এক.
বিশতলা বিল্ডিঙের সমান উঁচু দুটি ডাইনোসর রাস্তা দখল করে থাকলে আমি কীভাবে দ্রুত যাব, সে প্রশ্নটা মাথায় এবং বাথরুমের চাপ তলপেটে নিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। রাস্তা থেকে নেমে ঘুরে যাব, সে উপায় ছিল না; কারণ, রাস্তার পাশে জায়গা নাই। রাস্তাটা প্রশস্ত, মাঝখানে বল্লমের মতো ধারালো কালো রঙকরা লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা সড়কদ্বীপ। হাতের বামপাশে প্রায় বিশটা সিঁড়ি দিয়ে নামার পরে নিচে পিজি হাসপাতালের উঁচু বিল্ডিংগুলো আর অন্য পাশে পাহাড়ী ঢাল। রাস্তার দুই পাশেই লোহার শক্ত রেইল লাগানো। ঢাল বলতে একেবারে খাড়া, কমপক্ষে দেড়শ থেকে একশ ষাট ফিট খাড়া নেমে যাওয়ার পরে সেখানে কয়েকটি কড়ই আর মেহগনি গাছ, ওপর থেকে সবুজ তুলার মতো দেখা যায়। ওখানে ঢালুতে বারডেম, হোটেল শেরাটন আর পেছনে ঢাকা ক্লাব, এখান থেকে সবগুলো বিল্ডিঙের ছাদ দেখা যাচ্ছে অনেক নিচুতে। বড় রাস্তা থেকে একটা রাস্তা ঢালু হয়ে নেমে গেছে শেরাটনের সামনে দিয়ে হেয়ার রোড-মিন্টো রোডের দিকে। অন্য দিকের ঢালু রাস্তাটি নেমে গেছে হাতিরপুলের দিকে।
কিন্তু তার আগেই আমি রাস্তায় আটকে রয়েছিলাম জুরাসিক যুগের প্রাণী দুটির ভয়ে। ডাইনোসর দুটি বিকট গর্জনে একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে পিঠাপিঠি দুই কিশোর ভাইয়ের মতো; একটি অপরটিকে কামড়াচ্ছে, লেজের আছড়ানিতে গাছপালা ভেঙে যাচ্ছে, সড়কদ্বীপের লোহার রেলিংগুলো ভেঙে যাচ্ছে, আমাকে এদের পেটের নিচ দিয়ে যেতে হবে। হাতে একটা রঙিন ছাতা, আট শিকের ছাতা, তাই এর কাঠামো দুর্বল। দশ বা বারো শিকের ছাতা হলে ভরসা পেতাম; এমন দুর্বল একটা ছাতা নিয়ে দুটি ডাইনোসরের পেটের নিচ দিয়ে যেতে সাহস পাচ্ছিলাম না। আট শিকের ছাতা মানে, সেখানে সাতটি রঙিন কাপড়ের ফালি আছে।
রঙের ত্রিভুজগুলো আমার কাছে কোনো অর্থ বয়ে আনে নাই, তবু এই ছাতাটা নিয়ে আমাকে ওদের পেটের নিচ দিয়ে যেতে হয়েছে। তলপেটে বাথরুমের চাপ এত বেড়ে গিয়েছিল যে, একটা ডাইনোসরের ঘাড়ে অন্যটির কামড়ে যে ঘরঘর শব্দ হচ্ছিল আর পাহাড়ী ঝরনার মতো রক্ত ঝরে পড়ছিল, তাতে আমার হাতে ধরা ছাতাটার শিক ভেঙে গেল কখন, তা টের পেলাম না। ডাইনোসরের ভারী রক্তে আমার মাথা থেকে শরীরের এক পাশ সম্পূর্ণ ভিজে এমন লাল হয়ে গেল যে, আমার শরীরের একপাশ শাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর অন্যপাশ থিকথিকে ঘন রঙের দেখা যাচ্ছিল, এমন রঙের বৈচিত্র্য ছোটবেলা যখন ঘুড্ডিতে দেখতাম তখন বলতাম দোপাজ। মোরগ-মুরগি আর গরু-ছাগলের রক্ত দেখে অভ্যস্ত তো ছোটবেলা থেকে, মানুষের রক্তও দেখেছি অনেক, কিন্তু এমন কটু গন্ধ কখনো পাই নাই। পরিস্থিতির চাপে আমার তলপেট কখন ছুটে গেছে লক্ষ্য করার সময় ছিল না, তাই পাজামায় লাগা হলুদ রঙ কিংবা মলের গন্ধ কিছুই টের পেলাম না, শুধু ডাইনোসরের রক্তের লালরঙ আর তীব্র গন্ধে আমি ডুবে রইলাম মরার মতো।
আসলে আমি কালো রঙের মধ্যে অন্ধকারই দেখি না, অন্ধকার দেখি অন্য রকম রঙের মধ্যে। নানা রঙের অন্ধকার আছে, যেমন, বেগুনি অন্ধকার, নীল অন্ধকার, আসমানি অন্ধকার, হলুদ অন্ধকার, সবুজ অন্ধকার, কমলা ও লাল রঙের অন্ধকার।
