মাঝরাতে ‘ওথেলো’র খোঁজে হাত বাড়াতেই সেলফের দরজা খুলে আবছা অবয়ব সামনে দাঁড়ায়। প্রায়ান্ধকার ঘরে ঘোর লাগে—কে? কে ওখানে? এত রাতে?
কথা শেষ হওয়ার আগেই কানে আসে—দাঁড়াও দাঁড়াও এত ভড়কে গেলে চিনবে কী করে?
আলো জ্বালতে হাত বাড়াতেই সামনের অবয়ব কেঁপে ওঠে।
—আলো জ্বালা খুব দরকার?
—আপনি কে তা জানা দরকার।
—আসলেই দেখতে পাচ্ছ না? ভালো করে তাকাও। আমি তোমার মধ্যেই আছি, মানে তোমার মগজের কোষে।
‘তোমার মধ্যে’? ‘মগজের কোষে’? এসব হেঁয়ালির মানে কী?
সত্যি বলতে, মানে খোঁজার সময় আমার নেই। কাল দশটা পঁয়তাল্লিশে ক্লাস।
গত কয়েকটা ক্লাসে শেক্সপিয়রের ওপর লেকচার দিচ্ছি। কালকের ক্লাসের থিম ‘ওথেলো’। ইংরেজি নাট্য সাহিত্যের অন্যতম ঔজ্জ্বল্যের এই নাটকের ওথেলো চরিত্রে অভিনয় করা যেকোনো অভিনেতার জন্য সর্বোচ্চ সম্মানের বলে মনে করেন নাট্য দুনিয়ার মানুষেরা। বিশেষ করে কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতাদের জন্য। কিন্তু লন্ডনের বিখ্যাত রয়্যাল শেক্সপিয়র কোম্পানির বিদগ্ধ ও মননশীল কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতা হিউ কোয়ার্শি কোনোদিন ওথেলো চরিত্রে অভিনয় করেননি। যদিও অ্যাংলো-আফ্রিকান অভিনেতা হিসেবে তিনিই প্রথম শেক্সপিয়রের মুখ্য সব ঐতিহাসিক চরিত্রে অভিনয় করেছেন। যা সাধারণত শ্বেতাঙ্গ অভিনেতাদের জন্য সংরক্ষিত থাকে। কেন তিনি ওথেলো চরিত্রে অভিনয় করেননি, তা বিশ্লেষণ করে ‘হেজিটেশনস অন ওথেলো’ নামে অসাধারণ এক বক্তৃতা দিয়েছিলেন, ‘রেইস অ্যান্ড ক্লাস ইন দ্য রেনেসাঁ’ নামের সেমিনারে। এতকাল ওথেলোকে যে দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হতো, তার বাইরে ভিন্ন এক দৃষ্টিভঙ্গির অবতারণা করেন কোয়ার্শি। ইন্টারনেট থেকে পুরো বক্তৃতাটা নামিয়েছি। লেকচারের ফোকাস থাকবে এটাই। রাত জেগে সে প্রস্তুতি নিচ্ছি। মূল টেক্সটে আরেকবার চোখ বোলাবো বলে সেল্ফের ওথেলোর দিকে হাত বাড়ানো।
আপনি স্ট্র্যাটফোর্ড আপন-এভনের একজন অর্ধশিক্ষিত মানুষ। যার পড়াশোনার দৌড় লোকাল গ্রামার স্কুলের চৌহদ্দি পর্যন্ত। মাফ করবেন, আবারও কিছু অপ্রিয় কথা বলে ফেললাম।
এমনিতে শেক্সপিয়র নামের রহস্যময় এ মানুষটির প্রতি আমার কৌতূহল সব সময়ের। সেই এলিজাবেথিয়ান যুগ থেকে শুরু করে আজ সাড়ে চার শ’বছর ধরে প্রায় সমান জনপ্রিয় একটি নাম—উইলিয়াম শেক্সপিয়র। অথচ তার জীবনের পুরোটাই রহস্যে মোড়া। যেসব বিখ্যাত নাটক ও কবিতা তার নামে প্রচলিত, সেগুলো কি আসলেই তার লেখা? এ বিষয়ে যেখানে যা পেয়েছি, পড়েছি—সন্দেহ ঘোচেনি। মগজের কোষে একটা ‘কিন্তু’ বাসা বেঁধে আছে সেই ছাত্রজীবন থেকে। মগজের কোষে! সামনে দাঁড়ানো আবছা অবয়ব এখনই তো বললো সে আছে আমার মধ্যে। আমার মগজের কোষে। তাহলে? ভালো করে দেখার চেষ্টা করি—কে আপনি!
