এক.
কী দেখছ?—জায়নামাজ গুটিয়ে রাখতে রাখতে মাবিয়া প্রশ্ন করে খালেদ আব্দুল্লাকে। খালেদ তখন নিজেদের সম্পত্তির শেষ টুকরো লাল মসজিদ, তার পুকুর, ছড়ানো-ছিটানো গাছপালা, মসজিদের হাতার মধ্যে থাকা এফপি স্কুল, এক ডাক্তারের হেলথ সেন্টার আর খানদানি ছোট্ট গোরস্থানের দিকে তাকিয়েছিল। মাবিয়া খাতুন—চল্লিশ বছর আগে স্পেশাল অ্যাক্টে বিয়ে করা বিবি, পেছন থেকে এসে তার ডানকাঁধে হাত রাখে। বলে—কাফফারা দিতে ইচ্ছা করছে? আইডিওলজি বাধা? ছোট্টবেলায় এ গল্পটা তো শুনেছ। সম্বলহীন ইনসানেরা তিনটি উট পেয়ে তার কাছে গেলো। তারপর তার বলা আগের কথা মনে করিয়ে দিলো। তিনি কী বলেছিলেন? বলেছিলেন; নতুন ভালো রাস্তা খুঁজে পেলে আগের নেওয়া শপথের জন্য প্রায়শ্চিত্ত করো। তারপর নতুন পথকেই বেছে নাও। মনে পড়ে! যাও, না। নিজেদেরই তো মসজিদ; জুম্মাবারের নামাজটা পড়তে শুরু করো!
এককালে অ্যাকশান স্কোয়াডে ছিল খালেদ। উত্তর দেবে না ভেবেও বলে ফেলে, তুমি তো নিজের ফরজ ওয়াদা করে নিচ্ছ। বাকি দুনিয়ার জন্যেও কি তোমায় ভাবতে হবে?
—তুমি আমার স্বামী। তোমাকে ইমানের রাস্তায় নিয়ে আসাটাও আমার ফরজ!
খালেদ ঘুরে দাঁড়ালো।
—বাহ্! এই দুনিয়ার ভুখা ইনসানদের তকলিফ দূর করাটাই ছিল তোমার ফরজ। তুমি ইনকিলাব চাইতে, কমরেড মাবিয়া খাতুন।
ঘরে বোরখা পরে না মাবিয়া। তার মাথা হয়ে গলা—হিজাবে ঢাকা। নেকাব নেই। ফর্সা ধবধবে মুখের দুই গোল গোল চোখ থেকে ঘেন্নার বৃষ্টি এসে ঝলসে দিছিল খালেদকে।
—ইনকিলাব! তুমি এখনো বোখোনি। কিন্তু আমিও কি বুঝেছি? আপসোস এটাই, বহুত বখত নষ্ট হয়ে গেছে! ফরজ আদায় করো। চোখ বোজার সময় এসে গেছে। তারপরে কী করবে? আগুনের কড়াইতে সেদ্ধ হবে? সাপ-বিছের কামড় খেয়েই যাবে। কে বাঁচাবে তোমায়?
—মাবিয়া। তুমি না ডাইলেক্টিকস বোঝাতে। তুমি?
—দোজখ টানছে। অথচ তোমাকে বেহেস্তে যেতে হবে। এর থেকে বড় আর কি ডাইলেক্টিক্স আছে?
খালেদ বোঝে তার হার নিশ্চিত। তবু শেষ না দেখে ছেড়ে দেওয়ার ছেলে তো সে না— কেন তুমি এভাবে পিছলে গেলে মাবিয়া? কেন?
সামনে দাঁড়ানো অশরীরী অনেক সময় দিলো তাকে। একসময় ঝিরঝিরে হাওয়া বয়ে এলো পুকুর পেরিয়ে। ভেজা চোখেই সে দিকে তাকালো খালেদ।
মাবিয়া সরে এসে বিছানায় বসে। মুখটা দেয়ালের দিকে ঘোরানো। বলে, কলেজে পড়তে পড়তে দুজনেই নেমেছিলাম। তারপর কী সহ্য করিনি? আন্ডারগ্রাউন্ড, জেল? সংসারটাই হলো না। পালাতে গিয়ে বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে গেলো! তারপর তোমাদের গভর্মেন্ট এলো। শুরু হলো মুখার্জী, চ্যাটার্জী, সেন, বোস, মণ্ডলদের ছড়ি ঘোরানো। বন্ধ করতে পেরেছিলে? ওদের সেক্রেটারিয়েট মেম্বার হওয়া, কন্ট্রাক্টরি—ছেলে-মেয়েদের ইংলিশ মিডিয়াম, বিলেতের চাকরি—এমএলএ, এমপির টিকিট; আটকাতে পেরেছ? বাপ-মার শ্রাদ্ধে গুরুদশা, দুর্গাপুজোর অঞ্জলি সব চলে ওদের। ওতে নাকি জনসংযোগ হয়! আর তুমি নামাজ-কালাম করলেই দোষ? তুমি নিজের কাছে পার্টিজান। আর ওদের কাছে মোচড়মান। তাই না?
—ছিঃ মাবিয়া। ভাবতে পারি না। তুমি এইভাবে…ইস!
