সারাদিনই মাথার মধ্যে লেখালেখি-বিষয়ক পরিকল্পনা ঘুরপাক খায়। অজস্র লেখার প্লট মাথায় নিয়েই রোজ ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে রাজ্যের গল্প বলি। রিকশাঅলাকে রাজা হওয়ার গল্প শোনাই। বাসার সামনের চা-বিক্রেতাকে বিল গেটসের গল্প বলি। সুন্দরীদের শোনাই সানি লিওনের গল্প। মাঝে-মাঝে বিশৃঙ্খল জীবনের রুমমেট ধাক্কা দিয়ে আমার সেই গল্পের ব্যাঘাত ঘটায়। তবু একটু-আধটু লিখতে পারার ধাক্কা এভাবেই সামলাতে হয়।
কখনো কখনো লিখি। কখনো কখনো লিখে আবার নিজ হাতে কেটে ফেলি। মনে মনে ভাবি,এসব কিচ্ছু হয়নি। আবার লিখি; তা-ও মনঃপুত হয় না। ভাবতে ভাবতে সময় চলে যায়। লেখাটা আর গল্প হয়ে ওঠে না। শুধু একটি মনের মতো গল্প লেখার জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা চালাই। লিখে পত্রিকায় পাঠাই—ছাপা হয়, আবার হয় না। ফলে নিজের ব্যর্থতায় নিজেকেই অপদার্থ বলে তিরস্কার করি। সাফল্যের মুখ আর দেখি না। সেই দুই-একটা পত্রিকায় যা প্রকাশিত হয়,সেগুলোর অনলাইন সংস্করণের লিঙ্কসহ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেই। ফেসবুক বন্ধুদের ইনবক্সে লিঙ্ক দিয়ে অভিমত জানার আশায় উন্মুখ হয়ে থাকি। যার বেশির ভাগ উত্তর—মন্দ নয়, ওয়াও, অসাম, দারুণ, সুন্দর, ভালো, চালিয়ে যাও প্রভৃতি। এতে তেমন অনুপ্রেরণা আসে না। কোথায় যেন একটা শূন্যতা বিরাজ করে।
সে যাই হোক, এতেই মোটামুটি লেখক মহলে একটা সুনামের সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। বইমেলায় প্রকাশিত এক বইতে ফেসবুকে ফ্রেন্ডস-ফলোয়ারের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। আমিও লিখতে চাই, আমিও বই বের করতে চাই, বই বের করতে কী কী লাগে, কত টাকা দিয়ে বই করা যায়— এরকম পরামর্শ চেয়ে ভক্ত-অনুরাগীরা আমাকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিতে পরিণত করেন। মনে মনে পুলক অনুভব করি। কিছু হচ্ছে তাহলে—এই ভেবে লেখা-পড়ার গতি আরও বাড়িয়ে দেই।
সেদিন ছিল সাপ্তাহিক ছুটি। অলস দুপুরে ভাতঘুমের আগে একটা বই পড়ছিলাম। আমার দৃষ্টিতে চমৎকার প্রবন্ধ। যদিও প্রবন্ধে কোনো রস নেই। তাই নিরস বদনেই শব্দের পর শব্দ পার হয়ে যাচ্ছি। বইটির নাম ‘সমালোচকের দায়’। ‘সমালোচকের দায়’ কেন পড়ছি? নিজেই আবিষ্কার করি, আর কিছু না পারি সমালোচনাটা ভালো করতে পারি। সবার ভালো-মন্দ খুঁজে বেড়ানো আর কি! বলতে পারেন এক ধরনের ছিদ্রান্বেষণ। এছাড়া সাহিত্যের সমালোচনা হজম করার ক্ষমতা অর্জন করা। আমার এক পরিচিত কবি জাহিদ সোহাগকে অনেক খেসারত দিতে হয়েছে। শুধু সমালোচনার দায়ে। বেচারা এখন আর কারও সমালোচনা করেন না। বলতে পারেন সমালোচনা সাহিত্য থেকে অবসর নিয়ে দিব্যি মজার মজার কবিতা লিখে যাচ্ছেন। তো সেই বইটা পড়তে পড়তে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
