দিনের শুরুতে আকাশে ধোঁয়ার মতো হালকা মেঘের নিবিড় আনাগোনা। ক্রমেই কালো মেঘে রূপ নিয়ে সূর্যের আলো ঢেকে দিলে আবছা অন্ধকার নেমে আসে। বৈঠক ঘরের দীঘল বারান্দায় চেয়ারে বসে পা দুটি সামনের দিকে এলিয়ে দিয়ে হান্নান শিকদার বিস্তীর্ণ মাঠের ওপারে পুবের গ্রামগুলোর দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে প্রতীক্ষারত—বাবার মৃত্যুবার্তা—এই তো আসবে। বাড়ির পাশের জামগাছে বসে কাকগুলো ডাকাডাকি করে খাবারের খোঁজে বের হয়ে গেছে—দিনের এমন বেগতি অবস্থা দেখে গ্রামের মানুষের শরীর ও মন আলস্যে ভরা—গাঝাড়া দিয়ে কাজে যাওয়ার তাড়া নেই। গভীর রাতে বাড়ির কুকুরটা উঠোনে করুণ সুরে ঘেউ ঘেউ করেছিল, আর তখনই হান্নান ধরে নিয়েছে বাবার দিন শেষ। ভোর থেকে গুমট স্তব্ধতা হান্নান শিকদারের চারপাশ ছাপিয়ে এখন অনেক দূরে বিস্তৃত হয়েছে—দূর-দূরান্তের আত্মীয়স্বজন এসে বাইরঘরের বারান্দায় প্রায়-নিথর হান্নানের মূর্তিমান মুখের দিকে তাকিয়ে কোনো কথা না বলে বাড়ির ভেতরে ঢোকে। হয়তো সত্যি, নয়তো ভান, মৃত্যুযাত্রী মানুষকে দেখতে এলে স্বজনদের মুখ যেমন ভার থাকে, গম্ভীর থাকে, ঠিক তেমন। রান্নাঘরে টুনটান সামান্য শব্দ সারাবাড়ির নীরবতায় ফোড়ন কাটে—আয়োজন যা হচ্ছে তা শুধু ছেলেপুলেদের খাবার। ছোট ভাইটি ঢাকা থেকে এখনো আসেনি, যদিও রাতেই খবর দেওয়া হয়েছে।
গাঁয়ের কয়েকজন হান্নান শিকদারের পাশে এসে বসে। কেউ আদুল গায়ে, কেউ গেঞ্জি গায়ে। প্রতিক্ষিত—উৎকণ্ঠিত মানুষগুলোও নির্বাক ও নিশ্চলভাবে বসে—অপেক্ষা করে একটি খবরের—কখন?
বুকের কাছে শক্ত করে ধরে রাখা কোরআন নিয়ে তিন তরুণ মাদরাসার ছাত্র (তিনজনই) হান্নান শিকদারকে সালাম দিয়ে ঘরের ভেতরে গিয়ে বসে। বিছানা আগেই পাতা ছিল, তারা উচ্চৈঃস্বরেই কোরাআন তেলয়াত শুরু করে।
ক্রমে মেঘ আরও ঘনায়িত ও কালো হয়ে দিনের আলো শুষে নেয়। মাঝে মাঝেই দমকা বাতাস, কখনো হালকা বহমান হিম—শরীরে কাঁপন জাগায়।
সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে ঘনায়িত মেঘপুঞ্জ হঠাৎ ঝমঝম করে যেন ঘরা থেকে জল ঢেলে কিছুক্ষণ পর থেমে গেলেও মেঘখণ্ডদের ব্যস্ততায়, ছোটাছুটিতে, সাদাকালোয় রং বদলানোর খেলায় সূর্যের মুখ দেখার কোনো উপায় নেই। আকাশের সমস্ত অস্থিরতা এ বাড়ির সবার মনেও ঠাঁই করে নেয়। এমন সময়ই বাড়ির ভেতর থেকে একটি সরু অথচ নাকি সুরের কান্না ভেসে আসে। এরকম হঠাৎ হঠাৎ কান্নার সুর রাত থেকেই বাতাসে ভেসেছে অনেকবার। তাই হান্নান শিকদার এবারও এই কান্নার হেতু নিশ্চিতভাবে উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়।