মাবিয়া থমকে যায় কয়েক মিনিট। তারপর গুঁড়িয়ে যায় একটা নদীর বাঁধ। তার চোখের জলে হড়পা বান ডাকে। হাবুডুবু খেতে থাকে চল্লিশ বছরের দাম্পত্য। কী ইবলিশ ইনসান! পরকাল নিয়ে ভাবনা নেই। কী এমন তকলিফ হতো ওদের কথা মেনে নিলে! ওরা তো বলেছে। শেষ বয়সে ওরা দেখবে। এই ভাঙা বাড়িটা নতুন করে দেবে। নাহলে কোনদিন চাপা পড়েই মরতে হবে।
মাবিয়ার বন্যা থেকে বাঁচতে পালালো খালেদ। মসজিদের পুকুরের ভাঙা ঘাটলায় এসে বসলো। চারিদিকটা দেখছিল সে। গুমোট গরমে তার শরীরটা আনচান করছিল। ঘরে, বাইরে কোথাও একটু শান্তি নেই! কী করবে সে? তার বোজা দুই চোখের মাথা সামনে ঝুঁকে পড়লো।
আচমকা ভয়ঙ্কর হাওয়ার স্রোত! চোখ খুললো খালেদ—আকাশ থেকে নেমে আসছে, ওটা কী! প্রায় দেড় মানুষ সমান উচ্চতার এক শ্বেত পুরুষ। দুধসাদা আলখেল্লা, মাথার চুল, সাদা শনের গোছা পাকানো। দুই কানে বড় বড় শাখার মাকড়ি। পুরু দুই ঠোটে স্মিত হাসি। জুঁই, হাসনুহানা, বেলি, গন্ধরাজ, রজনীগন্ধা—এক হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে তার শরীর থেকে। সে খালেদের সামনে এসে দাঁড়ালো। খালেদের গলা শুকিয়ে কাঠ। নানির মুখ থেকে শোনা গল্পের কথা মনে পড়লো—জিন—ভূত?
পুকুর-মসজিদ-ভাঙাচোরা কবরখোলা আর পুরো চত্বর ছাড়িয়ে গোটা সৈয়দপুরজুড়ে হেসে উঠলো সেই পুরুষ। এক লহমায় জীবনের সব কিছু হারিয়ে ফেললো খালেদ। ওর অস্তিত্বে, চেতনায় তখন শুধু সেই পুরুষ। বুক কাঁপতে লাগলো ওর। কী দেখছে ও! এত হ্যালুসিনেশন কেন হচ্ছে! মাথার শিরাগুলো কি ছিঁড়ে যাবে?
হাসির দমকায় কাঁপতে থাকা চারপাশ শান্ত হলো একসময়।
—ভয় পেয়েছ?
আবার অট্টহাসি। তবে মাত্রা নিচে।
ঢোক গিললো খালেদ, হ্যাঁ। কিন্তু আপনি কে?
—তুমি সারা জীবনে এমন হাসি শুনেছ?
আবার হাসি। উঁচু মাত্রায়। দুই হাত দুদিকে ছড়িয়ে হাসছিলো সেই শ্বেত পাথরের মূর্তি। হাসির দমকে পুকুরের জলে ঢেউ উঠছিল। হাওয়ার স্রোত আরও দ্রুততর । তার মাথার লম্বা লম্বা চুল, গায়ের ঢোলা পোষাক এলোমেলো হয়ে উড়ছিল। খালেদ আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছিল। মানুষটা খালেদের পাশে বসে।
—বুঝেছ আমি কে?
খালেদ মাথা নাড়ায়, ‘না’।
—এখনো বুঝলে না? আমি জিন। শহরের মধ্যে এখনো এতটা ফাঁকা জায়গা নিয়ে তোমাদের এই মসজিদ—এই পুকুর আমার খুব ভালো লাগে। তাই আসি এখানে। কিন্তু তোমায় খুব দুখি লাগছে। কী হয়েছে?
শির দাঁড়াটা শিরশির করে উঠলো খালেদের—আপনি জিন? কী নাম আপনার?
—আমার ইন্তেহান নিচ্ছ? বোকা মানুষ খালেদ।
পুকুরের এপার-ওপারজুড়ে গমগমে প্রতিধ্বনি।
—কী করে বলবেন? নিশ্চয় কোনো বুজরুক ফকির আপনি। আমায় হিপনোটাইজ করছেন। এদিকটায় নজর দেই না। সেই সুযোগে এসে ঘাঁটি গেড়েছেন।
অবশিষ্ট সাহস একটা ঝোঁক হয়ে বেরিয়ে এলো খালেদের বুকের ভেতর থেকে। মুখটা ঝুঁকিয়ে একেবারে খালেদের মুখের কাছে নিয়ে এলো শ্বেতমানব। ফুলেল খুশবু তার সঙ্গে মিষ্টি আতরের গন্ধ। আগন্তুকের নেশা নেশা নিশ্বাস এসে আক্রমণ করলো খালেদকে। তারপর চোখের পলক পড়তে পারলো না! মানুষটা আর নেই।
একটা হাততালি। যেন শ্রাবণের জমাট মেঘ। খালেদ তাকালো ডানদিকে। প্রাইমারি স্কুলের ছাদের ওপর লোকটা। হাততালি দিচ্ছে—কে আমি? হা হা হা! কে আমি? অট্টহাসি আর হাততালি মিশে যাচ্ছে। খালেদের মনে হচ্ছে পাহাড় কেটে এই কোন ঝর্ণা লাফ দিয়ে পড়বে। কয়েকটা মিনিট। এবার বাম দিকের হেলথ সেন্টারের মাথায় লোকটা। আরও কয়েক মুহূর্ত। এবার, একেবারে পঞ্চরত্ন মসজিদটার মাঝের বড় গম্বুজটার ওপরে। সেই প্রাণ উড়িয়ে দেওয়া হাসি, হাততালির বিদ্যুৎ আর ঝর্ণার গর্জন—কে আমি? কে আমি?
খালেদ কেঁদে ফেললো। দুই হাতে মুখ ঢেকে কাঁদছিল খালেদ। কান্না, তার কাছে সবচাইতে ঘেন্নার। তবুও। কিন্তু কেন? সারা জীবনের যুক্তি ভেঙে যাওয়ার জন্য? এক অশরীরী শক্তি তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তার জন্য? নাকি যে ভয়ের সুড়ঙ্গ কাল তাকে পেরোতে হবে, তার জন্য? সে নিজেও বুঝতে পারছিল না। তবু ভেতর থেকে ডুকরানি উঠেই আসছিল। সামনে দাঁড়ানো অশরীরী অনেক সময় দিলো তাকে। একসময় ঝিরঝিরে হাওয়া বয়ে এলো পুকুর পেরিয়ে। ভেজা চোখেই সে দিকে তাকালো খালেদ।
দুই.
