বাক্সটির ভেতর কী আছে?—বাক্সটিকে ঘিরে বেড়ে ওঠা উপস্থিত ভিড়ে কানাঘুষা আর নানা মন্তব্য। পুলিশ এসেছে, তারাও বাক্সটিকে স্পর্শ করছে না। বোম ডিসপোজাল স্কোয়াডকে খবর দেওয়া হয়েছে। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা এসে উপস্থিত হয়ে সবার কৌতূহল মিটিয়ে দিতে পারবে। জনমনে উৎকণ্ঠা বাড়ছে। কী আছে বাক্সের ভেতর?
সূর্য তখন মধ্য গগনে। ভিড়ের জনতার শরীর দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। তাতে অবশ্য কারও ভ্রূক্ষেপও নেই। সবাই উৎসুক—বাক্সরহস্যের ফয়সালা দেখার জন্য। বাক্সটি মাঝারি আকৃতির, বেশ পরিচ্ছন্ন। আভিজাত্যের ছোঁয়া তার পরতে পরতে। পুলিশ বাক্সটিকে বোমা বা সেই রকম কিছু ভাবলেও জনতার বিশাল অংশের চিন্তা তাদের বিপরীত। প্রচুর সোনাদানা নয়তো কাড়ি কাড়ি টাকার বান্ডিল আছে বলেই ভিড়ের জনতার ভেতর কানাঘুষা চলছে।
গত আটদিন ধরে রতনের ছয় সদস্যের পরিবারের কপালে ভাত জোটেনি। কচু আর হেলেঞ্চা শাক সেদ্ধ করে তাতে লবণের ছিটা দিয়ে কোনোমতে তা খেয়ে বেঁচে আছে। দুর্বল শরীরে রতনও এসেছে বাক্সরহস্যের সমাধান দেখতে।
ঘরে পাঁচ বছরের ছেলেটির তিনদিন ধরে জ্বর। পকেট গড়ের মাঠ, পথ্য কেনার সামর্থ্য নেই। তাই জ্বরকেও তাড়ানো যায়নি ছেলের ছোট্ট শরীর থেকে। রতনের বউ অবশ্য কয়েকদফা এবাড়ি-ওবাড়ি করেছে। কিন্তু কেউ ধার দেয়নি। খালি হাতেই তাকে ফিরতে হয়েছে।
রতনের বউয়ের কান্নার জল গড়িয়ে কখনো মাটি স্পর্শ করতে পারেনি। পারেনি পদ্মার উত্তাল ঢেউয়ের মতো ফণা তুলে আছড়ে পড়তে অভাবের বুকে। তার পরনের ছেঁড়া শাড়ির আঁচল তা শুষে নিয়ে দিনিদিন আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। তিন ছেলেমেয়ে, বুড়ি মা, বউ আর রতন—কারও চোখেই আগামীকাল বলে কিছু নেই। ওদের স্বপ্ন দুপুরে কী খাবে, রাতের কি একটু ভাত জুটবে কপালে?
আশেপাশের প্রায় সব এলাকায়ই খবরটি পৌছেঁ গেছে। বাক্সরহস্যের ফয়সালা দেখতে ধীরে ধীরে জনতার ভিড় বাড়ছে। পুলিশের বোম ডিসপোজাল স্কোয়াড এখনো এসে পৌঁছায়নি। তাই তারা উৎসুক মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখতে সদা সচেষ্ট।
রতন বাক্সটির দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মনে নানা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। প্রথমে তারও মনে হয়েছিল বাক্সে বোমা বা এমন কিছুই আছে। কিন্তু ধীরে ধীরে উপস্থিত জনতার কথাবার্তা তার মনেও উদিত করেছে ভিন্ন এক সুখের ছবি। সে ভাবতে থাকে, এর ভেতরে নিশ্চয় কোনো ধনসম্পদ আছে। হয়তো বাক্সটি কোনো বড়লোকের ভাগ্যদোষে এইখানে সবার মাঝে উপস্থিত হয়েছে।
তার মনে ভেসে ওঠে—অনেক টাকার ছবি, সোনার গহনা। তার বউয়ের হাসিমাখা মুখ। সুখে মোড়ানো শরীরে তার যৌবন যেন উপচে পড়ছে। রতন যৌনসুখের পরশে আপ্লুত হয়ে পড়ে। তার মাথায় নানা চিন্তার মাঝে একটি চিন্তাই বারবার ঘুরপাক খায়—যদি বাক্সটির ভেতরের টাকা-পয়সা সোনাদানাগুলো পেতাম। তাহলে আর কোনো অভাব থাকতো না। সুখে বসবাস করতে পারতাম। ছোট ছেলেটির চিকিৎসা করানো যেতো। ভাতের অভাবে হাসফাঁস করতে আর হতো না।
