সন্ধ্যা হলেও বিকেলের রেশটা কাটেনি এখনো। চারদিকে হালকা আলোকনা জাঁক ধরে আছে। সড়কের পাশে দাঁড়ানো নিঃসঙ্গ দর্শক কলাগাছ। তার ডগা নাড়িয়ে সাঁই সাঁই করে গন্তব্যে দৌড়াচ্ছে দূরপাল্লার বাস। বিদায়ী আলোর পথরেখায় তাকিয়ে আছে সড়ক পাহারায় থাকা নিমগ্ন গাছের দল। গাবখান সেতু হয়ে নেমে আসা এই হাইওয়ে চলে গেছে ঝালকাঠী বাসস্ট্যান্ড। ঝালকাঠী বাসস্ট্যান্ড থেকে বরিশাল। বরিশাল থেকে ফরিদপুর। কিংবা আরও অনেক শহর-উপশহরের শরীরে। বাসন্ডা নদী এবং গাবখান ব্রীজের মাঝপথে এই এলাকা—যেখান থেকে গাড়িগুলো দৌড়ে যাচ্ছে গন্তব্যের উদ্দেশে। কীর্তিপাশা থেকে চলে আসা সরু কিন্তু পাকা পথ এসে মিশেছে এই হাইওয়ের সাথে। আমি বসে আছি এই তিনপথের সন্ধিস্থলে। চোখের দূরত্বে ঝুঁকে থাকা রেইনট্রির উঁচু ডালে মন বসছে না। কোথাও উড়ে যাওয়ার ইচ্ছাটা মনের মধ্যে ছটফট করছে। কখনো গাবখান। বাসন্ডা। কখনো মনে হচ্ছে এই সন্ধ্যাটা এভাবে বসে বসে বাতাসে বিলিয়ে না দিয়ে বরং ধানসিড়ির পাড়ে চলে যাই।
কোথাও যাওয়া হয় না। অথবা বিভিন্ন দিকেই চলে যাই আমি। আমার মন। আমার দেহ। ধানসিড়ি। বরিশাল অঞ্চলে নদী বলতে যাদের বোঝায় সেরকম কোনো বৈশিষ্ট্য নেই এই তিন নদীর মধ্যে। তবে তুলনা মূলক ধানসিড়ি ও বাসন্ডা থেকে গাবখান কিছুটা শক্তিশালী। বাকিদুটোর পূর্ব থেকে নদী নাম যুক্ত না থাকলে যে কেউ এই ত্রয়ী আত্মীয়াকে খাল বলে ভুল করতো। কিন্তু সদ্য জমিদারি হারানো তরুণের মতো মলিন মুখে ধবধবে পোশাকে এখনো সচল কিন্তু অসচ্চল বাসন্ডা-ধানসিড়ি। অন্ধকার ঘন হয়ে আসছে। তিনমুখা এই রাস্তার পাশে বেশিক্ষণ বসে থাকা যাবে না। কিন্তু এখন ছাত্রাবাসে ফিরে যেতেও মন চাইছে না। মনে হলো কিছুক্ষণ লাবণ্য দাশের সাথে কথা বলি। যেখানে জীবনানন্দ দাশ কিঞ্চিৎই থাকবে। অধিকাংশ গল্পজুড়েই থাকবো আমি আর লাবণ্য দাশ!
লাবণ্যকে ডাকতেই সুরঞ্জনা চলে আসে। মাথার মধ্যে জীবনানন্দ আসে। সুরঞ্জনা। মিহি স্বরে দুলাইন পাঠ করে আবার থেমে যাই। তাকিয়ে দেখি বিষণ্ন মুখে লাবণ্য দাশ আমার সামনে বসে আছে। দেখছে সুরঞ্জনা পাঠ করার সময় আমার মুখ কেমন হয়। সেখানে সুরঞ্জনা-বনলতা-না লাবণ্য থাকে। আমি অবাক হই না। লাবণ্যকে গত কয়েকদিন থেকে যেভাবে আমি নীরিক্ষা করছি। ভাঙছি-গড়ছি। নাচাচ্ছি। নাচছি। তাতে লাবণ্য আমার সামনে বসে চেহারায় নিজেকে খুঁজতেই পারে! তবে সামনে বসা লাবণ্যের দিকে তাকিয়ে কেনো যেন আমার লজ্জা লাগে। আমি ভেতরে ভেতরে ঘামছি। হয়তো কিছুটা ভয়ও পাচ্ছি। এই কারণে যে গত কয়েকদিন ধরে যেভাবে লাবণ্যকে নিয়ে আমি পরে আছি তাতে লাবণ্য আমার কাছে আসতে বাধ্য হয়েছে ঠিকই কিন্তু লাবণ্য দাশের আসা আমার কাছে কিছুটা ভয়েরও। নিজেকে সামলে নিয়ে সহজ হওয়ার চেষ্টা করি। লাবণ্য দাশ বুঝতে পারে আমার ভেতর-বাহির। লাবণ্যকে নিয়ে তৈরি হওয়া আমার কোনো প্রশ্নই মুখ থেকে বের হয় না। বের হতে হতে গলায় বাইম মাছের কাটার মতো আটকে যায়। আমি কাটা ছাড়ানোর জন্য গলা খাকড়ি দিতে থাকি। চার পাশের অন্ধকারের সাথে আমার ভয়ের মাত্রাও বাড়তে থাকে। আবার নিজেকে শক্ত করে লাবণ্যের চোখে নিমগ্ন হওয়ার চেষ্টা করি।
