শালিখচূড়া গ্রামটির কথা প্রথম শুনেছিল বিভূতিবাবুর মুখে। ফর্শা, গোলগাল চেহারা। চকচক করছে মাথার টাক। হাতে সিকো-৫ ঘড়ি। একঘণ্টা পর পর প্যান্টের পকেট থেকে নস্যির কৌটা বের করে এক চিমটি নাকে গ্রহণ করে। নস্যির কিছু অংশ মোটা গোঁফের মধ্যে লেগে থাকে। পরিস্কার করে না। মাঝে মাঝে নাক ঝাড়ে। তাতে করেই আশপাশ তটস্থ। তারপর বিভূতিবাবু এই অঞ্চলের সবার প্রয়োজন। জাপানি ইয়ানমার সেলো মেশিনের একমাত্র এক্সপার্ট। ইরি মৌসুমে বিভূতিবাবুর জয়জয়কার। বিয়ে করেছিল বিন্দুবালাকে। শালিখচূড়ার যোগেন পোদ্দারের বড় মেয়ে। ক্লাস এইট পর্যন্ত লেখাপড়া। তরুণী, গানের গলা মিষ্টি। বিভূতিবাবু মজে গেলেন। তারপর অনেক হাঙ্গামা করে, বিন্দুবালাকে অনেক টাকা দিয়ে ঘরে তুলে আনে। না! প্রথম থেকেই বিন্দুবালার সঙ্গে বনিবনা হয়নি। বিভূতিবাবুর শরীরে সব সময় তেল-পেট্রোলের গন্ধ। নস্যির ঝামেলা তো আছেই। নাচগান পাগল মেয়ে বিন্দুবালার মন উচাটন। টেকেনি।
বিন্দুবালা-বিভূতিবাবু উভয়ই চেষ্টা করেছে। হয়তো টিকে যেত। যদি অভাগা বিভূতিবাবুর সংসারে কেউ থাকতো। বাব-মা গত হয়েছেন স্বাধীনতার যুদ্ধের আগে। জ্ঞাতিরা একে একে বীরভূমে চলে গেছে। বিভূতিবাবু ইন্ডিয়াতে যায়নি। থেকে গেছে। প্রসার ভালো। যাবে কেন? বিভূতিবাবুর ধারণা, ইন্ডিয়াতে কেউ তাকে চিনবে না। আর এখানে প্রতিদিন মুদিওয়ালার সঙ্গে দেখা হয়। পকেটে অর্থকড়ি না থাকলেও সমস্যা নেই। কিন্তু ওই বিদেশে না খেয়ে থাকবে নাকি? বিভূতিবাবু খেটে খাওয়া মানুষ। কাঁচাপয়সার আনাগোনা আছে! পেট পুরে খায় ও টাকা জমায়। তাই উল্টো পণ দিয়ে বিন্দুবালাকে বিয়ে করেছে আবেগতাড়িত হয়েই। কিন্তু ওই যে মেলেনি।
বিভূতিবাবুর কাঁচাপয়সার প্রতি লোভ করেনি বিন্দুবালা। বিভূতিবাবুর সময় কোথায়? সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত কর্মে বিচরণ। নিঃসঙ্গ বাড়িতে বিন্দুবালা দিনের পর দিন রাতের পর রাত একাকী থেকেছে। এভাবে থাকতে থাকতে বিবাহিত আড়াই বছর যাপন করে।
বিন্দুবালা যাত্রাদলে নাম লিখিয়েছে। ধনঞ্জয় অপেরার সেকেন্ড হিরোইন। ওর যে মায়াবী কণ্ঠ আর বাঁকা চাউনি। প্রথম হিরোইন হতে এক মৌসুম লাগবে। বিভূতিবাবু প্রথমে হতভম্ব। এতদিন বিন্দুবালা ছিল, এখন তো একেবারে শূন্য। খা খা বাড়ি ছেড়ে সদরে এসেছে। নামি টেকনিশিয়ান। অর্ধশিক্ষিত বিভূতিবাবু নিজেকে তৈরি করেছে। তার সমস্যা হয়নি। ফুরফুরে জীবনযাপন করে। শুধু হঠাৎ হঠাৎ বিন্দুবালা প্রেমকাঁটার মতো বিঁধতে থাকে। তাই ভাবে, বিন্দুবালার খসম হিসেবে বিভূতিবাবুকে পছন্দ ছিল না। ওই রকম বেঁটো মানুষের পাশে বিন্দুবালা মারাত্মক বেমানান। বাঙালি সাধারণ নারীর তুলনায় ওর সব কিছুতেই ছিল নারীর ঐকান্তিক সৌন্দর্য। যা মায়াময়, অনন্ত তৃষ্ণার। ষোল বছরের বালিকা বিন্দুবালা বিভূতিবাবুর কোনো কিছুর সঙ্গে মানায় না। তারপরও এতগুলো দিন বিন্দুবালার সঙ্গে বসবাস। তাও কম কি? এতো এতো মানুষের মধ্যে তারটা ব্যতিক্রম নিয়তি!
