আগন মাসের চড়া রোদে এক হাতে লাঠিতে ভর, অন্যহাত কপালে ঠেকিয়ে ছানিপড়া চোখের ঝাপসা দৃষ্টিসীমানার আওতায় একজন পুরুষের অবয়ব নজরে আসে।
—কেডা রে ইলা হিগানো? কেডা ইলা? রাও করস না কেরে? মরার চোহেও দেহি না ভালা কইরা।
এক.
পুবের পুস্কুনির দহিণপাড়; আগাল-দিঘাল ফাটলটা অজগরের মতো বেঁকাত্যারা—যেন কাতলা মাছ হা করে আছে। জায়গায় জায়গায় মাটি দেবে পাড় ভেঙে জলখাপ ভেতরে ঢুকে গেছে। অবশ্য বাকি দুপাড়ের দশা একই। কেবল যে পাড়ে একসারি নাইরকোল গাছ, মাঝারি একটা তেঁতুই, একটা বিলেতি গাবগাছ আর গোসলের পিছলা ঘাটলা আছে—এর কিছুটা রক্ষা। শ বছরের পুরানা পুস্কুনি-নতুন করে ঝালিয়েছিল বেশ আগে। প্রমোদ কাকা আঙুলের কড়ইতে হিসাব করে বলে, বারোটা ভরা বাইশ্যার মৌসুম গিয়ে তেরোতম শুকনাতে পড়েছে এবছর।
এই মৌসুমে পাড় থেকে হাত দুই নিচে পানির লেয়ার। শীতের সময় পানি তলায় ঠেকে। বাইশ্যাকালে পাড়ে পানিতে সমান সমান থাকে। দহিণপাড়ে পাঁচমানুষ বেড়ের শিলকরুই গাছটার যে কয়টা শিকড় গোড়া থেকে পুস্কুনির পানিতে লুকিয়েছে, দূর থেকে সুলতানের আঁকা ক্যানভাসে মজুরের ফুলে ওঠা হাতের মতো দেখায়। কিছু বরাক বাঁশপাতি সমেত উপুড় হয়ে আড়াআড়িভাবে পুস্কুনিতে পরে আছে—গোড়ার মাটি আলগা। অনেকদিন থেকে থেকে পানির নিচের অংশে শ্যাওলা জমে বাঁশে-জিংলায়-খয়েরি পাতায় গুটিশামুক লেগে আছে ঝাঁকে ঝাঁক। বিহান না হতেই গেরস্তের একদল পাতিহাস প্যাঁক প্যাঁক করে ডানা ঝাপটায়ে হুড়মুড়িয়ে পানিতে নামে। মাথা ডুবিয়ে চর-চর আওয়াজ তোলে সারাদিন। আধার খায়।
পাড় লাগোয়া গোরস্তান। পুরান কবরের নিশানা এখনো কিছু কিছু মেলে—তবে বেশিরভাগ নিশ্চিহ্ন। নতুন করে সংস্কার হচ্ছে পুবদিকটা। বাকিটায় বাঁশঝাড়। ঝাড়ে অগুনতি কানিবগার বাসা। বাঁশের মাথায় ওরা দল বেঁধে আলস্যে সময় কাটায়। পাখা ঝাঁপটায়। উঁকিঝুঁকি মারে। ভিতরে ঘন জঙ্গল-পিসলাই, নেমুইন্দা আর আঁকন গাছে ঠাসা। তিলাডুফি-টুনটুনি-দইগল-অইলদাপক্ষী-মাইচ্ছ্যারাঙা-বাগডাইয়াসহ নানা কিসিমের পক্ষীর বাস এই পাড়ে। শিলকরুইয়ের মাথার চিকন ডালে বসা বাজের প্রখর চাহনি পুস্কুনির পানিতে। বাতাসে পাতিডাল দোল খায় তবু কী অব্যর্থ নিশানায় খপ করে মাছ ঠোঁটে নিয়ে উড়াল দেয়!