তবে ক্ষণকাল পরই সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। হান্নান শিকদারের কিশোরী কন্যা সীমা এসে বৈঠকখানার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, আব্বু দাদা মারা গেছে। তাড়াতাড়ি আসো—কথাটি বলেই সীমা বাড়ির ভেতরে অন্তর্হিত হয়।
বাবার মৃত্যুতে হান্নান শিকদারের মধ্যে তেমন বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি, যদিও মনে মনে বলেছে, ইন্নালিল্লাহ হে ওয়া ইন্নাইলাহি রাজিউন। সীমার কথা শুনে বারান্দার মানুষগুলো সীমার দিকে তাকায় বটে, তবে তার লাল ওড়নার প্রান্তটি ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায়নি। ঘূর্ণিবায়ুর মতো এসে খবর ছড়িয়ে নিমিষেই হাওয়া। সবার দৃষ্টি সেদিক থেকে ফিরিয়ে এনে হান্নান শিকদারের মুখে নিবদ্ধ করে—উৎসুক্য হলেও ছেলের বিকারহীন মুখ দেখে হতাশও হয়—তাদের মন ভারী হয়, দেখে, খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে হান্নান শিকদার।
গ্রামের দক্ষিণ পাশের খালের কিনারে খড়ের ছাওয়া তিনটি ঘরের যে বাড়িটি দেখা যায় তার একটি ঘরের খসে পড়া চালের নিচে শুয়ে আছে আলাউদ্দিন। খালের পার ছাপিয়ে উজানের পানি তরতরিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে ভাটির টানে—হাওরের দিকে। খুঁটিবাঁধা ডিঙ্গি নৌকোটি পানির তোড়ে তিরতির কাঁপতে কাঁপতে কিনারে এসে মিশেছে। এই ছোট বাড়িতে তেমন মানুষজন নেই, আলাউদ্দিন, তার স্ত্রী হালিমা আর ছেলে ও ছেলের বউ। আলাউদ্দিনের নিথর শরীরটি পড়ে আছে স্যাঁতস্যাঁতে মেঝেয় বাঁশের পাটিতে। বুকের ওপর টেনে দেওয়া ছেঁড়া কাঁথা—দুপায়ের আঙুল হলুদ, মুখ হাঁ-করা। আলাউদ্দিনের ঘরে হাউমাউ কান্না। ছেলেটি বাবার বুকের ওপর মুখ রেখে বলে, বাজান নাই, ও মা! বাজান তো নাই গো।
হালিমার হাড়গোড় ভেসে ওঠা কাতর শরীরটা বারবার আলাউদ্দিনের লাশের ওপর আছড়ে পড়ে, বিলাপের সুরে নানান অস্পষ্ট কথা থাকলেও একটি কথা স্পষ্ট শোনা যায়, ও আল্লাহ, তানার আগে আমারে ক্যারে নিলা না গো, আহা। ও আল্লা গো। আমি অহন কেমনে বাছাম গো।
মেঘের ঘনঘটা, মুখচোরা সূর্য কখনো সামান্য মুখ দেখায়, কখনো মেঘের আড়ালে লুকোয়। হালিমার কান্নার শব্দটি তীক্ষ্ম হয়ে বাতাসে ভাসতে ভাসতে আশপাশের বাড়িগুলোয় ছড়িয়ে পড়ে। সেসব বাড়ি থেকে নারী-পুরুষ-ছেলে-মেয়ে আলাউদ্দিনকে দেখার জন্য ছুটে আসে। ক্ষেতের আল ধরে হাঁটতে হাঁটতে ওরা খালের পারে আলাউদ্দিনের বাড়িমুখী হয়। তারা বলাবলি করে, দুজন মানুষ একদিনে বিদায় অইল, আল্লাহর খেলা বোঝা বড় কঠিন।
