হাইওয়ের রোড লাইটগুলো সব একসঙ্গে নিয়ে যাওয়ার পর সূর্যটা একটু দ্বিধায় পড়ে যায়—উঁকি দেবে কি দেবে না। কয়েকদিন ভ্যাপসা গরমের পর এই ভোরে দলে দলে কালো মেঘ ঘন গভীর জমাট বেঁধে পুরো আকাশ ঢেকে দিয়েছে। আফাজউদ্দিনের বিড়িতে শেষ টান দেওয়া ধোঁয়ার কুণ্ডলী পুব আকাশের দ্বিধাগ্রস্ত আলোর সঙ্গে মিশে যেতে থাকে কঠিন বাতাসের ধাক্কায়। কাছে-পিঠে কোথাও বৃষ্টি হয়েছে। বাতাসে লেগে আছে তার শীতল স্পর্শ। আফাজউদ্দিনের বুকভাঙা কাশির সঙ্গে নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে উঠে আসে একদলা কফ। কাছেই থুঃ করে ফেলে দেওয়া কফের দলায় ছাঁকড়া ছাঁকড়া রক্ত লুকাতে পারে না দ্বিধাযুক্ত ভোরের আলো।
আছিয়া লীলাদের ছাপড়ার পর্দা সরিয়ে বাইরে আসে। আছিয়ার শব্দ পেয়ে দ্রুত দুহাতে মাটি খুঁড়ে আফাজউদ্দিন। কফের দলাটা ঢেকে দিতে চায়। আছিয়া ছাপড়ার কোণায় রাখা বদনাটা হাতে নিতে নিতে গলা খেঁকড়ি দিয়ে উঠে, লুকান লাগব না। মরণ রোগে ধরছে, কত্ত কই, বয়স অইছে, বিড়িডা ছাড়েন, যদি দুইডা বছর বেশি বাঁচেন! চাপকল চেপে বদনা ভরে বেড়ার টাট্টিতে ঢুকে পড়ে আছিয়া। সারা ডেরায় গোটা বিশেক ছাপড়া আর তাতে শ’খানেক নারী, পুরুষ, শিশু। প্রাকৃতিক কাজ সারার জন্য এই একটাই টাট্টি। মানব বসতির প্রমাণ। নইলে আর বাকি যা কিছু, ক্ষুণ্নিবৃত্তি কিংবা জৈবিকতা জীবনের ধারাবাহিকতার অন্য প্রাণীর টিকে থাকার সঙ্গে খুব একটা পার্থক্য নেই।
কিছুক্ষণের মধ্যেই লম্বা লাইন পড়ে যাবে টাট্টির সামনে। আছিয়া প্রতিদিন সবার আগে কাজ সেরে তৈরি হয়ে যায়। শহরতলীর হাইওয়ের পাশে এরা ডেরা বেঁধেছে মাস ছয়। মাইল দশেক দূরত্বের শহরের অলিগলি সব চেনা আছিয়ার। স্বামী আফাজউদ্দিনেরও। এর আগেও বেশ কয়বার এসেছে এখানে।
আফাজউদ্দিন দলের সর্দার। তার পেছনে পেছনে চলে এই একশজনের দলটি। ছ’মাস একবছরের বেশি কোথাও থাকে না তারা। রক্তে যেন বাইরে বেরিয়ে পড়ার বেপরোয়া ডাক। কোথাও তিষ্ঠাতে ভালো লাগে না। এছাড়া আগের মতো আয়-রোজগারও নেই। তাদের ঝাড়-ফুঁককে আর মানুষ খুব ভরসা করে না। অল্পদিনেই বেকার হয়ে পড়ে মেয়েগুলো, কাস্টমার জোটে না। পুরুষগুলোর অবস্থা আরও খারাপ। আনাচে-কানাচে বিজলি বাতি, পিচ করা রাস্তা। সাপের বংশ নির্বংশ। দলের পুরুষগুলোর উত্তরাধিকারে প্রাপ্ত জীবিকা প্রায় বিলুপ্ত। কেউ আর সাপ ধরতে ডাকে না। এরা কেউ রিকশা চালায়, কেউ ট্রাকের ড্রাইভিং শেখে। কেউ বেকার বসে তাস পেটাতে পেটাতে কী করা যায়, তাই ভাবে। দুবেলা খাবারের জন্য পুরুষদের ভাবনা নেই। বউগুলো যা আনে হয়ে যায়। কিন্তু বিড়ি-সিগারেট, দেশি মদ পুরুষ হিসেবে যৎসামান্য শখ আহ্লাদ তো অস্বীকার করতে পারে না। এর জন্য বউদের কাছে হাত পাতলে তারা এখন লাঠি দিয়ে তেড়ে আসে। শালা এনজিও না কি। কত্তগুলো মহিলা পালা করে আসে আর বউগুলোরে কানমন্ত্র দেয়। বাচ্চগুলোরে স্কুলে নিয়ে যায়। রাতে সোহাগ করতে গেলে চূড়ান্ত মুহূর্তে বউগুলো হাতে কনডম ধরিয়ে দেয়। শালা আরামটাই শেষ।