বিভূতিবাবু আত্মবিশ্লেষণে পরাজিত। তাই তার বিন্দুবালার কথা মনে পড়ে। তবে ভাবে না। নারীরা চলে গেলে ফিরে আসে না। ওই কৈবর্তপাড়ায় পলানের মেয়ে দীপালি আরেকজনের জামাই নিয়ে ভেগে গেছে। বিভূতিবাবুর ভাগ্য ভালো বিন্দুবালা ডিভোর্স দিয়েছে। খুন করেনি।
সেই শালিখচূড়ায় বিন্দুবালার কথা মনে হলো। আরে বিভূতিবাবু বলেছিল, শালিখচূড়ায় বিন্দুবালা থাকে। ওর সংবাদ নেবেন।
তারপর মনে হলো, জায়গাটার নাম শালিখচ‚ড়া হলো কেন? আশপাশে কোথাও হয়তো শালিখের চ‚ড়া আছে। শালিখের আবার চ‚ড়া কী? জানা গেল, উত্তর পাশে পাহাড় আর বিলের মাঝখানের উঁচু ঢিঁপিটায় এক সময় প্রচুর শালিখ বসতো। রাজ্যের শালিখদের ওড়াউড়ি, আর কলরবে মুখর থাকতো। তারপর বহু বছরের ব্যবধানে ওই ঢিঁপিতে মোবাইল কোম্পানির টাওয়ার বসেছে। বিল জুড়ে হাইব্রিড মৎস্য প্রকল্প। এলাকাময় বৈদ্যুতিক বাতির বাহারি উপস্থিতি। শালিখচ‚ড়ায় দুএকটা করে গড়ে উঠছে টেক্সটাইল ইমারত। বিলের পাশ দিয়ে ইট বিছানো পথ। ভ্যান-রিকশা চলাচল করে। প্লট কিনেছে কেউ কেউ। সীমানার খুঁটিতে ঝুলছে সাইনবোর্ড। ভ্যান দিয়েও খালপার পর্যন্ত যেতে হবে। খাল পার হয়ে শালিখচূড়ার শেষ প্রান্তে যোগেন পোদ্দারের বাড়ি। ওই বাড়িতে এখন বিন্দুবালা থাকে।
বিভূতিবাবু বিন্দুবালার সংবাদ নিতে বলেছে। খাল পার হলেই দেখা যায় সামনে বিস্তৃত বিল। দূরান্তে টঙ্গীর বড় বড় ইমারত। শান্ত, বিলের বুকে রোদের ঝিলিক, মাছদের মাতামাতি, দিগন্তের এ ছবি নিয়ে শালিখচূড়ায় বিন্দুবালা থাকে। যোগেন পোদ্দার শ্রীমতি বিন্দুবালার জন্যই পরিচিত। খুঁজে পেতে অসুবিধে হয়নি। বিন্দুবালা স্বনামধন্য যাত্রাশিল্পী। অনেকবার পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। কত কাগজে যে ছবি ছাপা হয়েছে! সে শালিখচূড়ার মেয়ে।
ঠাকুর ঘরের উঠোনে দেখা হলো বিন্দুবালার কিশোর ভাই অনিরুদ্ধ পোদ্দারের সঙ্গে। পরিচয় দিয়ে বলতে হলো, আমি সত্যগঞ্জ থেকে এসেছি। শ্রীমতি বিন্দুবালা দেবীর সঙ্গে দেখা করব।
অনিরুদ্ধ উঠোন থেকে ঘরে গিয়ে মাঝবয়সী যোগেন পোদ্ধারকে নিয়ে উঠোনে এলো। আমি প্রণয় রোজারিও সত্যগঞ্জ থেকে এসেছি। শ্রীমতি বিন্দুবালার সঙ্গে দেখা করব। বিভূতিবাবু তার সংবাদ নিতে বলেছে।
বিন্দুবালার বাবা ভীষণ অবাক হয়। এতোদিন পর! হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে আসে। দাওয়ায় জলচৌকির উপর বসতে বলে। বড় ঘরের বারান্দায় পেরিয়ে যোগেনবাবু সামনের রুমটায় ঢুকে যায়। কিছুক্ষণ পর ফিরে বলল, আপনি বিশ্রাম নিন।
ইতোমধ্যে অনিরুদ্ধ এক ঘটি জল দিয়ে যায়। নাড়–, সন্দেশ নিয়ে আসে যোগেনবাবু।
বিন্দুবালার মুখোমুখি হয়ে কিছুটা নার্ভাস প্রণয় রোজারিও। বিভূতিবাবু কী এই বিন্দুবালার কথা বলেছে? খাটে শুয়ে আছে বিন্দুবালা। সারা ঘরে বিচিত্র মেডেল, আর পুরস্কার ট্রপি। দরোজায় সিদ্ধিদাতা গণেশের ছবি। মাথার পাশে যাত্রাসম্রাট অমলেন্দু বিশ্বাস-এর তৈলচিত্র। বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে শুয়ে আছে বিন্দুবালা।
সত্যগঞ্জ থেকে এসেছি। বিভূতিবাবু আপনার সংবাদ নিতে বলেলে, প্রণয় রোজারিও বলে।
বিন্দুবালা কতক্ষণ মিটমিট করে তাকায়। তারপর ঘরের কড়িকাঠের দিকে চোখ ফিরিতে নেয়।
আমি প্রণয় রোজারিও। বিভূতিবাবু আমার বন্ধুর মতোন। সে আমার খুব আপনজন। প্রণয় রোজারিও বিন্দুবালার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
বাবু কেমন আছেন?