ডানে-বাঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শান্তিপ্রিয় কলা গাছ। চোখের দূরে মিছিল করতে থাকা আখক্ষেত। আর আমার শরীর ছুঁয়ে আত্মজীবনী লেখায় ব্যস্ত সবুজ ঘাস। সবাইকেই মনে হলো তারা আমাদের আলাপে খুব মনযোগী। আমি স্বাভাবিক আলাপ চালাতে বিব্রতবোধ করলাম। হালকা বাতাসে চোখ ঢেকে যাওয়া চুল সরাতে সরাতে হাসলো লাবণ্য দাশ। সে হাসির ঘ্রাণে আমার ভয়-বিব্রতবোধ আর মোড় ঘুরে দৌড়াতে থাকা বাসের হর্ন সব দূরে চলে গেলো। কেবল আমি আর লাবণ্য।
কিন্তু ইমাম সাহেবকে পছন্দ না হওয়ায় বের হয়ে এসেছি। সীমান্ত নামাজে থাকায় আমি বের হয়ে এসেছি সেটা টের পায়নি।
সন্ধ্যা ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে। লাবণ্যকে সামনে রেখেই আমি হালকা অন্ধকারে নিজেকে বারবার পরখ করতে থাকি। মাথা চুলকে নিজেকে আবিষ্কারের চেষ্টা করি। ঘাসের চোখে চোখ রেখে স্থির হতে চাই। লাবণ্য হয়তো বিরক্ত হয়। এমন সময় সীমান্তের অনুপ্রবেশ। আমি মুক্তি পাই! অথবা লাবণ্যতে আটকে যাই আরও।
‘কি রে তোকে তো খুঁজে পাচ্ছিলাম না।’
সীমান্ত। আমার বন্ধু। সে ছবি আঁকে। বই পড়ে। ২৩০ জন ছাত্রের মধ্যে সে আমার একমাত্র বন্ধু। ক্লাসে ২৩০ জন ছাত্র থাকলেও আমি হয়তো ২৩১ নম্বর। যার কোনো অস্তিত্ব নেই। অথবা সে থেকেও থাকে না এখানে। চলে যায় সীমান্তকে ছাড়াই অন্য কোথাও। নিজস্ব জগতে।
মাথা তুলে আমি জবাব দেই।
‘হুম একটু বসলাম।’
‘নামাজ পড়িসনি!’
আমি কথা বলি না।
সীমান্ত বুঝতে পারে আমি নামাজ পড়িনি।
আমরা দুজন নামাজ পড়ার জন্যই একসাথে মসজিদে ঢুকেছিলাম। ও এগিয়ে গিয়ে সামনের কাতারে দাঁড়ালো। আর আমি দ্বিতীয় কাতারে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু ইমাম সাহেবকে পছন্দ না হওয়ায় বের হয়ে এসেছি। সীমান্ত নামাজে থাকায় আমি বের হয়ে এসেছি সেটা টের পায়নি।
ইমাম সাহেবকে নিয়ে আমি কিছু বলি না। বলতে ইচ্ছে করে না। চুপ করে থাকি।
‘এখানে বসে আছিস আর আমি খুঁজতে গেলাম দোকানে। ভাবলাম চা খেতে গেছো!’
আমি মাটির দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
‘বস’
‘না বসবো না। নামাজ শেষে আবার ইমাম সাব ধরেছিলো। দেশি বড়ভাই।’
‘ওহ। কি তাবলীগের দাওয়াত দিলো? সে তো আবার তাবলীগ করে।’
‘তুই চিনোস নাকি?’
আমি আর বিস্তারিত বলতে যাই না। নিজের ভক্তি-অভক্তি এবং এসবের কারণ নিজের পেটের মধ্যেই রাখি।
‘ওই আর কি…’
‘চল।’
আমি উঠি না। বসেই থাকি। উঠতে ইচ্ছে করছে না। একবার মনে হলো লাবণ্যর কথা সীমান্তকে বলি। আবার চিন্তা করলাম না কিছু বলবো না এখন। ক’দিন থেকে এমনিতেই আমার উপর ক্ষেপে আছে সীমান্ত। আমার উল্টাপাল্টা আচরণ নিয়ে মনে হচ্ছে ওর মধ্যে কোনো সন্দেহ তৈরি হয়েছে। একবার বলেছে আমাকে নাকি জিনে ধরেছে।
আমি হাসতে হাসতে বলেছি, ‘আরে বোকা। জিনে ধরবে কেন! আমি কি মেয়ে মানুষ নাকি? ধরলে ধরবে পরিতে!’