নিজের ছাপড়ায় ঢুকে ঝোলাটা আবার পরখ করে নেয় আছিয়া। একটা মানুষের ফিবুলা। গাজীপুর কবরস্থান থেকে জোগাড় করেছিল আছিয়া। একটা বড় শামুক, একটা ঝিনুক। কোনো এক নদীর পাড়ে কুড়িয়ে পাওয়া। নানা জাতের কমদামি বাম-মলমের কয়েকটা কৌটো, একটা আয়না। তুলার বান্ডিল, কয়েকটা শলাকা। সব ঠিকঠাক আছে। তবু একবার পরখ করে নেয়।
ততক্ষণে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে আফাজউদ্দিন। মুখে পাউডার, ঠোঁটে লিপস্টিক আর চোখে কাজল বুলিয়ে চুরি আর মালার গাছা হাতে নেয় আছিয়া। কানে ঝেখালানো কয়েক জোড়া দুল, চোখের পাতা, ভ্রূ, হাতের নখের মতোই অঙ্গ হয়ে লেগে আছে যেন জন্ম থেকেই, খুলতে হয় না। শাড়িটা প্যাঁচ দিতে দিতে ভাবে, এসবে আর ধরে না তাকে। ভাটির দিকে বয়স আর জীবনের লড়াইয়ের তীব্র ছাপ যে চোখ আর গাল থুতুনির ভাঁজে ভাঁজে, ঝুলে পড়া স্তনবৃন্ত—তাকে কি আর এসব সস্তা সাজে ঢাকা যায়? ব্লাউজের ভেতর লুকানো মলিন নোংরা ব্রাটিকে টেনেটুনে আরও শক্ত করে বাঁধে আছিয়া। যদি বুক দুটো আরও খানিক উঁচু দেখায়। যতই চেষ্টা করুক, এই উঠতি বয়সের মেয়েগুলোর সঙ্গে কি পেরে ওঠে? লীলা, কামিনী, অজুফা বয়স বিশের ঘর পেরোয়নি একটারও। জজ কোর্টের সামনে হরেক রোগের দাওয়াই মেলে সবাই বসে থাকে ঠিক, কোর্টফিরতি মানুষগুলোর গোপন অসুখের দাওয়াই এই সাজানো পসরায় নয়। লীলা, কামিনী, অজুফাদের ঢলঢলে যৌবনেই। এর টানেই মেয়েগুলোর কাছে নানা রোগের বাহানায় পুরুষগুলো যায়। কাছে গাঘেঁষে বসে। অকারণে মেয়েগুলোর গায়ে হাত দেয়। মেয়েগুলোও দুই-চার টাকা বেশি বাগানোর আশায় ঢলতে ঢলতে এলিয়ে পড়ে। পথচলতি মানুষগুলোর কাছে দৃষ্টিকটু লাগলে তাদের কী? দুয়েকজন বিশ্বাস থেকেও যে আসে না, তা নয়। নইলে আছিয়ার মতো বিগত যৌবনারা কী করতো! কচি মেয়েগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লাভ কী, মূল পূঁজিটাই তাদের উঠতি যৌবন। আর এ সত্য তা লাস্যময়ী মেয়েগুলো যেমন জানে, প্রৌঢ়া আছিয়াও জানে। আরও জানে বাকি সবই জারিজুরি।
