহিনী’র গোপিকৃষ্ণ বাবু ও শম্ভু ডাক্তার যেন আমাকে ডেকে বলছে, আয় আয় আয়…।
অনেক দিন হয়ে গেছে কোথাও যাই না, কেমন নিরাবেগ হয়ে পড়ছি। আজকাল মনটাকে স্বপ্ন দেখার অনুমতিও দেই না, হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দেয় যদি, তাই। কবে, কখন যে একটা গতানুগতিক অভ্যাসের দাসে পরিণত হয়েছি, জানি না। চার দেয়ালের বাইরে তেমন যাই না বলে নতুন কারো সঙ্গে পরিচয় হয় না, কথা হয় না। একদা মনে বড় সাধ ছিল কোথাও হারিয়ে যাবো, গভীর অরণ্যে কিংবা পাহাড়ের চূড়ায়। সংসার করবো না, সন্ন্যাসী হবো। কোনোদিন বাড়ি ফিরবো না। ছোটবেলার ভাবনা ভেবে আপনমনে জোরে জোরে হাসি। ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা, মনে মনে মেলে দিলেম গানের সুরের এই ডানা’ বেসুরো গলায় গাইতে থাকি। হৃদকম্পন আজ ঊর্ধ্বমুখী, টের পাই। জানি, এই বৃদ্ধ হৃদয়ের সঙ্গী হিসেবে কাউকেই আর পাবো না এই জীবনে। নিজস্ব সূচি বদলে একাই আজ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেই। ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে পড়া আত্মাটা আনন্দে সিক্ত হয়ে ওঠে।
কিছু শুকনো খাবার, পানি, সঙ্গে বিভূতিভূষণের শ্রেষ্ঠ গল্প বইটিসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ব্যাকপ্যাকে ঢুকিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়ি। গন্তব্য ঠিক করেছি, সমুদ্র। ঘরের দরজা খুলতেই রোদের উপত্যকা হেসে আমাকে অভিবাদন জানায়। দেখতে ফুলের মতো ছোট্ট একটা মেয়ে চার চাকার সাইকেল চালাচ্ছে, ওর চুল বেগুনি রাবার টেনে বাঁধা, মুগ্ধ টানাটানা চোখ, ওর সাইকেলের ঘন্টি ঝুমঝুম বাজে, কী সুন্দর শব্দ, আমি কান পেতে শুনি। মুক্ত বিহঙ্গের মতো মানুষ ইচ্ছাধীন হাঁটছে। অনেকদিন বাদে যেন ময়ুরপঙ্খি নাওয়ে বৈঠা হাতে আমিও অনন্তের পথে ভাসছি। আমার ময়ুরপঙ্খির গায়ে আকাশের গভীর নীল আর প্রকৃতির গাঢ় সবুজ রঙ এসে দোল খাচ্ছে, আমার মুগ্ধতা ক্রমশ বাড়ছে। বাড়ির সামনে পথের ধারে হরেক রঙের ফুল ফুটে আছে। ওদের রঙ, রূপ, রসে মনের অন্দরে নানান উপসর্গ এসে হাজির হয়। এই বয়সে সবকিছু কি আর মুখ ফুটে বলা যায়? আপনমনে খিলখিল হাসতে হাসতে ওদের ছুঁয়ে দেই। শূন্যে চক্রাকারে একদল সাদা পাখি