হঠাৎ খেয়াল করলাম, কেউ একজন এসে আমার শিয়রে বসলেন। বয়সে তরুণ। সরাসরি এর আগে কখনো দেখা হয়নি আমাদের। সম্ভবত ফেসবুকেই পরিচয়। টাইমলাইনে স্ট্যাটাসের পর স্ট্যাটাস কবিতায় ভরপুর। মনের মাধুরী মিশিয়ে চমকপ্রদ গল্পও লেখেন। লাইক-কমেন্টের ছড়াছড়ি। মানের বিচার করে কে? তাতে কি আসে যায়? প্রকাশ তো হলো। ফেসবুক লেখা প্রকাশের এক উন্মুক্ত মাধ্যম। কোনো নিয়ম-কানুনের বালাই নেই। আমার পোস্ট আমি দেব; যা খুশি তা দেব। যেমন ধরুন—আমি আজ লালশাক দিয়ে ভাত খেয়েছি লিখে দিতেও হাত কাঁপার কথা নয়। অথবা কবিতাই লিখে ফেললেন, ‘সকালে ফেরিঅলা দিলো হাক/ নেবেন নাকি লালশাক,/ শুনে আমিও অবাক/ লালশাক লালশাক/ আমিও খেয়েছি লালশাক।’
প্রথমত তাকে দেখে আমি কিছুটা বিরক্তও বটে। অসময়ে কেন আসতে হলো? কেবল ঘুমুতে যাচ্ছিলাম। সে যাই হোক, এসেই যখন পড়েছে কী আর করা যাবে? ভক্তদের নাকি বকা দিতে নেই। যথাসম্ভব সদ্ব্যবহার করতে হয়। তাই শত বিরক্তি সত্ত্বেও ঠোঁটাগ্রে কিঞ্চিৎ হাসির রেখা ফুটিয়ে তাকালাম তার দিকে। তিনি মুচকি হাসলেন। আমিও মাথা নাড়ালাম।
কোনো ভূমিকা ছাড়াই তিনি আমাকে বললেন, ভাই, আমিও কিন্তু টুকটাক লেখালেখি করি। দেখেছেন হয়তো ফেসবুকে। তবে আরও ভালোভাবে লিখতে চাই।
হাসিমুখে বললাম, ভালো কথা। দেখেছি ফেসবুকে। আর কোথাও লিখছেন? তিনি সবিস্ময়ে বললেন, আর কোথাও মানে?
আশ্বস্ত করি তাকে। বলি, না, মানে বলছিলাম পত্র-পত্রিকার কথা। এবার তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, আরে নাহ! পত্রিকায় কেন? ফেসবুকেই তো ভালো রেসপন্স পাচ্ছি। পত্রিকায় লিখলেও তো ফেসবুকেই শেয়ার দিতে হয়। না হলে কেউ দেখে? তাই ভাবছি, একেবারে বই করে ফেলব।
আমি চোখ দুটি বিস্ফারিত করে বললাম,এখনই বই! আরও যে শিখতে হবে ভাই।
তিনি ভ্রূ কুঁচকে বললেন, বলুন, কিভাবে শিখব? তার জিজ্ঞাসার ধরনে ভাবনায় পড়লাম। কী বলব, বুঝে উঠতে একটু বেগ পেতে হলো। নিজেকে সামলে নিয়ে বলি, পড়ুন বেশি বেশি। এবার তিনি যেন ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত বিরক্তিকে আমার দিকে ছুড়ে মেরে জানতে চাইলেন, কী পড়ব? খুব নির্লিপ্তির সুরে বলি, যা পাবেন তা-ই।
আমাদের কথা চলতে থাকলো। তিনি আমার কথা বুঝতে পারছেন কিনা, আমি অনুমান করতে পারছি না। তবে আমি তার প্রশ্নের যথাসাধ্য উত্তর দিয়ে যাচ্ছি।
তিনি বললেন, যেমন…
আমি বললাম, চটি থেকে শুরু করে চণ্ডীদাস। কথা শুনে তিনি আকাশ থেকে পড়লেন। যেন এইমাত্র ঝাড়া দিয়ে উঠেছেন, এমন ভঙ্গিতে বললেন, মানে?