চানখাঁরপুলের দিক থেকে রাস্তাটা ক্রমে নিচু হয়েছে, তারপর কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ আবার ধীরে ধীরে উঁচু হয়ে সোজা চলে গেছে ফার্মগেটের দিকে। আমি এসেছি মৎস্যভবনের দিক থেকে, একপাশে সোহরাওয়ার্দি উদ্যান, রাস্তা থেকে খাড়া প্রায় বিশফুট উঁচুতে, অন্য পাশে রমনা পার্ক, সেটি আবার রাস্তা থেকে কয়েক সিঁড়ি নিচে। হাতের বাম পাশের উঁচু খাড়া দেয়ালে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের স্লোগান ছিল, বেশিরভাগই মুছে গেছে, শুধু একটি শব্দ ‘গণতন্ত্র’ আবছাভাবে মুমূর্ষু রোগীর মতো কোনোভাবে তাকিয়ে আছে। একেবারে নির্জন রাস্তা ধরে গায়ে রক্ত আর মল নিয়ে একা হেঁটে চলেছি, কোথায় কার বাসায় যাব ভেবে পাচ্ছি না। নাকি গুলিস্তানে গিয়ে পাবলিক টয়লেটে ঢুকে ভালো করে সব ধুয়ে, গোসল করে নতুন জামা-কাপড় কিনে পরে নেব, ভাবছি কিন্তু আমার মাথা কাজ করছে না। মাথা প্রচণ্ডভাবে ঝিমঝিম করছে এবং ব্যথাও হচ্ছে। ডাইনোসরের রক্তে কি বিষ আছে? নাকি রক্ত ভারী বলেই মাথা ব্যথা করছে? হাতের ডান দিকে তাকালে দেখা যায় শহরটা ঢালু হতে হতে উপত্যকায় নেমেছে, সেখানে বিছিয়ে আছে রমনা আর মতিঝিল থানার সব রাস্তা আর বিল্ডিং। মতিঝিলের শাপলা চত্বরের চলমান গাড়িগুলো দ্রুতগামী পিঁপড়ার মতো দেখা যাচ্ছে এখানকার এই উঁচু থেকে। উপত্যকার পরেই সবুজবাগ, খিলগাঁও আর বাড্ডার পাহাড়ের গায়ে সামান্য গাছপালা আর বেশিরভাগই দালান-কোঠা দেখা যাচ্ছে। কমলাপুর স্টেশন থেকে একটা দ্রুতগামী আন্তঃনগর ট্রেন প্রথমে খিলগাঁয়ের উঁচুভূমিতে উঠল, তারপর আবার পশ্চিম দিকে ঢালু বেয়ে নামতে শুরু করল, তারপর তেজগাঁও স্টেশনে কিছুক্ষণ থেমে পূর্ব দিকের খিলগাঁও এবং বাড্ডা পাহাড় আর পশ্চিম দিকের কাফরুল ও মিরপুর পাহাড়ের মধ্যবর্তী উপত্যকার সমভূমি দিয়ে গুলশান থানা হয়ে সোজা উত্তর দিকে গাজিপুরের দিকে চলে যাবে। তুরাগ নদীর ওপার থেকেই আবার পাহাড়।
[সে ওইদিন কেন ঢাকা গিয়াছিল, তাহা সে কাহারও নিকট প্রকাশ করে নাই। প্রবল অসুস্থতা লইয়া যখন সে ঢাকা হইতে ফিরিয়া আসিয়াছে তখন সে দেখে তাহার স্ত্রী রিমা তাহাদের নাবালক পুত্র ও কন্যাকে লইয়া পিত্রালয়ে চলিয়া গিয়াছে। ইহার কারণও অজানা, হয়তো সে নিজে কিছুটা অনুমান করিতে পারে, কিন্তু কাহারও নিকট এ বিষয়ে কোনো কথা প্রকাশ করে নাই।]
দুই.
আমাদের বাড়ি মেইনরোড থেকে প্রায় এক কিলোমিটার ভেতরে, এখানে সাধারণত অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ শোনা যায় না, এতদূরে আসেও না। গ্রামটা মেইনরোড থেকে অনেক উঁচুতে, বাঁক পেরিয়ে পাহাড়ের ওপরের দিকে। আমাদের গ্রামের কেউ অসুস্থ হলে খবর পেতাম, মারা গেলে তো মসজিদের মাইকেই ঘোষণা হতো, তেমন কিছু হলো না, তবুও আমি কিছুক্ষণ পর পর অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন শুনতে পাচ্ছি। ঢাকা থেকে অসুস্থ হয়ে বাড়ি চলে আসার পর থেকেই আমি শয্যাশায়ী, কিন্তু এর মধ্যেই আমাকে ব্যবসার কাজ চালিয়ে যেতে হচ্ছে। মাথাব্যথার ধরন দেখে ডাক্তার বলেছে ব্রেনস্ট্রোক হওয়ার পূর্বলক্ষণ। তারা সিটিস্ক্যান করিয়ে রিপোর্ট দেখেই তো ওষুধ দিয়েছে, কিন্তু তাতে মাথাব্যথা তো কমেই নাই, বরং বুকে ব্যথা শুরু হয়েছে। বুকের মধ্য ও বাম দিকে ব্যথা শুরু হয়েছেÑ এ ধরনের ব্যথাকে খুব ভয় পাই, কারণ আমার শরীর বেশ ভারী। ছোটবেলা থেকেই তো সকালে ছানা-মাখন খাই, দুপুরে মাংস ছাড়া ভাত খেতে পারি না, সন্ধ্যায় দুধ-ডিম খেতে হয়, তাছাড়া আমাদের সব ভাই-বোনের শরীর ভারী। উচ্চতার তুলনায় ওজন বেশি, পাঁচফুট উচ্চতায় যতটুকু ওজন আমার থাকার কথা, তার