নদীঘেঁষা গ্রাম। ফসলের মাঠ দিগন্ত বিস্তৃত। শীতের ভোরে আলপথে হাঁটার সময় দুর্বাঘাস ভালোবেসে আদর করে দুই পা জড়িয়ে ধরে। ব্যাকুল চুমুতে পা ধুয়ে দেয়। এমন ভালোবাসায় পূর্ণ গৌরী গ্রাম। নদীর প্রবহমান স্রোতের সুরে ছেয়ে থাকে গ্রামের বাতাস। লিয়াকত আলী কিছুদিন আগেও জুয়া খেলতো। ঘরের চাল-ডালের কোনো হিসাব ছিল না তার। হাট-বাজারে তরিতরকারি বিক্রি করে যা আয় হতো, তা নিয়ে রাতে জুয়ার আসরে বসে যেতো। কোনোদিন জিততো, কোনোদিন হারতো। জিতলে বাসায় আনন্দ মনেই ফিরতো। সবাই তাকে লিকু জুয়াড়ি নামেই চেনে। মুখে দাড়ি থাকলেও নামাজ পড়তো না। কবে কোনোকালে মসজিদে গেছে হিসাব করে বলা কঠিন।
লিকুর গায়ের রঙটা সুন্দর। লম্বা। মাথাভরা চুল। চেহারায় একটা বিশেষ ভাব আছে। কথা কয় মধু মাখিয়ে। দাঁত বের করে। দেখতে খারাপ লাগে না, ভালোই লাগে। তার ব্যবহার মিষ্টি। অভাবে বউ অন্য পুরুষের হাত ধরে রাতের অঁধারে পালিয়ে গেছে। বউ চলে যাওয়ার পর কিছুদিন লিকু মনমরা হয়ে গড়াই নদীর পাড়ে চুপচাপ একা একা বসে থাকতো। কিভাবে ভাগ্যের পরিবর্তন করা যায়; এসব ভাবে। কখনো কখনো লালনের মাজারে যায়। আসরে বসে। মাঝেমধ্যে গাঁজাও খায়। কিন্তু তাতে তার ভাবের কোনো পরিবর্তন ঘটে না। কখনো কখনো শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে যায়। বকুলতলার ঘাটে বসে আগন্তুকদের গান শুনিয়ে দুই-চার টাকা যা পায়, তাতে তার মন ভরে না।
এর ভেতর সে আবার আর একটা বিয়ে করে। পাশের গ্রাম; মনোহরপুরের মেয়ে-নূরী বেগম। নূরী বেগমের আগে বিয়ে হয়নি। কুমারী মেয়ে। ভাবে, টাকা-পয়সা উপার্জন না করতি পারলে এই বউও থাকবিনানে! কবে কার সাত পালা যায়! দুশ্চিন্তা তাকে জড়িয়ে পেঁচিয়ে ধরে। হুট করেই সে মসজিদে যাওয়া শুরু করে। পাঁচওয়াক্ত নামাজ পড়ে। কথা বলা কমিয়ে দেয়। ধর্মকর্ম জানার চেষ্টা করে। জুয়া খেলা বন্ধ করে দেয়। বাজারে সবজি বিক্রি করলেও সবার সঙ্গে নরম ও মিষ্টি স্বরে কথা বলে। এ গুণ তার আগেও ছিল। তা আরও সুন্দর করার চেষ্টা করে। কৌশলে সে সবার ভেতর নিজেকে বদলানোর চেষ্টা করে। নতুন লিয়াকত আলী হয়ে উঠতে চায়। যাতে তার অর্থ ও সম্মান আসে।
আম লিচু সাজানো প্লেট সাজিয়ে সাবিনা ঘরে ঢুকে টেবিলে রেখে চলে যাচ্ছিল। ইমতিয়াজ আলী বললো, সাবিনা, প্লেটটা বিছানাতেই দাও।
লোকজনের ভেতর লিকু সত্যি সত্যি নতুন ভাবনায় যুক্ত হয়। আড়ালে আবডালে লিকু সবার আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। লিকুর পরিবর্তন লোকজন ভালোভাবে দেখে। একটু একটু করে তার সম্মান হতে থাকে। বাজার থেকে ফিরে বাড়িতে দুচার জনের সঙ্গে ধর্মকর্ম নিয়ে আলাপ আলোচনা নিয়মিত বিষয় হয়ে ওঠে তার। ভুলে ভরা সাধু-চলিত মিশিয়ে কথা বলে। এটা তার একরকম অভ্যাসই। এখন সেটাকে আরও সুন্দর করার চেষ্টা করে। লেখাপড়া জানা ছেলেদের কথা সে খুব করে খেয়াল করে, কে কিভাবে কথা বলে। তা আত্মস্থ করার চেষ্টা করে। ভাবে, সমাজে নিজের সম্মান আর অর্থ কামাতে হলে গৌরীর বাজারে এই লতাপাতা বেচে হবিনানে। পীরগিরি করতে হবি। সেটা তো হুট করে হবিনানে। আগে দুচার জন শিষ্য বানাতে হবি। ওদের পেছনে দুচারটে টাকা-পয়সা খরচ করতি হবি।
শহরের কোনো ডাক্তারের সঙ্গে লাইন-ঘাট করতি হবি। গ্রামের কারো অসুখ-বিসুখ হলি গাছ-গাছড়া দিয়ে চিকিৎসা করার নামে ডাক্তারের ওষুধ গাছের রসের ভেতর দিয়ে খাওয়ায়ে ভালো করতি হবি। এই চিন্তাটা তার মাথার মধ্যে স্রোতের মতো ঘুরতে থাকে। কিভাবে এটা করা যায়। কয়েকদিন এটা নিয়ে চুপচাপ ভাবতে থাকে। চার-পাঁচ জন প্রতি রাতেই তার বাড়িতে অনেক রাত পর্যন্ত থাকা শুরু করে। তাদের টাকা-পয়সা দেয়। অনুগত করে রাখে। ধর্মের কথা বলে। রোজ হাসরের কথা বলে। বেহেস্ত-দোজখের কথা বলে। হুরপরিদের পাওয়ার কথা বলে। দোজখের কঠিন শাস্তির কথা কয়। অসুখ-বিসুখ হলে তাদের সারানোর ক্ষমতাও আছে তার। এসবও বলে। এরা এসব শুনে গল্পে গল্পে গ্রামের বিভিন্ন লোকের কাছে বলে। প্রথম প্রথম তারা এসব শুনে পাত্তা দেয় না। বলে, লিকু জুয়াড়ি দেখি পীরসাজি গেছে! লিয়াকত আলীর সাজানো লোকেরা তাতে শক্ত করে বলে, তোমরা যা-ই কও না ক্যা!