সাপ্তাহিক হাটবারের দুপুরঅক্ত। পক্ষীশিকারি নিঃশব্দে গোরস্তানে প্রবেশ করে। একফালি উপুড় করা চালকুমড়ার আদলে তৈরি-পিঞ্জিরাই বলা যায়-যা সাইকেলের পুরান ধাসা আর বাঁশচাঁছা বেত সমন্বয়ে বানানো মাঝের অংশটা সবুজ পিসলাই আর নিমুইন্দা পাতায় এমনভাবে ঢেকে দেওয়া যে, ভেতরে কী আছে দেখা দুষ্কর-সে রকম একটা ডুফি (ঘুঘু) মারার ফানের তলায় চিকন নিরেট কঞ্চিটা গেঁথে জংলি তিলাডুফির বিরহ ডাক লক্ষ করে সন্তর্পণে সামনে এগিয়ে যায়। ওপরে ওঠাতে গিয়ে প্রথম কঞ্চিটা শেষ হলে তার নিচে আরেকটা কঞ্চি জুড়ে দিয়ে আরও ওপর দিকে ঠেলতে থাকলে পিঞ্জিরায় বন্দি ডুফিডা ডানা ঝাঁপটায়ে অনর্গল ডাকতে থাকে টুট্টুরেএএএ-টুউউউট-টু টুট্টুরেএএএ-টুউউউট-টু। জংলিটাও পাল্টা ডাক দেয়। পিসলাই গাছের ডালের ফাঁক গলিয়ে দুই/তিনটা আড়াআড়ি বাঁশের ওপর পিঞ্জিরা আটকে রেখে—নিঃশব্দে শিকারি পেছনে সরে যেতে থাকে। বাঁশে বাঁশে ঘষা লেগে কের্ররর কের্ররর আওয়াজ তোলে। বাঁশের শুকনা খোড়ল (খোলস) পায়ের তলায় পরে মচর মচর শব্দে শিকারি সতর্ক হয়।
দুশ গজ দুরের কাঁচা রাস্তা দিয়ে বাজারি একজন দুজন করে হাটে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে বেলা পরে আসলে লোকজনের যাতায়াত বাড়বে। কড়ইয়ের পাতিডালের কচি পাতাগুলায় যখন মাদাইন্না সূর্যের তেরছা আলো পরে বাদামি ঠেকবে তখন হাট জমে উঠবে। বাজারিদের মাথায় করে বয়ে নেওয়া খলইয়ের ভেতর থেকে শাকসবজি লেজ বের করে জানান দিবে-এই যে পালং-বউত্তা-নাইল্যাশাক কিংবা কচুরডুগা! কারও কাঁধে খলই ভর্তি কচিলাউ-মিডাকুমড়া, কোনোটায় চুক্কাবাইগোন কিংবা হোয়া-খিরাই। আবার কোনোটায় মূলা-শালগম। এসব গেরস্তের টুকিটাকি কৃষিজ ফসল। বর্গা বা নিজেদের একটু আধটু চারাবিছরায় প্রয়োজন মিটিয়ে অতিরিক্ত যা কিছু ফলায়-হাটবারে বিকোয়, ঘরে দুচার পয়সা বাড়তি আয়। একটু সচ্ছলতা যদি আসে প্রাত্যহিক জীবনে-এতেই মেলা খুশি এরা।
গোরস্তানের পইশ্মের কিনারে সিন্দূইরা আমগাছটা আধমরা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গোড়া থেকে হাত খানেক দূরে ধূসর-সবুজ হেউলা পরা দেয়াল ভাঙা কবরটার ঠিক পাশ থেকে শব্দের যে উৎপত্তি—তা হারু মিয়ার কানে ঢুকে বেশ দুর্বল থেকে দুর্বল হয়ে। তবু শিকারীর কান-একটু বেশিই সতর্ক।
—কেডা রে ইলা হিগানো? কেডা ইলা? রাও করস না কেরে? মরার চোহেও দেহি না ভালা কইরা।
প্রশ্নকর্তার গলার আওয়াজের সঙ্গে শিকারি হারু মিয়া পরিচিত-জবাব না পাওয়া পর্যন্ত থামবে না।
—আমি গো জি, আমি। হারু মিয়া।
—অ তুই নি, আমি আরও বাবতাসিলাম আমডার মনা না কিতা?