—বুঝতে পারছ না?
—আপনি…মানে…আমি যাকে সন্দেহ করছি, আপনি কি তিনি? অন্ধকারে মৃদু হাসির শব্দ ছড়িয়ে পড়ে।
—এ সন্দেহ তোমার দীর্ঘদিনের সঙ্গী। আমার ছবি আছে তো তোমার কাছে, ভালো করে দেখে মিলিয়ে নাওনা।
—আপনার ছবি? ওটা কি সত্যিই আপনার ছবি?
—তোমার কী মনে হয়?
—আমার মনে হয় ও ছবি ক্রিস্টোফার মার্লোর। একটু এদিক-সেদিক করে আপনার নামে চালানো হয়েছে। কিছু মনে করবেন না, যা মনে হয়েছে, তাই বললাম। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মার্টিন ড্রোশাউটের খোদাই করা যে ছবিটি সাড়ে চার শ’ বছর ধরে আপনার প্রতিকৃতি বলে পরিচিত হয়ে আসছে, ড্রোশাউট তা মার্লোর ছবির অনুকরণে তৈরি করেছেন। একই ধাঁচের পোশাক, একই ভঙ্গিতে দু’হাত ভাঁজ করা।
—এতেই প্রমাণিত হলো এই ছবি আমার না?
—শুধু তাই নয়। মার্লোর চোখ, চুল, অভিব্যক্তি সব মিলিয়ে তাকে দেখলেই মনে হয় তিনি একজন সৃজনশীল মানুষ। আপনার নামে যে ছবি পরিচিত তার চোঁয়াড়ে ভাব মনে পড়িয়ে দেয়, আপনি স্ট্র্যাটফোর্ড আপন-এভনের একজন অর্ধশিক্ষিত মানুষ। যার পড়াশোনার দৌড় লোকাল গ্রামার স্কুলের চৌহদ্দি পর্যন্ত। মাফ করবেন, আবারও কিছু অপ্রিয় কথা বলে ফেললাম।
আসলে ইচ্ছে করেই খোঁচা দেই। যেন মুখ ফসকে হলেও সত্যি কথাটা বেরিয়ে আসে। কিন্তু উদ্দেশ্য সফল হয় না।
—মার্লোকে খুব পছন্দ করো?
—সেটা জানা এখানে জরুরি নয়।
—ও কত ধুরন্ধর ছিল জান?
—জানি। একজন মুচির ছেলে হয়ে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়া এবং রানির চোখে পড়া। এরপর সরকারের গুপ্তচর হিসেবে ফ্রান্সে যাওয়া। এসব কিছু করতে গিয়ে নানা ধরনের চাতুরি তিনি করেছেন। তবে এর মধ্যে ক্যারিশমা আছে। বুদ্ধির ঝিলিক আছে। সবচেয়ে বড় কথা মার্লো সম্পর্কে ঐতিহাসিক তথ্য আছে। তার জীবনী আছে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে আপনার সম্পর্কে তেমন কোনো ঐতিহাসিক তথ্য নেই। অথচ একই বছর একই দেশে আপনাদের দু’জনের জন্ম। স্ট্র্যাটফোর্ড-আপন-এভনের লোকজন ক্রিস্টোফার মার্লোকে চিনতো। কিন্তু আপনার মতো নিজ সময়ে এত খ্যাতিমান একজন নাট্যকার-কবি সম্পর্কে তেমন কিছু জানতো না—এটা কি অস্বাভাবিক নয়?