লিকু জুয়াড়ি সত্যি সত্যি পীর হয়া গেছে কিন্তু। আমার বউয়ের কঠিন রোগ ছিল, সেই তো চিকিৎসা দিয়ে ভালো করলো। কোন ডাক্তারের অষুধে কাজ হয়নি। এভাবে দিনে দিনে লিুকু জুয়ারির সুনাম ছড়াতে থাকে। জুয়াড়ি নামটাও একসময় খসে যায়। পোশাকেও পরিবর্তন আনে। লম্বা বড় পাঞ্জাবি পড়ে। মাথায় সবসময় টুপি থাকে। নামাজের সময় দৌড়াতে দৌড়াতে মসজিদে যায়। এক ওয়াক্ত নামাজ বাদ দেয় না। অল্পদিনের মধ্যেই সমাজে তার একটা ভালো সুনাম গড়ে ওঠে। বাড়িতেও দুচারজনের জায়গায় বাড়তে বাড়তে পনের বিশজন হয়ে ওঠে। লিকু জুয়াড়ি পীর লিয়াকত আলী হয়ে ওঠে। সেও কিতাব-কোরআন পড়ে আরও জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করে। গ্রামের নামিদামি যারা একসময় তাকে পছন্দ করতো না, তিরস্কার করতো, তারাও এখন লিয়াকত আলীকে পীর মান্য করে। লিয়াকত আলী তাদের প্রায় নিজের ওয়াজ নছিয়তের আসরে দাওয়াত করে। ওয়াজ-নছিয়ত যেটুকু হয় তার চেয়ে অনেক বেশি থাকে খাবারের আয়োজন। গ্রামের এসব মানি লোকেরা খাবারের লোভেই তার বাড়িতে দাওয়াতে আসে। এখন তারা নিজেরাই লিয়াকত আলীর প্রশংসা করে। পীর মানে। লিয়াকত আলী জানে মধুর কথা দিয়ে সব কাম হয় না। এসব লোকের ভালো ভালো খাবার দিয়ে নিজের কাছে ভিড়া রাখতি হবি।
লিয়াকত আলীর এই পরিকল্পনা বাস্তবে কাজে লেগে যায়। দেখতে দেখতে পুরো গ্রামই শুধু নয়, গ্রাম ছাড়িয়ে আশপাশের গ্রামেও তার পীরগিরির সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।
সবাই চলে যাওয়ার পরে গভীর রাতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে লিয়াকত আলী ওয়াজ নসিয়ত করার অভ্যাস করে। আর নিজেকে বলে, লিকু জুয়াড়ি তুই এখন আর লিকু জুয়াড়ি না। তুই এখন পীর লিয়াকত আলী। বলে আর নিজেই হাসে; হায়রে দুনিয়া! তোরে যেমনি বোঝাই তেমনিই বুঝিস! লিয়াকত আলীর মনের ভাবনা বাতাসে ভাসে না, ভাসে; ভেসে ভেসে অনেক দূর যায় তার ওয়াজের শব্দ। বাড়ির পাশের অন্য বাড়ির লোকজনের কানে যায়। সবাই তাতে লিয়াকত আলীকে আরও সম্মান করে। লিয়াকত আলী যখন পথে হাঁটে, সবাই তখন তাকে সালাম দেয়। বিচার-সালিশে ডাক পড়ে। কিন্তু লিয়াকত আলী তাতে অংশ নেয় না। যায় না। ভাবে, এসব বিচার-শালিসে গেলে দুই পক্ষকে খুশি করা যাবে না। একপক্ষ খুশি হবে, আর এক পক্ষ অখুশি হবে। তাতে শত্রু তৈরি হবে। কী তরকার আজুড়ি শত্রু তৈরি করা! লোকজনকে বলে দেয়, ভাইওে আমি আল্লাহওয়ালা মানুষ। দিন-দুনিয়ার ওসব বিচার করা আমার কাজ নয়। আমি আল্লাহ-রসুলের সান্নিধ্য পাওয়ার জন্যি সাধনা করতেছি। আমি এখন শুলে স্বপ্নের ভেতর অনেক পীর মুর্শিদের দেখা পাই। আমার ভেতর একটা আধ্যাত্মিক শক্তি চলি আইচে। আমি এটা এখন নিজেই বুঝতেছি।
গৌরী গ্রাম আমি রহমতের গ্রাম বানা দেবো। এতে তার সম্মান আরো বেড়ে যায়। গ্রামের পয়সাঅলা লোকেরাও তার কাছে নিয়মিত যেতে শুরু করে। তার কথাবার্তা শোনে। আল্লাহ-রসুলের কথা শুনে তাদের প্রাণ জুড়িয়ে যায়। অনেকে তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। খুশি হয়ে তাকে টাকা দেয়। দিনদিন তার বাড়ির চেহারা বদলাতে শুরু করে। খাবারেও পরিবর্তন আসে। দৈনিকই ভালো ভালো খাবারের আয়োজন হয়। নিজেকেও এসব যোগাড় করতে হয় না। লোকজন দিয়ে যায়। এসব লোকজন সাধারণ লোকজন নয়, বড়লোকী লোকজন। লিয়াকত আলীর চেহারায় চকচকে ভাব আসতে শুরু করে।
নূরী বেগম বোঝার চেষ্টা করে, তার স্বামী যা করতেছে, এসব কি ঠিক কাম করতেছে, না কি লোক ঠকিয়ে ট্যাকা নিচ্ছে! মিথ্যে সম্মান কামাচ্ছে! আবার লোকজন নূরী বেগমকে মানতে শুরু করেছে। নূরী বেগম ভাবে আর হাসে, আমি কয়দিনের ছুঁড়ি, আমাকেও এখন সম্মান করে। আমার পায়ে হাত দিয়ে বাপ-বয়সী লোকেরা সালাম করে! হাতে ট্যাকা গুঁজে দেয়। ভালো ভালো শাড়ি দেয়। এসব ভালো লাগে না নূরী বেগমের। ভাবে, লোকে ক্যান এসব দেয়!
লিয়াকত আলী ভাবে, আমি ঠিক পথেই আগাচ্ছি। এ পথেই ট্যাকা সম্মান সব হবিনে। শুধু নূরীরে ঠিক রাখতি হবি। ও উল্টাপাল্টা করলে ঝামেলা। ওরে বোঝাতে হবে দুনিয়া হইলো ট্যাকার জায়গা। ট্যাকা থাকলি সব আছে। ট্যাকা না থাকলি কিচ্ছু নেই।
নূরী বেগমের অনুগত হয়েই থাকে পীর লিয়াকত আলী। সবকিছুতেই নূরীর কথাকে গুরুত্ব দেয়। আর নূরীর বয়সটাও তার অর্ধেক। সে কারণে তাকে আদর-যত্ন জিনিসপত্র সাধ্যমতো দিয়ে নিজের ষোলোআনা অনুগত রাখতে চেষ্টা করে। কিন্তু নূরীর ব্যাপারটা ভালো লাগে না। লিয়াকত আলীকে তার স্বামী-স্বামী লাগে না। চেহারার ভেতর কেমন যেন বাপ-বাপ লাগে। আবার লোকটা যা করতেছে তাতে মনে হয় লোকটা মানুষজন ঠকায়ে সম্মান কামাচ্ছে, টাকা-পয়সার মালিক হচ্ছে। নূরী বেগমের এসব ভালো ঠেকে না।
ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে রাতারাতি অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিতে পরিণত হয়ে ওঠে লিয়াকত আলী। চেয়ারম্যান-মেম্বার প্রার্থীরা লোকবল নিয়ে এসে তার পায়ে সালাম করে দোয়া চায়। গোপনে টাকা দেয়। কারণ সবাই মনে করে পীর লিয়াকত আলীর বাঁধা একটা ভোট আছে। এই ভোট যে পাবে, তার জয় নিশ্চিত। কিছুদিনের মধ্যে লিয়াকত আলীর টিনের সাদামাঠা ঘর বিল্ডিং হয়ে ওঠে। আশপাশের জমিও কিনতে শুরু করে। চার পাঁচ বছরের মধ্যে পীর লিয়াকত আলী পীরবাবা হয়ে ওঠে। পাঁচ ছয় কাঠার ভাঙাচোরা বাড়ি তিন বিঘা জমির ওপর বিশাল বাড়ি হয়ে ওঠে। ফুলের বাগান ফুলের বাগান মসজিদ মুরিদদের আলাদা ঘর; দ্রুত গতিতে তৈরি হয়ে যায়। শহরের কয়েকজন ধনী তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। তারা একসঙ্গে কয়েকটা প্রাইভেট গাড়িতে করে পীরের বাড়িতে আসে। সপ্তাহের পর সপ্তাহ থাকে। নিজেরা উপস্থিত থেকে বাড়ি তৈরি করে। এ যেন স্বপ্নের ভেতর দিয়ে সব কিছু হয়ে যাচ্ছে। লিয়াকত আলী নিজের চেহারাতে গম্ভীরতা নিয়ে আসে। কথা কম বলে। মেপে মেপে কথা বলে। কারণ সে জানে, শহরের যারা শিষ্য হয়েছে, তারা জ্ঞানে-গুণে তার থেকে অকাশের থেকে বেশি উপরের। এদের সঙ্গে যত কম কথা বলা যায়, ততই ভালো। আবার নিজের পীরগিরিও ধরে রাখতে হবে। নিজে গোপনে ধর্মেও বিভিন্ন বইপুস্তক পড়তে থাকে। জ্ঞান আহরণের জন্য।
লিয়াকত আলী বুদ্ধি আঁটে, অনেক নারী মুরিদানি আছে, তাদের অনেকে দেখতে বেশ সুন্দর। এদের দিয়ে বড়লোক শিষ্যদের সেবা করাবে। বাস্তবে শুরুও করলেঅ তাই। এতে সে দ্রুত ফলপ্রাপ্তি হয়ে ওঠে। এসব বড়লেঅক শিষ্য এসব নারী মুরিদানি ও তাদের তরুণী মেয়েদের সেবাযত্নে যেন এক নতুন জগতের সন্ধান পায়। এসব মুরিনদানি ও তাদের মেয়েদের প্রায়ই প্রচুর টাকা বখশিস দেয়। তারা এসব কারণে পীর লিয়াকত আলীকে আরো বেশি করে মান্য করে টাকা ঢালতে থাকে। লিয়াকত আলীও এসব বড়লোক শিষ্যদের সেবাযত্ন করার জন্য সুন্দরী নারী শিষ্যদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিয়ে আরো বেশি আগ্রহী করে তোলে।
এতে ইমতিয়াজ আলীর মোহ তৈরি হয় লিয়াকত আলীর ওপর। ধনীলোক। পুরো পরিবার শীষ্যত্ব গ্রহণ করে। কখনো কখনো তার সঙ্গে স্ত্রী ছেলে-মেয়ে সবাই আসে, কখনো নিজে একাই আসে। সঙ্গে দামি গাড়ি। গাড়িভর্তি জিনিসপত্র ভরা থাকে। গ্রামের যে সব ধনীলোক পীরের শিষ্য; তাদেও সবার জন্য উপহার আনে। যে কয়দিন থাকেন প্রচুর বাজার করে। সারাদিন সবার জন্য খাবার উন্মুক্ত থাকে। মাছ মাংস মিষ্টান্ন; কোনো কিছুর অভাব নেই। মুরিদানিদেরও স্বপ্ন থাকে তার সেবাযত্ন করার। কারণ তারা প্রচুর টাকা উপহার পান। আর তিনি দেখতেও রাজা-বাদশাদের মতো সুন্দর। সারাদিনে বেশ পরিশ্রম গেছে তার ওপর। রোদে দাঁড়িয়ে কখনো কাজ করেনি। পীরের শিষ্যত্ব নেয়ার পরে, তার বাড়িটা তৈরি করতে রোদে ভালোই পুড়েছে। এখনো কাজটা পুরো শেষ হয়নি। আজো রোদে পুড়েছে। সন্ধ্যার পরে নিজের বিছানায় শুয়ে একটু আরাম করছিল ইমতিয়াজ আলী। আম লিচু সাজানো প্লেট সাজিয়ে সাবিনা ঘরে ঢুকে টেবিলে রেখে চলে যাচ্ছিল। ইমতিয়াজ আলী বললো, সাবিনা, প্লেটটা বিছানাতেই দাও।
সাবিনা প্লেটটা বিছানায় রাখে। ইমতিয়াজ আলী একটা লিচু নিয়ে ছুলে মুখে দিয়ে সাবিনাকে বললো, তুমিও নাও।
সাবিনা অতটা সাহস করতে পারে না। ইমতিয়াজ আলী কত বড় লোক। তার পাশে বসে তার প্লেট থেকেই আম বা লিচু নিয়ে খাওয়ার মতো মানসিক শক্তি তার নেই। কাচুমাচু ভঙ্গিতে সাবিনা বললো, না, আপনিই খান। আমি হাসেলঘর থেকেই খ্যায়া আইচি।
ইমতিয়াজ আলী গলা একটু মোটা করে বললো, মিথ্যে কোস ক্যা? আমি বলতেছি, নে। সাবিনা মাথা নিচু করে ভিতুভিতুভাবে একফালি আম নিয়ে খেতে থাকে।
আপনি লোকটা ভদ্র আছেন, ভালো আছেন। তাই আপনাকে আমার পছন্দ হইচে। আমি নিজের থেকে আপনারে এতো রাতে ডাকি আনিছি।
ইমতিয়াজ আলী রোদমাখা চোখে সাবিনাকে দেখে। বেশ টাটকা। কচি। গড়ন গঠন ঢেউতোলা নদীর শরীরের মতো ঠেকে তার। গলাটা মোলায়েম করে বললো, গা-টা ব্যথা হয়ে গেছে। একটু টিপে দিবা? সারাদিন যে রোদ! একদম আগুনের মতো। সারা শরীর যেন পুড়ে ফোসকা হয়ে গেছে।
দ্বিধাগ্রস্ত সাবিনা। কী করবে বুঝতে পারে না সে। একবার ইচ্ছে করে, আবার ভাবে, পরপুরুষ। এটা করলি তো গুনাহ হবিনি। মানিব্যাগ থেকে হাজার টাকার দুটো নোট বের করে সাবিনাকে দিয়ে ইমতিয়াজ আলী বললো, নাও। রেখে দাও। পছন্দমতো কিনে নিও।
সাবিনাকে এর আগেও ইমতিয়াজ টাকা দিয়েছে, তার মাকেও দিয়েছে। মাঝেমধ্যে সে এটা করে। সে-কারণে সাবিনার খুব বেশি সংকোচ হলো না টাকা নিতে। মনে মনে খুশিই হয় সে। তাদের পরিবার এখন যে অনেকটা ভালো চলে তা যে এই লোকটার জন্য, তা সে ভালো করেই বোঝে। ফলে তার সব কথাই সে শোনে, তার মাও শোনে। শুনতে তাদের ভালো লাগে। তারা এটাকে পীরের আশীর্বাদ বলে মনে করে। পীরের চেয়ে ইমতিয়াজ আলীর প্রতি তাদের মনের টান অনৈক বেশি। বাইরে থেকে তা বোঝার কোন উপায় নেই। বাহ্যিকভঅবে তারা পীরের প্রতি বেশি মগ্নভাব করে থাকে, মন থেকে তারা ইমতিয়াজ আলীর সান্নিধ্যলাভের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। কারণ তার সান্নিধ্যে গেলেই পাঁচশ বা হাজার টাকার কয়েকখানা নোট পাওয়া যায়। এতে সংসারে সুখি সুখি একটা ভাব ভেসে ওঠে।
