চাকরিতে জয়েন করেছি একবছর। প্রাইভেট মেডিক্যালে ডাক্তারি না পড়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃ-বিজ্ঞানের মতো ইঁচড়েপাকা সাবজেক্টে পড়েছি বলে বড়ভাই এখনো ভালো করে কথা বলে না আমার সঙ্গে। বোন ডাক্তার হবে বড় সাধ ছিল তার। ডাক্তার না হয়ে একবার মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে গেছি, তবু নৃ ছিল। কিন্তু পত্রিকার রিপোর্টার হয়ে মানুষের কাছ থেকে চিরতরে দূরে সরে গেলাম। কী আর করা!
দুপুরে অফিসে পা দিতেই চিফ রিপোর্টার আপার হাঁক। যেতে হবে কুড়িগ্রাম! আজ রাতের বাসেই, শীতের নিউজ কাভার করতে। আমার মাথায় প্রেমিকের লাঠির বাড়ি পড়লো যেন। কাল তার জন্মদিন। কথা দিয়েছি অফিস ফাঁকি দিয়ে সারাদিন তার সঙ্গে থাকব, ইনডোর-আউটডোর। হায়রে জানুয়ারির শীতে তাকে জন্ম দিয়ে কতই না কষ্ট করেছেন আমার হবু শাশুড়ি। মনে মনে ভাবি, আজকাল কি আর অত শীত পড়ে? দেশ উন্নত হয়েছে, শীতে আর মানুষ মরে না এখন। তবু শীতের নিউজ কাভার করতে যেতে হবে প্রেমিকের জন্মদিন ফেলে। চিফ রিপোর্টার আপা রাতের বাসের টিকিট ধরিয়ে দিলেন হাতে, যেন আমার প্রেমের মরার টিকিট। প্রেম কি আর থাকবে? আমার প্রেমিক জন্মদিন নিয়ে বড়ই সিরিয়াস। আপা বললেন, যাও কালকের ডেট আজকে করে ফেলো, অফিস করতে হবে না। দশটার সময় আসাদ গেট চলে যেও। আমি ফেসবুকে ঢুকে আমরাই জাহাঙ্গীরনগর গ্রুপে একটা স্ট্যাটাস দিলাম, কাল ভোরে কুড়িগ্রাম ল্যান্ড করব, জাবির কেউ থাকলে আওয়াজ দিয়েন। তারপর আমার বার্থ ডে বয়কে ফোন দিলাম। অনলাইনে একটা নীল পাঞ্জাবি কিনেছিলাম, সেটা নিয়ে বের হলাম। তাকে কিভাবে পটাবো ভাবতে ভাবতে ভাবিকে ফোন দিলাম, কুড়িগ্রাম এসাইন্টমেন্টের কথা বললাম, বাসা ম্যানেজ করার দায়িত্ব দিয়ে দিলাম।
ফোন পেয়ে পড়িমরি করে পান্থপথে এলো আমার দোকানদার প্রেমিক নয়ন। পাঞ্জাবিটা দিয়ে আহ্লাদ করে বললাম, তুমি কি রিকশায় বসে হুডটা তুলে পট করে শার্টটা বদলে পাঞ্জাবিটা পরতে পারবে? অবাক হলো না, আপত্তিও করলো না। চুপচাপ রিকশায় উঠলো, পাঞ্জাবিও পরলো। বললাম, শোনো হইছে কী, ভেবে দেখলাম, জন্মদিন আসলে মায়ের সঙ্গে কাটানো দরকার। তুমি কাল কুমিল্লা চলে যাও। সারাদিন মায়ের সঙ্গে থেকে এসো। বললো, আচ্ছা। তোমার বাস কখন?
সর্বনাশ! জানলা কীভাবে!