মনা মানে মনফুর উল্লাহ। এই গাঁয়ের সবাই জানে কবর-বাঁশঝাড়-পুস্কুনির পাড়ে পাড়ে রাত-বিরেতে, উদানে-মাদানে ঘুরে বেড়ায় যে মানুষটা, সে মনফুর উল্লাহ। বয়স ধরা কঠিন, তবে পঞ্চান্ন থেকে ষাটের মধ্যে। অবয়ব যেন মৃণাল হকের হাতে রবীন্দ্রনাথের মূর্তি। দাড়ি-গোঁফে, ঘাড়ে-গর্দনে একসারা। মুক্তিযুদ্ধ দেখেছে স্বচক্ষে। কোন কিছু তিনবার জিজ্ঞেস করার পর জবাব মেলে। কখনো মেলে না। মনফুর উল্লাহ মর্জি। গায়ের মুরব্বি মরমালি হেকিম রসায়ে রসায়ে কয়, সংগ্রামের সময় যে জোরে জোরে গুলাগুলির আওয়াজ অইসিলো এইহানো, এতে মনফুর উল্লাহর কানে যে তব্দা লাগসিলো, ওই রেশ এহনো কাডে নাই।
হারু মিয়ার ভুরুতে বিরক্তি—দিলো তো শিহারটা মাডি কইরা!
জংলিডার ডাক থেমে গেছে। মানুষের আউঅট (আওয়াজ) পেলেই বন্দি ডুফিটাও সতর্ক হয়ে ওঠে। আর ডাকে না। ডুফি শিকারের আসল হইলো এই ডাক। ফান্দে বন্দিডুফির ডাকে জংলি ডুফি আকৃষ্ট হয়। যেন বিরহীর কষ্টে ছুটে আসে দুরন্ত প্রেমিক-প্রেমিকা। ফান্দের দুপাশে বারান্দা এমনভাবে তৈয়ার-যেদিকেই বসুক না কেন সুতার একটু টান লাগলেই ওপর থেকে জালিটা এতটাই দ্রুত নেমে আসে যে, পালানোর সুযোগ থাকে না। অতঃপর বন্দিত্বের ছটফটানি।
দুই.
এ অঞ্চলের সবাই বুড়িকে একনামে চেনে—কাছনি বুড়ি। কারও জি, কারও বুবু। বয়স পঁচাশির ওপর। গায়ের রঙ-দোআঁশ মাটির মতো। ছিপছিপা শক্ত গড়ন। উঁচায় মাঝারি। এখন কিছুটা নুইয়ে চলে। তবে হাঁটে হনহন করে। বয়স বাড়লেও চটাং চটাং কথার ধার একটুও কমে নাই। খালি পায়ে চলাফেরা করে—চটিজুতা না পরা বাতিক। এমন না যে নাই। তবে ফেরেকুচিৎ (কদাচিৎ) দেখা যায় ক্ষয় হয়ে চুম্বকের মতো পায়ের পাতার সঙ্গে লেগে থাকা নিল ফিতার রূপসা স্যান্ডেল। চুল সব পাকা। একরঙা চিকন পাড়ের ফিনফিনা শাড়ি গোড়ালির ওপর থেকে এক প্যাঁচে বুক ঢেকে ঘাড়ের পাশ দিয়ে পিঠে ঝোলানো থাকে। গরমে এটুকুই আব্রু। মাঝে মাঝে বয়েল কাপড়ের ব্লাউজ পরে। শীতে অবশ্য ভিন্নতা হয়। নিজের গরজে শীতকাপড় চাপায়।