এ-গাঁয়ে খেটে খাওয়া মানুষের সংখ্যাই বেশি। শিকদার বাড়ির মানুষ ছাড়া আর কতজন দুবেলা পেটপুরে খেতে পারে তা অবশ্য দেখার বিষয়। খেটে খাওয়া মানুষদের আজ কাজ নেই, দুজন মানুষ মারা গেছে এক গ্রামে—আবার কাজ! এমন পাষাণ মানুষের বসবাস গ্রামে নেই বললেই হয়। অনেকে খাওয়া-দাওয়া সেরে তৈরি হয় দুজন মানুষের সৎকারের জন্য। ওরা দল বেঁধে এ বাড়ি থেকে ওবাড়ি যায়, ও-বাড়ি থেকে এ-বাড়ি। মাঝে মাঝে কালো মেঘে ছাওয়া আকাশের দিকে তাকায়, বিড়বিড় করে কী যেন বলে।
কার কোথায় গোর হবে—জায়গা ঠিক করে দিলেই কাজে নেমে যাবে।
কুড়াল, খুন্তি, কোদাল নিয়ে গোর খোঁড়া, বাঁশ কেটে কাফন তৈরি করা, কাফনের কাপড় আনতে রন্দিঘাটে যাওয়া, মাইকে ঘোষণা দেওয়া ইত্যাদি অনেকেই নিজ নিজ দায়িত্বেই শুরু করে দেয়।
বসির শিকদারের উইল করা জমিতেই গ্রামের গোরস্থান—গ্রামের মৃতদের শেষ ঠিকানা। তবে বসির শিকদারের জন্য বিশেষ স্থানে আর আলাউদ্দিনের জন্য সাধারণ স্থানে গোর খোঁড়ার জন্য হান্নান শিকদার জানিয়ে দেয়।
গ্রামের মাঝখানের শিমুল গাছের নিচে বসেছে একদল মানুষ। হামিদ বিড়িতে টান দিয়ে বলল, দুইডা মৌতা মরল একদিনে, আল্লার লীলা বুঝা বড় কডিন। দাফুনকাফুন করাই অহন বড় দায়িত্ব। আর যেম্বায় মেঘ নামে…কথাটা শেষ না করে একটু দম নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আবার বলে, কুন সোমায় ঢল নামে কওন যায় না। আসমানের অবস্থা দেধরক খরাফ। দিনে দিনেই দাফুন করা দরহার। জাহিদ, কলেজে পড়ে—সবাইকে দেখে খানিক স্থির হয়ে বলল, থানায় খবর দিছেনি?
হামিদ জানতে চাইল, ক্যারে? থানায় খবর দেওন লাগবে ক্যারে?
জাহিদ আনমনা হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, বসির শিকদার মুক্তিযোদ্ধা। রাষ্ট্রীয় সম্মান দিয়ে দাফন করার জন্য সরকারের হুকুম হইছে। তাছাড়া দাফন-কাফনের জিনিসপত্রও দিবো। খরচাপাতিও নাহি দিব। ঠিক জানি না। সরকারের নতুন আইন।
হামিদ একটু মোচড় দিয়ে সামনে এসে জাহিদের মুখ পানে ঝুঁকে পড়ে বলল, ঘটনাটা বুঝায়া ক’ছে হুনি। রাষ্টের সরমানডা কী?
জাহিদ বুঝিয়ে বলে, থানা থেকে পুলিশ আসবে, তারা লাশের কফিনে বাংলাদেশের পতাকা দিয়া, বুঝলা চাচা, পতাকা দিয়া ঢাইক্যা দিবো। তারপর স্যালুট দিবো। বুঝলা?
