দক্ষিণ দিক থেকে ছুটে আসা রেল লাইনটি স্টেশন পেরিয়ে চিতল মাছের পিঠের মতো বাঁক নিয়েছে উত্তর-পূর্ব দিকে। শেষ বিকেলের জৌলুসহীন সূর্যের বিলিয়ে যাওয়া হলুদবরণ সোনাদানাগুলো গায়ে মাখতে মাখতে ছুটে চলছি দুই সহকর্মী। গাড়ির বিকট শব্দ আর ধুলো-ধোঁয়াহীন এ পথটি আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকবে, আপনি খেয়াল করবেন বা করবেন না। নদী আর রেল পথের এক অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য আছে। এরা স্থির অথচ ছুটে চলে অবিরাম বাঁক হতে বাঁকে, পথ হতে পথের সন্ধানে। সে গতির সঙ্গে ক্ষণিকের জন্য তাল মিলিয়ে চলতেও কী অদ্ভুত অনুভুতি!
পথের দুই পাশে ফুটে আছে কতশত নাম না জানা বুনোফুল। লাল-নীল-হলুদ-সাদা কত রঙ, কত ঢং। ঝোঁপের মাঝে কণ্টকাকীর্ণ গুল্মলতায় ফুটে আছে নীল রঙের বাহারি ফুল। কোনো কবি হলে তার প্রিয়তমার চূড়ো খোঁপায় দুই চারটি ফুল দুলিয়ে দিতো শ্লোকে শ্লোকে। অথচ আমাদের কাছে এসব কত তুচ্ছ, কত গৌণ! পথের দুই পাশে বিস্তীর্ণ মাঠ। ধান উঠেছে কিছুদিন আগে। খালি মাঠে ঝরা ধান কুড়ানোর কাজে ব্যস্ত ঘুঘুর দল। ঘাস ফড়িংদের পিছু নিয়েছে শালিক দম্পতিও। ঝকঝকে সাদা বকেরাও কী যেন খুঁজছে সেই সওদার হাঁটে। নরম রোদে গা এলিয়ে শুয়ে থাকা গাভীটির পিঠে বসা ফিঙেগুলো অনাকাঙ্ক্ষিত পোকামাকড় বেছে দিচ্ছে পরম মমতায়।
নাড়ার আগুনে গায়ে তা দেওয়া কিশোরদের দেখেও দুরন্ত শৈশব প্রশ্রয় পায়। শীতের জীর্ণশীর্ণ বৃক্ষরা অপেক্ষায় ঋতুরাজ বসন্তের। কাঠবাদামের মেরুনরঙা পাতাগুলো উল্টি খেয়ে খেয়ে মাটিতে নেমে পড়ছে রঙিন প্রজাপ্রতির মতো। কৃষাণীর অতি যত্নে লাগানো লাউয়ের মাচায় গলাগলি করে বেড়ে উঠছে লকলকে ডগা, খোঁপায় পরা ধবধবে সাদা ফুল। দূরে কৃষক বাড়ির আঙিনায় সুউচ্চ খড়ের গম্বুজ। জারুল ডালে ঘাপটি মেরে থাকা মাছরাঙাটি ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যায় চান্দাপুঁটিদের নিরীহ ছোটটাকে। দিনদুপুরে হানা দেওয়া দস্যি পানকৌড়ির চুরি ঠেকাতেও ব্যর্থ গৃহিণীর অপরিপক্ব হাতের নিশানাহীন ঢিল। দূর দিগন্তে আকাশ মিতালি পেতেছে মাটির সঙ্গে। বামপাশের কাকচক্ষুর মতো স্বচ্ছ দিঘির জল আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডকবে। এর নাম পৌরানবিবির দিঘি। টকটকে লাল সূর্যটি টুপ করে ডুব দিলো সেই মায়াবি দিঘির জলে। পশ্চিমের লাল আভায় লোহিত বর্ণ ধারণ করছে পুরো দিঘির জল যেন নতুন কুটুমকে স্বাগত জানাতে এক দিঘি রুহআফজা-মিশ্রিত লাল সরবত। নীল আকাশের কোল ঘেঁষে ঝকঝকে বকেরা উড়ে চলছে আপন আপন নীড়ে। মনে পড়বে জীবনানন্দের সেই পঙ্ক্তি, ‘সব পাখি ঘরে ফিরে, সব নদী ফুরায় জীবনের সব লেনদেন।’
আরও পড়ুন: ডগি ॥ কাজী মোহাম্মদ আসাদুল হক
এবার ফেরার পালা। সামর্থ্যের বেশি চলে এসেছি। তাই সাহায্য নিতে হলো রিকশাচালক হেনজু মিয়ার। নির্ঝঞ্ঝাট রাস্তায় শোঁ শোঁ করে এগিয়ে চলছে প্যাডেল চালিত রিকশা। হিমেল হাওয়ার ঝাপটায় গা কাঁটা দিয়ে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে। সূর্য আর চাঁদ এখানে পালাক্রমে ডিউটি করে। এখন চাঁদের পালা। পুব আকাশে ঠাণ্ড গোলগাল রূপবতী চাঁদ। রূপালি আলোয় ঝলমলে আকাশ। দুই পাশে সারি সারি গাছ। ঝোঁপের ধারে নরম কোমল আলোর লুকোচুরি-জোনাকিদের আনাগোনা। সওদা হাতে বাড়ি ফেরা হাঁটভাঙা পথিকদলের গল্পে গল্পে পথচলা। লাউয়ের মাচায় গলাগলি প্রেম, সর্ষে ফুলে আগুন, তিষি ক্ষেতে জোয়ার। দূরে কোথাও থেকে ভেসে আসা সেই গলাছাড়া গান, ‘এই যে দুনিয়া কিসের লাগিয়া, এত যত্নে গড়াইয়াছেন সাঁই…
হাওয়ায় ভাসা গান, ভরাট কণ্ঠ, নোটে লাগা-না লাগা সুর। কিন্তু সে সুরে সুরে ছুড়ে দেওয়া প্রশ্নের জবাব মেলে না কোথাও। পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপকের কোনো ভারী প্রশ্নাঘাতে নীরব শ্রেণীকক্ষের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসা শব্দের মতো সেই সুরেলা গান। সমস্ত প্রকৃতিজুড়ে নীরবতা, জলদগম্ভীর নীরবতা। কেবল দূর আকাশে জেগে থাকা চাঁদের বুড়ি মিটমিটিয়ে হাসে। হয়তো ব্যঙ্গ করে বলছে, আদার ব্যাপারির আবার জাহাজের খবর!