দিন শুরু দুমুইক্কা ফাহালের মুখে বাঁশের চোঙা ঠেকিয়ে দুগাল ভরে ফুঁ দিতে দিতে। আগুন চেতায়। ঝাপসা চোখে শুকনা, আধা শুকনা বন বা নেড়া মুঠি ধরে ঠেলে দেয় পাহালের মুখে আর আগুন দমকায়ে ওঠে। লক্লইক্কা আগুন।
তে-তিরিশ ভিডার লম্বা বাড়িটায় ঢুকলেই যে কেউ দেখতে পাবে পুবের পুস্কুনির পশ্চিম পাড়ঘেঁষা টিনের বেড়া দেওয়া ঘরের আশপাশে ঘুরঘুর করছে কিংবা উত্তর পাড় থেকে ঢুকে যাওয়া বাড়ির লাম্বাপথে এমাথা থেকে ওমাথায় হাঁটতে থাকা অবস্থায় কারো উঠানে টুক করে ঢুকে পড়ছে একজন বুড়ি। সম্পর্কে নাতি-নাতকল আর বউ-ঝিদের সঙ্গে আলাপ করতে করতে কখন যে দুপুর গড়িয়ে যায় টেরই পায় না। বাড়ির উত্তরখণ্ডে ঢুকতেই খবর পায় মাইজান মিয়ার বড় ফুরির বিয়া। সুবরবাড়া, মেন্দি পরানো, কাঁচা হলুদ বাটা দিয়া কনেকে গোসল করানো, শ কালের ঐতিহ্য বিয়ার গীত-এসব আয়োজনের ফুসুরফাসুর চলে মাসখানেক আগে থেকে। কাছনিবুড়িকে উঠানে ঢুকতে দেখেই কে যেন বলে উঠে—গীতের আসর মাত করইন্না ঐ তো আমডার বুবু আইয়া ফরসে।
—জটলার দিকে আগায়ে যায় লাঠিতে ভর করে। ঠক ঠক শব্দ ওঠে। মাইজানের ছোট ফুরি একটা বেতের মোড়া ঠেলে দিতে দিতে-মোড়াডাত বও বুবু।
—তুমি অহন কিতা আগের লাগান গীত গাইতায় ফারবায় নি, জানতে চাইলে আশি বছরের কাছনিবুড়ির চোখটা চক চক করে ওঠে। খুশির ঠেলায়-আনন্দে-আমোদে। কাঁপা গলায় উত্তর দেয়, ফারুম লো ফারুম।
ফরমান বাড়ি নেই। নিজের বাড়িতেও নিয়ে যেতে পারবে না কারণ বড় ছেলে সুখনালি জানতে পারলে হারু মিয়াকে কিছু না বলুক, মাকে শাস্তি পেতে হবে নিশ্চিত। ফরমান ভালো মানুষ। কিন্তু ভাইয়ের হিংস্রতার কাছে চিরকালটা মিইয়ে কাটিয়ে আসছে। প্রতিবাদ করতে গিয়ে সেও কি কম মার খেয়েছে? শেষ পর্যন্ত তো বাড়ি থেকেই বের করে দিল। আর বুড়িকে এভাবে রেখে যে চলে যাবে-তাও কি হয়? সংকট চারদিক ঘেরা।
স্বাধীনতার আরও কুড়ি বছর আগে তো হবেই, যেদিন বৌ হয়ে এসেছিল এই বাড়িতে-তখন নিতান্ত কিশোরী। বছর ঘুরতেই পোয়াতি-অতঃপর কোলে সন্তান। একজন মরেও মোট ছয়জনের জননী সে। কত সোবরবারার বিকাল সে একাই মাত করেছে এই সব ছাওয়াল-পাওয়াল তা কি জানে?
