দো-তলার সিঁড়ি বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। এই রক্ত টাটকা নয়, বেশ পুরনো। রঙে লাল ভাবটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। গন্ধটা এতটাই ভ্যাপসা-গুমোট যে, পেটের ভেতর থেকে নাড়িভুঁড়ি কণ্ঠনালী দিয়ে বাইরে আসতে চাচ্ছে। মন্ত্রীর নতুন পরিচ্ছন্নতাকর্মী আমজাদ মিয়া চারঘণ্টা আগে চাকরিতে যোগ দিয়েছে। এখন সে মন্ত্রীর বাসভবনের নিচতলায় দাঁড়িয়ে আছে। দারোয়ান নরেন্দ্র চন্দ্র দাস বলেছে—ওপরে দো-তলায় গিয়ে উত্তরদিকের কক্ষটা পরিষ্কার করতে বলেছেন স্যার। আর ধরো, এই কমলা লেবুটা ধরো, আরে নাও, খাও। এই নতুন পরিচ্ছন্নতাকর্মী আনমনে তুলে নেয় কমলাটা। আমজাদ মিয়া সিঁড়ি বেয়ে যত উপরে যাচ্ছে, তত গন্ধটা প্রকট হচ্ছে। আর দো-তলাটা কেমন যেন নিস্তব্ধ, নিথর। মৃতের ঠোঁটের মতো কালো-শব্দহীন! মোবাইল ফোনে রিংটোন বেজে উঠতেই সারাশরীর যেন ভয়ে শিউরে ওঠে। অল্প সময়েই ঘোর কেটে যায়, মন্ত্রীর ফোনে। তারপর কী কথা হয় সৃষ্টিকর্তা, মন্ত্রী আর আমজাদ মিয়া ছাড়া কেউ বলতে পারে না। আমজাদ মিয়ার গলায় শুধু ‘জি স্যার’ ধ্বনি দুটি রয়ে রয়ে উচ্চারিত হয়। কথা বলা শেষে সে দো-তলার বারান্দা দিয়ে পায়চারি করতে থাকে। রক্তগুলো ওই উত্তরদিকের দরজার নিচ দিয়ে গড়িয়ে আসছে। এমন দুর্গন্ধের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে জানালার ফাঁক দিয়ে ভেতরে দেখার চেষ্টা করতে আমজাদ মিয়ার কষ্ট হচ্ছে না। শুধু স্বগতোক্তি করে সে—এই রক্তস্রাত কার? হয়তো ভেতরে ফ্রিজটা নষ্ট হয়ে গেছে, হয়তো এটা মুরগির মাংস থেকে বের হয়ে আসা রক্ত, হয়তো এই রক্ত বিশালাকার অজগরের!
আচ্ছা, এখানে—এই নিচের ঝোপটার পাশে দুটো পাখিকে দেখলাম, একটি অন্যটির মুখে কেমন আদর করে দিচ্ছে। আহ! ওরা কি নব দম্পতি, মা-ছেলে, বাবা-মেয়ে, ভাইবোন? আমার স্ত্রীর কথা মনে পড়ছে, মায়ের কথা, বাবার কথা, বোনের কথা! আমাদের পুকুরটার কথা মনে পড়ছে। পোষা কুকুরটার কথা মনে পড়ছে! এই তো এই লোকটার মতো কেমন নাদুস-নুদুস আমার কুকুরটা। ‘আমার কুকুরটা’ উচ্চারণ করতেই প্রবল বেগে ঘাড়ের ওপর একটা আঘাত অনুভব করে। তারপর সে অনুমান করতে পারে, সে মাটিতে পড়ে আছে আর এতক্ষণ ছায়ার মতো, পোষা কুকুরের মতো যা দেখছিল, সেটা হয়তো মন্ত্রী, নয়তো নরেন্দ্র চন্দ্র দাস। ছায়াটা দূরে সরে যাচ্ছে। পাশে পড়ে থাকা একগোছা চাবি দেখে সে আবিষ্কার করে—উত্তরদিকের দরজাটা তালা দেওয়া। তবে সে বুঝতে পারে না—চাবিটা কে দিয়ে গেছে। স্পষ্ট মন্ত্রীকে সে দেখেছে, না নরেন্দ্র চন্দ্র দাসকে দেখেছে, হয়তো সে কাউকে দেখেনি, চাবির গোছা নিচতলা থেকে নিজেই নিয়ে উঠেছে। তাহলে সে এতক্ষণে দরজা খোলার চেষ্টা করেনি কেন? মানুষ এমন বোধ হয়, বাইরে থেকে ভেতর দেখতে বেশি ক্রিয়াশীল। এখন সে দেখতে পাচ্ছে—রক্তগুলো প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। আমজাদ মিয়া রক্ত হাতে মাখে, এখনো গরম, কোনো বৃদ্ধের রক্ত নয় এ, টগবগে যুবকের রক্ত! তারপর ধীরে ধীরে ঘরের তালা খুলে ফেলে। অসংখ্য মানুষের কোলাহল অনুভব করে আমজাদ মিয়া। তারুণ্যের কণ্ঠে শোনা যাচ্ছে—দলীয়, বিরোধীদলীয়, ইসলামপন্থী, ইসলামবিদ্বেষী, বামপন্থী, আর আস্তিক-নাস্তিকের স্বর। ওরা হয়তো একই পেয়ালায় মদ খাচ্ছে। ওরা হয়তো অট্টোহাসিতে ফেটে পড়ছে। ওরা মৃত্যুর কথাগুলো কবিতার মতো বলছে। আমজাদ মিয়া নিজের পরনের কাপড় খুলে ফেলে। গরম রক্ত সারাগায়ে মাখে আর হাসে। মানুষ কী চায়, শেষাবধি তাল মেলানোই তো মানুষের মজ্জাগত স্বভাব। হোক জীবিতের সঙ্গে, হোক মৃতের সঙ্গে, তাল সে মেলাবেই। আমজাদ মিয়া মৃতের সঙ্গে তাল মেলাতে চায়।