অদ্ভুত সুন্দর আর মায়ায় ঘেরা এই গ্রহটির প্রেমে পড়ে রবীন্দ্রনাথও বলেছিলেন, ‘মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’ মানুষ বাঁচতে চায়, প্রাণীকুল বাঁচতে চায়, বাঁচতে চায় বোবা বৃক্ষ-গুল্ম-লতারাজি। যন্ত্রণায় তিলে তিলে দগ্ধ কর্কট রোগী স্টিভ জবসও বাঁচতে চায়, ডাস্টবিনের পাশে উচ্ছিষ্ট খাবারের জন্য অপেক্ষমাণ কংকালসার টোকাই শিশুটিও বাঁচতে চায়। পৃথিবী এত সুন্দর বলে মানুষ বাঁচতে চায়। নাকি মানুষ বাঁচাতে চায় বলেই পৃথিবী এত সুন্দর? এ প্রশ্ন আপাতত অমীমাংসিত।
স্টেশনের প্রায় কাছাকাছি এসে গেছি আমরা। প্রকৃতির স্নিগ্ধতা পেরিয়ে এবার বিজলি বাতির কৃত্রিম ঝলকানি। হঠাৎ দেখি স্টেশনের অদূরে একদল লোক জটলা বেঁধে আছে। এগিয়ে গেলাম দুই সহকর্মী। একটি অপমৃত্যু। একজন নারীর খণ্ডিত মৃতদেহ। থেঁতলে যাওয়া টুকরো টুকরো অংশ একসঙ্গে করে পুটলি বাঁধা হয়েছে হোগলা পাতার পাটিতে। এখনো ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে সে পাটির ফাঁক দিয়ে। কাঁচা রক্ত! পিচগড়ানো রক্ত! স্বজনদের আহাজারি। আড়াই বছরের শিশুর মা মা ডাকা গগনবিদারি চিৎকার। অত্যাধিক শক্ত চিত্ত না হলে এখানে না থাকাই শ্রেয়।
আরও পড়ুন: পাগল ॥ কাজী মোহাম্মদ আসাদুল হক
লোকজন বলাবলি করছে সম্ভবত সুইসাইড। আচ্ছা, মানুষ সুইসাইড করে কেন? জীবন কত কষ্টের হলে মানুষ মৃত্যুর মাঝে সুখ খোঁজে? ছোটে সুখ নামক মরীচিকার পেছনে? আত্মহত্যা মহাপাপ। এ কাজে ইন্ধন যোগানো সমাজও মহাপাপী। এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত চলতে থাকে এপারে ওপারে।
আত্মহননকারী আপাতত জীবন থেকে ছুটি নিয়েছে। এরপর শুরু হবে আরেক পর্ব। লাশ ময়নাতদন্ত হবে। বুক ফেঁড়ে বের করে আনা হবে যকৃৎ, খুলি ভেঙে নেওয়া হবে মস্তিষ্ক। অনির্দিষ্টকাল লাশ ঘরে পড়ে থেকে পচে গলে যাবে ব্যবচ্ছেদ করা মৃতদেহ। তবু একটু সমাধিস্থ করতে সেই লাশ আনতে যাবে স্বজনরা। থানা-পুলিশ হবে, মামলা নথিবদ্ধ হবে, জিজ্ঞাসাবাদ হবে, ব্যবসাপাতি হবে, আরও কত কী!
এদিকে লাশকাটা ঘরে পচাগলিত রক্তের গন্ধে ভনভন করবে মাছির দল। অষ্টাদশীর রেশমি কেশের ঘ্রাণে ব্যাকুল হওয়া প্রেমিকটিও আজ নাকে রুমাল ধরবে। কী নির্মম! কী ভয়নঙ্কর! কী বিভৎস!
না, না—এই বিভৎস দৃশ্য দেখতে কেউ রেলপথে আসবেন না। বরং চলুন আগের কথায় ফিরি। ওই যে রূপালি চাঁদ, সারি সারি গাছ, লাউয়ের মাচা, সর্ষে ফুল, শুভ্র তিষি ক্ষেত, জোনাকির আলো, আর দূর থেকে ভেসে আসা সে অচেনা কণ্ঠ, ‘এই যে দুনিয়া কিসের লাগিয়া।’