সীমান্ত হাসে। চোখের সামনে যেন পরি দেখতে পাচ্ছে ও। বলে, ‘তোকে যে ধরে ধরুক। আমাকে ধরেছে তসলিমায়!’
‘এটা ভয়ের কিছু না। তসলিমা তো মানুষ! কিন্তু আমাকে তো ধরেছে অন্য কিছু!’
আমার গল্প হেসে উড়িয়ে দেয় সীমান্ত। আমিও কথা বাড়াই না। লাবণ্য বিষয়ে কারও সাথে কথা বলতেও ভালো লাগে না। তারপরও বলি। কিছু কিছু সীমান্তকে বলি। কথা তো কাউকে না কাউকে বলতেই হয়।
সেদিন শহরের বইপত্র লাইব্রেরী থেকে তসলিমার বই কেনার সময় আমি ওর মুখে দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আহারে বেচারা। কেমন খুশি খুশি মন! কিন্তু এই খুশিখুশি মুখটা মুহূর্তেই চিন্তিত মনে হয়। কারণটাও আমার অনুমেয়। যে কোনো শরীয়াবিরোধী বিতর্কিত বই আমাদের ছাত্রাবাসে রাখা নিষেধ। পাঠ তো দূরের কথা। তারপরও নসীম হিযাযীর সাথে সাথে আমি আর সীমান্ত হুমায়ূন আযাদ-তসলিমা নাসরিন পড়ি। এই পড়া প্রজেক্টকে বাস্তবায়ন করতে আমাদের রীতিমতো এক যুদ্ধ জয়ের কৌশল অবলম্বন করতে হয়। একরুমে আমরা ছয়জন থাকি। বড় রুম। ছোট ছোট ছয়টা চৌকি। চৌকির সাথে ছোট একটা করে টেবিলও। টেবিলে ক্লাসের বই সাজানো থাকে। বাকি জিনিসপত্র চৌকির নিচে তোরঙ্গতে রাখতে হয়। আমাদের অন্য চারজন রুমমেইটের একজন আবার কোরআনে হাফেজ। যে কারণে এশার নামাজ ফাঁকি দিয়ে রুমে তালাবদ্ধ হয়ে বসে থেকে টেবিল লাইট জ্বালিয়ে বই পড়ার কৌশলও সবসময় নিরাপদ হয় না। তার থেকে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে অসুস্থতার অজুহাতে রুমে তালাবদ্ধ থেকে নিষিদ্ধ বই পড়ার কৌশলই ভালো কাজ দেয়। কারণ নামাজে যাওয়ার সময় একবার এবং নামাজ চলাকালীন সময়ও মাঝে মাঝে রুম চেক করা হয়। যাতে কেউ ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ না পায়। তবে সুবিধার বিষয় হলো হাফেজ সাহেব অল্প বয়সে বিয়ে করার কারণে অধিকাংশ সময়ই বাড়িতে থাকে। তার বাড়ি থাকার সুবাধে আমরা তসলিমা ধরনের বিভিন্ন বই এশার নামাজের সময় ও ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার সময় পড়তে পারি।
এশার নমাজের পর প্রায় ত্রিশ মিনিটের নিয়মিত তালিম হয়। ভয়ের বিষয় হচ্ছে মাঝে মাঝেই আমাদের মতো আরও যারা নিয়মের গ্যাঁড়াকলে আটকে থাকার ভান নিয়ে অনিয়ম করে তাদের হাতনাতে ধরতে ছাত্রাবাসের রুমে সার্চ করা হয়। তখন শরিয়া পরিপন্থি কোনো বই পাওয়া গেলে তাকে ছাত্রাবাস থেকে বহিষ্কার করা হয়। আর অপরাধ বেশি হলে মাদ্রাসা থেকেই বহিষ্কার করা হয়। যেকোনো বই আমাদের দুজনার পড়া শেষ হলে তার ভাগ্য হয় সামনের বাসন্ডা নদীতে সাঁতার কাটার। অতি সবধানে আমরা তাকে বাসন্ডায় বিসর্জন দেই। সংরক্ষণ করতে গেলে বহিষ্কার হওয়ার সৌভাগ্য হয়ে যাবে! যদিও ততদিনে শরৎচন্দ্র পড়ে পড়ে বোহেমিয়ান জীবন যাপনের লোভে এসব বহিষ্কারের ভয় আমাদের কাছে অগুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে! তবুও সবার সামনে শরিয়তের দোহাই দিয়ে অপদস্ত হওয়ার ভয়টা থাকেই।
সীমান্ত আমার হাত ধরে টান দিলো।
‘কি রে ! উঠবি না?’
আমি উঠে দাঁড়ালাম। সদ্য নামাজ পড়ে আসা সীমান্তের দাড়িওয়ালা মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
‘কি রে তুই এতো তাড়াহুড়া করছিস ক্যান!’