তেরো দিন গত হলো আমজাদ মিয়ার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। নরেন্দ্র চন্দ্র দাস গ্রেফতার হয়েছে। এদেশ তো চিরদিন দাস গ্রেফতারে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। আর এমন ছোট জাতের নামে ‘ইন্দ্র’ যোগ করার বা কী দরকার ছিল! ‘চন্দ্র’ উপাধী কেন যে এই ছোটজাতের লোক গ্রহণ করে কে জানে! নিতান্তই অজ্ঞ সমাজ বলে কথা। তাই এসব ছোটলোকের নাম লম্বা ও উপাধিযুক্ত না হয়ে ছোট হওয়াই শ্রেয়। ঠিক আছে—নরেন গ্রেফতার হয়েছে। আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে—‘আমি আমজাদ মিয়াকে দো-তলার উত্তরদিকের কক্ষে যেতে বলেছিলাম। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেও দেখেছি। একটা কমলা নিজে না খেয়ে তাকে খেতে দিয়েছি। মন্ত্রী মহাশয়কে একবার উপরে উঠতে দেখেছিলাম। তারপর…তারপর…আর কিছু জানি না।’ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ধারণা—এতকিছু যে জানে, সে নিখোঁজ হওয়ার কারণও জানে, সন্ধান জানাও অসম্ভব নয়। তাছাড়া গোয়েন্দা সংস্থা বলছে—‘নরেন হিন্দু, আমজাদ মিয়া মুসলমান। যবনদের প্রতি হিন্দুদের বিদ্বেষ ভারতবর্ষে নতুন নয়। সুতরাং…। দ্বিতীয়বারের মতো পুলিশ ইনভেস্টিগেশন এসেছে মন্ত্রী জগৎসিংহের বাড়িতে। সিসিটিভির ফুটেজ পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু কালো আর ঝাপসা! দো-তলার উত্তরদিকের কক্ষের সামনে পুলিশ, জগৎসিংহ আর গোয়েন্দা বিভাগের লোকেরা দাঁড়িয়ে আছে। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ, অতএব আমজাদ মিয়া ভেতরেই আছে। কী আশ্চর্য! বাইরে রক্তের দাগগুলো নেই, রক্তও গড়িয়ে আসছে না। আমজাদ মিয়া সম্ভবত খুব ভালো পরিচ্ছন্নতাকর্মী। অথবা এমন হতে পারে আমাদের পুলিশ রক্তের দাগগুলো মুছে ফেলতে অভ্যস্ত। নতুবা পুলিশ দেখলে রক্তের দাগগুলো নিজেরাই মুছে যায়! একজন সাহসী পুলিশ কনস্টেবল ইতোমধ্যে দরজা ভেঙে ফেলেছে। ভেতর থেকে বহুদিনে জমানো একরাশ ধুলো ঝাপটা মারে চোখে। জগৎসিংহ যেন কার সঙ্গে কথা বলছেন! তারপর চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা নিজেরা শরীরে আঘাত অনুভব করে। ইউনিফর্মে স্পষ্ট রক্তের দাগ দেখতে পায়। ওরা পালাচ্ছে!
দুদিন পর পুলিশ হেডকোয়ার্টারে একটি ফুটেজ দেখছে সবাই। দৃশ্যটা মন্ত্রীর দো-তলার উত্তরদিকের কক্ষের। দেখা যাচ্ছে—একটা রক্তমাখা শরীর মন্ত্রীকে উপর্যুপরি কামড়ে রক্তাক্ত করছে! দর্শকরা কেউ কেউ বলছেন, তারা এই ফুটেজে মন্ত্রীকে দেখেনি। আবার কেউ বলছে, আমি কখনো মন্ত্রীকে দেখেছি, আবার কখনো দেখেছি একটা রামকুকুর! তবে হাই-কমান্ডের সিন্ধান্ত হলো— যেহেতু আপনাদের ইউনিফর্মের রক্তের দাগ উঠছে না এবং দিনদিন আরও জীবন্ত হয়ে উঠছে, অতএব ইউনিফর্ম পরিবর্তন বাঞ্ছনীয়। মন্ত্রীর বাড়ি থেকে একটা টেলিফোন আসে—স্যার, মন্ত্রীর বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে নতুন-টাটকা দাগ দেখা দিয়েছে। যত বেলা হচ্ছে দাগগুলো তত গাঢ় হচ্ছে। আরে বাপু, কিসের দাগ—ডিএমপি পুলিশ কমিশনারের হুঙ্কার। টেলিফোন ভেসে আসে—কে জানে কতকাল পুঞ্জিভূত রক্তের দাগ!