জাহিদের কথা শেষ হলে, একজন বলল, আরে বাপরে বিরাট সরমান। থানার পুলিশ আইবো, বিরাট বেফার!
ফটকু একটু ঘাড়ত্যাড়া ধরনের মানুষ। মুখে কথা লেগে আসে—তোতলা। সে বসা থেকে ওঠে দাঁড়িয়ে গামছা দিয়ে পিঠে আলতো বাড়ি দিয়ে বলল, তা তা তা ইলে বসির শিকদার এই সর.. সরমান ফাইবো ক্যা ক্যা রে? এই সর…মা.. মা মান ফাইবো আলাউদ্দিন। শিকদার কুনো…দি… নই যুদ্ধু করে.. রে রে নাই। যু.. দ..দু য়ের সোমা…য় গেরামেই আছি..ন। আলাল খা….ডি মুক..তি। নিব্বেজা.. ল।
জাহিদ বলল, সরকারি খাতায় বসির শিকদারের নাম। আলাউদ্দিন নামে কেউ নাই।
ফটকু কইলো, এই…ডা জালি…য়াতি।
শিমুল গাছের তলায় সকল উপস্থিতির মধ্যে কানাঘুষা শুরু হয়। ঘটনা কী? ঘটনা কী?
তরুণরা বলছে, সরকারি খাতায় যার নাম হেই সরমান ফাওনের যুগ্য। নাম না থাকলে সরমান ক্যার, হে?
হালকা-পাতলা গড়নের কঙ্কালের মতো ফটকু বলল, এই…ডা বেন্যায়। সরহারের খা….খা…তায় নাম থাকলেই মুক্তি অয়..য় না। ও মি…য়া…রা তোমরা কে…উ পরতি ..তি..বাদ করবা না?
বসে থাকা মানুষগুলোর মুখ থেকে রা বের হয়নি, কেউ কেউ মাটির দিকে তাকিয়ে রইল, কেউ কেউ চোখে চোখে চাওয়া-চাওয়ি করল। এসব দিয়ে সম্মানে কার কী আসে যায়? ওদের মাথায় এসব ঢোকে না। দুয়েকজন বুঝলেও শিকদার বাড়ির সঙ্গে টক্কা দেওয়ার মতো সাহস দেখানোর মানুষ এ-গ্রামে এখনো জন্ম নেয়নি একথা তারা হয়তো হলফ করে বলতে পারে। কেউ কেউ মনে মনে হাসল এই ভেবে যে, মরে গেলে সম্মান দেখালেই কী আর না দেখালেই কী? এ-রকম মিশ্র মনো-প্রতিক্রিয়া, সামান্য মিথষ্ক্রিয়ার কিছুক্ষণ পর কারো কারো ভাবান্তরও হয়।
মৌনতা কখনো তীব্র প্রতিবাদ, কখনো অসহ্য বেদনার উৎস। সবার মুখ পানে চেয়ে দেখে, হঠাৎ ফটকু বিদ্যুদ্বেগে শিমুলতলা থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। এর কিছুক্ষণ পরই অদৃশ্য হয় জাহিদ।
গ্রামের দুপাশের দুবাড়িতে দুটি মানুষের মৃত্যু হয়েছে, অনেকেই শোকে কাতর। এর মধ্যে আবার একটা বিরোধের আভাস পেয়ে দাফনকাফন করার জন্য স্বেচ্চায় আসা মানুষগুলোর চোখেমুখে দুর্ভাবনার কালো ছায়া পড়ে।
তাজুল চুপচাপ ওঠে শিকাদার বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়।
ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছে। কাদায় পূর্ণ হয়ে গেছে গ্রামের পথ। কোনো কোনো পথ বেশ পিচ্ছিল। পা টিপে টিপে হেঁটে তাজুল হান্নানের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।
হান্নান তাজুলের দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করে, মান্নান আইবো না?