চেয়ে দেড়গুণ বেশি আছে। হাঁটা-চলা খুব কম, সকালে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় হয়তো ভেতরের এই ঢালু রাস্তার এই এক কিলোমিটার হাঁটা হয়, তাও গলির ভেতরে অটোরিকশা পাওয়া গেলে আর হাঁটা হয় না, রাতে বাড়ি ফেরার সময় বেবিটেক্সিতে একেবারে ঘর পর্যন্ত। গ্রামের এই রাস্তাটা পাকা হলেও বেশ চিপা, না হলে একটা সেকেন্ডহ্যান্ড গাড়ি কিনেই ফেলতাম। গাড়ি কেনার আগে বাবার আমলের ভিটিপাকা টপবারান্দাওয়ালা এই টিনের ঘরটা বিক্রি করে দালান করে নিতে হবে।
এবার একেবারে কানের কাছে শোনা যাচ্ছে অ্যাম্বুলেন্সের কুউউ-কুউউ চিৎকার! উঠে বসে শোনার চেষ্টা করতে গিয়েও পারলাম না, শুয়েই থাকতে হলো। গত কয়েক দিনে রিমাকে কয়েকবার ফোন করেছি, সে ফোন ধরেই নাই। কেমন যেন লাগছে, আমার জীবনটা ফুলস্টপে এসে পৌঁছে গেছে কিনা বুঝতে পারছি না। বিবাহিত এবং একজন সংসারী মানুষ হয়েও, দুটি সন্তানের পিতা হয়েও আমি কি এই শূন্য বাড়িতে নিঃসঙ্গ অবস্থায় চিরবিদায় নেব? বাজার থেকে দিদারকে আসতে বলেছিলাম, সে একটু পরেই আসবে, কিন্তু শো-রুম খোলা রেখে এলে তো আমারই ক্ষতি। এখন গরম কাল, সেদিন ঢাকায় দেখলাম কৃষ্ণচূড়া আর জারুলের ফুলে শহর সেজে আছে; মানুষের মনেও গ্রীষ্মকালের একটা প্রভাব আছে, এ সময় কোমল পানীয় বেশি চলে, তাই আমি দোকান বন্ধ রাখার পক্ষে না। তবে দিদার ছাড়া আর কে আমার এত কাছে আসবে! সে- ই তো গত কয়েক দিনে আমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে দৌড়াদৌড়ি করছে।
আমি ভয়ে আল্লাহর নামে জিকির করা শুরু করেছি, জিকির করলে আমি দেখেছি, একেবারে নগদ উপকার পাওয়া যায়। জীবনে যখন যত বিপদেই পড়েছি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে আবেদন করলে তিনি আমাকে হতাশ করেন না, কখনো করেন নাই। প্রথম যেদিন বিষয়টা টের পেলাম, সেদিন ছিল শবেবরাতের রাত। সন্ধ্যার পরে মেজ আপার বান্ধবী ময়নার বাসায় গিয়েছিলাম। আপা তার বান্ধবীকে একটা চিঠি লিখে দিয়েছিল, খুলে দেখি নাই, সম্ভবত দুই বান্ধাবীর কারও একজনের প্রেমের, সেটি পকেটে নিয়ে আমি বড় রাস্তায় নেমে মোড় থেকে একটা চাঁদপুরী আখ কিনে তিন টুকরা করে দুই টুকরা বাম হাতে রেখে, ডানহাতে একটা খণ্ড দাঁত দিয়ে ছিলে খেতে খেতে সে বাড়িতে গিয়েছি। তাদের নতুন বিল্ডিঙের ছাদে গিয়ে একাদশীর চাঁদের আলোর একটি শাদা টুকরায় বসেছিলাম। ময়নার দুইহাতে মেহেদির আল্পনা আঁকা হয়েছে কিছুক্ষণ আগে, সে আমার সাধা আখের দুই খণ্ড প্রথমে গ্রহণ করতে চাইল না, পরে আমি ছিলে দিলে খেতে রাজি হলে তার কথা মতো আখ ছিলে দিলাম। দুজনে আখ খেতে খেতে একথা- সেকথার পরে খুব কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ময়না কেমন একটু ভয় পেয়েছিল। আমি জোর করে তার জামা ঠেলে ওপরে তুলে বুকে মুখ লাগিয়েছি, হাতের মেহেদি নষ্ট হবে বলে সে বাধা দিতে চাইলেও শক্তভাবে প্রতিরোধ করতে পারল না। তাদের বাড়িটা পাহাড়ের ঢালুতে, আশেপাশে আরও উঁচু দালান আছে, সেখান থেকে তাদের ছাদ দেখা যাওয়ার কথা, কিন্তু কতগুলো নারকেল গাছ এ বাড়ির ছাদ আড়াল করে রেখেছে। কায়দা করে তাকে নতুন ছাদের কর্কশ মেঝেতে শুইয়ে পাজামা খুলেছি, তখন পাঁচফোড়ন দেওয়া আচারের তেলের একটা গন্ধ ছাদে ছড়িয়ে পড়ছে বুঝতে পারলাম। ছোট ছোট সুড়কি আর সিমেন্ট-বালুর জমাট কণায় অসুবিধা হচ্ছিল, জবরদস্তির ফলাফলে টের পেলাম কাচভাঙ্গায় আমার হাঁটু কেটে গেছে, রক্ত ঝরছে; জিন্সের প্যান্ট ভিজে গেছে। শেষ মুহূর্তটি ছাড়া আর একটুও ভালো লাগে নাই আমার কাছে, বরং এবড়োথেবড়ো ছাদে অসুবিধা হচ্ছিল, সেই সাথে তার ভেজা চুলের একটা তীক্ষè গন্ধে সারাক্ষণ বমি বমি লাগছিল। বেগুনি রঙের একটা অন্ধকার চারদিক থেকে নেমে এলো। সে অন্ধকারে নিজেকেই চেনা যাচ্ছিল না।