অলৌকিক পুরুষ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল, তুমি খুব সৎলোক। বলো কী চাও?
—এই পুকুরে কেউ আর বিয়ের জলঘট ভরতে আসে না। কতদিন শুনিনি গঙ্গার ঘাটে বাঁশি—‘বাজে গো কমলা/ আমরা চলো যাই।’ বিয়ের গান!
—বিয়ের গান শুনবে? তুমি না বিপ্লবী?’
কোথাও কোনো আওয়াজ আর নেই। ডানপিটে কুকুরেরাও চুপ করে গেছে! ভেজা-ভেজা হাওয়ায় বুকভরে শ্বাস নেয় খালেদ, বিপ্লব? জিন, তুমি বিপ্লবের কী জানো?
—জিন কী না জানে? মানুষ খালেদ, তুমি বলো।
কী মায়া জিনের গলায়! কলজের ভেতরে একটা নাদেখা চাকু হঠাৎ খোঁচা মারে। কথা ভারী হয়ে আসে খালেদের—জানো জিন? আজকাল কেউ আর এ পুকুরটায় ঠাকুর ভাসান দেয় না। পুরো সৈয়দপুর ভেঙে পড়তো এই ঘাটে ভাসানের সময়।
কোন গাছের অন্ধকার কোটর থেকে একসঙ্গে কিছু পোকা ডেকে ওঠে—কট্টর…কট্টর।
—এই জন্যই মাতব্বর উকিল মাহামুদ আলী বলে বেড়াচ্ছে, তুমি কাফের।
ডাকটা ছড়িয়ে পড়ে—কট্টর…কট্টর…কট্টর।
ওই ফুলগাছগুলো—ওই যে টগর, জবা, শিউলি, লঙ্কাজবা, কলকে—এই ফুলবাগান আমি জন্ম থেকে দেখছি। স্নান সেরে এখান থেকে ঠাকুর পুজোর ফুল নিত সবাই। জিন! কেউ আর আসে না স্নান করতে! কে ফুল তুলবে? দেখো দেখো—ঝরা ফুলের পচা দেহ মাটিতে মিশে কাদাকাদা হয়ে আছে! খালেদকে দেখে জিন দুচোখ বুজে ফেললো—যাদের জন্য কষ্ট পাচ্ছ? তারা কে খালেদ? এই তোমার মসজিদ, তোমার পুকুর, বাগান, তোমাদের কবরখোলায় তারা কি আসতে পারে? সাচ্চা ঈমানদার এভাবে ভাবে না!
মুদিত দুইচোখ বন্ধই থাকে জিনের। খালেদের বুকের মধ্যে কেন যেন দূর্গা পুজোর ঢাক বেজে ওঠে—জিন…ছোট্টবেলা থেকে কী দেখেছি জানো? ওই যে সীমানা! ওর বেড় দিয়ে ওই যে রাস্তা! ওখান দিয়ে যারাই যাচ্ছে। মসজিদের দিকে ফিরে দুই হাত কপালে ঠেকাচ্ছে, আজকাল কেউ আর এদিকে ফেরে না!
জিন চোখ খোলে। তার দুচোখের মণিতে একটা হালকা সবুজ আভা।
—মানুষ খালেদ। তুমি কী বলছ জান! তোমার দুশমনেরা তো এই কথাগুলোই বলে বেড়াচ্ছে। তুমি কৌমের বিরোধী!
—জিন। আমাদের এই সাত পুরুষের লাল মসজিদ। যেন লাল মসজিদই থাকে। এইটাই চাই আমি। তুমি পারবে না জিন, পারবে না?
ঘুমিয়ে থাকা শিশুর মতো মুচকি হাসি হাসছে জিন—মসজিদের রঙ লাল হোক কী নীল, তাতে তোমার কী আসে যায়! তুমি ঈমানদার হও মানুষ খালেদ। ঈমানের পথে চলো! মসজিদ ইবাদতের জায়গা। এছাড়া তুমি তো এসব কিছুই বিশ্বাস করো না! লাল থাকলেও যা হবে নীল থাকলেও তো তাই। তোমার তাতে কী!
নরম কাদায়, এক পা তোলে তো, অন্যপা আরও বেশি ডুবে যায় খালেদের। তবু বলে, আমি যে একা হয়ে গেছি। আমার পার্টি দুর্বল। মানুষ সরে যাচ্ছে দিনদিন। পাঁচ আঙুলের মুঠো না হলে ঘুষি হবে কী করে?
নজর ঝাপসা হয়ে যায়। চোখদুটো জ্বালা করে। দু-এক ফোঁটা নোনাপানি গড়িয়ে পড়ে খালেদের দুইগাল বেয়ে—আমি একটা অন্ধ গলির শেষে এসে দাঁড়িয়েছি জিন। সামনে কি পেছনে কোনদিকে যাওয়ার উপায় নেই। খুব তেষ্টা পায় জানো। বাঙালপাড়ার শীতলা পুজোর প্রসাদ—ঠাণ্ডা আমানি। তাই খেতে ইচ্ছে করে খুব। কালু, আমি, বাবু, সিরাজ আমরা দল বেঁধে যেতাম। দুহাতে আঁজলা ভরে খেতাম। বুকের ভেতরটা ঠাণ্ডা হয়ে যেতো! এখনো যাই দাঁড়াই প্যান্ডেলে। ওরা কথা বলে। তারপর যেন ইচ্ছা করে ভুলে যায়। চাইলে বলে। ফুরিয়ে গেছে। চাঁদা দিতে চাই। নেয় না। বামুনপাড়া, সাহা কলোনি, বাঙালপাড়া, ধোপা পাড়ার মেয়ে-বৌরা বাচ্চা নিয়ে রোজ সন্ধ্যায় জলপড়া নিতে আসতো এখানে। হ্যাঁ, এই লাল মসজিদে। রোজ সন্ধেতে। দূর থেকে দেখতাম! কেউ আসে না আর! আরও ডুকরে ওঠে ওর বুকের ভেতরটা। দুই হাত দিয়ে ওর দুই গাল মুছে দেয় জিন। খালেদ বোঝে না কেন এত আপন মনে হচ্ছে এই অবিশ্বাস্য লোকটাকে! তার দুই হাত চেপে ধরে সে! বলে, মসজিদের এই চেনা লাল রঙ নাকি আমায় নিভিয়ে দিতে হবে। উঁচু দেয়াল দিয়ে একে জেলখানা বানাতে হবে। এর চত্বরে বাচ্চারা আর খেলবে না! ওই যে হাতার মধ্যে প্রাইমারি স্কুল আর সরকারি ডাক্তারখানা, নানা কত তদ্বির করে বসিয়েছিল সৈয়দপুরের জন্য। সব আমাকে তুলে দিতে হবে? নাহলে…
—নাহলে?