—কিতা ভাবতাস বুবু?
—না না বইন। কুস্তা না। একটা বড় দেইক্কা ফান দেসাইন দেহি। হাদা-খয়ার দিস বেসতি, মুহ দিয়া বাইত যাই।
তিন.
সিন্দূইরা আম গাছের গোড়াতে দাঁড়াতেই বন্দি পাখিটার ডানা ঝাপটানি শুনতে পেয়েছিল কাছনিবুড়ি। আহা সে কি ছটফটানি! বন্দিত্বের দশা তার বড় চেনা। কখনো ঘরবন্দি, কখনো বাইর। কাছনিবুড়ি পাগলের মত হাঁসফাঁস করতে থাকে। কী এক অসহ্য কষ্টে তার বুক মোচড়ে ওঠে। দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে মাটিতে বসে পড়ে। অতীত বড় নির্দয়।
—চুদানির জি আবার দেমাগ দেহাস। আজগা তর ফিডের চামডা না তুইল্যা আমি অফিস যাইতাম না। শালির গরের শালি।
—দেখলেন দেখলেন, কত বড় সাহস? আমি নাকি ভাত দেই না, যত্ন-আত্তি করি না। মাইন্সের বাড়িতে বাড়িতে যাইয়া বদনাম করে আমার নামে।—বড় ছেলের বৌ গলা কাঁপায়ে নালিশ জানায়। আর সপাৎ সপাৎ করে মুইট্যা হুরুনের বাড়ি পরতে থাকে পিঠে। কাছনিবুড়ি মাটিতে লুটায়। বিলাপ করে।
—এর লাইগ্যাই তরে ফেডে দরসিলাম ফুত? ছিনাল বেডির কতায় তুই আমারে মারতাসত!
—বদনাম করস কেরে? খাওন দেই না আমি?
—ও ফুত। আর করতাম না। আর যাইতাম না কেউর বাইত। মারিসনা আমারে, আল্লার দোয়াই লাগে তর।
এলোপাথাড়ি বারি থামে না। চার বছরের নাতনিটা এই দেখে মজা পায়। বারান্দা থেকে আর একটা উঠান পরিষ্কারের মুইট্যা হুরুইন আগায়ে দেয় বাপেরে। এইবার বুড়ি উল্টা গালাগাল দিতে থাকে।
—তর বুহে ঠাডা ফরব। আল্লাহ মাফ করত না তরারে। তুই বুড়া অইতে না? তর ফোলাফানেও তরে এমনেই কষ্ট দিব।
—আর একদিন যুদি আমার কানে আয়, দম ছাড়াইলামু কইয়া দিলাম।
হাতে ব্যথা উঠলে গালাগাল দিতে দিতে বুড়িকে উত্তরের ভিটের মাটির ঘরে ঢুকায়ে বাইরে থেকে দরজায় শিকল টেনে দেয়।
বড় অসহায় লাগে তার। চোখের সামনে ভেসে উঠে নিজের মানুষটার মরা মুখ। মুখ কি আর মুখ আছিল? চামড়া ঝলসে গেছিল। সাতচল্লিশ বছর আগের সেই ক্ষত অনেকটা শুকিয়ে গেছে। কিন্তু আত্মজের কাছ থেকে এই যে পাওয়া-এ কি মিটবে আখেরেও?
চার.