তোমার চিফ আপা আমাকে ফোন করেছিল! আমি নাজমা আপা না নয়ন কাকে চুমু খাবো, ভেবে পাই না। তুমি কি দশটা পর্যন্ত আমার সঙ্গে থাকতে পারবা? নয়ন আজ দারুণ কুল! বলল পারবে। শুধু আজ না বরাবর কুল। এইযে আমি এত বিয়ে পিছিয়ে দিচ্ছি, তবু রাগ করে না। শীতের কাপড়ের জন্য একবার বাসায় যেতে হবে। নয়ন বললো, আমি নিচে দাঁড়াবো, তুমি বাসা ঘুরে আসো। পান্থপথ থেকে আজিমপুর যেতে যেতে আমি বললাম, নয়ন হইছে কী, একটু চুমুটুমুতো খেতে হবে, কোথায় যাবো? এবার নয়ন হাসে, যাবি তো দুইদিনের জন্য, এত ফেয়ারওয়েলের কী আছে! শোনো ছেলের কথা! আমি বললাম, ধরো, যদি বাসটা অ্যাক্সিডেন্ট করে, যদি মরে-টরে যাই? নয়ন বলে, থাক থাক হইছে। মরিস না। নাজমা আপা বাসার চাবি দিয়েছে তোর ব্যাগে! আমি ব্যাগ হাতিয়ে সত্যি চাবি পেলাম!
নয়নকে নিউমার্কেট নামিয়ে দিয়ে বাসায় গেলাম। ভাই ভাবী মা আর ভাতিজীর সংসার আমার। ভাইয়া অফিসে, ভাবি কলেজ থেকে ফিরেছে। মেয়েও ফিরেছে স্কুল থেকে। সবাইকে জড়াজড়ি করে আদর করলাম, ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। নিচে নয়ন দাঁড়িয়ে, হাতে কয়েকটি ব্যাগ। বলি, কী কিনলা?
শাড়ি! আমি এমন অবাক হলাম—শাড়ি? কার জন্য?
কাল বাড়ি যেতে বললা না? মার জন্য।
আমি আরামসে দম নেব নেব, তখনই বললো, তোমার জন্যেও একটা কিনলাম! একটা শাড়ি খুব পছন্দ হলো। জীবনে তো শাড়ি পরলা না! আজ একটু পরো, দেখি! এইবার আমি বদলা নেই—কী ফেয়ারওয়েল দিচ্ছ মনে হয়? নয়ন এইবার বেকায়দায়! বললো, যা যা পরিস না। বুয়াকে দিয়ে দেব।
আমরা খেয়েদেয়ে নাজমা আপার বাসায় গেলাম। শাড়ি পরলাম। নয়ন বললো, তাকানো যাচ্ছে না। আর যদি কোনোদিন শাড়ি কিনি। তওবা তওবা! এত পচা লাগতেছে! হাসতে হাসতে কোলে তুলে নিলো।
এই আমার দ্বিতীয়বার শাড়ি পরা। এর আগে যেদিন শাড়ি পরেছিলাম, আমার আগের প্রেমটা ভেঙেছে সেদিনই। কেন যেন কাছের ছেলেদের প্রেমে পড়ি না। মিলন পড়তো ঢাকা কলেজে। বন্ধুর বোনের বিয়েতে গিয়ে পরিচয়, তারপর প্রেম। ক্যাম্পাস থেকে শাড়ি পরে এসেছিলাম ঢাকায় ডেট মারতে। দুজনে বসেছি রমনা পার্কে। দুটি ছেলে হেঁটে যাচ্ছিল, হঠাৎ একটি ছেলে বলল, তোমার পায়ের কাছে বসে জীবন কাটিয়ে দিতে পারি। আমার মাথায় শয়তানি কিড়মিড় করলো। ওকে ডেকে বসলাম—এই যে শোনেন! মিলন একবার বললো, কী করছ! ছেলেটা এসে দাঁড়ালো, আমাকে বলছেন? আমি বললাম, হ্যাঁ, কী বললেন? আমার পায়ের কাছে…? ছেলেটা নার্ভাস হলো না, আবার বলল, তোমার পায়ের কাছে বসে জীবন কাটিয়ে দিতে পারি। আমি বললাম ঠিক আছে বসুন আমার পায়ের কাছে, অনুমতি দিলাম। আমরা একটা বেঞ্চে বসে ছিলাম, ছেলেটা আমার মুখোমুখি পা বরাবর নিচে বসলো। মিলন বললো, ভাই আপনি জানতো। আমি বললাম, না থাকুন। আমরা গল্প করতে