রতনের ভাবনা বেড়ে চলে, বাক্সটি খোলার পর যদি সব টাকাপয়সা আর সোনাদানা গরিবের মাঝে ভাগ করে দেওয়া হতো, তাহলে অন্তত বহু গরিবের না খেয়ে উপোস দেওয়ার কাল ঘুচতো।
তার স্বপ্নভঙ্গ হয়, নজু মেম্বারের ডাকে।
—ওই রতন, এইদিকে আয়।
রতন এগিয়ে যায়, সালাম দেয়। নজু মেম্বারকে ঘিরে আছে গ্রামের মান্যগণ্যরা। রতনকে চা আর বিস্কিট আনার হুকুম দিয়ে আবারও নজু মেম্বার বাক্সটি নিয়ে গভীর আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
রশিদের দোকান থেকে রতন চা বিস্কিট এনে সবাইকে পরিবেশন করতে থাকে। একটু অসাবধানতার কারণে রতনের হাতের কাপ থেকে চা উছলে পড়ে নজু মেম্বারের সাদা পায়জামায়। ব্যস, তাৎক্ষণিক রতনের কপালে জোটে উত্তম-মাধ্যম।
দুঃখী মন নিয়ে রতন আবারও এসে দাঁড়ায় বাক্স ঘিরে রাখা ভিড়ের ভেতর। নজু মেম্বারের আচরণে রতনের মনে কোনো দাগ ফেলে না। দুঃখ একটু সে পায়। তবে তা সাময়িক। এগুলো তার জীবনে অনেক তুচ্ছাছিতুচ্ছ ঘটনার মতোই।
রতন আবার স্বপ্নের ভেতর চলে যায়। গত আটদিনের উপোসী মনে আসে নবজোয়ার। রতন সুখের জলে সাঁতার কাটতে শুরু করে। তার উঠোনে পাকা ধান ছড়ানো। তার বউ, মা আর মেয়ে মিলে ধান শুকোচ্ছে, ঝেড়েমুছে গোলায় ভরছে। আহা, তার কপালে কি এই সুখ আসবে কখনো!
ক্ষতি কী—এই বাক্সটির ভেতরের টাকা-পয়সা বা সোনাদানার যতসামান্যও যদি মেলে তাহলেই তার অভাব চিরতরে ঘুচে যায়।
মানুষের ভিড় আর সূর্যের তাপে প্রচুর গরম পড়েছে। একে তো ভাদ্রমাস, তার ওপর গত পনের দিন ধরে বৃষ্টির দেখা নেই। রতনের বেশ পিপাসা পায়। সে এগিয়ে যায় রশিদের দোকানের দিকে। পাশে রাখা ড্রাম থেকে পানি খেয়ে রতন কাছের একটি গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসে পড়ে। হঠাৎ তার শরীরের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে। মাথা গুলিয়ে যায় ঝিমঝিম করে। তার চারপাশ ঘুরছে। রতন টালমাটাল হয়ে উঠতে গিয়ে ধপাস করে পড়ে যায়।
অনেকক্ষণ পর রতনের সম্বিৎ ফিরে আসে। সে দেখে ভিড়ের পাশে সেই গাছের নিচে বসে আছে। চারপাশে অনেকে মানুষ। তবে তাদের সব আগ্রহ বাক্সটির ভিড়কে কেন্দ্র করে।
রতনের পাশে বসে আছে একজন ফকির গোছের মানুষ। রতন সেদিকে তাকায়। ফকির তাকে দেখে হাসে। সে ফকিরের দিকে তাকিয়ে থাকে।
ফকির তাকে জিজ্ঞাসা করে, ক্ষুধা লাগছে কী? রতন মাথা নাড়ে। ফকির তার দিকে একটি শেকড় এগিয়ে দিয়ে তা খেয়ে নিতে বলে। রতন ফকিরের কথায় শেকড় মুখে দিয়ে চিবোতে থাকে। তার মনে হতে থাকে, এ কি অদ্ভুত জিনিস! অদ্ভূত সুমিষ্ট তার স্বাদ! শেকড়টা খাওয়ার পর তার গায়ের জোর যেন কয়েকগুণ বেড়ে যায়! ক্লান্তিটাও কেটে যায়।
সে ফকিরকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে যাবে, তখন আবার ফকির বলে ওঠে—তুই কে বল তো?