অদ্ভুতভাবে নাক ডাকছে আফিজউদ্দিন। বুকটা ওঠা-নামা করছে হাফরের মতো। লোকটাকে দ্রুত ডাক্তার দেখানো দরকার। মেয়েকে সে বলেছে বারকয়েক। পাশেই বেঘোরে ঘুমাচ্ছে মেয়ে সাবিত্রী। সারারাত জাগে বাপ-বেটি। বাপ ছাউনির বাইরে আর মেয়ে ভেতরে। সকাল সকাল বের হতে হয় বলে আছিয়া অন্যের ছাউনিতে ঘুমাতে যায়। নতুন নাগর জুটেছে সাবিত্রীর। জুটুক। বাঁচতে মাটি নেই, মরতে মাটি নেই তাদের। আগে ছিল ঘাট থেকে ঘাট। এখন জলহীন দেশে নগর থেকে নগরে পতিত জমি। যেখানেই থাকুক এই আলগা নাগরের উৎপাত রোদ বৃষ্টির মতো অবশ্যম্ভাবী। সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই। এখানেও ডেরালাগোয়া গাড়ির গ্যারেজ, দিন-রাত নেই, টায়ারে বাতাস ভরা, বদলানো। এটা সেটা পার্টসের জন্য বাস, ট্রাক ড্রাইভারদের লাইন লেগেই থাকে। যে কেউ যখন তখন ছাপড়ায় ঢুকে গেলে মুখ বুঝে সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই। বাধা দিতে গেলেই হৈ-হল্লা, লাঠালাঠি। পরদিন এলাকাবাসীর মান সম্মানের স্বার্থে এলাকা ছেড়ে আবার বেদুঈন জীবন। আগে থেকে জায়গা ঠিক না থাকলে এই বাচ্চা-কাচ্চা আর জোয়ান নারী দলে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরা যে কি মুশকিল! কয়েকবার এমন মাশুল দিয়ে এখন মুখ বুঝে সহ্য করে যায়।
তবে এই নাগর বেশ টাকা পয়সা দেয়। দিনভর কোর্টের বারান্দায় বসে যা রোজগার হয়, তার চেয়ে বেশিই দেয় বলে সাবিত্রী আর কাজে যেতে চায় না আছিয়ার সঙ্গে। আছিয়াও জোর করে না। কাল বলে রেখে ছিল মেয়েকে, বাপকে ডাক্তার দেখানোর কথা বলে নাগরের কাছ থেকে টাকা কিছু বেশি রাখতে। রেখেছে কি না কে জানে। এখন ঘুম থেকে জাগালে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠবে মেয়ে, রূপটা যেমন ভদ্রলোকের, মেজাজটাও তেমনি। এখন ঘুমাক, বরং বিকালে ফিরে যা করার করবে।
লীলা কামিনীদের সঙ্গে হাইওয়েতে উঠে যেতে যেতে দেখে দুটি কমবয়সী ছেলে মেয়ে হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলতে বলতে ঢুকছে ডেরার ভেতরে। হয় সাংবাদিক, নয় এনজিও। হোক যা কিছু। এখন ফিরে জিজ্ঞেস করার সময় নেই। আছিয়া জানে, যতই নির্ঘুম কাটুক না রাত, যতই দমবন্ধ করা কাশিতে ধুঁকতে থাকুক আফাজউদ্দিন, এরা ঢুকেই সর্দারকে খুঁজবে। আর আফাজউদ্দিন হাঁফাতে হাঁফাতে শুরু করবে সেই পুরানকালের গফ, কোনদিন কোন এমপির বাড়িতে দুইটি সাপ ধরেছিল বাচ্চা-কাচ্চাসহ, কোনদিন কোন ম্যাজিস্ট্রেটের কোয়ার্টারে, কোনদিন কোন ডিসির বাংলোয়, বলতে থাকবে আর প্রতিটা গফের সঙ্গে বারকয়েক তাদের জানাবে—তারা তাকে একনামে চেনে। আফাজউদ্দিন সর্দার বললেই হয়। বৃদ্ধ অকর্মণ্য হয়ে যাওয়া মানুষ বাস্তবতার রুক্ষ চামড়া ঢেকে রাখতে চায় যৌবনের দুঃসাহসের স্মৃতি দিয়ে।
বাস থেকে নামতে নামতে দূর থেকে বাড়ন্ত ভিড়টা দেখা যায়। দিন আজ চড়ে গেছে অনেকখানি। কোর্টে ভিড় জমার আগে আগে জায়গা নিতে না পারলে নানা কিসিমের সমস্যা দেখা দেয়।