লাগলাম। মিলন বসে রইল পাশে। ঘণ্টা দুয়েক পরে ছেলেটি বললো, আমার বাথরুম পেয়েছে, ক্ষুধাও পেয়েছে, আধাঘণ্টার ব্রেক পেতে পারি? এইবার আমি বিজয়ীর হাসি হাসলাম। বললাম, দেখলেন, আমার পায়ের কাছে বসে জীবন কাটবে না, আরও ম্যালা কিছু করতে হবে। যান এবার। কথা হিসাব করে বলবেন। ছেলেটা চলে গেলো। মিলন বললো, তোমার সঙ্গে আমার আর দেখা হোক চাই না আমি। হয়ে গেল ব্রেক আপ। শাড়ি পরে চোখ মুছতে মুছতে ক্যাম্পাসে ফিরলাম।
নয়টার দিকে বের হলাম আমরা। আমাকে বাসে তুলে দিয়ে নাজমা আপাকে চাবি পৌঁছে দিয়ে বাসায় যাবে নয়ন। বাস ছাড়তেই ফেসবুকে ঢুকলাম।
আমরাই ‘জাহাঙ্গীরনগর’-এ দেওয়া পোস্টে কিছু কমেন্ট এসেছে। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান-সাবেক মিলিয়ে প্রায় বিশ হাজার মেম্বার এখানে। কেউ কেউ জানতে চেয়েছে, এই শীতে কুড়িগ্রাম কেন? কেউ বলেছে কুড়িগ্রামে এয়ারপোর্ট হইলো কবে? শুধু আমার এক স্যার জানতে চেয়েছেন, ওখানে আমার থাকার জায়গা আছে কিনা? স্যার আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন, কাজেই এই গ্রুপে। এভারগ্রিন স্যার আমাদের ডিপার্টমেন্টের উষ্ণতা।
আমি ইনবক্সে গিয়ে স্যারকে নক করি, আছেন?
আছি তো নীলা, আপনি কই?
বাসে, কুড়িগ্রাম যাই। ওখানে থাকার জায়গা আছে কিনা, জানতে চেয়েছেন। আছে নাকি কোনো রেফারেন্স?
আছে। আমার এক ক্লাসমেট আছে।
মনে মনে হিসাব করি, স্যার হলেন ষোলো নম্বর ব্যাচ, আমি পঁয়তাল্লিশ। প্রায় ত্রিশ বছর!
কী নাম তার? কী করেন?
রনক। রনক নাহার। ওখানকার একটা স্কুলে পড়ায়। একাই থাকে। বিয়ে করেনি।
ঠিকানা নিলাম। ফোন নম্বরও।
আমাদের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি রুমা আপার বাসায় থাকার কথা আমার। আমাদের পত্রিকার অনলাইন ভার্সনও আছে বলে একটা ভিডিও ক্লিপও লাগবে। ক্যামেরাম্যান মিশুক ভাই আছেন বগুড়ায়। তিনি কাল আমার সঙ্গে জয়েন করবেন। দুজনেরই কাল রাতে রুমা আপার বাসায় থাকার কথা। পরশু রাতে ফেরা।
নয়নকে ফোন দিয়ে আহ্লাদ টাহ্লাদ করে ঘুম দিলাম। মাঝরাতে কোথায় যেন থামলো বাস। নামলাম না। সকাল বেলা নামলাম, নেমে বুঝলাম শীত কাকে বলে। রুমা আপার বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খেয়েদেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। লোকজনের সঙ্গে কথা বললাম, কৃষক, বৃদ্ধ, শিশুর সঙ্গে। গেলাম হাসপাতাল, স্কুল সবখানেই। মিশুক ভাই কিছু ক্লিপ নিলেন। কাজ শেষ প্রায়। আজ রাতেই ফেরা যায়। নাজমা আপাকে ফোন দিলাম। বললেন, অতদূর গেছ, ঘুরে টুরে আস। কিছু সাইড স্টোরি পেলে করে ফেলো। বসের কথা ক্যামনে ফেলি।