রতন তার নাম বলতে গিয়েও পারে না। তার গলায় যেন স্বর আটকে যাচ্ছে। বহু চেষ্টা করেও সে একটি শব্দও উচ্চারণ করতে পারে না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে ফকিরের তাকিয়ে থাকে।
ফকির তাকে বলেন—তোর পূর্বপুরুষ ছিলে জমিদার। ভাগ্যদোষে তুই এইখানে পইড়া আছস। এই এলাকা থেকে তিনদিনের হাঁটা পথ জিঞ্জির পাড়া। সেইখানে ছিল তোর পূর্বপুরুষদের জমিদারি। প্রজাবৎসল হিসেবে বেশ সুনাম ছিল তাদের। সবার বিপদে আপদে সাহায্য সহযোগিতা করতো। কিন্তু ভুল মানুষই করে। আবার ভুলের মাশুল দিয়ে মানুষ শুদ্ধও হয়।
একবার কী এক কারণে এক কামেল ফকিরকে অপমান করে বসেছিল তোর পূর্বপুরুষ এক জমিদার। কামেল ফকিরের অভিশাপে পরের বছর জমিদারিতে ভয়াবহ খরা হলো। হাজার হাজার মানুষ না খেয়ে মারা পড়ললো। সেটা সামলে ওঠার পরপরই আবার শুরু হলো ওলাওঠা। তাতে পুরো জমিদারি উজাড়। জমিদারের পরিবারের সবাই মারা গেলো। কিন্তু তার একছেলে কী করে যেন বেঁচে বেরিয়ে যায়। তারই উত্তরসূরিই হইলি তুই। অহন বুঝছস কিছু?
রতন সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে।
ফকির বলে চলে, তোর পূর্বপুরুষরা অনেক ধনী ছিল। তাদের মৃত্যুর পর তাদের বিশাল ধনসম্পত্তি যে যেভাবে পারছে লুট করে নিয়ে গেছে। অবশ্য ওগুলো রক্ষার জন্য তোদের বংশের কেউ তখন ছিলও না। মৃত্যুর আগে জমিদার মাটির নিচে কিছু টাকা লুকিয়ে রেখেছিলেন ভবিষ্যতের জন্য। তা পাহারা দেওয়ার জন্য তিনি এক যক্ও নিয়োগ করেছিলেন। যক্-কে শর্ত দেওয়া ছিল, তার বংশের আগামী তিন পুরুষের কেউ যদি মাটি খুঁড়ে টাকা বের না করে, তাহলে তার বংশের কারও হাতে এই টাকাপয়সা তুলে দিতে পারলে যক্ তার দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়ে যাবে।
গত পরশু দিন, আমার সঙ্গে সেই যকের দেখা হইছে। আমি সব শোনার পর, গণনা করে তোর সন্ধান যককে জানাই। গতকাল রাতে যক গচ্ছিত ধনের বাক্স নিয়ে তোর বাড়িতেই যাচ্ছিল। কিন্তু পথিমধ্যি তার হাতের বাক্সটি মাটিতে পড়ে যায়। ধনদৌলত পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে যকের ধর্ম হলো, যার ধন একবারে তার সামনে নিয়ে তা রাখার। তার আগে অন্য কোথাও রাখলে সেটা সেখানেই পড়ে থাকবে। যক আর তা বয়ে নিয়ে যেতে পারবে না।
রতন কিছুই বুঝতে পারে না। শুধু একদৃষ্টিতে ফকিরের দিকে ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে থাকে। ফকিরের গল্প যেন রতনকে ভিন্ন এক জগতে নিয়ে গেছে।
ফকির বলে চলে, ওইখানে যে বাক্সটি পড়ে আছে, সেটি তোর। এর ভেতরে যা আছে তাতে একমাত্র তোরই অধিকার। এখন তুই কী করবি, ভেবে দেখ!