‘কাজ আছে। বলবো নে চল।’
আমরা হাঁটছি। গাবখান ব্রিজ থেকে নেমে আসা রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছি বাসন্ডা ব্রিজের দিকে। বাসন্ডা ব্রিজের আগেই বাম পাশ দিয়ে সোজা নেমে যাওয়া ঢালের মাথায় আমাদের মাদ্রাসা। দেয়াল তোলা এরিয়ার মধ্যেই ক্যাম্পাস ও ছাত্র হোস্টেল। রাতে দেয়াল তোলা এরিয়ার বাইরে বের হওয়া নিষেধ। এসব নিয়ম মেনেই অনিয়ম করি আমরা। শহরে যেতে চাইলে ম্যানুয়ালে নির্দিষ্ট শিক্ষকের অনুমতি দেওয়ার স্বাক্ষর নিয়ে যেতে হয়। না হলে প্রতি ক্লাসে দায়িত্ব দেওয়া ছাত্র প্রতিনিধি আছে। গোপন চর আছে। যারা শিক্ষককে খবর দিয়ে শাস্তির ব্যবস্থা করে। কখনো আমি একা। কখনো আমরা দুজন মিলে শহরে যাই। আমাদের উল্লেখ করার মতো কাজ থাকে না যা অনুমোদন যোগ্য হবে। সেজন্য আমরা দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকের কাছে যাই না। কিন্তু তিরস্কার এড়াতে আমাদের লুকিয়েই যেতে হয়।
মা-বাবা ছেলেকে ধরে জান্নাতে যাওয়ার পরিকল্পনা করলেও আমি যে জাহান্নামের কাছাকাছি চলে যাচ্ছি সে ব্যাপারে মনে মনে প্রায় নিশ্চিত হয়েই গেছি! ঘুম ডাকতে ডাকতে হঠাৎ মনের মধ্যে মৃত্যু ভয় তৈরি হলো।
আজ রাতেও যে ঘুম হবে না। সেটা লাবণ্যর সাথে দেখা হওয়ার পরই বুঝতে পারছিলাম। তারপরও অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছি ঘুমানোর জন্য। রাতে ঘুমাতে না পারলে সারাদিন ঠিকঠাকভাবে কিছুই করতে পারি না। আর এখানে সকালে ঘুমানোর কোনো সুযোগ নেই। ফজরের জামাতের পর মসজিদে তালিম হয়। সেখানে ক্লাসওয়ারি ছাত্রদের হাজিরা নেওয়া হয় বিশেষ গুরুত্বের সাথে। তাছাড়া ফজরের আজানের পরই শুরু হয়ে যায় নামাজের জন্য ডাকাডাকি। নামাজের আহবান করে সাওয়াব নিতে সচেতন নামাজিরা কেউ পিছিয়ে থাকতে চায় না। এসব কারণে আমার মতো উদাসীন নামাজিরও ঘুম থেকে উঠে মসজিদে যেতে হয়। সবার মসজিদমুখী তাড়ায় খেয়াল করারও সুযোগ থাকে না রাতে স্বপ্ন বা নিজস্ব চেষ্টায় স্বর্গারোহণের ফলে শরিয়া অপবিত্রতার কথা। পরিবারের মান্নত অনুযায়ী যেদিন আল্লাহওয়ালা হওয়ার এই কারখানায় ঢুকেছি সেদিই বুঝেছিলাম আমার নিজস্বতা বলে আর কিছু থাকছে না। মনে মনে কিছুদিন বিদ্রোহ করেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাবা-মায়ের মুখের দিকে চেয়ে বদহজম হওয়ার ভয় নিয়েও কোরমা পোলাই খেতে থাকলাম। মা-বাবা ছেলেকে ধরে জান্নাতে যাওয়ার পরিকল্পনা করলেও আমি যে জাহান্নামের কাছাকাছি চলে যাচ্ছি সে ব্যাপারে মনে মনে প্রায় নিশ্চিত হয়েই গেছি! ঘুম ডাকতে ডাকতে হঠাৎ মনের মধ্যে মৃত্যু ভয় তৈরি হলো।
উড়ন্ত মনকে বোয়েম ভরে রেখে কাল থেকে ঠিক মতো নামাজ পড়বো বলে ঠিক করলাম। রুমের ভেতরে ঘুমিয়ে থেকে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে অন্যদের ক্লাসে যেতেও বলবো না। ক্লাসও ঠিকমতো করবো বলে ঠিক করলাম। কিন্তু চোখ থেকে লাবণ্য দাশ যাচ্ছে না। সে আমার চৌকির মাঝামাঝি স্থির হয়ে আছে। চিৎ হয়ে শুয়ে থাকায় আমি তাকে এড়াতে পারছি না। কাত-উপুর হয়েও তাকে এড়াতে পরলাম না। অবশেষে ঘুমের চেয়ে বেশি গতিতে মৃত্যুভয় আর লাবণ্য দাশ দুটোই আমাকে আঁকড়ে ধরলো।
আমার এপাশ-ওপাশ টের পেয়ে পাশের চৌকি থেকে সীমান্ত ডাক দিলো-
‘এখানো ঘুমাস নি?’