সাবিনা যত্ন করে ইমতিয়াজ আলীর পা টিপে দিতে থাকে। সাবিনার উঠতি শরীরের প্রতি তার লোভ কিছুদিন থেকেই তৈরি হয়েছে। বাঁশের চরাটে বসে সে যখন নদীর দিকে তাকিয়ে দুপুরের বাতাস খায়, আর নদীর ঢেউ দেখে, তখন মনের কোণে সাবিনার শরীরের ভাঁজগুলো ঢেউয়ের সাথে ভেসে ওঠে, নদীর ঢেউয়ের সঙ্গে তার শরীরের ভাঁজ এক হয়ে তার মনের কোণে কেমন এক পাগলাতৃষ্ণা বানিয়ে ভেসে যায়, দিগন্ত থেকে দিগন্তে। মনটা উদাস হয়ে ওঠে। তার গান গাইতে ইচ্ছে করে, ‘হাতের কাছে ভরা কলস তৃষ্ণা মেটে না’। গুনগুন করে গায়ও। তাতে সুর উঠুক আর না উঠুক। এদিক ওদিক তাকায়, যাতে কেউ না শুনে ফেলে বেসুরো গান। পীরের বাড়িতে লালনের গান! কেউ শুনলে মানও থাকবে না।
পীরের বাড়িতে একা থাকায় স্ত্রীর সান্নিধ্য কয়েকদিন পায় না ইমতিয়াজ আলী। শরীরটা তেতে আছে। সাবিনাকে মধুর করে কথা বলতে থাকে সে। স্বপ্ন দেখাতে থাকে। তাকে অনেক ভালো জায়গায় বিয়ে দেবে। বিয়েতে অনেক টাকা পয়সা খরচ করবে। অনেক ধুমধাম করবে। গান-বাজনা গবে। কতো আনন্দ হবে। ইমতিয়াজ আলীর কথা বিশ্বাস করে সাবিনা। সে জানে লোকটার এ ক্ষমতা আছে। ইমতিয়াজ আলীর দেওয়া দুই হাজার টাকার দুটো নোট সাবধানে নিজের কাছে রাখে সাবিনা। ইমতিয়াজ আলীর প্রতি মনটা তার একটু একটু করে ভিজে ওঠে। ইমতিয়াজ আলী আদর করে তার পিঠে হাত দেয়। আস্তে আস্তে সারা পিঠে হাত বুলাতে থাকে। সাবিনা একটু উসবিস করে। ভীতু স্বরে বলে, কেউ দেখি ফেললি কিন্তু বিপদ হয়া যাবিনি।’ ভয় ভয় করে সাবিনার। আবার লেঅকটা অতগুলো টাকা দিছে। আগেও দিছে। টাকাটা তার কাছে দিন দিন লোভের হয়ে গেছে। সাবিনা সংকোচ করে। ভয় ভয় করে। কিন্তু নিজেকে সরিয়ে নেয় না। আপত্তি করে না।
ইমতিয়াজ আলী ঠিকই সাবিনাকে বুঝে ফেলে। ভয় থাকলেও আপত্তি বা বাধা নেই। টাকার প্রতি ওর একটা মোহ তৈরি হয়ে গেছে। ওকে মাঝেমধ্যে টাকা দেওয়ার ফাঁদটা ভালো হয়েছে। আর ও অত টাকা কোথায় পাবে! কে দেবে অত টাকা! টাকার একটা শক্তি আছে। সে শক্তির কাছে কত বড় বড় মহারথি বিক্রি হয়ে যায়। আর সাবিনা তো একটা চুনোপুটির থেকেও ছোট। দাড়কি মাছ। তাও না। ধর্তব্যের ভেতরেই পড়ে না। সাবিনা যে মনে মনে তার কাছে বেচা হয়ে গেছে ইমতিয়াজ আলী তা ভালোভাবেই বুঝে নেয়। সাবিনাকে দুবাহুর ভেতর নিয়ে বুকের ভেতর টেনে নেয় ইমতিয়াজ আলী।
আমার ক্যাম্বা যিন ভয় করতেছে। সাবিনা ঘামতে থাকে। নিশ্বাসে ভারি ঠেকে।
ভয় করবে ক্যান? আমি কী বাঘ-ভালুক! তোমারে তো আদরই করতেছি। খ্যায়া তো ফেলতেছি না।
তারপরও আমার ভয় করতাছে। আমারে এখন ছাড়ি দেন। পরে অন্য আর এক সময় আসবোনে।
সাবিনার কথায় গুরুত্ব না দিয়ে ওকে আরো একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাসি দিয়ে বলে ইমতিয়াজ আলী, তুমি নিজের ভালোও বোঝো না। আমি যে তোমারে আদর করতাছি, এটা তোমার ভাগ্য, বুঝছো!
সাবিনা ভাবে, লোকটার কথা মিথ্যা না। লোকটা বড়লোক মানুষ। চেহারাও তো সিনেমার নায়কের মতো। গাদা গাদা ট্যাকার মালিক। ভয় ভয় হলেও আপত্তি বা বাধা কোন কিছুই তার থাকে না তার। ইমতিয়াজ আলী বড়লোক মানুষ; তার ভালো লাগে। অত টাকাঅলা, অমর সুন্দর চেহারার পুরুষ তো জীবনে কোনদিনও সে পাবে না। এসব ভাবনাও সাবিনার ভেতর বাতাসের মতো ভাসতে থাকে। সাবিনা মানসিকভাবে সমর্পিতা হয়ে যায় তার কাছে। ইমতিয়াজ আলী বললো, তুমি অনেক ভালো মেয়ে, সাবিনা। তোমারে আমি বড় ঘরে বিয়ে দেবো। টাকা-পয়সা দেবো। কোনদিন অভাব কষ্ট চোখে দেখবা না। শুধু আমার পোষমানা হইয়া থাকবা।
আচ্ছা। কিন্তু আপনার সাত আমার এসব কথা আপনি কারোর কাছে কবেন না কিন্তু। এসব যদি কেউ জানি যায়, তাহলি কিন্তু বাতাসে ছড়া যাবিনি। তখন কিন্তু আমার বিয়ে হবিনানে। গলায় দড়ি দিতি হবিনি। এসব কথা কি কারোরে কওয়া যায়! কারোর কবোনানে। তুমি কিন্তু রোজ রোজ আমার ঘরে চলি আসবা।
আচ্ছা। আসবোনে। মা চলি আসতে পারে। অনেকক্ষণ আইচি তো!
ইমতিয়াজ আলী উঠে গিয়ে ঘরের বাইরে ভালো করে দেখে আসে লোকজন কেউ আছে কিনা। একদম ফাঁকা। কেউ নেই। অনেকটা দূরে পুকুর পাড়ে আম গাছের নিচে কুদ্দুস বয়াতি একা একা একতারা বাজাচ্ছে। অন্যদিকে খেয়াল নেই। ইমতিয়াজ আলী ঘরে ঢুকে দরোজাটা ভালো করে বন্ধ করে দেয়। গায়ের পাঞ্জাবিটা খুলে বিছানার একপাশে ফেলে রাখে।
ইমতিয়াজ আলী সাবিনার শরীর নিয়ে মেতে ওঠে। সাবিনার কেন যেন হুট করে মনে হলো লোকটা একটা শুয়োর। শুয়োর যেভাবে মাটিকাদা খোঁড়ে, লোকটাও আমার শরীরে যেন সেরকম খুঁড়তেছে। আকস্মিকভাবে সাবিনার তখন একটা দুঃসহ স্মৃতি মনে পড়ে। মামাবাড়িতে বেড়াতে গিয়ে একরাতে মামাত ভাই সবুরও তাকে এভাবে খুঁড়েছিল। ইমতিয়াজ আলী আর সবুর তার কাছে কল্পনায় এক হয়ে মিশে যায়। দুজনের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না। সবুরের সেই কথা আজো কেউ জানে না। হয়তো জানবেও না কোনদিন। সে ভাবে, সে তো একদিনই; একটা রাতই। কিন্তু আজকে যা ঘটছে, এটা তো এখন থেকে দৈনিকই ঘটবে। দুদিন আগে-পরে মা ঠিকই বুঝতে পারবে। নাকি মা-ই কৌশলে আমাকে লোকটার কাছে টাকার লোভে ঠেলে দেছে! টাকার কাছে মাকেও তো মাঝেমধ্যে কেমন যেন অচেনা লাগে!