শবেবরাতের সন্ধ্যায় বাড়ির বউ-ঝিরা গোসল করে নফল নামাজ পড়ত, এখনকার মেয়েরা পড়ে কিনা জানি না। সেদিন ময়নাও সন্ধ্যায় গোসল সেরে তাহিয়াতুল ওজুসহ নফল নামাজ পড়েছিল। নামাজের পরেই সে হাতে মেহেদি লাগিয়েছিল, তাই তার চুল ভেজাই ছিল। গরমের দিন, ঘামসহ ভেজা চুল থেকে ওই উৎকট গন্ধটি আসছিল। তবে ছাদ থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় আর ঘাড় ফিরিয়ে একবারও তার দিকে তাকাই নাই। বাড়ি আসার পরে খুব খারাপ লাগছিল, মেজআপার বান্ধবীর সাথে, এমন একটা পবিত্র রাতে, ইবাদতের সময় জোর করে এমনটা করা ঠিক হয় নাই। তখন মা জীবিত ছিলেন, আমি থাকতাম মা-বাবার ঘরের বারান্দায়, মা ভেতর থেকে বললেন মসজিদে গিয়ে যেন নামাজ পড়ি। শবেবরাতের রাতে আল্লাহ সকল গুনাহ মাফ করে দেন, সকল ইচ্ছা পূরণ করেন। মা কি আমার একটু আগে করে আসা পাপের কথা বুঝতে পেরেই এই কথা বলেছেন? মায়েরা কি সন্তানের মনের কথা বুঝতে পারেন!
গোসল করে ঘাম ধুয়ে রুটি আর হালুয়া খেয়ে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়লাম। এশা নামাজের আগে ইমাম সাহেবের বয়ান শুনে মনে হলো তিনিও আমার ভেতরের পাতাগুলো পড়ে ফেলেছেন। কেমন একটু ভয় হতে লাগল; এশা নামাজের পরে নফল নামাজ পড়ে কিছুক্ষণ হুজুরের সাথে সুর করে আস্তাগফিরুল্লাহ পড়লাম। তখন বেশি রাত পর্যন্ত জেগে থাকার অভ্যাস ছিল না, শরীর তো ছোটবেলা থেকেই ভারী, তাই চোখে ঘুম বেশি। বাড়িতে এসে শুয়ে পড়লাম, কিন্তু কী আশ্চর্য, আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন বলে সকালে মনে হলো! ঘুড্ডির সাথে যেন আমি অনন্ত আকাশে উঠে গেছি, এমন মনে হলো। একটা নীল অন্ধকারে ভেসে বেড়াতে লাগলাম বকাট্টা ঘুড্ডির মতো। সমস্ত পৃথিবীটা, সকল মানুষের দায় এবং দেনা, চাওয়া এবং পাওয়া নিয়ে অনেক নিচে পড়ে আছে, আর আমি নীল অন্ধকারে যেন অমরত্বের জাদুর স্পর্শে ভেসে বেড়াতে বেড়াতে কোনো অনন্তলোকে চলে যাচ্ছি।
এরপরে যাকে ধরেছিলাম তার পরিচয় বলব না, জানতেও চাইবেন না, কারণ, সেটা অনেক পাপ! চিরচেনা মেয়েটি উচ্চতায় আমার চেয়েও উঁচু। গায়ের রঙ আমাদের মতোই ফরসা, নাক-মুখ-চেহারা, শরীর-স্বাস্থ্য সবই ভালো, কিন্তু সাহসের অভাবে আগাতে পারছিলাম না। একদিন রাতের বেলা যখন কারেন্ট ছিল না, অন্ধকারে দুয়ারে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পেছন থেকে গিয়ে দুহাতে ঘিরে ধরে বুকে হাত রাখলাম। সে তীব্র প্রতিবাদ করে উঠল, এতে আমার রক্তপ্রবাহ বেড়ে গেল, হাত ধরে টেনে নিজের রুমে নিয়ে গেলাম। মানসম্মানের ভয়ে সে মুখে শব্দ করল না; কিন্তু বাধা দিয়েছে সারাক্ষণ। যা হওয়ার তাই হলো; কিন্তু এবারও আমার কিছু ভালো লাগল না, বিন্দুমাত্র আনন্দ পেলাম না। তবে সে রাতে ঘুম হলো না। আল্লাহ আমাকে বললেন, “হৃদয় বেপারি, তোর পাপ তোকে অনেক ভারী করে তুলেছে। তুই নিজেকে সংশোধন কর।”
[পরদিন তাহাদের বাড়ির জামিলেবু গাছটির পাতা ঢলিয়া পড়িল, সেদিন হইতে ডালি, পাতা, সব শুকাইতে লাগিল। অচিরেই গাছটি শুষ্ক হইয়া এক আঁটি তৃণ হইয়া উঠিল।]
তিন.