—নাহলে? ওরা আমায় ভয়ে দেখাচ্ছে!
—কারা?
—কজনের নাম বলবো। তুমি তো জিন। তুমি সব জানো। মরতে ভয় নেই। কিন্তু আমি জান থাকতে পারবো না!
জিনের চোখে এক রহস্যময় আলো আর অন্ধকার একসঙ্গে খেলছে দেখতে পায় খালেদ। জিন বলে, মানুষ খালেদ। তুমি এসব কেন ভাববে? তুমি না ইনকিলাবি? ইনকিলাবের জন্য তোমার জান কবুল । পুজো, জলপড়া, নামাজ, কৌম নিয়ে তোমার কিসের এত জ্বালা! ছাড়ো এসব। যাও ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। অনেক রাত হয়েছে। যাও।
জ্বিনের গলাটা কি একটু কর্কশ লাগে? ওর চোখ দুটোতে কি লালজবার রঙ দেখতে পায় খালেদ? আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকায় সে। ধোঁয়াশা আর নকল আলোর বাঁধ পেরিয়ে একটা তারাকে খসে পড়তে দেখে—বাড়ি আমি যাবো না জিন। তুমি যেখান থেকে এসেছিলে, সেখানে চলে যাও। এ আমাদের জমিন-পানি। তুমি এখান থেকে যেতে বলার কে?
আবার সেই দশদিক কাঁপানো ওলোটপালোট হাসি। বাজতে থাকে খালেদের চেতনে-অবচেতনে, পুকুর-মাটি-গাছ-রাস্তা, দূরের ওই দোকানগুলো। তারপরে কাঁড়িকাঁড়ি বহুতল এপাড়া-ওপাড়া, এই ওয়ার্ড থেকে ওই ওয়ার্ড হয়ে গোটা শহরজুড়ে। জিন হেসেই চলে। খালেদ খুঁজে পায় না তার পায়ের তলার মাটি।
—গায়ে লেগে গেলো, মানুষ খালেদ? তাহলে আমার পায়ের কাছে গড়াগড়ি দিচ্ছ কেন? তুমি কি নিজে কিছুই করতে পারো না?
বাঁধভাঙা বন্যার জল সরে গেছে। নরম কাদায়, এক পা তোলে তো, অন্যপা আরও বেশি ডুবে যায় খালেদের। তবু বলে, আমি যে একা হয়ে গেছি। আমার পার্টি দুর্বল। মানুষ সরে যাচ্ছে দিনদিন। পাঁচ আঙুলের মুঠো না হলে ঘুষি হবে কী করে?
ঘাটের সিঁড়ির একেবারে শেষধাপে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল জিন। জলের অর্ধবৃত্ত ঢেউয়ে তার প্রতিবিম্ব কাঁপছিল তিরতির করে।
—এখানে এসো মানুষ খালেদ!
জীবনে প্রথম মন্ত্রমুগ্ধ কথাটার মানে অনুভব করে খালেদ। তারপর ঘাটের ভাঙা চাতাল থেকে একপা একপা করে নিচে নেমে আসে।
—একটা ছুঁচলো দাড়ি, কটা চোখের, বুড়ো লোকের গল্প বলি। তুমি জান খালেদ। তবু বলছি। লোকটাকে না! তারা, মানে তারই নিজের কাফিলার লোকেরা তাড়িয়ে দিয়েছিল। তবু লোকটা হেরে যায়নি। বারবার তাকে ওরা তাড়াতো। আর সে বাড়ি গিয়ে নিজের হাতিয়ারে শান দিতো। বাদশাহ, উজির, নাজির, সিপাহসালার—পুরো বাদশাহির শুধু ওই বাদশাহী কেন তামাম দুনিয়ার সব বাদশার সেপাইরাই তাকে খুঁজছিল, সে তো সবার দুশমন। তাকে পেলেই কতল করবে। কিন্তু তার তো একটাই খোয়াব। তার উস্তাদ যে তাকে শিখিয়েছে—বাদশাদের দিন শেষ। এবার আওয়ামের পালা! তবে সেও বড় আসান কাজ না। হরবখত নজর রাখতে হবে। আওয়াম যেন নিজেরা, নিজেদের দুশমন না ভাবে। যেন ভাগ না হয়! আওয়াম ভাগ না হয়!