হে আইতাছে। মাইক্রোবাস ভাড়া কইর্যা আইতাছে। কিছু কইবি?
থানায় খবর দিছোনি?
হ্যাঁ, মান্নানই সব ব্যবস্থা করছে।
একটা খারাপ খবর আছে।
কী খবর?
তোমার বাপ নাহি মুক্তি আছি না। মুক্তি আছিন আলাউদ্দিন।
কে কইলো?
তোতলা ফটকু। লগে জাহিদও সায় দিল।
হেরা অহন কই?
হেরা খাল মুইখ্যাই গেল। আলালের বাড়িত যায়নি…, কথাটা শেষ না করে হান্নানের দিকে তাকায় তাজুল।
হান্নান শিকদার যদিও এই সত্য জানে তবু আজ প্রকাশ করার কোনো উপায় নেই। সে জানে বাপের মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট দেখিয়ে মান্নানের চাকরি হয়েছে। এই সত্য যদি মিথ্যে প্রমাণিত হয় তাহলে শিকদার বাড়ি কালিমায় লেপে যাবে, আর মান্নানের চাকরিও চলে যেতে পারে। ক্রমে হান্নানের মুখ ভার হতে থাকে—বাবার মৃত্যুর জন্য যতটা না কাতর ছিল এখন তাকে তার চেয়ে অনেক বেশি কাতর দেখাচ্ছে; বুকের ভিতরে ফাঁকা শূন্যতা অনুভব করে—হাহাকার করে উঠে বুক। অজানা একটা কষ্ট সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পর তাজুলের হাত ধরে টানতে টানতে বাড়ির ভাঁড়ার ঘরে গিয়ে ঢোকে হান্নান। তাজুল সম্পর্কে তার ফুফাত ভাই। সময় অসময়ে শিকদার বাড়িতেই থাকে। লাঠিয়ালও বলা চলে।
তাজুল, কী করন যায় অহন? হান্নান শিকদার শুধোয়।
সামাল দেওন লাগব।
তুই যা, আমার মাতায় আর কুলাইতেছে না। কতাডা ফাঁস অইলে বড় বেজ্জেতি অউন লাগব।
তুমি ভাইবো না। আমিই সব ঠিক করতাছি।
তাজুল তার দুজনকে সঙ্গ নিয়ে বের হয়ে যায় তোতলা ফটকু আর জাহিদের খোঁজে। খালের পাড় ধরে ফটকু হেঁটে যাচ্ছিল। তাজুলরা তাকে সেখানেই ধরে ফেলে। ফটকুকে কোনো কথার সুযোগ না দিয়েই তার মুখ ও হাত গামছা দিয়ে বেঁধে পাঁজাকোলে নিয়ে গহিন জঙ্গলের গাবগাছের সঙ্গে বেঁধে রাখে।
জাহিদ নিরুদ্দেশ। সারাগ্রামেও তার খোঁজ মেলেনি। তাজুলের অন্তরে একটা কাঁটা বিঁধে আছে—কোনো ফ্যাসাদ বাঁধায় কিনা কে জানে?