লোকটার প্রতি মার অতি বাড়তি দরদ কেনো! এ দরদ তো লোকটার জন্য না, লোকটার টাকার জন্য। মা-ও লোকটার কাছে শোয় না তো! রোজ রোজ তার শরীর টিপতে আমাকে পাঠায় কেন! মাও তো তার শরীর টেপে। লোকটা কি মাকে এমনি এমনি ছাড়ি দেয়! পুরুষ মানুষ এরকম একলা ঘরে প্যায়া কি কাউকে ছাড়ি দেয়! সাবিনার ভেতর অনেক প্রশ্ন তৈরি হয়। যদিও সে তার প্রশ্নের সঠিক উত্তর নিজেও জানে না। কিন্তু এসব প্রশ্ন তার মধ্যে গরমভাতের ফ্যানা উতলে ওঠার মতো উতলে ওঠে। লোকটাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সাহস হয় না। উত্তর যদি সত্যি হয়ে যায়, তখন কষ্ট বাড়বে, এই ভয়েও জিজ্ঞেস করে না। লোকটার ট্যাকার প্রতি মা’র লোভের জিবি আছে এ তো জানা কথা। লোকটা মাকে অনেক ট্যাকা দেয়। লোকটার কত টাকা! এ বাড়িত কী মধু আছে; তার মোহে দিনের পর দিন এরকম একটা বড় লোক মানুষ পড়ি থাকে; কত কী কাম করে! পীরমাও তো লোকটার ট্যাকা নেয়। পীরমার ঘরেও তো লোকটা ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ি থাকে। পীরমার সাতে লোকটা দৈনিক অত সময় ধরি ঘরের ভেতর একলা একলা কী করে! কী কথা কয়! কী শিক্ষা দেয়! ব্যাটা ছাওয়াল আর মিয়ামানুষ একসাত এক ঘরে থাকলি কী হয় তা কে না বোঝে! লোকটা তো ট্যাকা খাওয়ায়ে এ বাড়ির সব কিছু দখল করে নেছে।
লোকটা কী মেয়েমানষের লোভেই এ বাড়িত পড়ি থাকে! পীরবাবা তো ট্যাকার জন্য সব পারে! পীরগিরি তো উপরে উপরে দেখায়। ভেতরে তার ট্যাকার লোভ কুমিরের প্যাটের মতো। দুচোখ খোলা রাইখাও বন্ধ করি থাকে। কিচ্ছু দ্যাখে না। শুধু ট্যাকা দেখে। সাবিনা এসব ভাবতে ভাবতে থাকে। আবার ভাবে, আমি যদি পোয়াতি হয়া যাই, তখন আমার কী হবিনি! মুখ দেখাবোনে ক্যাম্বা! নিজের ভেতর হুট করে প্রশ্নটা খেজুর গাছের কাঁটার মতো গেঁথে যায় তার।
সাবিনার শরীর থেকে ইমতিয়াজ আলী নেমে ঢকঢক করে পানি গিলতে গিলতে বললো, তুমি এখন তাড়াতাড়ি চলি যাও।
ইমতিয়াজ আলীর সঙ্গে আলিমুদ্দিনের মানসিক দ্বন্দ্ব ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠতে থাকে। দুজনেরই অনেক টাকা। দুজনেই পীরবাড়ির কর্তৃত্ব নিজের দখলে নিতে মরিয়া ওঠে। দুজনেই লিয়াকত আলীকে নানাভাবে টাকা দিয়ে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেষ্টা করে। লিয়াকত আলী তাদের টাকায় গ্রামের মাঠে একের পর এক জমি কিনতে থাকে। বাড়ির সাথে জমি কিনে সুন্দর বাগানবাড়ি তৈরি করে। দুজনে পাল্লাপাল্লি টাকা ঢেলে তাদের পীরবাবাকে কব্জা করতে চায়। পীরবাড়ির সবকিছু নিজের দখলে নেয়ার চেষ্টা চালাতে থাকে দুজনেই। বারেক মেম্বারও এ সুযোগ গ্রহণ করে। পীরের মামাত ভাই সে। তাকে হাতে রাখার জন্য ইমতিয়াজ আলী গোপনে তাকে প্রচুর টাকা দেয়। আবার আলিমুদ্দিনও গোপনে তাকে টাকা দিতে থাকে।
বারেক মেম্বার যখন যার সামনে তখন তার। আর ইমতিয়াজ আলী ও আলিমুদ্দিন দুজনে কখনো তার সামনে একসঙ্গে পড়লে বারেক মেম্বার কারো পক্ষই গ্রহণ করে না। দুজনের দিকেই সমান তাল মেলায়। বারেক মেম্বারের বড় শক্তি নূরী বেগম। সে যা বলে নূরী বেগম তাই শোনে। নূরী বেগম ও বারেক মেম্বারের মধ্যে গোপন একটা সম্পর্ক আছে; প্রেমের সম্পর্ক। তাদের দুজনকে নিয়ে এসব কথা সবারই জানা। কিন্তু মুখ ফুটে কেউ বলে না। সাহস করে না। ভেতরে ভেতরে ঠিকই গুঞ্জন চলে। পীর নিজেও এ কথা জানে। কিন্তু এ নিয়ে সে কখনো কিছু বলে না। কাউকে কিছু জিজ্ঞেসও করে না। লিয়াকত আলী জানে বারেক মেম্বার ইচ্ছে করলে তার পীরগিরি মাটিতে মিশে দিতে পারে। নূরী বেগমকেও তার ভয়। অর্ধেক বয়সী স্ত্রী। সেও যখন-তখন যা তা করে ফেলতে পারে। অনেক কৌশলে লিয়াকত আলী তাকে পোষ মানিয়ে রাখে। সে মনে মনে ভাবে, ঘরের ভেতর যা করে করুক, বাইরে কথা না গেলেই হয়। আমার টাকা আসলিই হয়।
শিষ্যরা নূরী বেগমকে বিভিন্ন সময়ে টাকা দিলে তা গ্রহণে সংকোচ করতো। প্রথম প্রথম নিতোই না। বারেক মেম্বারই তার মধ্যে আস্তে আস্তে টাকার লোভ ধরিয়ে দেয়। নূরী বেগম বয়সে বেশি বড় নয়। তেইশ চব্বিশ বছর। উজ্জ্বল শ্যামলা রঙ। গড়নটা নদীর আঁকাবাঁকা ঢেউরেখার মতো। ভোরের শিশির ভেজা দুর্বাঘাসের মতো টলটলে তার ঠোঁট। ইমতিয়াজ আলীরও ভালো লাগে নূরী বেগমকে। আলিমুদ্দিনেরও ভালো লাগে। দুজনেই নূরী বেগমের সান্নিধ্য লাভের জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে। টাকা দেয়। উপহার দেয়। নূরী বেগম ভাবে, টাকা এত সস্তা! এতো এতো টাকা! সাতজনমেও তো আমার কেউ এত টাকা চোখে দেখেনি। কত দামি দামি শাড়ি, কত কী উপহার! জীবনে তো এসব চোখেও দেখিনি। নূরী বেগম নিজেও যেন নিজেকে চিনতে পাওে না! ভাতে-কষ্টে অভাবে বড় হওয়া নূরী বেগমের এতা কদর! এতো টাকা!