জ্বিনের দুচোখে আবার সবুজ আভা।
—এই একটাই তো দোয়া জিন। সৈয়দপুরে শুধু সৈয়দপুরে কেন এই দুনিয়ার কোত্থাও, কক্ষনো কোনো ভাগ না হয়! হুঁশ হওয়া থেকে দেখছি; সব্বাই,যার সারা দেহে রসকলি সেও বলছে—লাল মসজিদ আমাদের। আমাদের সবার। সেটাকে বাঁচাও জিন! ভাগ হতে দিও না।
ওর বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা সেই আলোর পাত বরাবর একটা আলো ঝলসানো তলোয়ার আর একটা সোনালি-আগুন রঙের পাখাওয়ালা ঘোড়া মূর্ত হয়ে উঠলো কয়েক লহমায়।
প্রশ্নের উত্তর দেয় না জিন। বলে চলে—সেই ছুঁচলো দাঁড়ি একাই ছিল বুঝলে? কিন্তু সে ভয় পায়নি! সে রোজ গিয়ে তাদের দেখাতো তার হাতিয়ার কত ধারালো। তাতেই কাজ হবে। খেতো গলাধাক্কা। কিন্তু সে কিছুতেই দমেনি। খেতে, খেতে একদিন তার কাফেলার লোকেরা তাকেই বানিয়ে নিলো নিজেদের সিপাহসালার। তারপর কী হলো, জানো?
তিন.
—সে শক্তি আমার নেই জিন! আমি এক দুর্বল মানুষ।
খালেদকে সঙ্গে করে জিন চলে এসেছিল মসজিদের খোলা চত্বরে। খালেদ তখনো জিনের দুই চোখের তারায় ছুঁচলো দাড়ি মানুষটার গল্পের ছায়াছবি দেখতে পাচ্ছিল।
—তুমি সারা জীবন ইনকিলাব জিন্দাবাদ, ইনকিলাব জিন্দাবাদ বলে গেলে। তাহলে কোন শক্তিতে ইনকিলাব করবে ভেবেছিলে?
—আমি তো আগেই বলেছি। পাঁচ আঙুল দিয়ে মুঠো তৈরি করতে পারছি না। কাদের নিয়ে কিছু করবো? একা কী করতে পারি আমি?
—তুমি পারো। বহুত তাকতওয়ার তুমি!
—না। আমি দোয়া করছি, তুমি বাঁচাও আমার মসজিদটাকে।
—আমি শুধু জাদু করতে পারি। মানুষ খালেদ, শুধু জাদু!
কথাক’টা কুয়াশা হয়ে ভিজিয়ে দিল খালেদকে। কিছুক্ষণ আকাশের দিকে চেয়ে রইলো জিন। তারপর স্ফটিক স্বচ্ছ হাতদুটো দিয়ে খালেদের বুক স্পর্শ করলো।
একটা চূড়ান্ত ওলোট-পালোট হয়ে গেলো যেন! নিজের ভেতরে প্রচণ্ড ঘূর্ণি উঠে আসছে অনুভব করলো খালেদ। সেই ঘূর্ণির ধাক্কায় ওর বুকের দেয়াল চুরমার হয়ে গেলো। সেখান থেকে প্রথমে বেরিয়ে এলো নীল-সবজে-বেগুনি রশ্মির একটা পাত। কোনো যন্ত্রণা হচ্ছিল না ওর। তারপর অবিশ্বাস্য! যদিও বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সীমারেখা আছে কি নেই সেটাই খালেদ ভাবতে পারছিল না। তবু, ওর চোখের পলক পড়ছিল না। ওর বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা সেই আলোর পাত বরাবর একটা আলো ঝলসানো তলোয়ার আর একটা সোনালি-আগুন রঙের পাখাওয়ালা ঘোড়া মূর্ত হয়ে উঠলো কয়েক লহমায়।
জিন এগিয়ে গিয়ে মাটি থেকে তলোয়ারটা তুলে নিলো। তারপর দুই দিকে দুই ডানা মেলে মাটিতে পা ঠুকতে থাকা ঘোড়াটার লাগাম ধরলো।
—মানুষ খালেদ। রাতের এখনো অনেকটা বাকি। যাও। তোমার স্বপ্নের পথে যারা কাঁটা বিছিয়েছিলা, উপড়ে ফেলো তাদের। কিন্তু মনে রেখো, শরীরের মৃত্যু হয়ে লাভ নেই। ইবলিশের কবল থেকে যতক্ষণ না আত্মা, রুহ মুক্ত হচ্ছে, ততক্ষণ তারা লড়েই যাবে তোমার সাথে…যাও!’
কী বলছে জিন! অ্যাকশান করেছে সেই কোন কালে! এখন এই পয়ষট্টি বছর বয়স…সুগার , প্রেসার…চোখে ভালো দেখতে পায় না ও…মাঝেমাঝে হাতপাথরথর করে কাঁপে! ও চড়বে ঘোড়ায়! শিরদাঁড়ার মধ্যে একগাদা কিন্তু ছু্টোছুটি করতে থাকে। অপেক্ষা করতে থাকে জিন। তারপর তার অধৈর্য গলার স্বরে দাউদাউ আগুন জ্বলে ওঠে। সব মায়া ধোঁয়া হয়ে মিলিয়ে যায় আকাশে।
খালেদের বুকের ভেতরেও আনন্দাশ্রুর স্রোত বয়ে যাচ্ছিল। আর দেরি করলো না সে। আলো ঝলমলে তলোয়ারটার দিকে তাকাতে তাকাতে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।
—সব নিকাষ করে যখন ফিরে আসবে মানুষ খালেদ, দেখবে তোমার এই লাল মসজিদ-পুকুর-বাগান, তোমার জন্য সব পেয়েছির দেশ হয়ে গেছে। প্রতিটা ইট, মাটির কণা তখন বাজের আগুন। হাত দিতে কেউ আর সাহস পাবে না। যাও। যাও।
খালেদ এগোলো। জোরালো স্লোগান ভেসে আসছিল আকাশবাণী হয়ে—কমরেড নো পাসারান—কমরেড নো পাসারান!
চার.