উড়ছে। ওদের চোখে, আমার চোখে, পৃথিবীর সমস্ত ভালোলাগা যেন এক্কাদোক্কা খেলছে। নাগরিক ভিড়ের মধ্যে দেখি একজোড়া তরুণ-তরুণী, ওদের চোখ প্রসারিত, আদর আদর মুখ, কোনে শূন্যতা নেই, নেই কোনো ক্লান্তি, কী নিবিড় মায়ায় হাত ধরে এগিয়ে চলছে। ওদের দিকে চেয়ে থেকে মস্তিষ্কের নিউরনে ভালোবাসার উপস্থিতি টের পাই। কী অনাবিল আনন্দে ওরা সম্পর্কের যত্ন করছে, আরও মজবুত করে সেলাই করছে ওদের বন্ধন। ওদের দিকে অপলক তাকিয়ে থেকে একটা ছায়া অনুভব করি, বসন্ত ছায়া। ছায়াটি ঘূর্ণির মতো আমার চারপাশে ঘুরঘুর করছে। ঘরের বাইরে এত ছায়া, সাদা মেঘের ছায়া, গাছের ছায়া, পাখির ছায়া, ফুলের ছায়া, মানুষের ছায়া, সম্পর্কের ছায়া, পৃথিবীর সর্বত্র শুধু ছায়া আর ছায়া। মিছেমিছি চারদেয়ালের মধ্যে আমি বিষণ্নতায় ডুবে ছিলাম। বাইরে কত আনন্দ! এতসব ছায়ার মায়া মাথায় নিয়ে পাবলিক বাসে চড়ে উড়তে উড়তে আমি পৌঁছে যাই আটলান্টিকের পাড়ে।
সেদিন ছিল উইক ডে। কর্মময় দিনেও এত মানুষ এসেছে সমুদ্রের কাছে, অবাক হয়ে দেখি। সারসের দল উড়ে উড়ে সমুদ্রে আগত অতিথিদের স্বাগত জানাচ্ছে। মন আমার ময়ুরের মতো নাচছে। ঘোরলাগা ঢেউয়ের শব্দে বুকের কিনারে ভেজা হাওয়ার হিল্লোল শরতের কাশফুলের মতো দোল খাচ্ছে। শেষ বিকেলের লালচে রোদে বালির উপরে কিশোরীর মতো দৌড়াতে দৌড়াতে চলে যাই জলের কাছে। জল আমাকে বুকে তুলে নেয়, জলের অসীম আদরে শিহরিত হই। জল আমার চারপাশে ঘুঙুর পায়ে নাচতে থাকে। জলের বিমূর্ত নাচের ঠমকে আমিও দুলতে থাকি। দৃষ্টি যায় অদূরে, সমুদ্র জাহাজে। ভাবি, সমুদ্রে ভাসা জাহাজটি কোন বন্দরের টানে উতাল-পাতাল ভাসছে, কোথায় ফেলে এসেছে দূরগামী নাবিক তার ছায়া, মায়া, ভালোবাসা। কি জানি। জল আমাকে উসকে দেয়, আরো রাশি রাশি আনন্দে ডুবে যেতে প্রণোদনা দেয়। অদ্ভূত এক আনন্দে আমি থরথর কাঁপছি, বাঁধভাঙা ঢেউয়ের মতো হাসছি। জল, হাওয়ায় যখন আমি মাতোয়ারা ঠিক তখনই শুনতে পাই কেউ আমাকে ডাকনাম ধরে ডাকছে। ডাকের উৎস খুঁজে দেখি কয়েক হাত দূরে প্রিয় লেখক বন্ধু লিমা হাসিমুখে তাকিয়ে আছে, ইশারায় কাছে ডাকছে। অপ্রত্যাশিতভাবে ওকে পেয়ে আনন্দ বেড়ে দ্বিগুণ হলো।
অনেকক্ষণ ধরে তোকে দেখছিলাম, যেন পাখির মতো উড়ছিলি।
কাছে আছিস নাই কেন?