এত উপহার! ক্যান দেয় তারা আমাকে! কী জন্যি দেয় আমাকে! আমি তো কিছু করি না তাদের জন্য। নূরী বেগমের ভাবনায় এসব প্রশ্ন ঘুরতে থাকে। বারেক মেম্বারের সঙ্গে নূরী বেগমের যে একটা সম্পর্ক আছে; বাতাসে ভাসে, ভেতরে ভেতরে তা আছেও। সেই শক্তিতে নূরী বেগমের কাছ থেকে বারেক মেম্বার প্রায়ই কোন না কোন উছিলা করে টাকা নেয়। কখনৈা ধারের কথা বললেও তা ফেরত দেয় না। নূরী বেগমও এখন তা বোঝে বারেক মেম্বার টাকা নেয়া মানেই একদম নিয়ে নেওয়া। নূরী বেগমের ভেতরেও টাকার লোভ তৈরি হয়। ইমিতিয়াজ আলীর টাকার জন্য দিন দিন তার প্রতি একরকম দুর্বল হয়ে পড়ে নূরী বেগম। আলিমুদ্দিন বুঝতে পারে নুরী বেগম ইমতিয়াজ আলীর দিকে বেশি গোড়ে যাচ্ছে। আলিমুদ্দিনের সহ্য হয় না। সে গোপনে কৌশলে নূরী বেগমকে জড়িয়ে ইমতিয়াজ আলীর নামে বদনাম ছড়াতে থাকে। নূরী বেগমের কানেও তা যায়। পীরের কানেও যায়। ক্রমেই এসব কথা বাতাসে গরম হতে থাকে।
কানাঘুষা চলতে থাকে। বারেক মেম্বারকে নিয়েও এসব কথা আছে। আবার ইমতিয়াজ আলীকে নিয়েও যা-তা কথাবার্তা চলছে। নূরী বেগম নিজের ভেতর নিজেই ভাঙচুর হতে থাকে। ভাবে, বারেক মেম্বারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক থাকলেও, সে তো আমাকে দিয়েই অনেক টাকা কামাই করে নিচ্ছে। কিন্তু ইমতিয়াজ আলী আমাকে যে এতো এতো ট্যাকা দেয়, অত ট্যাকা কী খালি খালি দ্যায়! নাকি বেহেস্ত কেনার জন্য দ্যায়! আমি বেহেস্তের কী বুঝি! পীরইবা বেহেস্তের কী বোঝে! ওসব ক্ষমতা কী তার আছে! অত সুন্দর সুঠাম সুপুরুষ আমার মতো শ্যামলা গ্রাম্য মেয়ের পেছনে এতো ট্যাকা ঢালে ক্যান! আলিমুদ্দিনই বা ঢালে ক্যান! আলিমুদ্দিনের ট্যাকা থাকলিও চেহারায় তো ইমতিয়াজের এক কেনিকোনাও না। এসব ভাবনার ভেতর দিয়ে সময়ের সিঁড়ি ধরে দুজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। বাইরের লোকের কথা কানে তোলে না। পীরবাড়ির বাগানে তিন দিন ব্যাপী বিশাল মাহফিল চলছে। সারারাত চলে এই মাহফিল। খাওয়া-দাওয়া সবকিছুর আয়োজন থাকে।
গ্রামের লোকজন, বাইরের গ্রামের লোকজন, দূর দূরান্ত থেকে বহু লোকজন আসে এই মাহফিলে। বিশাল বাগানবাগিতে বিশাল প্যান্ডেল করা হয়। পুরুষের জন্য আলাদা। মেয়েদেও জন্য আলাদা। বাড়ির মহিলারাও মাহফিলে রাতভর অংশ নেয়। বাড়ির অন্দরমহল মধ্যরাতে প্রায় একরকম ফাঁকা হয়ে যায়। ইমতিয়াজ আলীকে দিনের একফাঁকে নূরী বেগম মাহফিল চলার সময় একটু রাত করে তার ঘরে দেখা করার কথা বলে। ইমতিয়াজ আলী যেন এরকম কথার জন্যই অপেক্ষা করছিল কয়েকদিন। মাহফিলের দ্বিতীয় রাতে যখন মাহফিলের ওয়াজ শুনে সবাই মশগুল হয়ে উঠেছে, হঠাৎ ইমতিয়াজ আলী নূরী বেগমের ফোন পেয়ে তার ঘরে আসে। বারেক ম্বোরের চোখে তা এড়ায় না। লিয়াকত আলী ওয়াজ করতেই তার চোখ ইমতিয়াজ আলীর দিকে যায়, সে যে বাড়ির ভেতরের দিকে যাচ্ছে তা সে ভালেঅ করেই অনুমান করে।
নূরী বেগমের ফোন না পেলে তো তার মাহফিল ফেলে উঠে যাওয়ার কথা নয়। বাড়ির ভেতর তো নূরী বেগম আর দুএকজন মহিলা ছঅড়া কেউ নেই; ইমতিয়াজ আলীর এ যাওয়ার মানে তার কাছে অন্যরকম ঠেকে। তারপরও ইমতিয়াজ আলী বা নূরী বেগম কাউকেই কিছু বলার শক্তি তার নেই। কারণ ইমতিয়াজ আলীর প্রচুর টাকা আছে। সেই টাকার দিকে তার লকলকে জিব বের হয়ে থাকে। আর নূরী বেগমের যে বয়স এই বয়সের একটা মেয়েকে আদওে সোহাগে পুরো শাসন করার ক্ষমতা তার নেই। মনের ভেতর এসব ভাবনা চাপা দিয়ে ওয়াজ নসিয়ত চালিয়ে যায়। তবে তাতে সুতাকাটা ঘুড়ির মতো এলোমেলো মনে হয় তার ওয়াজের কথা।
ইমতিয়াজ আলী ঘরে ঢুকতেই নূরী বেগম বললো, আপনি ক্যাম্বা পুরুষ? আপনার এতো ট্যাকা-পয়সা! এতো সুন্দর চেহারা! শহরে বাড়ি-গাড়ির মালিক। আপনারে তো পীরবাড়ির সবাই মানে। শুধু আলিমুদ্দিন ভাই হিংসায় জ্বলে। তো আপনার সাহস নাই ক্যান? আপনারে আমারে কইতে হইলো আমার ঘরে আসার কথা!
তুমি তো পীরেরর বউ। অনেক হিসেবের ব্যাপার আছে। কিছু কইলে তুমি কী মনে করো না-করো! আবার আলিমুদ্দিন আর বারেক মেম্বার তো ওৎ পেতে থাকে। পীরবাবাও কী ভাবে না ভাবে বোঝা যায় না।
এতো হিসাব কইরা চলেন আপনি! তো আমারে এতো এতো ট্যাকা দ্যান কি জন্যি? শোনেন, আপনি পুরুষ মানুষ। পুরুষ মানুষের মতো কথা কবেন। আপনার মতো অত বুদ্ধিসুদ্ধি আমার নাই। আমি সুজাসুজি বুঝি। আমাক নিয়ে আপনার অন্য কোন ইচ্ছে থাকলে কন। না-হলে মাহফিলে যান। বারেক চলি আসতি পারে। আলিমুদ্দিনও আমার পিছ লাগি থাকে। আঁড়ি গুরু যেমন গাই গরুর পেছনে শুকে বেড়ায়, আলিমুদ্দিনের অবস্থা তাই। আপনি লোকটা ভদ্র আছেন, ভালো আছেন। তাই আপনাকে আমার পছন্দ হইচে। আমি নিজের থেকে আপনারে এতো রাতে ডাকি আনিছি।
ক্যান এখানে পড়ে থাকি! ক্যান তোমারে টাকা দিই। ক্যান তোমারে ভালোবাসি। সবই তো তোমার জন্যি।
বারেক মেম্বার নতুন এলাকায় কিছু টাকা খরচ করে কয়েকজনকে মুরিদ বানিয়ে ধীরে ধীরে নিজেকে পীর বানাতে চেষ্টা করে। ক্রমেই তা কয়েক এলাকাতে নাম-ধাম ছড়িয়ে পড়ে। বারেক মেম্বার পীর হিসেবে পরিচিতি ও সম্মান পেতে থাকে।