ভালো।
ওরা পরস্পরের দিকে তাকায়। প্রণয় রোজারিও খুব অবাক হয়। হায়! বিভূতিবাবুর বউ এত রূপবতী। যাত্রার মেয়েরা কী এরকম হয়!
বিভূতিবাবু আপনার কথা বলেন।
বিন্দুবালা কথা বলে না।
যাত্রামঞ্চে নাচতে গিয়ে এসিডদগ্ধ হয়ে উরু থেকে পায়ের এক অংশ ঝলসে গেছে। উন্মাদ ভক্তের ফাঁসি হয়েছে। এ সংবাদ জানে।
আপনি নাকি অসাধারণ অভিনয় করেছেন, সীতার বনবাসে। বিভূতিবাবু আপনার সীতার বনবাস বারবার দেখেছেন। গদগদ করে বলে যাচ্ছে প্রণয় রোজারিও।
আর দেখবে না। মৌনকণ্ঠে বলে বিন্দুবালা।
ও কিছুক্ষণ শব্দহীন থাকে।
বারবার বিন্দুবালার সঙ্গে বিভূতিবাবুকে মেলাতে চায়। পারে না। বিন্দুবালা বিভূতিবাবুর মতো সাধারণ না। অসাধারণ। ওরকম শান্ত সৌম্য চেহারা প্রণয় রোজারিও দেখেনি। তাই বারবার সবকিছু গুলিয়ে ফেলছে।
আপনি কি আর কখনও মঞ্চে উঠবেন না? প্রণয় রোজারিও প্রশ্ন করে।
বিন্দুবালা ছল ছল চোখে বলে, না।
বিভূতিবাবুর মুখে আপনার সীতার বনবাস-এর গল্প শুনে শুনে আমারও ইচ্ছে হয়েছে, পালাটা আমি দেখবো। আপনাকে দেখার পর মনে হলো, পালাটা আমি বিভূতিবাবুর মতো মমতা নিয়ে দেখব।
বিন্দুবালা কোনো কথা বলে না। মৌন, স্থবির। শুধু চোখ দুটো পিট পিট করছে।
আপনার কি কিছু বলার আছে? প্রণয় রোজারিও প্রশ্ন করে।
বাবু কি আমাকে অভিশাপ দিয়েছিল?
বিন্দুবালা জল খায়।
মনে হয় না। সমর্থ থাকা সত্ত্বেও সংসার করল না। তার ধারণা বিন্দুর মতো মেয়ে কই?
মনে রেখেছে?
হয়তো।
এ সময় শাঁখের ঘণ্টা বাজছে। আর কতক্ষণ পর অন্ধকার নিয়ে রাত নামবে। পোদ্দার বাড়ি জুড়ে নিস্তব্ধতা।
প্রণয় রোজারিও বলল, দিদি, আমি চলে যাচ্ছি। আজই সত্যগঞ্জে ফিরে যাবো।
বিন্দুবালা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, বাবুকে বংশ রাখতে বলবেন।
আবার শালিখচূড়ার রাস্তায় নেমে এলো প্রণয় রোজারিও। খাল পার হয়ে টাওয়ার পেরিয়ে শালিখচূড়া ছেড়ে চলে যাচ্ছে প্রণয় রোজারিও। ওর মনে হলো, বিভূতি বাবুকে বলা যাবে, বিন্দুবালার সংবাদ পেয়েছি।