ষোলো শতকের শেষ দিকে লন্ডনে উইলিয়াম হল নামে একজন ব্যক্তি ছিলেন যিনি সরকারি কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন। খুলেই বলি, তিনি আসলে সরকারের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করতেন।
অন্ধকারে তার মুখ ভালো দেখা যাচ্ছে না। সেখানে কি অভিব্যক্তি ফুটেছে, তাও বোঝা যায় না। আগাগোড়া সত্যিই আমার মনে হয়েছে শেক্সপিয়রের নামে যেসব নাটক কবিতা এত বছর ধরে চলে আসছে, তা আসলে মার্লোর লেখা। সরকারি দায়িত্বে নিযুক্ত থাকা, গুপ্তচরবৃত্তি বা অন্য কোনো কারণে তার পক্ষে হয়তো নিজের নামে ওগুলো ছাপানো সম্ভব হয়নি। তিনি ‘শেক্সপিয়র’ ছদ্মনাম নিয়েছিলেন অথবা শেক্সপিয়র নামে কোনো একজনকে পাণ্ডুলিপিগুলো দিয়েছিলেন, যে নিজের নামে ওগুলো ছাপিয়ে দিয়েছে। আমার দু’জন ছাত্রও এ ব্যাপারে আমার সঙ্গে একমত। ওরা শেক্সপিয়র গবেষণার সর্বশেষ তথ্যের খবর রাখে। আমার এ বিশ্বাসের পেছনে আরও কারণ আছে। শেক্সপিয়র নাট্যকার হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পাওয়ার আগেই ‘ডক্টর ফস্টাস’ লিখে ক্রিস্টোফার মার্লো বিখ্যাত হয়েছেন। শয়তানের কাছে নিজের আত্মা বন্ধক রেখে নানা অবিচারে মেতে ওঠা ফস্টাস শেষ পর্যন্ত শয়তানের বীভৎসতার শিকার হন। শেক্সপিয়ারের ‘মেজর ফর মেজার’ ও ‘ট্রয়লাস অ্যান্ড ক্রেসিডা’ নাটক দুটিতেও এ ধরনের বীভৎসতার গন্ধ রয়েছে। আর ‘টাইটাস অ্যান্ড্রোনিকাস’-এর কাহিনি তো বীভৎসতম। এক নারীর ওপর প্রতিশোধ নিতে টাইটাস অ্যান্ড্রোনিকাস তার সন্তানদের হত্যা করে তাদের রক্ত ও হাড়গোড় সিদ্ধ করে পাই বানিয়ে হতভাগ্য ওই নারীকে খেতে বাধ্য করে। এ ধরনের কাহিনি নির্মাণ ক্রিস্টোফার মার্লোর চরিত্রের সঙ্গে বেশি মানানসই। তার চরিত্রে এক ধরনের আদিমতা ছিল।
এসবের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে অন্ধকারে আবার তার হাসির শব্দ ভেসে আসে।
—এতেই তোমার মনে হলো নাটকগুলো আমার নয়, মার্লোর লেখা?
—আরও অনেক কারণ আছে। সব বলতে গেলে রাত ভোর হয়ে যাবে। অত সময় নেই। শুধু দুয়েকটা কারণ বলছি। যেমন গ্রামার স্কুলের বাইরে আর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আপনার হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা তো দূরের কথা। যদ্দুর জানি স্ট্র্যাটফোর্ড-আপন-এভনের বাইরে আপনি লন্ডন শহর পর্যন্ত গিয়েছিলেন। দেশের সীমা পেরিয়ে অন্য কোনো দেশে গিয়েছিলেন বলে জানা যায় না। মার্লোরটা কিন্তু জানা যায়। এই বিদ্যা ও ভ্রমণের দৌড় নিয়ে আপনি কী করে ফ্রান্স, ইতালি, গ্রিসের মতো দেশের ঐতিহাসিক কাহিনি এত দক্ষভাবে নাটকের উপজীব্য করলেন? আইনের এত সূক্ষ্ম মারপ্যাঁচই বা জানলেন কী করে? আপনি এত বিখ্যাত একজন মানুষ কিন্তু আপনার সময়ের কোনো লেখালেখি, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র কোনো কিছুতেই আপনার সম্পর্কে কোনো উল্লেখ নেই। কেউ আপনার সম্পর্কে কিছু জানে না। আপনি দেখতে কেমন ছিলেন, সে বিষয়েও নিশ্চিত কিছু জানা যায় না। এমনকি আপনার স্বাক্ষরেরও ঠিক নেই। নিজের নাম লিখেছেন আট রকম বানানে। একেক জায়গায় একেক রকম বানান। এটা কী হতে পারে? একজন মানুষ—বিশেষ করে আপনার মতো বিখ্যাত মানুষ, নিজের নামের বানান বার বার ভুল করবেন! আর কত বলবো? আপনার কবরে কেন আপনার নামটা পর্যন্ত উল্লেখ নেই? সত্যি করে বলুন তো কবরটা কি আপনারই?
—কবর নিয়েও সন্দেহ?