অলৌকিক ঘোড়ার পিঠে খালেদ। দুই পাখা মেলে শহরের আকাশরেখার অনেক ওপর দিয়ে উড়ে চলেছে ঘোড়াটা। হাওয়ার ঝাপটায় মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছে পড়ে যাবে। নিচে তাকিয়ে দেখেছে রাতের শহর। একগাদা আলোর বিন্দু। বুক ঢিপঢিপ করলেও, সেই চল্লিশ বছর আগের উত্তেজনা ওকে সোজা করে রেখেছে। জিনের কথামতো বাম হাতে কোমরের তলোয়ার আর ডান হাতে ঘোড়ার লাগাম শক্ত হাতেই ধরে আছে সে।
সামনের আকাশ ঢালু হয়ে নামতে শুরু করলো। ঘোড়ার পাখা নাড়ানোর গতিও কমছে। খালেদ বুঝতে পারে প্রথম গন্তব্য এসে গেলো। ঘোড়াটা মসৃণভাবে মেহেতাব আলীর চারতলা বাড়ির খোলা ছাদে নেমে আসে। তলোয়ারটা ডানহাতে উঁচু করে ধরে ঘোড়ার পিঠ থেকে নামল খালেদ। ।জিন বলেছিল তলোয়ার ছোঁয়ালেই সব ‘সিমসিম’ খুলে যাবে। কী হবে, জানে না খালেদ। কিন্তু তার আর ভয় করছে না। ভেতর থেকে বন্ধ করে রাখা সিঁড়ির দরজার দিকে সে এগিয়ে যায়। এরপর একে-একে সেই দরজা পেরিয়ে দোতলার সদর দরজার সিকিউরিটি ফিটিংস। সেখান থেকে একেবারে মূল মাতব্বর উকিল মেহেতাব আলীর বিছানার পাশে। রুপোলি তলোয়ার থেকে আলো ঝলসে পড়ে মেহেতাবের চোখে। উকিল উঠে বসে। সামনে অস্ত্র হাতে খালেদ। মেহেতাবের বিস্ফারিত দুই চোখ ফেটে পড়তে চায়। জোর করে খালেদকে কৌমের মাথাদের কাছে প্রায় তুলে নিয়ে গিয়েছিল সে।
সেদিন সবাই মিলে ঘেন্না, লজ্জা আর ভয় মেশানো থুতু ছিটিয়ে দিচ্ছিল খালেদের মুখে। সে; মাসোয়াত…ইশত্রাকিয়াত…। সে নাস্তিক…তাই শুধু না। সে কাফের—ইবাদতের পাক ইমারত সে কাফেরদের দখলে দিয়ে দিচ্ছে। ইন্তেকালের পর তার খতরনাক দশা হবে। তাই নিজেকে বাঁচাতে, কৌমকে বাঁচাতে—সব দিয়ে দিতে হবে ট্রাস্টিকে। বদলে নিঃসন্তান খালেদ আর মাবিয়াকে দেখবে তারা। একমাসের মেয়াদ দিয়েছিল তারা। আজ রাতেই শেষ হচ্ছে সেই সীমা। কাল সকাল থেকে কী করবে এরা—আধো ঘুম আধো জাগা সেই চিন্তাটা খুব জোর ধাক্কা মারে খালেদের মাথায়। ও ভাবে কী করা উচিত এখন! এই তলোয়ারের এক কোপে মেহেতাবের মুণ্ডুটা উড়িয়ে দেবে?
একটা গোঁ-গোঁ আওয়াজে এবার মেহেতাবের দিকে চোখ পড়ে খালেদের। তার দুচোখ থেকে জল পড়ছে। দুই কষের দুই পাশ থেকে গড়িয়ে পড়ছে লালা। দুই হাত জোড় করে কিছু বলতে চাইছে। কিন্তু মুখ থেকে কোন আওয়াজ বেরোচ্ছে না। বিছানা থেকে উৎকট পেচ্ছাপের গন্ধ ভেসে আসছে। খালেদ আলো ঝলসানো তলোয়ার বিঁধিয়ে দিলো মেহেতাবের কপালের ঠিক মাঝখানটায়। তারপর চেপে ধরে থাকলো অনেকক্ষণ। আলোয় আলো হয়ে গেলো, ক্রিমিনাল কোর্টের ক্রোড়পতি উকিল। তার সারা মুখে তখন কী হাসি! তলোয়ার বের করে নিলো খালেদ। তার হাতদুটো জড়িয়ে ধরলো মেহেতাব।
—ভুল বলেছি ভাই। যা করেছি সব ভুল। বেহদ গুনাহ হয়েছে! নিজের পাপকে কোরবান করতে পারিনি। দোজখেও ঠাঁই হবে না আমার। মাজহাব নিয়ে বাড়াবাড়ি না করতে; তিনিই তো বলে গেছেন। মাথা গুলিয়ে গেছিল ভাই! সাড়ে সাঁইত্রিশ কাঠা—অনেক কোটির ব্যাপার। কথা ক’টা বলছিল মেহেতাব যেন স্বপ্নের ঘোরে। খালেদের প্রতিটা রোমকূপ থেকে বয়ে যাচ্ছিল আনন্দের স্রোত।
—এখন বুঝেছি ইবাদতের আসল জায়গা দিলো। আপনি আমার চোখ খুলে দিলেন খালেদ ভাই। মেহেতাবের মুখে এক অচেনা হাসি। একেই বুঝি স্বর্গীয় হাসি বলে। তার দুই চোখ থেকে মুক্তোর মতো জলের কণা ঝরে পড়ছিল। খালেদের বুকের ভেতরেও আনন্দাশ্রুর স্রোত বয়ে যাচ্ছিল। আর দেরি করলো না সে। আলো ঝলমলে তলোয়ারটার দিকে তাকাতে তাকাতে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।
পাঁচ.