আমি জীবনেও কোনো দিন কলেজ-ভার্সিটিতে পড়ি নাই, কিন্তু শিক্ষিত মানুষের সাথেই তো চলাফেরা, এ জন্য কেউ কি আমাকে অশিক্ষিত বলতে পারবে? আমি শিক্ষিত মানুষদের চাকরি দেই, তারা চাকরির জন্য আমার কাছে আসে, তাদের রুজি-রোজগারের ব্যবস্থা করে দেই। কাজ পছন্দ না হলে, মানুষটা পছন্দ না হলে কিংবা তার স্বভাব-চরিত্র পছন্দ না হলে পাছায় লাত্থি দিয়া বিদায় করি। এ কারণে অনেকে মনে করে আমার আন্ডারে চাকরি করা কঠিন, কথাটা ঠিক না, কারণ, আমি তো তাদের মারধর করি না, চুরির মিথ্যা অপবাদ দিয়া গোডাউনে নিয়া আটকে রাখি না। এই দেশে অনেকেই তা করে।
যারা আমার নামে মিথ্যা কথা ছড়ায়, তাদের আমি চিনি। তারা মনে করে আমি অন্ধকারের বাসিন্দা, এটাও ভুল কথা। আমার সম্পর্কে, মানুষ বেশিরভাগই মিথ্যা কথা ছড়ায়। মাঝে মাঝে মনে প্রশ্ন জাগে, এটা কি শুধু আমার ক্ষেত্রেই ঘটে, নাকি আরও মানুষের ক্ষেত্রেও হয়? আমি শিওর, পৃথিবীর বেশির ভাগ ভালো মানুষই ওভাররেটেড, তাদের মধ্যেও অনেক দোষ পাওয়া যাবে, আবার যারা খারাপ মানুষ বলে পরিচিত, তারা সত্যিকারভাবেই আন্ডাররেটেড। যাকে লোকে পছন্দ করে, দেখা যায় অকারণেই প্রশংসা করে, আর যাকে অপছন্দ করে তাকে সামান্য কারণে বা অকারণেই ঘৃণা করে। সমাজের মধ্যে যারাই অন্যের ব্যাপারে মন্তব্য করে, তাদের সবার বিবেচনাবোধ কি সঠিক? তাদের প্রশংসা, তাদের ঘৃণা কি পরিমিত মাত্রায় প্রকাশ পায়? যদি তাদের পরিমিতিবোধ না থাকে, তাহলে সমাজের একজন খারাপ মানুষকেও মানুষ ঘৃণা করে করে বেশি খারাপ করে তুলতে পারে; আবার একজন ভালো মানুষকে পাওনার চেয়ে বেশি প্রশংসা করে ভারী করে তুলতে পারে।
আমি আসলে অন্ধকারের বাসিন্দা নই, আমাদের ফ্যাক্টরির শ্রমিকদের নাইট ডিউটির মতো আমি এখন দিনে ঘুমাই, আর রাত জেগে কাজ করি; এজন্যই বোধহয় লোকে আমার সম্পর্কে ঐ মিথ্যা কথাটা বলে। আমি জানি অন্ধকার কোনো অবস্থা না, এটা একটা নাম মাত্র। আপনারা শুধু কালোকে অন্ধকার বলেন, আমি কালোকে অন্ধকার বলি না। আসলে আমি কালো রঙের মধ্যে অন্ধকারই দেখি না, অন্ধকার দেখি অন্য রকম রঙের মধ্যে। নানা রঙের অন্ধকার আছে, যেমন, বেগুনি অন্ধকার, নীল অন্ধকার, আসমানি অন্ধকার, হলুদ অন্ধকার, সবুজ অন্ধকার, কমলা ও লাল রঙের অন্ধকার।
সারা শরীর থেকে যেন মাংস খুলে খুলে পড়ে গেছে অনেকখানি। কয়েক মাস ধরেই চলে আসছে নতুন ব্যবসা, এরমধ্যে শিহাবভাই আমাকে তার ব্যবসার পার্টনার করে নিয়েছে।
[সে আসলে বলিতে চাহিতেছে অন্ধকার একটি সত্তা, ইহার এক কিংবা একাধিক নাম রহিয়াছে। একটি বিশেষ্য পদের যেমন অনেকগুলো বিশেষ্যপদ থাকিতে পারে, তেমনই একজন অন্ধকারের ভিতরে, একজন বিশেষ্যের অধীনে ও সত্তার অভ্যন্তরে অনেক বিশেষ্যপদ থাকিতে পারে। এ কারণে অন্ধকার কখনো নাম, কখনো সর্বনাম উভয়রূপ ব্যাকরণিক শব্দশ্রেণীতে অবস্থান করিতে পারে।]
চার.
অ্যাম্বুলেন্সের শব্দে আবার জেগে উঠলাম। আজ কিন্তু মনে পাপবোধ তীব্র হয়ে ঘরে আগুন লাগার মতো শিখাগুলো সাপের জিভ হয়ে লকলক করছে। দিদার তো এলো না, আবার ফোন করব, গায়ে সে শক্তিও নাই। বুকের ব্যথা তীব্র হচ্ছে, গলা দিয়ে গোঙানির মতো শব্দ হচ্ছে, পাশের ঘরের, আমার মেজ ভাইয়ের ঘরের কেউ শুনতে পারছে কিনা বুঝতে পারছি না। মেজ ভাইয়ের ঘরের কেউ এখন আর আমার ঘরে আসে না, ভাই-ভাবি, কলেজপড়ুয়া ভাইঝি কেউ না। তবে বাইরে দেখা হলে ভাইয়ে এটা-ওটা জিজ্ঞাসা করে, তবে আগের মতো আন্তরিকতা আর নাই। আমার বিয়ের পর থেকেই হয়তো জায়গা-জমি নিয়ে কোনো কথায় তারা রাগ করেছে। বাপের ঘর আমি ছোট ছেলেহিসাবে পেয়েছি, এটায় মেজভাই বাধা দিয়েছিল। যাই হোক, এখন আমি অসুস্থ, বিছানায় পড়ে গোঙাচ্ছি, এটা কি তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না? আমি যদি এখানেই বিনা চিকিৎসায় মারা যাই, পাশের ঘরের তারা কি দায় এড়াতে পারবে?