দূর হতে তোর হাসি দেখতে ভালো লাগছিল।
হুম, অনেকদিন পর ছাপহীন লাগছিল রে।
এমন আনন্দে সবসময় থাকবি।
হ্যাঁ, আনন্দ ছাড়া জীবনে প্রাণ নেই। তবে আজকাল বয়স বাধা দেয়।
বয়স ভুলে আনন্দে ডুব দিবি।
সমুদ্রে এসে তা-ই মনে হলো আজ, আনন্দ করতে হলে ভুলে যেতে হয় বয়স।
কুশলাদি বিনিময়সহ টুকটাক গল্প শেষে আরও কিছু সময় ধরে দুই বন্ধু মিলে নির্বিকার চিত্তে সমুদ্রের বিশালতার দিকে তাকিয়ে থাকি। আমি এবং লিমা দু’জনেই মিতভাষী বলে দেখা হওয়ার সময়টা যতটা উচ্ছ্বাসের ছিল কাছে আসার পর ততটা আমাদের মুখে আর কথা নেই। অনেক বছর ধরে আমরা বন্ধু, আমাদের মধ্যে হৃদ্যতারও অভাব নেই, একের প্রয়োজনে অন্যে দৌড়ে যাই, কিন্তু আনুষ্ঠানিকতা বা দেখানোর বদলে আমরা নীরব থাকতেই পছন্দ করি। সূর্য ক্রমশ হেলে পড়ছে, দিনের আলো নিভে আসছে। জলের স্রোত কিছুটা অশান্ত হয়ে উঠেছে। লোকজন গোছগাছ শেষে ধীরে ধীরে সমুদ্র তীর হতে বিদায় নিয়ে গন্তব্যে হাঁটছে। হঠাৎ খেয়াল করে দেখলাম শীতে কাঁপছি। পুরো বিকেল জলে ভিজে এখন রীতিমতো ঠকঠক কাঁপছি। আমার বেগতিক অবস্থা দেখে লিমা বললো, ‘চল, দেখি কোথাও চা-কফি কিছু পাই কি না।’ আমি বললাম, ‘এখানে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।’ ও বললো, ‘আমি বেশ আগে এসেছি, হেঁটে হেঁটে চারপাশ দেখেছি, কয়েকটা দোকান আছে সামনে, গিয়ে দেখি পাই কি না।’ অতপর, আমরা সমুদ্রতীর ছেড়ে, জলের মায়া, সারসের ছায়া পেছনে ফেলে আধাঁরের পাঁচিলঘেঁষে হাঁটতে থাকি চা-কফির খোঁজে। সেদিন যে ভরা পূর্ণিমা, জানা ছিল না। চারদেয়ালের মাঝে নিজেকে বন্দি করে কত কী যে ভুলতে বসেছি, হিসাব নেই। সোনার থালার মতো চাঁদটাও আমাদের সঙ্গ দিচ্ছিল, সঙ্গে হাঁটছিল, ছোটবেলার মতো।
অসুখী মানুষের তালিকা থেকে নিজের নামটা সরিয়ে ফেলি। বড় নির্ভার লাগে। প্রবল ভালোলাগার আবেশে চোখজোড়া বুঁজে আসে।
সন্ধ্যা ততক্ষণে ঘন হয়ে এসেছে। লিমার চেনা দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে গেছে। রাত নয়টার মতো তখন। বন্ধ দোকানের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দু’জনে অসহায়ের মতো মুখ চাওয়া-চাওয়ি করি। আমি হতাশ হলেও লিমা হতাশ হওয়ার পাত্র নয়। ও খুব বুদ্ধিমতী। একটা পিজা দোকানে ঢুকে যেখানে চা-কফি বিক্রি হয় না, কেমন করে যেন ওদের রাজি করালো দুই কাপ চা করে দেওয়ার জন্য। এই হলো আমার বন্ধু লিমা, কথা কম বলে, প্রয়োজনীয় কাজ ঠিকঠাক করে। আমরা ভেতরে গিয়ে বসি, চায়ের জন্য অপেক্ষা করি। পাশের টেবিলে চোখ যায়, দেখি একজন বিদেশি স্থিরদৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। বিদেশে সাধারণত কেউ কারও দিকে এভাবে সরাসরি তাকিয়ে থাকে না। দৃষ্টি ফিরিয়ে নেই। আমরা কিছুটা হকচকিয়ে যাই এমন দৃশ্যে। লিমাকে টিপ্পনী কেটে বললাম, তোকে দেখছে, কেমন করে পিজা স্টোরে চায়ের ব্যবস্থা করলি। ও হাসে আমার কথা শুনে। কিছুক্ষণ পর আমাদের কাঙ্ক্ষিত কফি এলো।