আমার জন্যি না আমার দেহের জন্যি? সত্যিটা বলতে পারেন না? ক্যাম্বা পুরুষ আপনি! আমার কাছে আসি বসেন। আর শোনেন আপনারে কিন্তু আমি ভালোবাসি না। আমি ভালোবাসি আপনার ট্যাকা। আপনি সাবিনার সাথেও বিছানায় শোন, আমি জানি। ওর মাকেও আপনি ছাড়েন না। আমি কিন্তু সব জানি। আপনি পরকালের চিন্তা করে পীরবাড়িতে পড়ি থাকেন না। এ কালের বেহেস্তের ভেতর থাকার জন্যি নিজের বউ ফেলে রাখি আপনি এখানে পড়ি থাকেন। কন, আমি মিথ্যা কইছি? আমিও আপনারে ডাকিছি সেও ট্যাকার জন্যি। আপনার ট্যাকা এখন আমারও ভালো লাগে। আপনার কাছ থেকে তো এতোদিনে কম ট্যাকাও নিইনি! আলিমুদ্দিনও আমার কাছে শোয়ার জন্যি ট্যাকা দেয়, ও আমি বুঝি। ধরা দেই না। আবার দূরেও সরায়ে রাখি না। নেন, যা করেন তাড়াতাড়ি করেন। চারদিক লোকজন ভরা। আপনারও খোঁজ পড়তি পারে যখনতখন।নূরী বেগম লাউডগার মতো ঘাড়টা তার দিকে বাঁকিয়ে নিয়ে আদুরে স্বরে আবার বললো, কাল আমাক দশ হাজার ট্যাকা দেবেন কিন্তু। দরকার আছে। লাগবিনে। দেবেন তো? দশ হাজারই কিন্তু। এক টাকা কম হলিও হবিনানে।
এ কয়ডা টাকা আবার টাকা নাকি! দেবোনে। এ সময়ে নূরী বেগমের টাকা চাওয়ায় ইমতিয়াজ আলী খুশিই হয়। নূরী বেগমকে তার মুহূর্তে ক্রয়কৃত দাসী মনে হয়। ক্ষমতাধর মনিব হয়ে ওঠে সে।
ইমতিয়াজ আলী নূরী বেগমকে আদও করে ঘর থেকে বেরুতে বেরুতে ভাবে, গ্রামের একটা অশিক্ষিত মেয়ে এতো সাহসী হয় কী করে! এতো বোঝে কিভাবে! সাবিনার কথাও জানে, তার মায়ের কথাও জানে। সরাসরি সে সব বলে ফেলে কিভাবে! যেখানে আমি নিজে তার প্রতি উন্মত্ত হবো কি সে নিজেই তা হয়েছে। এসব ভাবনা তার মাথায় ঢোকে না।
বারেক মেম্বারের সঙ্গেও নূরী বেগমের এই একই সম্পর্ক। বারেক মেম্বার বিদ্যুৎ চলে যাবার পরে নূরী বেগমের ঘরের কাছে এসেছিল, কারণ ইমতিয়াজ আলী মাহফিলের কাছে বাগানের কোথাও ছিল না। সে ধারণা করেছিল ইমতিয়াজ আলী ঠিক নূরী বেগমের ঘরে গেছে। ঘরের কাছে এসে কান পেতে ঠিকই সে বুঝেছে তার অনুমান ঠিক। বরং এতে সে খুশি হয় এখন থেকে নূরী বেগম ও ইমতিয়াজ আলী দুজনকেই আচ্ছামতো জব্দ করে নিয়মিত টাকা আদায় করতে পারবে। বারেক মেম্বারের কাছে এ যেন নিজের বউকে পরের কাছে দিয়ে টাকা উপার্জন করার মতো ব্যাপার। কারণ বারেক মেম্বারের সাথে নূরী বেগমের অনেকদিন ধরেই শরীরী সম্পর্ক চলে আসছে। সেই নূরী বেগম যে অন্য আর এক পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছে তাতে বারেক মেম্বারের একটুও খারাপ লাগলো না, তার রুচিতেও বাঁধলো না। কিন্তু সে তা বুঝেও না বোঝার মতো ভান করে দ্রুত বাগানবাড়িতে গিয়ে মাহফিলে ব্যস্ত থাকে। কারণ এ সম্পর্ক নিয়ে আপাতত কোন কথা তুললে বা বাধা দিলে তার নিজেরই ক্ষতি। তখন আর টাকাপয়সা নাও দিতে পারে ইমতিয়াজ আলী। নূরী বেগমও বেঁকে বসতে পারে। পীরবাড়ি ছেড়েও চলে যেতে পারে ইমতিয়াজ আলী। ভাবে, নূরী যা করে করুক, যার কাছে শোয় শুক, আমি ট্যাকা পাইলেই হয়। গড়াই নদীর স্রোতের মতো ওরা ভাসি যাক গে তাতে আমার কী!
ইমতিয়াজ আলী একসময় বউ-বাচ্চা নিয়ে পীরবাড়িতে এসে থাকলেও, পরবর্তীতে তাদের না এনে একা একাই এসে থাকে। পীরবাড়ি তার কাছে নারীসঙ্গলাভের অবাধ ও নিশ্চিন্ত জায়গা হয়ে ওঠে।যেন সব কুসুমই এখানে তার জন্য ফুটে থাকে। টাকা ছড়ালে সব এসে হাজির হয় নিজের থেকেই। আলিমুদ্দিন একআধটু ঝামেলা করার চেষ্টা করলেও তার সঙ্গে পেওে ওঠে না টাকার জোরের কারণে। চেহারারও একটা গুরুত্ব আছে। ইমতিয়াজের সুন্দর চেহারাটাও নারীদের আকৃষ্ট করে। আলিমুদ্দিন বহু টাকা ঢেলেও ইমতিয়াজ আলীর কারণে নিজের কোন অবস্থান তৈরি করতে পারে না। সে কারণে অনেক ক্ষুব্ধ সে ইমতিয়াজ আলীর উপর। বারেক মেম্বারের সঙ্গে যুক্তি করে তাকে অপমান অপদস্ত করে বিতাড়িত করার পরিকল্পনা করে আলিমুদ্দিন। আলিমুদ্দিন জানে কাজটা অত সহজে হবে না। বারেকও তা জানে। বরং অঅলিমুদ্দিনের কাছ থেকে এ সুযোগে বড় অঙ্কের টাকা বাগিয়ে নেয়।বারেক মেম্বার জানে ইমতিয়াজ আলী যেভাবে সবকিছু দখল করে নেছে, নূরী বেগমের সঙ্গেও যে সম্পর্ক, তাকেই কখন যে সে ভুলে যায়!
মনে মনে আতঙ্কিত হয়ে ওঠে সে। ভাবে, বেশিদিন এ্যাম্বা চলতি দিয়া যাবি না। নূরীকে নিয়ে সে ভাগবে। নূরীর কাছে অনেক টাকা আছে। ইমতিয়াজ আলীর কাছ থেকেও বড় অংকের টাকা বাগাতে হবে নূরীর সঙ্গেও সম্পর্কেও কথা বলে। তারপর নূরী বেগমকে দূরে কোথাও গিয়ে আরাম-আয়েশে কিছুদিন কাটানো যাবে। তারপর তাকে ছুড়ে ফেলে দিলে কেউ বুঝতেও পারবে না। জানবেও না। নিজের মনের গোপন ইচ্ছে গোপন করেই ভরা নদীর মতো আবেগ দিয়ে নূরীকে সে সব বোঝাতে থাকে। নূরী প্রধম প্রধম অরাজি হয়। বলে, এখানে থেকেই তো আমরা গোপনে নিশ্চিন্তে সব কিছু করতে পারতিছি। ট্যাকার ট্যাকাও পাচ্ছি। সম্মানও পাচ্ছি। তুমি আমি নিশ্চিন্তে একসাতে শুতিও পারতেছি। চলি যাওয়ার কী দরকার! আমি যাবো না।
এখানে থাকলি তো তুমি আমার বউ হতি পারবানে। আর তুমিও তো নিজেকে হারা ফেলতিছো। ইমতিয়াজ আলী তোমাক যে পাওয়া পাইছে, আর ছাড়বিনি মনে কর? ও লোকের অনেক ট্যাকা। তুমি আর আমি তো তার কাছ থেকে কম খাসাইনি। আরো কিছুদিন খসা নিয়ে চলো দুজনে কোথাও যেয়ে ঘর বাঁধিগে। আমার তো ভয় হয়, কোনদিনে আলিমুদ্দিনও তোমাক খ্যায়া ফেলবিনি। তুমি বাঁচবানে ক্যাম্বা? আর আমরা চুরি করে এসব করার চেয়ে কোথাও চলি যাওয়া ভালো না! এখনি তো যাতি কচ্ছি নে। আবার আমি যদি কোথাও বিয়ে করি ফেলি, তখন তো আর তুমি চাইলেও আমার বউ হতি পারবানে। ইমিতিয়াজ আর আলিমুদ্দিন তোমাক নিয়ে যা করতেছে, যা কথা ছড়াচ্ছে, কয়দিন পর তো সবই যাবিনি।