কথাটি শেষ করেই ফকির হনহন করে হেঁটে রতনের চোখের সামনে থেকে চলে যায়। রতন আবারও রশিদের দোকানের সামনে আসে। পানি খেয়ে ধীরে ধীরে ভিড়ের ভেতর গিয়ে দাঁড়ায়।
তার মনের ভেতরে ধন্দ। ফকিরের কথা কি সত্যি! তার এখন কী করা উচিত? এত মানুষ, পুলিশ, সবার সামনে থেকে কী করে রতন তার সম্পত্তি উদ্ধার করবে? তার খুব রাগ হয় যকের ওপর। ব্যাটা আরেকটু সামলে চললে এই বাক্সটি আজ আমার বাড়িতে থাকতো। আবার পরক্ষণেই ভাবে, ফকির হয়তো এমনিতেই তাকে এসব বলে নিজের কেরামতি জাহিরের চেষ্টা করেছে। কিন্তু আবার ভাবে, তার সঙ্গে এমন মিথ্যা বলে ফকিরের কী লাভ!
মনের দোলাচাল অভাবী রতনকে সিধান্তে নিয়ে যায়—না এভাবে পচে গলে সে আর মরবে না। সে তার অধিকার আদায় করবে। এই বাক্স তার। এটা সে কাউকে নিতে দেবে না। ভাগ্যের পরিহাসকে বারবার সে কপালের দোষ দিয়ে মানবে না। সে রুখবে, তার কপাল সেই বানাবে।
রতন ভাবছে। আর তাকিয়ে দেখছে বাক্সেটিকে। যে রহস্যের সন্ধানে বাজারের চৌমাথায় হাজার লোকের উপস্থিতি, সেই সন্ধান রতন আগেভাগেই জেনে গেছে। এখন তার ভাগ্য গড়তে হবে। সংগ্রাম করতে হবে তার অধিকারের জন্য।
হঠাৎ রতন সাইরেন শুনতে পায়। পুলিশের গাড়ির বিশাল একটি বহর ভিড়ের দিকে আসছে। রতন বুঝতে পারে, এরা বাক্সটিকে নিয়ে যেতে এসেছে। কিন্তু রতন কিছুতেই বাক্সটিকে নিয়ে যেতে দিতে চায় না।
তার মনের কোণে আবার ভেসে আসে সুখের জোয়ার। প্রিয় সন্তানের উল্লসিত আনন্দ উদযাপন, বউয়ের মুখের হাসি আর মায়ের তৃষ্টিতে পরিপূর্ণ মুখের ছবিগুলো।
গাড়িগুলো এগিয়ে আসে। রতনের ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হয়ে ওঠে। না কিছুতেই তার সম্পদ সে অন্যকে নিয়ে যেতে দেবে না। এই বাক্সটি তার, এর ওপর শুধু তার অধিকার।
রতন ভিড় ঠেলে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাক্সটির ওপর। বগল দাবা করে ঝেড়ে দে দৌড়।
এমন কাণ্ড দেখে সবাই হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। জনতার বাকরুদ্ধতা কাটতে বেশি সময় নেয় না। তাদের উপলব্ধি হয়, তাদের বাক্সের রহস্য না জানিয়ে কেউ একজন বাক্সটি ছিনিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে। তারাও, ‘ধর, ধর’, বলে চিৎকার শুরু করে। দৌড়ায় রতনের পেছনে।
রতন প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে। জীবনের সব অপ্রাপ্তিকে বুকে জড়িয়ে রতন খুঁজছে তার নতুন ঠিকানা। যেখানে গেলে তাকে কেউ কিছু করতে পারবে না। সে সুখের নীড় বাঁধবে। অভাবের দুয়ারে ছাই ফেলে, সোনালি দিনকে করবে অনন্ত।
কিছুদূর মাত্র। তারপর জনতার আক্রোশ তার ওপর আছড়ে পড়ে। এক মুহূর্তের ব্যবধানে রতন হয়ে যায় একটি অতীত।
পুলিশ বাক্সটিকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। নয়নপুর বাজারের চৌরাস্তায় এখন আশ্বিনী ঝড়ের উত্তেজনা। উত্তাল জনতা বাক্সটির ভেতরে কী আছে জানতে ফুঁসে উঠেছে। তাদের আর তর সইছে না।
পুলিশ বাক্সটি খোলে। তারপর সবাই যা দেখে তা কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না। জনতার চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। আর নয়নপুরের এক অলিখিত ইতিহাস হয়ে মুখেমুখে রটে যায় রতনের নাম।