নাজমা আপার ফোন রাখতে না রাখতেই নয়নের ফোন। শোনো নীলা হইছে কী! বাড়ি এসে দেখি, আমার বিয়ে ঠিক। মা বললো, তোমাকে তার একটুও পছন্দ নয়। মেয়ে ঠিক করে ফেলেছে, বলছে বিয়ে না করলে যেদিকে দুই চোখ যায় চলে যাবে। আজই বিয়ে। নয়ন ব্যাকুল হয়ে জানতে চায়, কী করবো, নীলা? তুমি একবার মায়ের সঙ্গে কথা বলবে? আমি বললাম, করে ফেলো বিয়ে। আমি তো রইলামই।
নয়নের সঙ্গে আমার পরিচয় ল্যাপটপ কিনতে গিয়ে। দোকানদার সে। ওয়ারেন্টির এক বছর যেতে যেতে তিনবার বিগড়েছিলেন তিনি। বারবার নয়নের দোকানে যেতে যেতে প্রেম হয়ে গেছিল। একবছর পর শাড়ি ও এনাদার ব্রেক আপ।
সন্ধ্যার দিকে রনক আপাকে ফোন দিলাম। আ-আমি নিলুফার বলতেই জানতে চাইলেন, নীলা? মলয় আমাকে তোমার কথা বলেছে। আসবে? আমি বললাম, আসব। কিভাবে আসতে হয় বলে দিন। রুমা আপার বাসায় উঠেছি শুনে বললেন, তুমি রুমার কাছ থেকে বিদায় নাও, আমি ওর বাসায় একজনকে পাঠাচ্ছি, শুভ ওর নাম। ও তোমাকে নিয়ে আসবে। আমি মিশুক ভাই ও রুমা আপার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শুভর সঙ্গে রনক আপার বাসায় চলে এলাম।
ছোট একটা দুই রুমের বাসায় থাকেন রনক আপা। রাত হয়ে গেছিল, তিনজনে খেয়ে নিলাম। শুভ চলে গেলো। রনক আপা বললেন, শুয়ে পড়বে নাকি একটু গল্প করবে?
আমি ফস করে বললাম, রনক আপা, একটা সিগারেট খেতে পারি? হাসলেন তিনি, জলের মতো ঠাণ্ডা হাসি, বললেন খাও। তারপরই বললেন, তোমার কেন মন খারাপ, আমাকে বলবে? আমি সিগারেট ধরিয়ে বললাম, আজ আমার প্রেমিক নয়নের জন্মদিন এবং বিয়ে। তিনি বললেন, তোমার প্রেমিকের বিয়ে উপলক্ষে আমাকেও একটা সিগারেট দাও। সিগারেট ধরিয়ে বললেন, তুমি ফোন করে অফিস থেকে কয়েকটা দিন ছুটি নাও। আমার কাছে থাকো। থাকবে? আমার সত্যিই ঢাকা ফিরতে ইচ্ছে করছে না। যদি না ফিরি শীতের রিপোর্ট লিখে পাঠিয়ে দিতে হবে। হঠাৎ ঠিক করলাম, থাকব। বললাম, তাহলে আমি রিপোর্টটা লিখে ফেলি। ল্যাপটপ বের করে লিখতে বসলাম। তিনি বললেন, চা খাবে? দাঁড়াও চা নিয়ে আসি। আমি বললাম, ল্যাপটপটা নয়নের দোকান থেকে কিনেছিলাম!
তিনি যখন চা নিয়ে ফিরলেন, আমার লেখা তখন প্রায় শেষ।
চা খাচ্ছি দুজনেই চুপচাপ। হঠাৎ যেন অনেক দূর থেকে বলছেন, আমি ত্রিশ বছর বাড়ি যাই না! আমি চমকে তার মুখের দিকে তাকালাম! এমন মুখ আমি কখনো দেখিনি। কী আছে সেই মুখে আমি বলতে পারবো না। দুঃখ-কষ্ট, বিষণ্ণতা—এসব শব্দ বড় কম ওজনের মনে হয়। তিনি হাসলেন, সেই হাসি দেখে আমি আমূল নড়ে গেলাম।
বললেন, আমি যখন জাহাঙ্গীরনগরে পড়তে যাই, তুমি তখন কোথায় ছিলে নীলা?
কোথাও ছিলাম না তখন আমি।
তোমার কি আজ রাতে ঘুম আসবে?
মনে হয় না। নতুন জায়গায় ঘুম আসতে চায় না।
শুধু নতুন জায়গা বলে?
এবার আমি হাসলাম। আমার মনে হলো হাসিটা তার মতো হয়ে গেলো।
তবে এসো গল্প করি। ক্যাম্পাস ছেড়ে আসার পর আর যাইনি। আগের মতোই আছে?