আজ অনেক বাচ্চা জমায়েত হয়েছে মাঠে। বোধকরি র্যালি-টেলি বের হবে। এই বাচ্চা-কাচ্চাদের র্যালির জমায়েতের কারণে কোনো কোনোদিন পুলিশ এসে বেধড়ক পেটাতে থাকে। শালা কত রকমের যে র্যালি, বারো মাসে চব্বিশটা। প্রচণ্ড গরমে ভদ্রলোকের বাচ্চাদের টসটসে গালে রক্ত জমাট বাঁধতে থাকে লাল হয়ে। আছিয়ার মায়া হয় এদের দেখলে।
কিন্তু লোকটা যেখানে গাড়ি থেকে নেমেছে, সেখানে ফকফকা আলো। মোটেই তাকে চিনতে কষ্ট হয় না আছিয়ার। কেবল ভুঁড়িটা বেড়েছে বেঢপ…
বড় প্রবেশ গেটটার পাশে খালি মাঠের ঘাসের ওপর জায়গাটা সবচেয়ে নিরাপদ। স্যারদের গাড়ি ঢুকতে বের হতেও অসুবিধা হয় না, র্যালি বের হতেও অসুবিধা হয় না। সেখানে পুরান বাজারে ডেরা বাঁধা বেদুঈন মেয়েগুলো আজ আগেই সুবিধামতো জায়গা নিয়ে নিয়েছে। আছিয়াদের আজ বসতে হবে পেছনে। কাস্টমার আসবে কম। কিন্তু কী কপাল আজ! চাটাই বিছিয়ে বসতে না বসতেই বোরকা পরা এক মহিলা এগিয়ে আসে আছিয়ার দিকে। মেঘ না চাইতেই জল। মহিলাটি হাঁটু গেড়ে পাশে বসামাত্রই আছিয়া তার বোরকার বাইরে বের হয়ে থাকা একগাছা চুল একটানে ছিঁড়ে নেয়। মহিলা ভ্যাবাচ্যাকা খেতেও ভুলে যায় আকস্মিকতায়। ঝোলা থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে তাতে চুলগুলো মুড়িয়ে হাতে দিয়ে বলে, ঘরে-বাইরে শত্রু তর। আল্লাহ-রসুল-পীরের নামে শনি মঙ্গলবার মিলাদ পড়াইয়া চুলগুলো গেঁথে দিবি পাঁচ হাত মাটির নিচে, পশ্চিম দিকে। মহিলার চোখে মুখে নেমে আসা গভীর বিশ্বাসের ছায়া দেখে মনে মনে আনন্দ হয় আছিয়ার। শোন, আমারে দিতে কই নাই, আল্লা-রাসুলের নামে দিতে কইছি। মহিলার অশিক্ষিত দৃষ্টিতে আরও গভীর হয় বিশ্বাসের ছায়া। আছিয়া জানে এ এক অব্যর্থ দাওয়াই। ঘরে-বাইরে শত্রু বললে ঘায়েল হয় না, এমন মানুষ সে একজনও পায়নি এ পর্যন্ত। মানুষ যে কী এমন মহামূল্যবান ভাবে নিজেকে, সর্বদা শত্রু পরিবেষ্টিত হয়ে থাকার সুখে জীবন কাটায়, কল্পিত শত্রুর ঘাড়ে নিজের সব ব্যর্থতা আর অপ্রাপ্তির দায় চাপিয়ে বাঁচার উপলক্ষ খোঁজে।
দাঁতের পোকা খুলতে এসেছে মহিলা। মন্ত্র পড়ে ফুঁ দিয়ে তুলা দিয়ে দাঁত চেপে ধরে। বের করে দেখায় পোকা কিলবিল করছে। কালো কালো পোকা। বিষ বেদনা আজ থেকে শেষ। বেশি না বিনিময়ে মাত্র একশত টাকা দাবি করে আছিয়া। শত্রু নিধনের পরামর্শ তো বিনামূল্যেই আগে দিয়েছে। এটুকু পোকা খোলার পারিশ্রমিক। আশি টাকায় রফা হয়। বেলা দুপুর গড়ানোর আগে শ’তিনেক টাকা জমে তার হাতে। অন্য যেকোনো দিনের চেয়ে বেশি। আজ পূর্বপুরুষদের দোয়া ভর করছে নিশ্চিত।