আমি চলি গেলি পীরের কী হবিনি? দুর্নামে তো ওর মাথা ভরি যাবিনি।
পীরের কথা ভাবতি গেলি তোমার আর আমার কিছু হবিনানে। আর পীর কী ভালো! বাদ দাও, তোমার যখন ইচ্ছে নাই। তুমি আসলে ইমতিয়াজ আলী আর আলিমুদ্দিনকে ছাড়ি যাতি চাচ্ছো না। পীরও তো তোমাক ওদের কাছ ঠেলে দিয়ে রাখেছে। পীর তো ট্যাকার পাগল। বউ দিয়ে হোক আর য্যম্বাই হোক ট্যাকা পালিই হয়! পীর তো ট্যাকার কাছে বেচা।
তুমিও তো তাই। ইমতিয়াজের সাথে আমার সম্পর্ক তো তুমি জানিউ মানি নিছো। কী জন্য? ট্যাকার জন্য।
কথা ঠিকই কইছো। আমিও তো ট্যাকার লোভে তাই করতেছি। এটা বেশিদিন করা যাবি না। থাক, যাতি না চাও, ভালো। তুমি তোমার মতো য্যাম্বা আছো, সেম্বাই থাকো। আমিও দেখি একটা ভালো মেয়েটেয়ে খুঁজে বিয়ে করে আমার মতো থাকি। আমার ট্যাকার লোভ আছে সত্যি। ট্যাকার লোভেই ইমিতিয়াজ আলীকে কিছু কই নি। না হলি ওকে আমি কাটি গড়াই নদীতে ভাসায়ে দিতাম।
বারেক মেম্বারের বিয়ের কথা শুনে নূরী বেগমের বুকের ভেতর গরম খুন্তি লাগার মতো ছ্যাৎ করে ওঠে। টাকার লোভে ইমতিয়াজের সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে উঠলেও, সেখানে হৃদয়ের কোন কিছু না থাকলেও, শরীরী সম্পর্কটুকু ছাড়া। হৃদয়ের সম্পর্ক তো বারেকের সাথে। মন দিয়ে শরীর তো শুধু বারেককেই পায়। সে ভাবে, ইমতিয়াজের আগ্রহ তো কয়দিন পরে থাকবিনানে। আর ট্যাক্রা কয়দিন সে ঢালবিনে তারও তো ঠিকঠিকানা নেই। পুরুষ মানষের সবকিছুই তো মনস্বাধীন। এ বাড়িতে দৈনিক কত মেয়ে আসে কত মেয়ে যায়, কখন কে ইমতিয়াজের নজরে পড়ে কে জানে! মেয়েমানুষকে কাছে টানার মতো সব শক্তিই তো ওর আছে। যেমনি ট্যাকা আছে, তেমনি ফর্সা একহারা চেহারা। দেখতিও সেরকম! তেমনি ট্যাকা ছিটানোর হাত। সে চাইলে কে না ধরা দিবিনে! না চাইলেও কেঊ কেঊ ধরা দেয়ার জন্য নিজেই বসি থাকবিনে। তখন আমার প্রতি তো আগ্রহ থাকবিনানে। বারেক মেম্বার অন্য কাউকে বিয়ে করে ফেললি তখন তো ও পথও আমার বন্ধ হয়া যাবিনি। গাঁজাখুরি পীরের সাথে থাকা লাগবিনি সারাজীবন। ভাবে, না, বারেকের সাথেই চলি যাবো। বারেক এখন য্যাম্বা পা ধুয়ে মুছে তেল মাখা দিয়ে কদর করতেছে, পাক্কা রোদের মতো যৌবন ওর। কোন মেয়েক বিয়ে করে ফেললি তখন আর আমার অ্যাম্বা কদর থাকবিনানে। ওর রোদের জ্বালাও থাকবিনানে। যদি নিজের যৌবনই মনের মতো করে ভোগ করতি না পারলাম, এসব ট্যাকা দিয়ে কী হবি! যৌবন চলি গেলে কী আবার ফিরে পাবোনে! এ ভাবনা প্রবল হয়ে ওঠে তার মধ্যে। বারেক মেম্বারের সাথে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেয় সে। বারেককে তা একবারেই বুঝতে দেয় না। বারেককে দিনে দিনে মেঘফাটা রোদের তেজের মতো আরো তেজোদীপ্ত করে তার প্রতি আগ্রহী করে তোলে।
নূরী বেগমের সে ভাবনার কিছুই বুঝতে পারে নাবারেক মেম্বার। সে ক্রমশ উন্মত্ত হয়ে ওঠে নূরী বেগমকে স্থায়ী করে পাবার জন্য। নূরী বেগম ঠিক এরকম উন্মত্ত করেই তুলতে চায় তাকে। সে চায় বারেক তাকে পাওয়ার জন্য উন্মত্ত আবেগে দড়িছেঁড়া ষাড়ের মতো বেহুঁশ হয়ে উঠুক।
বারেক নূরী বেগমের জন্য যতটা না উন্মত্ত হয়ে ওঠে, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি উন্মত্ত হয়ে ওঠে তার টাকার জন্য। বারেক মেম্বার তা নূরী বেগমকে বুঝতে দেয় না। সে এমন এক ভাব করে চলে নূরী বেগমের প্রেমে সে যেন দিওয়ানা!
নূরী বেগমও ঠিক সেটাই বোঝে, বারেক মেম্বার তাকে সত্যিকার ভালোবাসে। বারেক মেম্বারের টগবগে যৌবনটাকে সে তার একদম নিজের করে পেতে তাকে নিয়ে দূর কোথাও চলে যাবার জন্য মন স্থির করে ফেলে।
নিজেদের পরিকল্পনা অনুযায়ী কিছুদিন পরেই বারেক মেম্বার ও নূরী বেগম গৌরী গ্রাম ছেড়ে বহু দূর চট্টগ্রামের অজ এক গ্রামে গিয়ে নতুন জীবন শুরু করে। বারেক মেম্বার যে ভাবনা থেকে নূরী বেগমকে নিয়ে এসে বিয়ে করেছে, সে ভাবনা থেকে সরে আসে। নূরী বেগমের যে পীর লিয়াকত আলীর সাথে তালাক হয় নি, সে কথা গোপনই থেকে যায়। বারেক মেম্বার নূরী বেগম ফাঁকি দিয়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার কথা ভাবলেও সে আর যায় না। কারণ সে নূরী বেগমের কাছ থেকে প্রচুর টাকা পেয়েছে। নূরী বেগম আসার সময় পীরের প্রচুর টাকা নিয়ে এসেছে।
ইমতিয়াজ আলীর কাছ থেকেও সে অনেক টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সব টাকাই সে বারেক মেম্বারের হাতে তুলে দেয়। টাকাগুলো হাতে পাওয়ার পর বারেক মেম্বার নিজের সঙ্গে নিজে অনেক যুদ্ধ করে। কখনো ভেবেছে নূরী বেগমকে ফেলে রেখে অন্য কোথাও চলে যাবে, আবার ভাবে, গৌরী গ্রামেই ফিরে যাবে। আবার ভেবেছে, না, থাক। নূরীর সঙ্গেই থাকি। ও এত ট্যাকা নিয়ে আইছে। পীরের ঘর ছাড়ি আইছে। আমারে তো বিশ্বাস করে সব আমার হাতে তুলে দিছে। আর নুরী পরের বউ হলিউ বয়স তো কাঁচাই। থাক ওকে নিয়েই থাকি। ও তো আমারে বিশ্বাস করি, ভালোবাসিই আইছে। বারেক মেম্বার নিজের আগের চিন্তা মাথা থেকে ফেলে দেয়। নূরীকে বিবাহিত বউ বলে সমাজে থাকতে শুরু করে। সবাই তা বিশ্বাসও করে নেয়। বারেক মেম্বার নতুন এলাকায় কিছু টাকা খরচ করে কয়েকজনকে মুরিদ বানিয়ে ধীরে ধীরে নিজেকে পীর বানাতে চেষ্টা করে। ক্রমেই তা কয়েক এলাকাতে নাম-ধাম ছড়িয়ে পড়ে। বারেক মেম্বার পীর হিসেবে পরিচিতি ও সম্মান পেতে থাকে।