একটা চাপা গোঙানি ভেসে আসছে বাতাসে। হারু মিয়া কান খারা করে। সে আগায়ে যায় ভাঙ্গা কবরটার দিকে। কাছনিবুড়ি মাটিতে বসে আছে। এক হাত গাছে ঠেকিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করছে। লাঠি ধরা হাতটা ঠক ঠক করে কাঁপছে। হারু মিয়া কী করবে বুঝতে পারে না। মাটি ফুড়ে জিনের মত মনফুর উল্লাহ উদয় হয়। জানে যেন তার পানি ধরে। ফরমান বাড়ি নেই। নিজের বাড়িতেও নিয়ে যেতে পারবে না কারণ বড় ছেলে সুখনালি জানতে পারলে হারু মিয়াকে কিছু না বলুক, মাকে শাস্তি পেতে হবে নিশ্চিত। ফরমান ভালো মানুষ। কিন্তু ভাইয়ের হিংস্রতার কাছে চিরকালটা মিইয়ে কাটিয়ে আসছে। প্রতিবাদ করতে গিয়ে সেও কি কম মার খেয়েছে? শেষ পর্যন্ত তো বাড়ি থেকেই বের করে দিল। আর বুড়িকে এভাবে রেখে যে চলে যাবে-তাও কি হয়? সংকট চারদিক ঘেরা।
যেখানে ওরা আছে এর ঠিক পইশ্মে একটা ছোট ডোবা। হাতে ৩৫ বাই চল্লিশের কার্নিশ হবে বড়জোর। ডোবার পইশ্মের পাড় ঘেঁষে লম্বা উঠান। চারদিক খোলা। দহিণের ভিডায় রফরমানের দুচালা টিনের ঘর। পাকা ইটের গাঁথুনি। আস্তর পরেনি এখনো। দৌড়ে ফরমানের উঠানের চাপকল থেকে মনফুর উল্লাহ লোটায় করে পানি এনে ঝামটা দিলে কাছনিবুড়ি স্বাভাবিক হয়।
—জি, তুমারে বাইত দিয়া আমু না কিতা? এহলা এহলা থাকতায় ফারবায়নি গরে, না কিতা ওই বাড়িত দিয়া আমু? ফরমান আইতে আইতে ত রাইত অইয়া যাইব গা।
—না না বাজান, ঐ বাড়িত যাইতাম না। আমারে গরই দিয়া আয়। থাকতাম ফারুম। ফারলে ফরমানরে একটা সংবাদ দিস বাপ।
ঘরে পৌঁছায়ে ফিরে আসার সময় হঠাৎ হারু মিয়ার হাতটা ধরে কাছনিবুড়ি।
—হারু, একটা কতা কইতাম চাইসলাম?
—কী কতা কইবা, কও জি।
—ফাইক্যা শিহার না কল্লে হয় না বাজান? বন্দি পাইখ্যার যে কী কষ্ট!
হারু মিয়া থমকে যায় কাছনিবুড়ির কথা শুনে-মুখে রা সরে না। জি, অহন ইকটু গুমাই থাহ-বলে দরজাটা বাইরে থেকে টেনে দিয়ে উঠানে নামে ওরা।
ফান্দে বন্দি তিলাডুফিডা যখন উড়ায়ে দেয় হারু মিয়া, অনেকদিন উড়তে না পারা পাখিটা দুই-একবার মাটিতে ধপ করে আছাড় খায়। আবার ওড়ায়। চারবারের মাথায় আস্তে করে উড়ে গিয়ে বসে ছোট্ট নেমুইন্দা ডালে। পরপর তিনটা ডাক দেয়। এইবারের ডাক ভিন্ন। হারু মিয়া বুঝতে পারে এ শিকার ধরার ডাক না, এ মুক্তির ডাক।
সন্ধ্যা উতরেছে ততক্ষণে। বাইরে মোষের চামড়ার মতো আন্ধার। বাজারি মানুষদের কথাবার্তা-চলার শব্দ ক্রমেই কমে আসছে। কাছনিবুড়ি দেখে, চাটাই ছেড়ে মানুষটা চেয়ারে বসে দিব্যি মিটমিট হাসছে। এই যাত্রায় বোধহয় তাকে নিতে এসেছে। মানুষটা হাত বাড়ায়ে দিলে বহু ঘাত প্রতিঘাতের সাক্ষী কাছনিবুড়ি ডুফি হয়ে শুন্যে উড়াল দেয়। তার ঘুম আর কাটে না।