দুপুরে তখন পুরো কোর্ট পাড়া ধীরে ধীরে ঝিমাতে থাকে, থামতে থাকে ব্যস্ত মানুষদের ত্রস্ত দৌড়, তখন ঝোলাটা গুটিয়ে গেটের বাইরে ফুটপতে চা আর কেক নিয়ে বসে আছিয়া। সাবিত্রীর নাগর জোটার পর থেকে সকাল বেলা আর কিছু খেয়ে বের হওয়া হয় না। আগে নিজে ঝোলা গোছাতে গোছাতে মেয়ে বাসি ভাত হোক কিংবা গরম ভাত হোক মেলামাইনের থালায় লবণ-মরিচ দিয়ে তৈরি করে দিতো। কেকের টুকরায় কামড় দিতে দিতে ডিভাইডার পার হয়ে উল্টামুখী ওয়ানওয়ে রাস্তার পাড়ে মনোরম লেকটার দিকে তাকায় আছিয়া। পাতা বাহারের গাছের ফাঁকে ফাঁকে সিমেন্টের তৈরি বেঞ্চ। আছিয়া বেগমের মনে পড়ে বছর পঁচিশ আগেই এই লেকটা ছিল প্রমত্তা পূর্ণযৌবনা নদী। তার নিজের বয়সও তখন পঁচিশেরই ধারে কাছে। নদীতে নদীতে নৌকা বহর নিয়ে ঘুরে বেড়াতো পুরো দল। চোখের সামনে নদীগুলো সব শুকিয়ে খাঁ খাঁ। পরের মাটিতে অস্থায়ী আবাস ছাড়া এখন আর কোনো গতি নেই। মালিকানাহীন জলে আর ভেসে থাকা যায় না। এক এলাকার মাটি থেকে অন্য এলাকার মাটিতে ছাউনি বাঁধা। অস্থায়ী উদ্বাস্তু জীবন। পলিথিনে মোড়া নৌকার ছইয়ের মতোই অস্থায়ী একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই। পার্থক্য শুধু এখানে খুঁটিটা মাটিতে গাঁথা। প্রায় বছর পনের হতে চললো জলের সঙ্গে আর যোগাযোগ নেই।
সামনের এই আপাত নিরীহ লেকটি যখন প্রমত্তা নদী ছিল তখন একবার মাস ছয়েক ছিল সেখানে। সহস্র ঘাটের স্মৃতি ছাপিয়ে এই ঘাটের স্মৃতিটাই জ্বলজ্বলে আছিয়ার মনে। সারাদেশে তখন শেখের বেটির অসহযোগ আন্দোলন, কী জানি বলতো মিছিলে! নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার। এতদিন পর মনেও নেই ঠিক ঠাক। কেবল মনে আছে এই রাস্তা ঘাট, কোর্ট প্রাঙ্গণ—সব খাঁ খাঁ করতো। তখনই লোকটা দিনে এখানে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শুনতো। আর রাতে নেশায় চুর হয়ে নৌকায় ঢুকতো। পর পর কয়েকটা রাত কাটিয়ে লোকটা একটা স্বর্ণের চেইন হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল আছিয়ার। মাস নয়েক পরে অন্য ঘাটে মেয়েটা জন্ম নিলে আছিয়া দেখে নাক, মুখ চোখ তো বটেই, গায়ের রঙটা পর্যন্ত ওই লোকটার। লোকটা এই শহরের সবচেয়ে বড় স্বর্ণ ব্যবসায়ী। মেয়ের নাম যখন সাবিত্রী রাখে তখনো কম হৈ-চৈ করেনি ডেরার সবাই। আফাজউদ্দিনের মেয়ের নাম সাবিত্রী। এ কেমন কথা! হিন্দু নাম! মুখ খোলেনি আছিয়া। একটা কিছুতে তো লোকটার স্মৃতি থাক। এছাড়া বহরের আবার ধর্ম কী। ঈদের দিনে যেমন মুরগি জবাই করে তেমনি পূজার দিনে মণ্ডপে পাত পেতে খিচুড়ি খায়। এই নামধাম এসব তো চলার পথের বৃহত্তর মানুষের সংস্কৃতি। কখন কিভাবে সঙ্গ নিয়েছে ওরা নিজেরাও জানে না।