চালের টিনের ছোট্ট ছিদ্র দিয়ে এক রত্তি সূর্যের কড়া আলো এসে তেরছাভাবে পড়েছে আমার মাথা বরাবর ঠিক উল্টা দিকের টিনের বেড়ায় ঝুলানো একটা ক্যালেন্ডারের জাতীয় স্মৃতিসৌধের সামনেকার একটা কৃষ্ণচূড়ার রঙিন ডালে। গলন্ত বিকালের সেই সোনার ডিমটা একটু পরেই দিন-তারিখের চৌকোনা খোপগুলোতে এসে পড়েছে। এখনও ওটা মাটি থেকে প্রায় চার ফুট উঁচুতে আছে, নিচে নেমে আসতে আসতেই ওটার তেজ কমে যাবে, সূর্যটা ক্রুদ্ধ সজারু থেকে একটা নিরীহ খরগোশে রূপান্তরিত হয়ে মিশে যাবে।
আমার ছেলেটার মুখটা মনে পড়ছে, ওর মুখটা ভাদ্র মাসের পাকা তালের মতো মনে হচ্ছে। ওর শরীর থেকে একটা গন্ধ আসে, মাথা থেকে, ঘাড় থেকে, পিঠ থেকে এমনকি কসাইয়ের দোকানে ঝুলানো ছিলা ছাগলের রানের মতো উরুসন্ধি থেকেও গন্ধ আসে, সব জায়গার গন্ধই আমার কাছে ভালো লাগে। এটা কি বাপ বলেই এমন হয়? ছেলেটা এখনও স্কুলে যাওয়া শুরু করে নাই, এরমধ্যে সে অক্ষর চিনে, সংখ্যা চিনে, দুই অংকের যোগ-বিয়োগও মুখে মুখে করতে পারে। ছেলেটাকে ওর মা আমার দিক থেকে ফিরিয়ে রাখার চেষ্টা করছে, মেয়েটাকেও করছে, তবে হাইস্কুলের ক্লাস নাইনে পড়া মেয়েটা এখন মায়ের শাসনের বিরুদ্ধে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে তীব্র আন্দোলনের মধ্যে আছে, শিঘ্রই সে হয়তো স্বায়ত্তশাসন লাভ করবে।
ছোটবেলা বাবার কাছে চেয়ে কখনো খেলা পাই নাই, আমাদের এলাকার পেছনে, ওপরের গ্রামে একটা মেলা হয়, আর নদীর তীরে সমতলভূমিতে, মানে পৌরসভায় একটা মেলা হয়, সেখানে যেতাম বাবার দেওয়া সামান্য পয়সা নিয়ে গিয়ে খেলনা কিনতে পারতাম না। বাবা ছিলেন নারায়ণগঞ্জ ঘাটের কুলি, লবণের সাম্পান থেকে লবণের বোঝা মাথায় নিয়ে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে নেমে আবার পিছলা মাটি বেয়ে উঠে ওপরের দিকে লবণ কারখানার গোডাউনে রাখতেন। তখনরকার যুগে এই অঞ্চলের অনেকেই নাকি এই কাজ করতেন, অনেকেই সেসব কথা অস্বীকার করে।
আমার বড়ভাই আবদুল খালেক লেখাপড়া শিখে ব্যাংকে চাকরি পাওয়ার পরে আমাদের পরিবারে সচ্ছলতা এসে নতুন পয়সার ওপর রোদপড়া আলোর মতো হেসে ওঠে। পড়ার খরচ দেওয়া পাশাপাশি এটা-ওটা কেনার জন্যও টাকা দিতেন বড়ভাই; মেলায় যাওয়ার জন্যও টাকা দিতেন, তখন শৈশবের সাঁকো পার হয়ে কৈশোরের ভিন্ন জমিনে উঠেছি। মেলা থেকে খেলনা কিনতাম, বাবা বোঝাতেন, খেলনা কিনে কী লাভ? পেটে দিলে মুখে স্বাদ লাগে। আমাকে কেউ বাবার কথার উত্তরটা যুগিয়ে দেয় নাই, নিজের থেকেই মনে হতো, মেলা থেকে ওটা –ওটা কিনে খেয়ে লাভ কী? আড়াই ঘণ্টা পরে হজম, চার ঘণ্টা পরে হাগা, ব্যস সব শেষ! একটা খেলনা কিনলে আমার এক বছর চলে যেত, পরের বছরের খেলনা কেনার জন্য আয়োজিত মেলা থেকে নতুন খেলনা কেনার পরেও পুরান খেলনাটি নতুন খেলনার পাশে স্থান পেতো।