আমি জেগে থাকলেও কোনো আওয়াজ দিলাম না।
রুমের সবাই ঘুমাচ্ছে। ইচ্ছে হলো না এই গভীর রাতে কথা বলে কারো ঘুম নষ্ট করি। তার থেকে ঘুমানোর চেষ্টাকেই ভালো মনে হলো।
চোখের সামনে লাবণ্য দাশ হাঁটছে। আমিও হাঁটছি তার পিছু পিছু। পিছন থেকে তাকে দেখছি। হেলেদুলে চলা লাবণ্য দাশ কিছু দূর গিয়ে ক্ষাণিক দাঁড়ালো। আমি একটু পিছিয়ে পড়েছিলাম। আমি আবার দূরত্ব কমিয়ে আনার জন্য দ্রুত হাঁটার চেষ্টা করলাম। লাবণ্য দাশ আবার হাঁটা শুরু করলো। আমিও হাঁটছি। আমাদের দূরত্ব বাড়ছে। আমি হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলাম। তাও দূরত্ব কমছে না। একসময় লাবণ্য দাশ আবছা হয়ে গেলো। আর দূরে স্পষ্ট হয়ে উঠলো একটা অশ^ত্থ গাছ। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে লাবণ্য দাশকে খুঁজছি। এই একই স্বপ্নে আজও ঘুম ভেঙে গেলো! ঘড়ির দিকে দেখলাম সোয়া চারটার মতো বাজে। বুঝতে পারলাম আজ আর ঘুম হবে না। একটু পরেই ফজরের আজান হবে। ঘামতে থাকা শরীর থেকে গেঞ্জি খুলে আবার শুয়ে পড়লাম। ঘুমের আগে যে শরিয়ত মতো চলার ডিসিশান নিয়েছিলাম সেটা বাস্তবায়ন করতে এখন তাহাজ্জুদ পড়া যেতে পারে। কিন্তু আলসেমি কাটিয়ে সেটা আর হলো না। কিছুক্ষণের মধ্যে আজান দিলো।
সীমান্তের এই আবিষ্কার ও কথিত ওঝা’র প্রাথমিক আচরন, পাঠজ্ঞান আমি মুগ্ধ। তারপর ওঝা’র কাছে আমি নিয়মিত যাতায়াত করতে থাকি।
আসরের নামাজ শেষে আমি আর সীমান্ত বাসন্ডা নদীর পাড় ধরে হাঁটছিলাম। আজও লাবণ্যকে স্বপ্ন দেখার কথা বললাম। আজ আর সীমান্ত হাসলো না। ওকে কেমন চিন্তিত মনে হলো।
‘জানিস গত রাতে আমি তসলিমাকে স্বপ্ন দেখেছি।’
আমি জোরে হাসলাম। এ হাসি শরিয়তের তিন প্রকার হাসির আওতায় আটকে থাকলো না। আমার হাসি দেখে সীমান্ত কিছুটা বিরক্ত হলো।
‘আচ্ছা তুই প্রতিরাতে জীবনানন্দের বউকে স্বপ্নে দেখতে পারিস। আর আমি সিঙ্গেল তসলিমাকে স্বপ্ন দেখতে পারবো না?’
জীবনানন্দ দাশকে লাবণ্য দাশের অবহেলা নিয়ে অনেক লেখা পড়েছি। তার সমালোচনা শুনেছি। কিন্তু লাবণ্য’র মতো একজন সুন্দরী জীবনানন্দের কাছ থেকে কতটুকু ভালোবাসা পেয়েছে সে প্রশ্ন আমরা করি না। জীবনানন্দ পড়তে পড়তে আমার লাবণ্য’র প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। ভাবতে থাকি লাবণ্য দাশ কেমন ছিল। সে কিভাবে কথা বলতো। তার আচরণ কেমন ছিল। সে কিভাবে হাসতো। এসব ভাবতে ভাবতে আমার মনের মধ্যে একজন লাবণ্য দাশ তৈরি হয়ে যায়। মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে লাবণ্য দাশের ছায়া। আর আমি জীবনানন্দের কবিতার চেয়েও লাবণ্য দাশ নামক কবিতায় ডুবতে থাকি। আমার এই ডোবাডুবির গল্প পুরোটাই জানে সীমান্ত। সে আমার এই কাল্পনিক প্রেম নিয়ে ক্ষ্যাপায়। আমি কিচ্ছু বলি না। হাসি। আমি লক্ষ করলাম সীমান্ত সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে। হাসি চেপে রেখে বললাম, ‘হ্যাঁ পারবি। পারবি না কেনো! কিন্তু এতদিন তো ছোটবেলার প্রেমিকাকে স্বপ্ন দেখতি।’
‘হুম আমিও সেটাই ভাবছি। হঠাৎ করে স্বপ্নে তসলিমা আসলো কেনো! তবে একটা মজার ব্যাপার কি জানো?’
আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। আগ্রহ নিয়ে তাকালাম।
আমার চোখে প্রশ্ন।
‘তসলিমা বোরকা পড়া ছিল।’
‘ধূর।’
‘আরে সত্যি বলছি।’
‘এবার মনে হচ্ছে আমার না তোর মাথা নষ্ট হয়ে গেছে।’
আমরা কুমার বাড়ির পাশ দিয়ে শহরের পেট বরাবর এগিয়ে যাওয়া রাস্তা ধরে হাঁটছি। অনেকক্ষণ কারো মুখে কোনো কথা নেই। ভাবছি চিন্তার এই জগতটা মন্দ না। বাস্তবের থেকে নিজেকে আলাদা করে রাখার একটা ব্যাপার। যদিও কিছুটা ভয় থেকেই যায়। সমাজের তথাকথিত আচরণ সীমার দেয়ালের বাইরের কিছু হয়ে গেলো কিনা। কিন্তু অধিকাংশ সময়ই এই কল্পনার জগৎটাকে। এই লাবণ্য দাশকে। আমি খুব উপভোগ করি। মনে মনে ঠিকও করে রাখি সামনের বার লাবণ্য দাশকে সামনে পেলে কী কী প্রশ্ন করবো।
‘আচ্ছা অর্ক চল আমরা আবার একদিন কীর্তিপাশা যাই।’
‘না ধানসিড়ি যাবো।’
‘না কীর্তিপাশা। জীবনানন্দ তোর মাথাটা খেয়েছে।’
‘কেন? কেন কীর্তিপাশা কেন! তোরও কি লাবণ্য দাশকে দরকার নাকি?’
‘ধুর! তা না। আর ওখানে কি লাবণ্য দাশ আমার জুব্বার পকেটে ঢোকার জন্য বসে আছে নাকি!’
‘তবে?’
‘জায়গাটা আমার ভালো লাগে। পুরাতন জমিদার বাড়ি দেখতে দেখতে শরৎচন্দ্রের উপন্যাস আর গোয়েন্দা থ্রিলের ছবি দুটোই পাওয়া যায়।’
‘না রে ভাই আমি যাবো না। ওখান থেকে আসার পরই লাবণ্য আমাকে চেপে ধরেছে।’
সীমান্ত হাসলো। আসলেও তাই। আমরা দুজনে এক বিকেলে কীর্তিপাশা জমিদার বাড়ি গিয়েছিলাম। অনেক পুরাতন বাড়ি। ভেতরে ঢুকতেই কেমন ভয় ভয় লাগছিল। ভাঙা বাড়ির পেছনে একটা অপরিষ্কার পুকুর। কিন্তু পুকুরের ঘাটলায় বসার স্থানটা পরিষ্কার। আমরা অনেকক্ষণ বসেছিলাম সেই ঘাটলায়। সন্ধ্যার পরও। মাথার মধ্যে ভয়ের জুজু ঝেঁকে বসার আগেই আমরা বের হয়ে এসেছি। ঘাটলায় বসে থাকতে থাকতে আমার মনে হচ্ছিল লাবণ্য দাশ ঘাটলার নিচের সিঁড়ি থেকে কাঁকে কলসী নিয়ে ওপরের দিকে উঠে আসছে। আমি মুগ্ধ চোখে তার পায়ের দিকে তাকিয়ে আছি। সেদিনের পর থেকে আমার মাথায় কলসী কাঁকে উঠে আসা লাবণ্য দাশ। হাসে। দৌড়ায়। গান গায়। কিন্তু কবিতা পড়ে না।
‘তাই নাকি! তাহলে চল তোকে একজন ওঝা’র কাছে নিয়ে যাই।’
‘ধাৎ। এই যুগেও কি মানুষ ওঝা ঠোঝা বিশ্বাস করে নাকি!’
‘করে না আবার! দরবারি মাদ্রাসায় পড়েও এই প্রশ্ন করছ! প্রতিদিন দেখছো না কত কিছু হচ্ছে!’
এটা তো ঠিক যে আমরা মাদ্রাসায় পড়ছি এখানের অনেক কিছুর সাথেই আমি এবং সীমান্ত মানিয়ে নিতে পারছি না। ধর্ম বিশ্বাস করি না সেটা বলার সাহস আমার নেই। কিন্তু ধর্মের সাথে জড়িয়ে যাওয়া নানান কুসংস্কারকে নিয়ে আমি প্রায়ই কথা বলি। যে কারণে এরই মধ্যে সহপাঠীদের মধ্যে নাস্তিক খেতাব পেয়ে গেছি! অবশ্য এটা নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপও নেই। আমি কি সেটা আমি জানি। কারও কথায় নিজেকে নাস্তিক ভেবে আরাম কিংবা ভয় কোনোটাই আমি পাই না। এই যে নিজের থেকে নিজেকে অস্বীকার করা। নাম বদলে নিজের থেকে ভিন্ন একজন মানুষকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা। সেটাও হয়তো এইসব কুসংস্কার থেকে বাঁচার জন্য। যেমন এই সীমান্ত আর অর্ক্য আমাদের মা-বাবাদের রাখা নাম নয়। আমার নাম মোহাম্মদ কলিমউল্লাহ ফরায়েজী। বাবা কখনো কলিম বলেও ডাকেন। কিন্তু সুস্থভাবে যখন ডাকেন তখন নামের সাথে জড়িয়ে রাখা ফরায়েজী বাদ দেন না। তার পূর্বপুরুষ ফরায়েজী আন্দোলন করে এই অভিধা পাওয়ায় সে অনেক গর্ববোধ করেন। কিন্তু আমি নিজেকে বানালাম অর্ক। সমরেশ মজুমদারের উপন্যাসের এই চরিত্রটি আমার খুব পছন্দের। কিন্তু আমি যেমন মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীনকে সীমান্ত বলে ডাকি। সেও আমাকে অর্ক নামে ডাকে। এই নিজেদের আলাদা করার প্রক্রিয়া আমাদের নিজেদের মধ্যেই থাকে। আমরাই রাখি। কারণ প্রকাশ্য হলে এখানে এগুলো নিয়েও তিরস্কার সহ্য করতে হবে!