দুজনের মৃত্যু সংবাদ সকালেই মসজিদের মাইকে ঘোষণা করা হয়েছিল, একটি শুক সম্বাদ, একটি শুক সম্বাদ, নবীগঞ্জ নিবাসী, বিশিষ্ট সমাজ সেবক, মসজিদের সাবেক সভাপতি, বীর মুক্তিযোদ্ধা, মরহুম বসির উদ্দিন শিকদার সকালে ইন্তেকাল ফরমাইয়াছেন। আইজ বাদ আছর তাহার জানাজা তার বাড়ির পাশের মাঠে অনুষ্ঠিত হইবে। আপনেরা সবাই জানাজায় শরিক হইয়া মরহুমের জন্য দোয়া করিবেন। এই ঘোষণার পরই আরেকটি ঘোষণা দেওয়া হয়, প্রিয় এলাকাবাসী, শুক সম্বাদ, শুক সম্বাদ, নবীগঞ্জ গ্রামের দক্ষিণ পাড়ার আলাউদ্দিন সকালে মারা গিয়াছে। তাহার জানাজাও বাদ আছর তার বাড়িতে অনুষ্ঠিত হইবে।
উঠোনের পাশে বরইগাছের নিচে আলাউদ্দিনের লাশ বাঁশের খাটিয়ার ওপর সাজানো।
রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মুক্তিযোদ্ধা বসির শিকদারের সৎকারের জন্য কালিপাড়া উপজেলা থেকে ইউএনও-র একজন প্রতিনিধি, থানা থেকে নয়জন পুলিশ সদস্য এসেছেন।
বসির শিকদারের কফিন জাতীয় পতাকায় সাজানো হয়েছে এবং ‘বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি’ লেখা কাগজটি ফুলের ডালিতে সেঁটে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঝড়োবাতাস আর মুষলধারায় বৃষ্টি শুরু হয়। জানাজার জন্য মানুষের প্রস্তুতি থাকলেও তারা শিকদার বাড়ির বৈঠক ঘরে আশ্রয় নেয়।
তাজুলের মনে এখনও অস্থিরতা রয়ে গেছে। তার চোখ খুব চঞ্চল, এদিক-সেদিক দেখে, খোঁজ রাখে কোনো অঘটন ঘটে কিনা। বাইরে জমাট ঘন অন্ধকারে অচল দৃষ্টি দিয়েই অনুচ্চ স্বরে বলল, বাফরে বাফরে, এমুন মেঘ বাফের জনমে দেহি নাই, যেবায় ঢলক নামল! সব ভাসাইয়া নিবো। এমন ঝড়োবৃষ্টিতে জানাজা পড়ার সাধ্য কার?
শিকদার বাড়িতেই বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় গ্রামের জানাজা পড়ুয়াদের। বসির শিকদারের জানাজা শেষ করে আলাউদ্দিনের জানাজা পড়ে দাফনকাফন করবে। কখন বৃষ্টি থামবে কে জানে? অজানা অস্থিরতায় মানুষগুলো যেন হাঁসফাঁস করছে।
দুবাড়ির আঙিনায় কফিনে সাজানো দুটি লাশ বৃষ্টিতে ভিজছে। ঘন অন্ধকারের বুক চিরে মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝিলিক। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ। খাল দিয়ে চড়চড় করে উজানের পানি নেমে যাচ্ছে ভাটিতে। বৃষ্টির ছাঁটে ভিজি যাচ্ছে ঘরের জিনিসপত্র। মৃতদের শোকে কাতর কিছু মানুষও ঝুম বৃষ্টির আমেজে আর হিমেল বাতাসের স্পর্শে তন্দ্রাচ্ছন্ন। পথপ্রান্তর কাদায় পরিপূর্ণ। কৃষকদের মনে সামান্য আতঙ্কও স্পষ্ট হয়ে উঠছে—এমন ধারার বৃষ্টি দীর্ঘক্ষণ হলে ক্ষেতের ফসল বিনাশ হবে। হায় খোদা! বৃষ্টি থামাও।
বৃষ্টি থামে এশার নামাজের পর। ইমাম সাহেব তাড়া দিচ্ছেন, তাড়াতাড়ি করেন। আবার বৃষ্টি নামতে পারে। দুই-দুইডা মৌতার জানাজা শেষ করা অহন বড় কত্তব্য।