কিন্তু আজকের আমি আর সেই আমি নাই, এখন আর খেলনার স্থায়িত্বে বিশ্বাস আমার নাই। শরীরের বাইরে যতটুকু চর্বি আছে, তাতেই আমার চলাফেরা অন্যদের তুলনায় সংরক্ষিত, ভেতরে যদি এমন চর্বি জমে লিভারে, চর্বি জমে মস্তিষ্কে, চর্বি জমে শিরায় শিরায় তাহলেই তো একদিন মেশিন বন্ধ হয়ে যাবে চিরতরে। কোনো ফোরম্যানই কোনো পার্টস পুনরায় চালু করতে পারবে না, দেশের সেরা ইলেকট্রিশিয়ানও কন্ট্রোল প্যানেলের একটা তার জোড়া দিয়ে নতুন করে সচল করতে পারবে না। এসব কারণে আমি মউতের হোগায় লাত্থি দিয়অ মউত তক ছহিছালামতে জিন্দা থাকতে চাই।
শচীন তেন্ডুলকার ওয়ানডে ম্যাচে দুইশ সেঞ্চুরি করেছে, এই একজন খেলোয়াড়কে পৃথিবীর কে যে কোন দিক দিয়ে অনুসরণ করছে তা কে জানে! আমাদের এলাকার রবিউল মজুমদারের মতো জনপ্রিয় নেতার ছোটভাই কবিরুল ভাই, মানে কবির ভাই দেখতে একজন ভালো মানুষ, কিন্তু লোকে তার নামে আগে-পড়ে অনেক কিছু বলাবলি করে। কবির ভাই নাকি শচীনকে ওয়ানডে ম্যাচে অনেক আগেই ছাড়িয়ে গেছে, শুধু ওয়ানডে ম্যাচে না, টেস্ট ম্যাচেও। তার কোনো বাছবিচার নাই, হোটেল সোনারগাঁ-শেরাটন থেকে শুরু করে সদরঘাটের ভাসমান হোটেলের বেডরুম পর্যন্ত কোনো কিছু তার বাকি নাই। তবে এ কথা সত্য যে, এই দেশে যত শিল্প-কারখানা আছে, দু-চারটা বাদ দিলে প্রায় সবগুলোর মালিকই এমন; অনেকে শুধু বরিশাইল্লা সুন্দরী অবিবাহিত ওয়ার্কারদের লোভেই ধার-দেনা করে দুইটা মেশিন কিনে রাতারাতি শিল্পপতি হয়ে গেছে। আমার পানিরগুদামের কাছেই জাহাঙ্গীর ভাই, বয়সে আমার সমান, বা দুই-চার মাস বড় হতে পারে, সেও শচীনকে ছাড়িয়ে গেছে। এই এলাকা ছাড়াও, ঢাকা-চাঁদপুর-চিট্টাগাং, দুবাই, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান এবং সিঙ্গাপুরে তার এই বিশাল অভিজ্ঞতা হয়। তার যে খাঁচড়া-স্বভাব, ফেরিঘাটের, লঞ্চঘাটের, রাইসমিলের চিপাচাপার যত বিচ্ছিরি চোহারার, নোংরা কাপড় পরা ভাসমান ‘ভাওর’ আছে, মাত্র দুইশ টাকা দিয়ে সে যে কারও কাছেই লুঙ্গি তুলতে পারে। ঘরে অতি সুন্দরী বউ রেখে রাস্তাঘাটের চিপাচাপায়, তারখাম্বার সাথে দাঁড় করিয়ে খাড়ার মধ্যেও সে কাজ সারতে পারে। আমি কিন্তু লবণ-কারখানার কুলির পোলা, অত নিচে নামতে পারি না; আমার কাছে যারা আসে, তারা শিক্ষিত, কলেজে পড়ে। আমার অফিসরুমের পেছনে যে ছোট বাক্সের মতো রুমটি আছে, সেখানে ছোট একটা চৌকি ভাসিয়ে দিয়েছি, সেখানে প্রতি রাতেই ধোয়া বেডশিট পাততে হয় আমার জন্য। আমার অফিসের ম্যানেজার হোসেনের খালাতো বোন ঝুমা, অতি সুন্দরী মেয়ে, সরকারি কলেজের রয়্যাল সাবজেক্ট- ইংরেজিতে সে অনার্সে পড়ত, সে আসত আমার কাছে। তার মাধ্যমে আরও অনেকেই এসেছে, কাউকে আমি টাকা দিয়া, পয়সা দিয়া, কথা দিয়া কিংবা আপ্যায়নে ঠকাই নাই। জাহাঙ্গীর ভাই যে দুইশ টাকা দিয়া রাতের কাজ সারে, আমি তো চার-পাঁচশ টাকা শুধু ওদের আপ্যায়নের পেছনেই খরচ করি। তবে ওই ঝুমা, মেয়েটা বেশ ভালো, অনেক স্টাইল জানত। এই বয়সে সে এত স্টাইল কোথা থেকে রপ্ত করেছে কে জানে। নাকি সেও পুরুষ ব্যবহার করে শচীনকে ছাড়িয়ে যাবার গোপন প্রতিজ্ঞা করেছে!