ত্রিশ বছর আগে কেমন ছিল আমি তো জানি না। শুনেছি অনেক জংলা ছিল, দালানকোঠা অনেক কম ছিল।
হুমম, আমাদের গাঁয়ের মতো।
হঠাৎ আমি বলে বসলাম, এই ক্যাম্পাস আপনার কাছ থেকে বাড়ি কেড়ে নিয়েছে?
হ্যাঁ, আমার খুব আফসোস হয়, কেন ওখানে গিয়েছিলাম আমি!
আমার আর কথা বলতে সাহস হয় না। অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। তিনি বললেন, ঘুমিয়ে পড়ো। আমি আচ্ছা বলতেই তিনি পাশের ঘরে চলে গেলেন।
রাত প্রায় দুইটা বাজে, তবু ফোন দিলাম নাজমা আপাকে।
আমি কাল ফিরব না।
মানে কী? কই থাকবা? ওখানে তুমি কাকে চেন?
আমার ইউনিভার্সিটির এক বড় আপা আছেন। ওনার কাছে থাকব।
কী হইছে তোমার? বলো আমাকে।
কিছু হয়নি, থাকতে ইচ্ছে করছে, ছুটি দিলে দেন, না হলে চাকরি নট করে দেন।
এসব কী কথা! কী হইছে ঠিক করে বলো।
নয়নের বিয়ে আজ!
নাজমা আপা আর্তনাদ করে উঠলেন—হায় আল্লাহ, আমি কেন তোমারে কুড়িগ্রাম পাঠাইলাম!
আধা ঘুম আধা জেগে রাত পার করলাম। দেখলাম আপা রেডি হচ্ছেন স্কুলে যাওয়ার জন্য। বললেন, তুমি নাস্তা খেয়ে নাও। আমি স্কুল ঘুরে আসি। আজ আর ক্লাস করবো না। কয়েকদিন ছুটি নিয়ে আসি। অনেকদিন ছুটি নেই না, ম্যালা ছুটি পাওনা হয়েছে।
আমি উঠলাম, অচেনা কারও বাসায় চেনা মানুষের মতো ঘুরে ঘুরে দাঁত মাজলাম, গোসল করলাম, নাস্তা খেলাম। মিশুক ভাইকে ফোন দিলাম, আপনি তাইলে যান, আমি আসতেছি। রিপোর্ট একটা আপনাকেও মেইল করেছি, একটু দেইখা দিয়েন। বাসায়ও ফোন দিলাম, মা কী বুঝলো, কে জানে। বললো, আচ্ছা, কবে ফিরবি?
খানিক পরেই ফিরে এলেন আপা। বললেন, চলো তোমাকে ঘুরিয়ে আনি। আগে তো আসোনি কুড়িগ্রাম। এই জায়গার নাম মুন্সীপাড়া। খানিক এদিক-ওদিক একটু ঘুরে এলাম আমরা। এসে দুপুরে খেয়ে একটা ঘুম দিলাম। উঠে দেখি রাত দশটা বাজে।
আমাকে উঠতে দেখে আপা হাসলেন, আমি তোমার জন্য ছুটি নিলাম, আর তুমি সারাদিন ঘুমালে? এসো খেয়ে নেই। খেতে বসে টুকটাক গল্প হলো। জানলাম আপার বাড়ি পটুয়াখালী, গলাচিপা। মা আর বোন আছে সেখানে। খেয়ে এসে আপার ঘরে বসলাম।
গুনগুন করে গান গাইছে আপা। অচেনা সুর! কথা প্রায় বোঝা যায় না। আমি খুব কান পাতি। ধীরে ধীরে কথা স্পষ্ট হয়—আমাদের গাঁয়ের নাম রুমাল, সেখানে বৃষ্টির শব্দ হয় ফোঁপানোর মতো। রুমাল রুমাল বলে তন্ময় হয়ে গাইতে থাকেন, একটাই শব্দ। কী আছে সেই সুরে? হাহাকার? আমি জানি না।
আমি তার হাত ধরি, আমাকে বলবেন?