বললাম, সংবাদপত্র থেকে শুরু করে ঝালমুড়ি বা বাদামের ঠোঙা।
এবার সত্যি সত্যি তিনি অবাক হলেন। কিছুক্ষণ থেমে থাকলেন। হয়তো বলার মতো জুঁতসই কিছু পাচ্ছিলেন না। একটু ভেবে ছোট্ট করে বললেন, বলেন কী ভাই?
হাসলাম। হাসতে হাসতেই বললাম, হু, সঙ্গে বইও পড়বেন। আগে পাঠাভ্যাস গড়ে তুলুন। কণ্ঠের দুনিয়ার তাবত হতাশা ঢেলে বললেন, আমি তো লেখালেখির কথা বলছি। পড়াশোনার ব্যাপারে কোনো পরামর্শ চাইনি। এ ধরনের আহাম্মকি কথায় কার না মেজাজ গরম হয় বলুন! আমিও কিছুটা বিরক্ত হলাম। বিরক্তিটুকু মৃদু হাসির আড়ালে চালান করে দিয়ে বললাম, সঙ্গমের আগেই কি স্ত্রীর কাছে বাচ্চা চাইবেন? তিনি লজ্জিত হলেন। মুখখানা কেমন লাল হয়ে উঠলো। মনে হয় সঙ্গমের কথা এই প্রথম শুনলেন। তাই মাথাটা নিচু করেই বললেন, কি যে বলেন ভাই! কিসের মধ্যে কী?
এবার উঠে একটু নড়েচড়ে বসলাম। ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে গ্রাম্য নববধূর মতো লাজনম্র মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, বিয়ে করেছেন? মাথা নিচু করেই বললেন, না ভাই। সুযোগ এখনো আসেনি।
বললাম, দুঃখিত! তাহলে আপনি সঙ্গমের মর্যাদা বুঝবেন না। যাই হোক, কিছু মনে করবেন না।
তিনি এবার স্বাভাবিক হলেন। বললেন,নাহ! কিছু মনে করিনি। বললাম, লেখালেখিটাও এক ধরনের সৃষ্টি। তাই এমন উদাহরণ দিলাম। তিনি মাথাটা একটু উঁচু করলেন। আমার চোখের দিকে আর তাকালেন না। শান্তস্বরে বললেন,বুঝেছি। বলুন তবে কী করতে হবে? আমি হেসে বললাম,সেজন্যই আপনাকে বেশি বেশি পড়তে বললাম। কারণ আপনি যতই পড়বেন; ততই শিখবেন। নিজেই বুঝবেন লেখালেখি কাকে বলে এবং উহা কত প্রকার ও কী কী?
এতক্ষণ মুখে চোরাহাসি থাকলেও তিনি এবার চূড়ান্তভাবে বিরক্ত। কিঞ্চিৎ রাগমিশ্রিত কণ্ঠে বললেন,আবারও সেই একই কথা। পড়া- পড়া- পড়া। আমি লিখতে চাই। পড়ার অত সময় কোথায়? পড়েই যদি জীবন চলে যায়; তবে লিখব কখন?
