শিশুটির এই জন্মটাই ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত। তাই পৃথিবী তাকে সহজ ভাবে মেনে নিতে পারেনি। পৃথিবীর এ বিমাতাসুলভ মনোভাব পদে পদে তাকে বাধাগ্রস্ত করেছে।
শিশুটির মা সুফিয়া তেরো বছর বয়সে অপ্রত্যাশিতভাবে জননী হলো। বিষয়টা যে পুতুল খেলা নয়, তা হাড়ে হাড়ে টের পেলো সুফিয়া। এই অনাকাঙ্ক্ষিত শিশুটি যখন তার স্তনে বেঁচে থাকার অবলম্বন খোঁজে, লজ্জায় সে কুটি কুটি হয়ে যায়।
বিছানায় তোষোকের ভাঁজে রাজার লাল কনডমের প্যাকেট দেখে অনাকাঙ্ক্ষিত শিশুটি যখন জিজ্ঞেস করে, ওইটা কী? সুফিয়ার মায়ামাখা কালো মুখে লাল মাড়ি বের করে শিশুটির দিকে তাকিয়ে হাসে। কনডম তখন অনাকাঙ্ক্ষিত শিশুটির কাছে একটা রঙিন স্বপ্ন, একটা অচেনা আনন্দ, অনভিজ্ঞ কল্পনার ঘোর। ও তখনো বোঝে না সুন্দরেরও রয়েছে জীবনবিনাশী শক্তি। আবার অনাকাঙ্ক্ষিত শিশুটি যখন দেখে, কার্নিশের সিক্ত বুকে ফুটে থাকা গাঢ় নীল ফুল দুপুরের হাওয়ায় হাওয়ায় দুলছে, তখন ওটা মন দিয়ে ছুঁতে শরীরে স্পর্শ চাই সে। তাই জানালার গরাদে দিয়ে উরু পর্যন্ত পা গলিয়ে দেয় উন্মুক্ত আকাশে। আর পায়ের তালুর নিচ দিয়ে চলে যায় রিকশা, সাইকেল, মোটরগাড়ি আর কিছু মানুষ। সোনাগাছির বিমল ঘোষের দোকানের রসগোল্লা, সকালের ঠাণ্ডা লুচি পা তার ছুঁয়ে দেবে যেন একটু হলেই। তবু সে গাঢ় নীল ফুল ছুঁতে পারে না। সুফিয়ার পা দুখানা তখন বাংলাদেশের মাটি খোঁজে ভাত ঘুমের অপেক্ষায় শুয়ে থাকতে থাকতে।
সাদা বোরকা পরা চাঁদের বুড়ি অনাকাঙ্ক্ষিত শিশুটিকে কোলে নিতে চাইলে সে ভয় পায়। তার ভয় দেখে ফোকলা বুড়ি ফকফকিয়ে হাসে—মা সুফিয়াও হাসে। তবে তার দলে কি কেউ নেই? সে শুধুই একা! তাই তো সে মাকেও বলতে পারে না, রাবার ব্যান্ড আর আলপিন দেওয়ার বিনিময়ে মঞ্জু তাকে ফ্রক খুলতে বলেছিল। অথবা মায়ের ঘরের অতিথি বন্ধুরা সুযোগ পেলেই তার খোলা শরীরে কী সব খুঁজে ফেরে। ইত্যাদি এমন সব কথা। শিশুটি প্রতিদিন এভাবে বিস্ময়ের সঙ্গে একা বাস করতে করতে অপেক্ষা করতে থাকে এক অজানা পরিণতির।
তার অনেক পরের কথা।
একদিন মা সুফিয়ার জরায়ু ছিঁড়ে অনাকাঙ্ক্ষিত আরেকবার বেরিয়ে আসে একার ভুবনে। এবার মাতা সুফিয়া প্রচণ্ড কষ্ট পায়। ব্যথার সঙ্গে রক্তক্ষরণ হয় দীর্ঘদিন। তা যাই হোক, নিজের দুখানা ডানা পেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত সে এক ধরনের তৃপ্তি বোধ করে। সে উড়তে থাকে, উড়তে থাকে—নিজের দেশের খোঁজে। এখন প্রশ্ন হলো সে কি দেশ খুঁজে পাবে? না ক্লান্ত হয়ে বসে পড়বে অচেনা কোনে বৃক্ষের ডালে? অথবা ফিরে আসবে মায়ের ঘরে?