আমরা আয়েশ করে চুমুক দিতে গিয়ে দেখি, লোকটি তখনো তাকিয়ে আছে, আমরা তাকাতেই এবার হাত তুলে ‘হাই’ বলেছে। পৃথিবীতে সব ধ্বনিরই প্রতিধ্বনি হয়। আমরাও এবার সহজ হই, হাসিমুখে প্রত্যুত্তরে হাত তুলি। এরপর লোকটি আমাদের টেবিলে এসে বসে, পরিচিত হই। কাউন্টার থেকে আরেকটি কাপ চেয়ে নিয়ে তাঁর সঙ্গে কফি ভাগ করে নেই। আমাদের গল্প জমে ওঠে। শিশুদের যেমন সময় লাগে না অন্য শিশুর সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতে, তেমনি বয়স্ক মানুষেরও সময় লাগে না অন্য বয়স্কের সঙ্গে গল্প জমিয়ে তুলতে। লোকটির কপালে একটি কাটা দাগ রয়েছে, চুলগুলো সোনালি আঁশের মতো, পোশাক খুব পরিপাটি, মুখাবয়বজুড়ে একটা শান্ত ভাব রয়েছে। আমরা ভেবেছি লোকটি আমাদের প্রজন্মের হবে। গল্পচ্ছলে জানতে পারি তাঁর বয়স সাতাশি বছর, দুই মাস পর উনি আটাশি হবেন। আমাদের থেকে উনি পঁচিশ বছরের বড়। তাঁর শারীরিক কাঠামো দেখে বুঝতেই পারিনি এত বয়স হয়েছে৷ তাঁর উজ্জ্বলতা, প্রাণচাঞ্চল্য আমাদের স্পর্শ করে।
জানতে চাই, এই প্রাণশক্তি ধরে রাখার রহস্য কী? উত্তরে তিনি বললেন, ‘মানসিক শান্তি।’ লিমা বলল, ‘এই অস্থির সময়ে মানসিক শান্তিতে থাকা তো কঠিন।’ তিনি বললেন, ‘খুব সহজ।’ আমরা সমস্বরে বলি, কীভাবে? তাঁর উত্তর ছিল, ‘যা মানসিক শান্তি বিনষ্ট করে তা এড়িয়ে যাওয়া, এবং নিয়মিত শরীর চর্চা করা। আর হ্যাঁ, মনোযোগটা শুধু নিজের দিকেই দিতে হবে। এতে নিজেও স্বস্তিতে থাকা যায়, পাশের মানুষকেও শান্তিতে রাখা যায়।’ লোকটির কথা বলার ভঙ্গিমা ছিল শিল্পের মতো। তাঁর মুখে কোনো বিষাদ নেই। আমরা তাঁর মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল চেয়ে থাকি, কিংবা নিজেদের জীবন ভেবে উদাস হয়ে পড়ি কিছু সময়ের জন্য। এদিকে ক্লান্তি আমাদের তাড়া করছিল। গোটা দিনের ধকলে দু’জনেই নেতিয়ে পড়েছি। আমাদের ক্লান্ত মুখ লোকটির আলাপ থামিয়ে দেয়, বুঝতে পারি। তাঁর কমনসেন্সও অনুকরণীয়। তাঁর জায়গায় বেশীরভাগ বাঙালিই গল্প চালিয়েই যেত। যা-ই হোক, তাঁর থেকে বিদায় নিয়ে আমরা গন্তব্যে পা চালাই। লিমা আমাকে বাসে তুলে দিয়ে ওর গাড়ির দিকে চলে যায়।
ঘরে ফিরে ফ্রেশ হয়ে সমুদ্রের গন্ধ মেখে, আর প্রকৃতি ও মানুষের ছায়া, মায়া, প্রেম শরীরে জড়িয়ে বিছানায় এলিয়ে দিই নিজেকে। জানালার পর্দা ভেদ করে চাঁদের আলো এসে খেলছে আমার সঙ্গে। পূর্ণিমার আলোতে আমার দুধ সাদা বিছানা ভিজে যাচ্ছে। থোকা থোকা জ্যোৎস্নার আলোতে শরীরের প্রতিটি খাঁজ ফুটে উঠেছে ফুলের ন্যায়। আমার সর্বাঙ্গে আনন্দ প্লাবিত হচ্ছে সমুদ্রের অথই ঢেউয়ের মতো। বাতাসে বিস্তীর্ণ বেলিফুলের ঘ্রাণ, প্রথম যৌবনের মতো শিহরিত হই। বহুদিন, মাস, বছর ধরে ক্ষয়ে যাওয়া শরীর, মন, পাখনা মেলে নিঃসীম আকাশের দিকে উড়তে শুরু করেছে, যেখানে শুধু আলো আর আলো। প্রায় মৃত মনে নতুন আলোর বন্যা বয়ে যায়। অসুখী মানুষের তালিকা থেকে নিজের নামটা সরিয়ে ফেলি। বড় নির্ভার লাগে। প্রবল ভালোলাগার আবেশে চোখজোড়া বুঁজে আসে।