আমিও দৃঢ় কণ্ঠে বললাম, লেখালেখির বিষয়ে আমার কোনো পারমর্শ নেই। যা কিছু বলব, পড়ার ব্যাপারেই বলব।
তিনি এবার উঠে দাঁড়ালেন। চোখ তার লাল টকটকে। কী পরিমাণ রাগ হলে এমন হতে পারে তা অনুমান করছি। এবার ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন, আপনি জানেন না বললেই হতো। শুধু শুধু সময় নষ্ট করলেন! আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল, আপনাকে দিয়ে কোনো উপকার হবে না।
আমি তাতে অবাক হইনি। মানুষের শরীরে যৌনানুভূতি এলে যেমন হয়; তার অবস্থা এখন তাই। প্রবল উত্তেজিত। সৃষ্টির উন্মাদনায় কম্পমান তার শরীর। রাগমোচন তো দূরের কথা,উপগত হওয়ার আগেই নেতিয়ে পড়বেন। তা জেনেও হাসিমুখে বললাম, যেহেতু বিয়ে করেননি, তাই সব কথা বলতে পারছি না। তিনি হুঙ্কার দিলেন। বললেন,সেই একই কথা বলে যাচ্ছেন। বিয়ের সঙ্গে লেখালেখির সম্পর্ক কী?
বললাম, রাগমোচন কী জানেন? সেক্স করেছেন কখনো? তিনি যেন কিছুটা ভড়কে গেলেন। থতমত খেয়ে বললেন, এ কেমন কথা? আমি সেক্স করেছি কি না, তা আপনাকে বলব কেন? শুনুন, আপনাকে যথেষ্ট সম্মান করি। তাই আপনি যাচ্ছেতাই বলে যাবেন?
আমি স্বাভাবিক কণ্ঠেই বললাম, যৌনসঙ্গীর রাগমোচন করতে না পারলে আপনি যেমন চূড়ান্ত পর্যায়ে ব্যর্থ হবেন, তেমনি পাঠকের আকাঙ্ক্ষা নিবৃত্ত করতে না পারলেও তদ্রূপ ব্যর্থ হবেন। কথাটার মানে সময় হলেই বুঝে যাবেন।
ভদ্রলোক অনেক সহ্য করেছেন। আর হয়তো পারছেন না। চরম পর্যায়ে অপমানিত বোধও হচ্ছে তার। শেষে তাই এটুকুই বললেন, আপনার সেক্স আপনিই করুন। তবে আজ এটাই জানলাম, লেখালেখি সম্পর্কে আপনি কিছুই জানেন না। আপনার কোনো ধারণাই নেই। সাহিত্য সম্পাদকদের তেল দিয়ে লেখা প্রকাশ করে যাচ্ছেন।
আমি এবার সজোরে হাসলাম। আকাশ কাঁপানো হাসি। বাতাসে ভেসে চলল সে হাসির লহরি। হাসির ঠমক থামিয়ে মুখটা তার কানের কাছে নিয়ে ফিসফিস করে বললাম,সে জন্যই আমি এখনো লেখক হতে পারিনি। পাঠকই রয়ে গেলাম। এবার তিনি এক বুক অভিমানে বিরস বদনে চলে গেলেন। তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবলাম, আমি কি ভুল কিছু বললাম? লেখালেখির বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু? হাতেকলমে শেখার সুযোগ রয়েছে কি না? পুরোটাই তো চর্চার ব্যাপার। ভাণ্ডার সমৃদ্ধ না করে দান করতে নামা বোকামি নয় কি? পাঠকের রাগমোচন না হলে আমি তো চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ। তবে যৌনতার সঙ্গে লেখালেখির তুলনা করাটা আদৌ ঠিক হলো কি না। আরও তো কত উদাহরণ দেওয়া যেত। নিজেকে কিছুটা অপরাধী মনে হলো। ভদ্রলোককে এভাবে ক্ষ্যাপানো বোধ হয় উচিত হয়নি। যা হোক,কখনো দেখা হলে ক্ষমা চেয়ে নেব। ভাবতে ভাবতেই ঘুমটা ভেঙে গেলো। উঠে দেখি, পাশে কেউ নেই। কাকে বলছিলাম, চেহারাটা মনে পড়ছে না!