ঝড়, নাকি সাইক্লোন নাকি টাইফুন নাকি হ্যারিকেন—কিভাবে আজ রাতের গতি মাপা যায় ভাবতেই পারছে না খালেদ। সে শুধু উড়েই চলেছে আর তার তলোয়ার নেমে আসছে একের পর এক। ইমাম মোদ্দাবের গাজী, চামড়া ব্যবসায়ী রফিকুল হাসান, প্রফেসর আনোয়ার হোসেন—একেক করে ট্রাস্টের সব হর্তাকর্তার কপালের মধ্যিখানে তলোয়ার ছুঁইয়ে দিয়েছে সে। সবাই অনুতাপের কান্নায় আপ্লুত। কেউ আর তার পথে বাধা হবে না। আরও কিছু মানুষ বাকি ছিল। পার্টির স্টেট সেক্রেটারি বিনয় গুহ—পার্টি কমিউনের ঘরে আচমকা তাকে দেখে কমরেড বিনয়ের হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাচ্ছিল। সব থেকে হতভম্ব চোখে সেই তাকিয়েছিল খালেদের দিকে। খালেদের দেওয়া চিঠির উত্তরে বিনয় জানিয়েছিল, কমরেড, এই সংকটপূর্ণ অবস্থায় সংখ্যালঘুদের চোখে খলনায়ক হতে পারি না আমরা। তাই আপনার একান্ত অনুরোধ সত্ত্বেও এই বিষয় থেকে আপনাকে পিছিয়ে আসতে বলছি। শেষরাতে খলেদের তলোয়ারের আলোয় বোবা হয়ে গেলো বিনয়। তারপর তলোয়ারের জ্যোতিস্পর্শ পেয়ে একটাই কথা বললো, মাছ আবার জলে মিশবে—কমরেড!
জিন বললো, না। খালেদ, না। নিজের ভেতরের সব অন্ধকারকে নিজের হাতে পুড়িয়েছ তুমি। এখনো তুমি দুর্বল। ওঠো না!
সব শেষে বিধায়ক-পৌরপিতা-মন্ত্রীকে তলোয়ার ছোঁয়ালো খালেদ। সে সরাসরি একমাস সময় দিয়েছিল—নাহলে! খালেদ যখন চলে আসছে সে তখন কাঁদছে, অনেক পাপ করেছি খালেদ ভাই! সব ছেড়ে দেবেনা সব। তারপর খালেদ চললো নিজের বাড়ির দিকে। মাবিয়ার সঙ্গে এই তলোয়ারের দেখা করাতেই হবে। মাবিয়া কিন্তু একটুও ভয় পেলো না। অবাকও হলো না। শুধু বললো, নিজের হাতে বেহেস্তে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ করলে তুমি। শয়তানের কবল থেকে তোমায় বার করতে পারলাম না। তাই তোমার যা গতি তাই হবে! তার সেই অবিচল ঠাণ্ডা চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে ওই একবারই থমকেছিল খালেদ। তারপর সে তার কাজ করলো। সঙ্গে সঙ্গে মাবিয়া চোখ বন্ধ করে ফেললো। অনেক ডাকলো খালেদ। শুয়ে থাকা তার দেহটাকে ধরে অনেক ঝাঁকালো। কিন্তু মাবিয়া চোখ মেললো না।
ছয়.
আকাশের ঊষার লাল রঙ তখন ফুটে উঠছে। মসজিদের ছাদে ঘোড়া থেকে তলোয়ার হাতে নেমে এলো সে। জিন পশ্চিম দিকের আকাশে দুই হাত তুলে মগ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নিঃশব্দে তার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল খালেদ। বললো, সবাইকে মুক্তি দিয়ে এসেছি। তাহলে আমার এই লাল মসজিদ বাঁচবে তো?
জিন একইভাবে দাঁড়িয়ে ধ্যানগম্ভীর গলায় বললো, মসজিদের দেয়াল ছুঁয়ে দেখো। যদি আকাশের বাজ ছুঁয়ে দেয় তোমায়, তাহলে ঠিক আছে আর নাহলে? এখনো বাকি!
—তার মানে? ভোর হয়ে আসছে। আলো ফুটে যাবে। তুমি চলে যাবে। এখনো কী কাজ বাকি!
জিন ফিরলো খালেদের দিকে, তুমি তো সবার রুহকে আজাদ করলে। কিন্তু তুমি কি পাক, তোমার রুহ্ কি মোতির মতো সাদা! দেখেছ? নাহলে—তোমার এই লাল মসজিদ আবার ভেঙে দেবে কেউ। ভাগ হয়ে যাবে তোমার সৈয়দপুর?
—তাহলে আমি? আমাকেও?
—হুঁ। মাথা নাড়ে জিন।
খালেদের মনে পড়ে সব থেকে কঠিন অ্যাকশানে পার্টি থেকে তাকে পাঠানো হতো। সবাই জানতো নিজের যুক্তির প্রতি কমরেড খালেদের বিশ্বাস অগাধ। সে পালাবে না—সে পালাতে পারে না। আজ এই শিশিরস্নিগ্ধ ভোরবেলা চ্যালেঞ্জটা নিয়েই ফেললো খালেদ। তারপর দুই হাতে তলোয়ারের বাট শক্ত করে ধরে কপালের ঠিক মাঝখান দিয়ে নিজের মস্তিষ্কের ভেতর ঢুকিয়ে দিলো। তারপর—কোনো সমুদ্র স্রোত নয়, কোণো ঘূর্ণি নয়, শুধু লাভা আর লাভার স্ফুটন। খালেদের আর কোনো চেতনা থাকলো না! তাপমাত্রার ঘানিতে পিষে যেতে থাকলো তার সমগ্র অস্তিত্ব।
চল্লিশ বছরের পার্টি সদস্য খালেদ আবদুল্লা আছড়ে পড়েছিল মসজিদের বড় বড় থামের তিন দিক খোলা বারান্দায়। সেখানে শুয়ে দুই চোখ মেলে দিলো সে। তারপর প্রাণভরে দেখলো—বহুবহু দিন পরে সানাই-ঢাকঢোল বাজিয়ে এক বিয়ের দল মঙ্গলঘটে জল ভরে নিয়ে যাচ্ছে। পুণ্যার্থী কত মানুষ স্নান সেরে পুকুরঘাটে সূর্য প্রণাম করছে। কেউ কেউ ছড়ানো ছেটানো গাছগুলো থেকে সাঁজি ভরে তুলে নিছে শিউলি, টগর, জবা। ওদিকে চত্বরের সীমানাঘেঁষা উঁচু বসার জায়গাগুলোতে কত মানুষ করছে ধ্যান, প্রাণায়াম। এই সাত সকালেই কতগুলো দুস্টু ছেলে কবরখোলায় গিয়ে জুটেছে। চালতা গাছের মাথায় আটকানো ঘুড়িটা তারা পাড়বে। খুব হাসি পেলো খালেদের। তার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়া জিনকে বলতে চাইলো—ওদের উঠতে বারণ করো। পরে গেলে লাগবে। জিন হেসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। খালেদ শুনতে পেলেঅ প্রাইমারি ইস্কুলটায় ঘণ্টা বেজে উঠলো অনেকদিন পর। তার মানে আবার ছাত্র এসেছে। স্কুল চলবে। ওর দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে শুরু করলো। জিন সুগন্ধী হাতের পাতা দিয়ে ওর দুই গাল মুছিয়ে দিয়ে বললো, আজ থেকে তোমাদের হেলথ সেন্টারে আবার ডাক্তার বাবু বসবে! ও উঠে বসার চেষ্টা করছিল। জিন বললো, না। খালেদ, না। নিজের ভেতরের সব অন্ধকারকে নিজের হাতে পুড়িয়েছ তুমি। এখনো তুমি দুর্বল। ওঠো না!