প্রায়ই পত্রিকায় মাদ্রাসার শিক্ষক কতৃক ছাত্রকে বলাৎকারের ঘটনার সংবাদ দেখা যায়। কিন্তু যে ঘটনাগুলো সংবাদ মাধ্যম পর্যন্ত যায় না। কিংবা বন্ধুদের মধ্যে সমযোতায় যৌনতা হয়! একটু পড়ার অভ্যাস থাকার কারণে এ বিষয়ে আগেই জেনেছিলাম। মাদ্রাসার পাশাপাশি ছাত্রী হোস্টেল, ক্যাডেট কলেজে এই ধরনের কাজ হয়। যৌনতা যে অস্বীকারের কোনো বিষয় না এই জ্ঞান ইঁছড়েপাকা মাথা আগেই জেনে নিয়েছিল। সেজন্য এ ধরণের কিছু শুনলে চমকে উঠি না। এখানেই যে এমন একটা ঘটনা ঘটতে পারে সেটা গত মাসের একটা ঘটনা না ঘটলে বুঝতে পারতাম না। একই ক্লাসের দুই ছাত্রকে রুমের মধ্যে নাকি হাতে নাতে ধরে ফেলেছিলো তাদের সহোপাঠীরা। প্রতিষ্ঠানের নিয়ম অনুযায়ী ঘটা করে তাদের বিচার হলো। বহিস্কারও করা হলো দুজনকে। কিন্তু প্রায়ই যে আমাদের এক শিক্ষকের নামে একই অপরাধর কথা শুনি তার কোনো বিচার হয় না। সব কিছু নিয়ে আলোচনা হলেও এই বিষয় নিয়ে আমার সাথে কারো আলোচনা হয় না।
পরের দিন আমরা সীমান্তের চেনা ওঝার কাছে গেলাম। ওঝা আমাদের উপর ক্লাসে পড়েন। বয়সে আমাদের থেকে চার পাঁচ বছরের বড়। আর শরীয়তের নিয়ম পালনে একদম পাক্কা। কথা বলতে বলতে দেশ-বিদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির অনেক কথাই বললেন। এরকম ধর্মীয় পরিবেশে থেকে এতো খোঁজ-খবর রাখা বিস্ময়কর লাগছিলো আমার কাছে। সীমান্তের এই আবিষ্কার ও কথিত ওঝা’র প্রাথমিক আচরন, পাঠজ্ঞান আমি মুগ্ধ। তারপর ওঝা’র কাছে আমি নিয়মিত যাতায়াত করতে থাকি। সে বিভিন্ন ধরণের বই পড়তে সাজেস্ট করে। কখনো আমি একা আবার কখনো আমরা দুজন মিলে সে বই সংগ্রহ করে পড়ি। চুরি করে জেলা পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে খুঁজে পড়ি। সম্পর্ক মজমুদ হলে সীমান্তের পাশাপাশি আমি ওঝাকেও লাবণ্য’র কথা শেয়ার করি। আমার এইসব চিন্তা। কল্পনা শুনে সে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। সে আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করে, এটা অতিচিন্তার ফসল। এই কল্পনা মাথায় নিয়ে ঘুরতে থাকলে আমার স্বাভাবিক কাজ ব্যহত হবে। এমনকি আমার পড়ালেখারও ক্ষতি হতে পারে। তার এই উপদেশ আমার পছন্দ হয় না। আমি লাবণ্য দাশকে চাই। সেটা বাস্তবে নয়। এমনই কল্পনায়। আমার মতো করে।
আমার লাবণ্যকে রেখে আমি আরেক লাবণ্যের দিকে তাকাই। দেখি-লম্বা চুল, রোদরঙা শাড়ি পরা একজন মধ্যবয়সী মহিলা হেঁটে যাচ্ছেন!