চোখ বন্ধ করেন কনক আপা, প্রায় শোনা যায় না—এমন করে বলতে শুরু করেন, আমার একটাই বোন, বড়বোন, কনক নাম ওর। আর আছে মা। আর আমার রুমাল। আর আমার এক বন্ধু ছিল, মন্নাফ নাম ওর। আমরা যখন থ্রিতে পড়ি কুকুর কামড়েছিল ওকে। বোনের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল মন্নাফ। বোনের শশুরবাড়ির গাঁয়ে কার্ত্তিক মাসে বিরাট মেলা বসে। সেই মেলায় গিয়েছিল বোন জামাইয়ের সঙ্গে। সেখানেই কপালে সাদা দাগওয়ালা এঁটেল মাটি রঙের একটা কুকুর কামড়েছিল তাকে। অল্প একটু রক্ত বেরিয়েছিল। বোনজামাই কাঁধের গামছা দিয়ে মুছে দিয়েছিল। পরেরদিন বোনকে নাইয়োর নিয়ে ফিরে এসেছিল সে। তারপর দিন স্কুলে এসেছিল মন্নাফ। আমাদের মেলার গল্প বলেছিল। কুকুরের কামড়ের দাগও দেখিয়েছিল। তারপর সবাই ভুলে গিয়েছিল সে কথা। পৌষ মাসে জ্বর এলো মন্নাফের। পানি খেতে পারে না। সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার এলেন দেখতে। জানতে চাইলেন কুকুর কামড়েছিল কিনা! জলাতঙ্ক নামের এক গরম বাতাস বয়ে গেল রুমালের ওপর দিয়ে। বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতে হবে মন্নাফকে!
আমাদের গাঁয়ের গৃহস্থ বাড়ির বাইরের দিকে একটা করে ঘর। গৃহস্থ কৃষকের কামলারা থাকে। মন্নাফের বাবা সেইঘরের চারদিকের বেড়া খুলে দিলো। মাঝখানে খুঁটিতে বাঁধা থাকতো মন্নাফ। গাঁয়ের কেউ না কেউ থাকতো সেখানে। পানি খেতে পারতো না মন্নাফ। খাবার দিলে মুখ নামিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করতো। সে বছর আমাদের স্কুলে বাষিক পরীক্ষা হলো না। নতুন ধান গোলায় উঠে গেলো। পিঠা হলো না। লাঠি খেলা যাত্রাপালা হলো না। মন্নাফ বেঁচে ছিল মাস খানেক। তারপর একটা গরম বাতাস রুমালের ওপর দিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে গেল ওকে। আমরা তো জানতামই ও ভেসে যাবে। ওর কষ্ট শেষ হয়েছে। মন্নাফের কবরে কেউ পানি দেয়নি। কিন্তু কথা শোনেনি বৃষ্টি। সেই মাঘে গরম বাতাসের তোয়াক্কা না করে ঝরলো মন্নাফের কবরে। ছিটানো সরিষা সবুজ করে দিল মন্নাফের কবর।
দুদিন পর বাতাস থেমে গেলো। হাসি খালা মাকে এসে বললো, পানি খায় না মন্নাফের মা। সেই মাঘের দুপুরে রুমালে চৈত্র। আঙিনায় সেবার মূলা। মা কয়েকটা মূলা তুলে এনে অনেক পানি দিয়ে বারবার ধুয়ে কেটে টুকরা করলো। কলাপাতায় মুড়ে আঁচলে জড়িয়ে নারিকেলের তেলের বোতলটা নিয়ে চলে গেলো মা। একটা পিঁড়ি উঁচু একটা নিচু। মন্নাফের মায়ের মাথায় তেল দেয় মা, আর গল্প করে, দূর গাঁয়ে বিয়ে হওয়া আমার ছোটখালাকে তার শ্বশুর বাড়ির লোকজন কত কষ্টে রেখেছে, সেসব। আমার ছোটখালার দুঃখে কাঁদতে থাকে মন্নাফের মা। তখন পেছন থেকে হাত ঘুরিয়ে মন্নাফের মার মুখে মূলা তুলে দেয় আমার মা। কানতে কানতে মূলা চিবায়। তারপর থেকে মন্নাফের মায়ের মাথায় কেউ না কেউ তেল দেয়, দুঃখের গল্প করে কাঁদায় আর মূলার টুকরা মুখে তুলে দেয়। মাথার তেল গড়িয়ে পড়ে কাপড়ে। বেশিদিন বাঁচেনি মন্নাফের মা।