—না করে উপায় আছে? যেসব কথা লিখে রেখেছেন—‘বন্ধু, এ কবরে যা আছে তা তুলো না। কবরের ওপর পাথরটি যেভাবে আছে সেভাবেই থাক। ওর ভেতর থেকে আমার হাড়গোড় নাড়াচাড়া কর না। যে তা করার চেষ্টা করবে তার ওপর অভিশাপ নেমে আসবে।’ জীবনে রহস্য, মরণেও রহস্য—এত রহস্যের কারণ কী? আসলে কে আপনি বলুন তো? দয়া করে রহস্যের কারণ বলুন।
আবার হাসি।
—তোমার তো সময় নেই।
—আপনি বলুন। আমি সব কাজ বাদ দেব। প্রয়োজনে কালকের ক্লাস পরে নেব।
এতদিনের রহস্যের কিনারা হওয়ার ক্ষীণ সম্ভাবনা দেখে ব্যাকুল হয়ে উঠি। কিন্ত কৌতুক মেশানো কণ্ঠে তিনি বলতে শুরু করেন,
সময় আসলে আমারও খুব কম। যাই হোক, কিছু আভাস তোমাকে দিচ্ছি। দেখো রহস্য উন্মোচনে দিশা পাও কি না। একটু খুঁজলে এসব তথ্য তুমিও পাবে। ষোলো শতকের শেষ দিকে লন্ডনে উইলিয়াম হল নামে একজন ব্যক্তি ছিলেন যিনি সরকারি কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন। খুলেই বলি, তিনি আসলে সরকারের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করতেন। উইলিয়াম হল আর উইলিয়াম শেক্সপিয়র দু’জনার নামে প্রথম অংশে মিল পাচ্ছ? অবশ্য এ ধরনের মিল থাকা সে সময় অস্বাভাবিক ছিল না। এটা একটা বিশেষ ঘটনা তাই মিলের বিষয়টা উল্লেখ করলাম। উইলিয়াম হল নিজের পরিচয় দিতো ডব্লিউএইচ নামে। আসলে এই ডব্লিউএইচ আরেক জনের সাংকেতিক নাম। যিনি ক্রিস্টোফার মার্লোর মতোই গুপ্তচর ছিলেন। পনেরো শ’ ষোলো সালে তাকে নেদারল্যান্ডসে পাঠানো হয়েছিল কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ বয়ে নেওয়ার জন্য। এর চার বছর পর তাকে পাঠানো হয় ডেনমার্কে। তুমি তো জানো, সে বছরের শেষ দিকে ডেনমার্কের পটভূমিতে বিখ্যাত নাটক ‘হ্যামলেট’ রচিত হয়। শেক্সপিয়রকে নিয়ে কল্পনায় তুমি অনেক যোগ বিয়োগ করেছ, পুরো একটা গোয়েন্দা প্রতিবেদনই প্রায় বানিয়ে ফেলেছ। এখন ভেবে দেখতে পারো ডব্লিউএইচ আসলে কার সাংকেতিক নাম ছিল। সে ডেনমার্কে যাওয়ার পর পরই ‘হ্যামলেট’ রচিত হওয়াটা নিছক কাকতাল কি না, ইত্যাদি ইত্যাদি। তুমি ভাবো আর কালকের ক্লাসের প্রস্ততি নাও। আমার যাওয়ার সময় হলো। গুড বাই।
হ্যামলেটের সেই ডায়ালগের কথা মনে নেই? ‘টু বি, অর নট টু বি, দ্যাট ইজ দ্য কোয়েশ্চেন’—তোমার মতো করে ইন্টারপ্রেট করে নাও। তোমার কল্পনাপ্রবণ মনের অসীম ক্ষমতা। বাই। গুড বাই।
আবছা অবয়ব দ্রুত সরে যাচ্ছে।
—শেক্সপিয়র…শুনুন। উইলিয়াম…উইলি…আপনি কি সত্যিই এসেছিলেন? মরিয়া হয়ে চিৎকার করি।
আবার হাসি।
—হ্যামলেটের সেই ডায়ালগের কথা মনে নেই? ‘টু বি, অর নট টু বি, দ্যাট ইজ দ্য কোয়েশ্চেন’—তোমার মতো করে ইন্টারপ্রেট করে নাও। তোমার কল্পনাপ্রবণ মনের অসীম ক্ষমতা। বাই। গুড বাই।
—উইলিয়াম, উইলিয়াম…।
হঠাৎ পিঠে মৃদু স্পর্শ।
—কী উইলিয়াম উইলিয়াম করছ? সারা রাত তো পড়ার টেবিলেই ঘুমোলে। এখন ওঠো।
স্ত্রীর অফিস আটটায়। আমাকে ডেকে দিয়ে তিনি বেরিয়ে গেলেন। এবার আমাকেও বেরোনার আয়োজন করতে হবে। দশটা পঁয়তাল্লিশে ক্লাস।