সন্ধ্যা সন্ধ্যায় ডেরায় ফিরে আছিয়া নিজের ছাউনিতে ঢুকে দেখে আফাজউদ্দিন তখনো শুয়ে। কপালে হাত দিয়ে দেখে গায়ে তীব্র জ্বর। জ্বরের ঘোরে উল্টা-পাল্টা বকছে আফাজউদ্দিন। এই রাতে কোথায় ডাক্তার দেখায়, কী ওষুধ খাওয়ায়—বিভ্রান্তি লাগে আছিয়ার। সাবিত্রীকে ডাকতে ডাকতে বাইরে আসে সে। সাবিত্রী কল তলায় বসে ওয়াক ওয়াক করছে। অভিজ্ঞ দৃষ্টিতে এ লক্ষণ স্পষ্টই চিনতে পারে আছিয়া। সাবিত্রীকে সে বিয়ে দিয়েছিল। গাজীপুরে ঘর মাটিঅলা পাত্র দেখে। সাবিত্রীর রূপ দেখে লোকটা নিজেই আগ্রহ করে ঘরে নিয়েছিল। খুশি হয়েছিল আছিয়া। গার্হস্থ্য লোকের রক্ত শেষ পর্যন্ত গার্হস্থ্য ঠিকানাই পেলো। সুখেই জীবন কাটাতে পারত মেয়েটা। কিন্তু ওই যে আধা রক্তে বেদুইন টান, ঠিক ঘর ছেড়ে ছেলে একটা কোলে নিয়ে বাপের বহরের সঙ্গ নিয়েছে। আর ফিরে যায়নি।
বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, যেকোনো মুহূর্তে তুমুল রূপ নেবে। ঘরে খাবার কিছু নেই। সারাদিন কিছুই রাঁধেনি সাবিত্রী। আপাতত আফাজউদ্দিনের চিন্তাটা দূরে সরিয়ে বাইরের চুলায় পাতা জ্বালিয়ে ভাতের হাড়ি চাপায় আছিয়া। বাতাসের তোড়ে পাতার আগুন হাড়ির নিচ ছেড়ে ডাইনে বায়ে লাফায়। চুলার ভেতরে একটা গাছের ডাল দিয়ে চেপে চুপে উতলা আগুনকে সামলাতে সামলাতে আছিয়া গলা উঁচিয়ে জানতে চায় সাবিত্রীর কাছে, শেষ মাসিক কবে হইছিলি। সাবিত্রী অন্ধকারে বসে পা নাচায় আর নির্বিকার জবাব দেয়, মনে নাই। পাশে বসা ছেলেটার নাকের সিকনি শাড়ির আচল দিয়ে মুছে নেয়। ভাতের হাড়ি নিয়ে ছাউনিতে ঢুকতে ঢুকতে মেয়েকে ফিসফিসিয়ে বলে, আজ নাগর আইলে খালাসের টাকা আদায় করবি।
হ, একদিন বাপের ডাক্তার ওষুধের টাকা, আরেকদিন খালাসের টাকা—ব্যাটা বড় ঠেকছে। বাপের ডাক্তার ওষুধ। আছিয়া থামে। আফাজউদ্দিনকে আজ ডাক্তার দেখানো হয়েছে। জানে না সে। কী কইছে ডাক্তার? ওষুধ কই। সাবিত্রী আঙুলের ইশারায় ডেরায় প্রবেশ মুখ দেখায়—ওই যে।
লাল রঙের গাড়ি থেকে নেমে লোকটা ওষুধের পোটলা নিয়ে এদিক-ওদিক ডাকে সাবিত্রীকে। সাবিত্রী দৌড়ে আগায়। হাইওয়েতে জ্বলে ওঠা রোডলাইটের আলোতে আলোছায়ায় মাখামাখি। সাবিত্রী তার জন্যই বসেছিল বাইরে। লোকটার চোখে পড়েনি। সম্ভবত ওষুধের পোটলাই হবে, সাবিত্রীর হাতে দিতে দিতে বিড়বিড়িয়ে কী বলে হাত বিশেক দূরত্বে ছাউনির সামনে দাঁড়িয়ে কিছু শুনতে পায় না আছিয়া। কিন্তু লোকটা যেখানে গাড়ি থেকে নেমেছে, সেখানে ফকফকা আলো। মোটেই তাকে চিনতে কষ্ট হয় না আছিয়ার। কেবল ভুঁড়িটা বেড়েছে বেঢপ, আর মাথার ঝাকড়া চুল উধাও হয়ে জায়গা করে নিয়েছে বয়সের টাক। নইলে সেই নাক, সেই মুখ, চোয়াল আর দুধে আলতা রঙ।