রুমালের মানুষ কবে থেকে পানি খাওয়া ছেড়েছিল, কারও মনে নেই। একসঙ্গে বসে মিটিং করে হয়নি কিছুই। যেমন করে মাথার চুল বাড়ে, হাতের নখ বাড়ে, বাতাস বয়, তেমন করে পানি খাওয়া ছেড়েছে রুমাল। আশপাশের গ্রামের মানুষ একসময় জানতে পারে,পানি খায় না রুমাল। মরে যাওয়ার সময় পানি খেতে পারেনি মন্নাফ, সেকথা কখনো ভোলে না রুমালের মানুষ। আমাদের নদী, টিউবওয়েল, পুকুর—সবই আছে, তবু আমাদের জমিতে মূলা, শশা, কেশুরের চাষ বাড়তে থাকে, চাল কিনে খায় রুমাল! রুমালের ছেলেমেয়েদের বাইরের গ্রামে বিয়ে হয় না আর।
এই রুমালের আমি আইয়ে পরীক্ষায় খুব ভালো রেজাল্ট করে ফেললাম। গ্রামের সবাইকে কনক বললো, রনকের আইয়ের ফল খুব ভালো, বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে দেই ওকে। দেখি যদি পাস করে। কনকের কথায় চুপ করেই ছিল গ্রামের সবাই। যখন জানা গেলো সত্যি পাস করেছি, তখন কেউ আপত্তি করেনি। দিন এসে গেলো আমার যাত্রার। ব্যাগ গোছাচ্ছিলাম আমি আর কনক, মায়ের হাতে একটা ঝকঝকে রূপালি এলুমিনিয়ামের জগ দেখে থেমে গিয়েছিলাম।
দয়া হয় না কনকের। রূপালিকে ব্যাগে ভরে। নীলা কাঁথা জড়িয়ে শুয়ে থাকে রূপালি। টুঁটি থেকে হাত সরায় না রূপালি। চেচাই না, কাঁদেও না। চোখেরও পানি লাগে। তাই ভাসে না। কনকের গলা ভাসে। যেন গ্লাস ভরা পানিতে পিপড়া ভাসে। পানি খাও না জানলে সবাই তোমাকে অ্যাবনরমাল ভাববে না?
কনক আমাকে জাহাঙ্গীরনগর রেখে পরের দিনই ফিরে যায়। আমি একটু একটু করে পানি খাওয়া শিখি আবার। অবাক হয়ে দেখি, কত রকমের মেয়ে। টুনি নামের একজনের সঙ্গে খুব ভাব হয়।
ঈদের ছুটি শুরু দুদিন পরে। কনক আমাকে নিতে আসবে। রুম রুম থেকে ধার করা গল্পের বইয়ে ব্যাগ ভরেছি। বাড়ি যাব সেই আনন্দে দিশেহারা আমি। বিকেলে কনক আর মা এসে হাজির। দেখে, আমি আনন্দে আত্মহারা। মা আমাকে নিতে এসেছে। সবাই দেখা করতে এসেছে। মায়ের আনা পিঠা সবার হাতে। টুনিকে নিতেও ওর মা এসেছে। হঠাৎ টুনি বললো, খালাম্মা রনককে এবার আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাই। আমাদের সঙ্গে ঈদ করবে। টুনির মাও বললো, হ্যাঁ আপা নিয়ে যাই। আমার রুমের বাতাস বন্ধ হয়ে গেলো। নড়ে উঠলো ফিতাচুড়ি পরা হাত। শুকনা ঠোঁট। মায়ের জবাব, আচ্ছা নিয়ে যান।
পানি খেয়ে অচ্ছুত হয়ে গেছি আমি। আমাকে আর নেবে না রুমাল।
ঢাকা ফেরার পথে আমার মাথায় আর রনক আপা ছাড়া কিছু নেই। গুনগুন গান গেয়ে, ফিসফিস করে কথা বলে যেন কারবালার গল্প আমাকে শুনিয়েছেন তিনি, কাবু হয়ে গেছি আমি। ঢাকা নেমে আমি বাসায় যাই না। অফিসেও না। আমি সেই রুমালকে ছুঁতে পটুয়াখালীর লঞ্চ ধরতে ছুটি।