কিন্তু জিনের কথা শুনলে তো খালেদের চলবে না! এত কিছু ঘটে যাওয়ার একটা রাতের শেষে তাকে নিশ্চিত হতে হতে হবে। থাকবে তো! তার লাল মসজিদ—চিরকাল বাজের আগুন হয়ে! থাকবে তো সেই বাজের আগুন সৈয়দপুরের মানুষকে আলো দেওয়ার জন্য। তাকে জানতেই হবে। শরীর ঘষটাতে ঘষটাতে এগিয়ে চললো। ওকে আটকালো না জিন। তার শেষ কথাটা শুনতে পেল খালেদ, নাম জানতে চেয়েছিলে। শুনে যাও। আমার নাম আফ্রিদি রশিদ—আফ্রিদি রশিদ!
তবু রক্তের গন্ধ যাচ্ছিল না। সে গন্ধ যাচ্ছিল না মৌলানা আফ্রিদি আর সেই সবারই হাত থেকে, গা থেকে, যারা লাশটা ধুয়েছিল!
নামটা দ্বিতীয়বার আর শুনতে পেলো না খালেদ। দেয়াল ছুঁয়ে ফেলতেই সাড়ে ছহাজার ভোল্টেজের ধাক্কা ওকে মেঝেতে পেড়ে ফেললো। শরীরের ওপরের নীলচে আকৃতিটুকু শুধু মেঝেতে মিশে থাকলো। তখন আশেপাশে সব গাছে শালিক, চড়ুই আর বেনে বৌদের কী ডাকাডাকি—আর গল্পগুজব! ভোরের আলো সবে ফুটেছে!
সাত.
রাজধানী থেকে এসেছিল আর এক আফ্রিদি—মৌলানা গুলাম আলী আফ্রিদি। গলায় জড়ানো সাদাকালো চেককাটা স্কার্ফ, শ্বেতশুভ্র আলখাল্লা, শ্মশ্রু ও তসবিহ হাতে তিনিই প্রথম খালেদ আবদুল্লার মৃতদেহ মসজিদের বারান্দায় পড়ে থাকতে দেখলেন। সেদিনই ট্রাস্টের দেওয়া আলটিমেটাম শেষ হয়ে গিয়েছিল। বাউন্ডারি দিয়ে পুরো দৌলত কৌমের হেফাজতে নেওয়ার জন্য তিনি নিজে এসেছিলেন। তৌবা তৌবা—কী কাণ্ড এর মধ্যে! কিন্তু কৌমের মাথারা সবাই ছিল। খালেদের বেওয়াও ইজাজত দিলো। তাই একদিকে চলছিল সীমানা বরবর আটফুট উঁচু করোগেটেড শিট বসানোর কাজ। অন্যদিকে ওই জঙ্গলে ভরা কবরখোলায় খালেদের গোর দেওয়ার প্রস্তুতি।
বেশিক্ষণ লাগলো না। ঘণ্টাতিনেকের মধ্যেই গোর দেওয়া শেষ হয়ে গেলো। বাউন্ডারি দেওয়ার কাজ চললো বেলা চারটে পর্যন্ত। তিনবার পুলিশ এসেছিল। মেজবাবু চক্রবর্তী সাহেব পাকা লোক। সম্প্রীতি যেন বজায় থাকে মেপে রেখেছিলেন। মাবিয়া খাতুনের সঙ্গেও দেখা করে এসেছেন। একাধারে মন্ত্রী একাধারে কাউন্সিলারও গিয়েছিলেন তার সঙ্গে। বলেছেন, সব তারা দেখবেন চিন্তা নেই।
চিন্তা একটা হয়েছিল বটে। কোন ফচকে ছোড়া আইব্যাংকে খবর দিয়েছিল। খালেদ আবদুল্লা নাকি মরণোত্তর চক্ষুদানের অঙ্গীকার করেছিল। মাবিয়া তাদের বুঝিয়ে বিদায় করলো। চোখ না থাকলে কেয়ামতের দিন কী হবে? যদিও চোখ বলে তো কিছুই ছিল না। বেসিনে হাত ধুতে ধুতে ভাবছিল মেহেতাব আলী। লাশকে গোসল করাতে কেউ রাজি হচ্ছিল না। একে মুরতাদ—তারওপর ওই লাশ! বাধ্য হয়ে তাকেই এগোতে হয়! ফিরে এসে সন্ধে থেকে এই নিয়ে কতবার যে হাত ধুল মেহেতাব। তবু রক্তের গন্ধ যাচ্ছিল না। সে গন্ধ যাচ্ছিল না মৌলানা আফ্রিদি আর সেই সবারই হাত থেকে, গা থেকে, যারা লাশটা ধুয়েছিল!