আমার ভক্তি-শ্রদ্ধা উঠে যায় ওঝা’র আরেকটা অপরিচিত আচরণে। ওঝা এক বলৎকারের অভিযোগে জড়িয়ে যায়। এরপর সীমান্ত আমাকে তার কাছে যেতে না করে দেয়। আমারও আর যেতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু দিনদিন আমার অবস্থার অবনতি হতে থাকে। ক্লাসে যাওয়া হয় না। পড়া হয় না। যেখানে সেখানে বসে থাকি। রাতে ঘুম হয় না। বহিষ্কারের ভয়ে নিয়ম করে নামাজেও যাই না। আমাকে না জানিয়েই সীমান্ত বাবার কাছে খবর পাঠায়। বাবা এসে আমার শরীরের অবস্থা দেখে এতটাই ভয় পেয়ে যান যে সামনে টেস্ট পরীক্ষাও তার কাছে গুরুত্ব পায় না। মাদ্রাসার হুজুরদের সাথে আলাপ করলে তারা বলে দেয় আমাকে পরি ধরছে। কোনো ফকিরের কাছে নিয়ে এটা ছাড়াতে হবে। বাবা আমাকে বাড়ি নিয়ে আসেন। প্রায় তিন মাসব্যাপী চলে পরি ছাড়ানোর প্রক্রিয়া। কিন্তু ততদিনে আমার শরীরের অবস্থা আরও অবনতির দিকে। শেষ পর্যন্ত বাবা মাথা থেকে ফকিরের বিশ্বাস তাড়িয়ে আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। এতদিন কাউকে কিছু না বললেও ডাক্তারকে আমি সব খুলে বলি। বাবাকে এসব বলতে নিষেধ করি। ডাক্তার বাবাকে ডেকে দ্রুত একজন মানসিক বিশেষজ্ঞ দেখাতে বলেন।
বাবা লুকিয়ে রাখতে চাইলেও আমার মানসিক সমস্যার কথা গ্রামে রটে যায়। গ্রামবাসী বুঝতে পারে জসিমউদ্দিন ফরায়েজীর ছেলে কলিম পাগল হয়ে গেছে। একমাত্র ছেলের এই অবস্থা দেখে মা আমার থেকেও বেশি অসুস্থ হয়ে যায়। শরীরের জোর কমে গেলেও আমি কখনো সেড়ে ওঠার লোভে ডাক্তারের কাছে যেতে চাই। আবার লাবণ্যকে হারানোর ভয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে চাই না।
গতকাল আমাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছে। দেশের নামকরা সাইকিয়াট্রিস্ট ডা. সুনীল বসাককে দেখানোর জন্য। তিন সপ্তাহ অপেক্ষা করে তার সিরিয়াল পাওয়া গেছে। আমার খুব কাছের বন্ধু সীমান্তকেও বাবা সাথে নিয়ে এসেছে আমাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য। আমি টেস্ট পরীক্ষা দিতে পারিনি। আলিমের ফাইনাল পরীক্ষাও মিস করেছি। গত কয়েক মাস আমার কেমন করে গেছে সেটা আমি বলতেও পারবো না। কিন্তু যেভাবেই যখন যেখানে থাকি আমি মুহূর্তের জন্যও লাবণ্যকে ছাড়িনি। তাকে কেমনে ছাড়বো আমি! কতো সাধনা করে তাকে পেয়েছি আমি। আমি তাকে ছাড়তে চাই না। এ কথা আমি বাসার কাউকে বলতে পারবো না। তবে আমার সীমান্তকে খুব সন্দেহ হচ্ছে। মনে হচ্ছে সে আমার সবকথা হয়তো বাবা-মাকে বলে দিয়েছে। তা না হলে বাবা আমাকে এত দ্রুত ঢাকায় নিয়ে আসতো না।
আমি আর সীমান্ত রিকশায়। অথবা আমি আর লাবণ্য। পিছনের রিকশায় মা-বাবা। সীমান্ত আমাকে বোঝাচ্ছে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য। আমি কান দিয়ে শুনছি ঠিকই কিন্তু মাথায় কিছু ঢুকছে না। ঢুকলেও সেটা মাথায় থাকছে না। মাথায় বাজছে লাবণ্যের গান। অথবা কোনো কিছুই আমি বুঝতে-শুনতে চাইছি না। আমি রিকশায় বসে লাবণ্যর দিকে তাকিয়ে আছি। অথবা সীমান্তর কথা শুনছি। অথবা কিছুই শুনছি না। ঠিক করলাম ডাক্তারের কাছে যাবো না। আমি স্বাভাবিক জীবন চাই না। আমার এই কল্পনা। এই লাবণ্যকে নিয়েই আমি থাকবো। ঠিক কররাম রিকশা সামনের মোড় ঘুরলেই আমি নেমে দৌড় দিবো। সীমান্ত হঠাৎ বললো,
‘ওই দ্যাখ তোর লাবণ্য দাশ যায়!’
আমার লাবণ্যকে রেখে আমি আরেক লাবণ্যের দিকে তাকাই। দেখি-লম্বা চুল, রোদরঙা শাড়ি পরা একজন মধ্যবয়সী মহিলা হেঁটে যাচ্ছেন!
লাবণ্য দাশের সাথে দেখা হওয়ার পর
সানাউল্লাহ সাগর
প্রকাশক: অনুপ্রাণন প্রকাশন
প্রচ্ছদ: আল নোমান
মূল্য: ২০০ টাকা