পুলিশ সদস্যরা তৈরি হয়ে গেছেন। একজন হাবিলদারের কমান্ডে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হবে। অন্যরা হাবিলদারের পেছনে। তিনি বললেন, এখন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সশ্রদ্ধ সালাম প্রদর্শন করা হবে। অস্ত্র নামাও। বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সালাম প্রদর্শন করো।
পুলিশ সদস্যরা প্রথমে রাইফেল সামনের দিকে ওপরের দিকে তুললেন, তাতে বাম হাত দিয়ে আঘাত করে রাইফেল নিচে নামালেন। পায়ে আঘাত করলেন মাটিতে।
হাবিলদার আবার বললেন, বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সশ্রদ্ধ সালামের প্যারেড শেষ।
প্যারেড শেষ করেই থানার সদস্যরা দ্রুত গ্রাম ত্যাগ করলেন। এই বর্ষার পানিকাদা মারিয়ে তারা কিভাবে থানায় পৌঁছাবেন সে চিন্তায় অধীর—এখানে দাঁড়াবার জন্য আর কর্তব্য মনে করেননি।
দুটি মরদেহের জানাজা পড়া হলো।
দুবাড়ির আঙ্গিনা থেকে দুটি মরদেহ গ্রামবাসী রওনা হয় পাশের গোরস্থানে। দিনের বেলায় খোঁড়া কবরে এখন পানিতে থৈ থৈ। কয়েকজন যুবক গামলা দিয়ে কবরের পানি সেঁচে। অঝর ধারায় বৃষ্টি ঢেলে মেঘশূন্য প্রসারিত স্তব্ধ আকাশে ঘাসফুরের মতো অগণিত গ্রহতারা ফুটে উঠেছে। চাঁদহীন, জোছনাহীন দিগন্ত উপচানো পাথরের মতো ঝিমধরা কালো অন্ধকারে ঢাকা; ডোবানালা থেকে অসংখ্য ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ডাকে মুখরিত গোরস্থানের চারপাশ, নিকটাত্মীয় ছাড়া গ্রামের মানুষেরা জলকাদা মাড়িয়ে এখানে এসে মৃতদের অন্তিম শয়ানে সামিল না হয়ে নিজ নিজ ঘরে ফিরে গেছে। দুয়েকজনের হাতে হ্যারিকেন। সামান্য মৃদু আলো। লাশ বহনকারীরা বিরামহীন দোয়া দরূদ পড়ে যাচ্ছে। রাতজাগা পাখির ডানা ঝাপটানো শোনা যায়। বিশাল মাঠ বৃষ্টিজলে টইটুম্বুর, ঝিরঝিরে বাতাসে হিমের পরশ। গোরস্থানের মাটিও ভিজে থ্যাকথেকে কাদা, স্থানে স্থানে চিপচিপে পানি—এসব মাড়িয়ে গ্রামবাসী মৃতদের অন্তিম শয়ানের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
গোরস্থানে জাহিদ আর তোতলা ফটকুকে দেখে তাজুলের পেট মোচড়ায়! এদের গায়ের জামাকাপড় এমন জলকাদায় মাখা কেন? কিন্তু তার দুর্ভাবনার কথাটি কারও কাছে প্রকাশ করতে না পেরে নীরব থাকে।
নিজ নিজ কবরে এখন মৃতদের শায়িত করা হবে। মৃতদের কবরে শায়িত করার সময় বসির শিকাদারের মুখমণ্ডলটি শেষবার দেখার জন্য ইমাম সাহেব নিকটাত্মীয়দের ডাক দেন।
হান্নান শিকদার, মান্নান শিকদার, তাজুলসহ আরও কয়েকজন লাশের শিয়রের পাশে এসে বিনম্র শ্রদ্ধায় শোকাহতের মতো গম্ভীর হয়ে দাঁড়ায়।
শুভ্র কাপড়ে আচ্ছাদিত বসির শিকদারের মুখমণ্ডল উন্মোচন করা হলে সমবেত মানুষেরা বিস্ময়ে বিমূঢ়। সমবেত মানুষের বুকের ভেতরে অনুচ্চ ভাষা, ‘একি! আলাউদ্দিনের লাশ!’
মন্তব্য