না, বিষয়টা হাসির না। এক মেয়ে একবার এসেছিল, সে পাশের অন্য এক কলেজের বিএ ক্লাসে পড়ত, সে মেয়ে তো উঠে যাওয়ার সময় ব্রার ফিতা লাগাতে লাগাতে বলেছিল, একশ একজন পুরুষকে আমি দেখতে চাই। ওরে বাবা, কী সাহসী মেয়ে! সে তার কাক্সিক্ষত সেঞ্চুরি পূরণ করতে পেরেছিল কিনা, জানি না, সে আর কখনো আমার কাছে আসে নাই।
ছোটবেলা যাদের সাথে খেলাধূলা করতে গিয়ে, চলাফেরা করতে গিয়ে বড়বাইয়ের হাতে মারধর খেয়েছি তারা কেউ কোনো ক্রিমিনালের সন্তান ছিল না। ওদের মা-বাবা কোনো ফৌজদারি বা দেওয়ানি মামলার আসামি ছিল না, এমনকি পাড়া-মহল্লায় সালিশী বিচারে অভিযুক্তও ছিল না, তবুও ওদের সাথে শিতে নিষেধ ছিল, কারণ? ওরা গরিব ছিল, ওরা আমার মতো স্কুলের ছাত্র ছিল না, ওরা ঘাটে নায়ের মাঝি বা মিল-কারখানার শ্রমিক ছিল। ওদের গায়ের আমার গায়ের মতো পরিচ্ছন্ন পোশাক ছিল না আর মুখের ভাষায় ভদ্র আবরণটা ছিল না। ওরা ক্রুদ্ধ হলে কলমের খোঁচায় কারও ক্ষতি করতে পারত না, শুধু দোতলা-তেতলা গালি দিয়ে মনের ঝাল মেটাত। আর বড়ভাইয়ের অফিস থেকে তার কলিগ অথবা বন্ধুরা যখন বেড়াতে আসত, তাদের ঠাট-বাট দেখে বুঝতে অসুবিধা হতো না যে, তাদের বৈধ আয়ের সাথে ব্যয়ের বিরাট ব্যবধান। ঋণখেলাপি শিল্পপতি আর ঋণখেলাপিদের সহযোগী ব্যাংক কর্মকর্তারাই ছিল আমাদের বাড়িরর অতিথি, আমার ভাইয়ের সাদরে আপ্যায়িত মেহমান। তখন থেকেই বড়ভাইয়ের প্রতি আমার শ্রদ্ধা চৈত্রমাসের খালবিলের পানির মতো তলানিতে গিয়ে ঠেকলো।
একদিন বড়ভাবির এক বাচ্চাওয়ালা মুরগি পাশের বাড়ির স্বপনের মায়ের লাউ না শিম চারা তুলে ফেরার ঘটনায় ঝগড়া হয়েছিল, স্বপনের মা নাকি সেখানে আমার নামেও কিছু কথা বলেছে। নিজকানে শুনি নাই, কিন্তু ভেবে পািচ্ছলাম না, আমি যা বাড়িতে করি, তাতে তো কোনো সাক্ষী থাকার কথা না। ব্যাপারটা মাথায় ঢুকল না। মেজ ভাবি আগেই আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে রেখেছে, ছোটভাবিও কথা বলে না। শুধু বড় ভাবি বলত, সেটাও বন্ধের উপক্রম। ঐ ঘটনার দুয়েক দিন আগে-পড়েই বোধ হয় আমাদের বাসার কাজের মেয়ে বরিশালের মেয়ে আয়শাকে নিয়ে কথা উঠল। মা মারা যাবার পরেও যখন বাবার মতি-গতি অন্য রকম লাগছিল, তখন ভাইয়েরা মিলে বাবাকে হজ্বে পাঠিয়ে দিয়েছিল। বড়ভাইয়ের চাকরি আছে, কারেন্ট জালের কারখানা তখন তার মালিকাানয় ছিল, কিছু টাকা দিয়েছে। মেজভাইয়ের মালিকানা ছিল, আর ছিল গরুর ফার্ম, সে ভাইও কিছু দিয়েছে। ছোটভাই ভিন্ন জায়গায় নতুন কারখানা স্থাপন করায় সবাই সেন্দহ করছিল, সে গোপনে টাকা না মেরে দিলে হঠাৎ এত টাকা কোথথায় পেল? এই সন্দেহ থেকে সে ভিন্ন গ্রামে ভাড়া বাসায় চলে যায়, সে বাবাকে হজ্বে যাওয়ার ব্যাপারে সহযোগিতা করতে চেয়েছিল, কিন্তু তার স্ত্রী বোধহয় দেয় নাই। আমার হাজিবাবাকে কেউ কেউ সন্দেহ করতে শুরু করেছে, আয়শার পেটের উচ্চতাবৃদ্ধির কারণে। কেউ কেউ আামকেও সন্দেহ করেছে, কারণ, এসব আমার বিয়ের অনেক আগের ঘটনা। বড়ভাই আয়শাকে দ্রুত ঢাকা নিয়ে কোনো ক্লিনিক থেকে খালাস করানোর ব্যবস্থা করেছে। তখনই গ্রামের ভেতরকার, বাড়ির আশপাশের মানুষের চোখের ভাষা কেমন যেন বদলে গেছে। আমি কি সকলের সন্দেহের পাত্র?
এর কাছাকাছি সময় আমার পানির গুদামের ভেতর একটা ঘটনা ঘটে গেল, ঘটনার দিন আমি সেখানে ছিলাম না, ছিলাম ঢাকায়। রাজনীতিবিদ কবির ভাইয়ের চাচাত ভাই ফরিদ কোথা থেকে একটা মেয়ে ধরে নাকি রাতচুক্তি করে আমার গুদামের পাশে বড়ভাইয়ের মিলের শ্রমিকদের থাকার কোয়ার্টার ঘরে নিয়ে এসেছে। ফরিদ এবং তার বন্ধু এবং সাঙ্গপাঙ্গ মিলে ছয়-সাতজন তরুণ পুরুষ মেয়েটিকে একেরপর এক ধর্ষণ করেছে, মেয়েটির চিৎকারে কারখানা থেকে শ্রমিকরা এসে সেখানে উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করেছে। ক্রদ্ধ ফরিদ নাকি শ্রমিকদের মাথায় পিস্তল দিয়ে আঘাত করে ধমক দিয়ে সরিয়ে দিয়েছে। পরদিন ঢাকা থেকে ফেরার পরেই বড়ভাই ডেকে নিয়ে এসব কথা জানাল। আমরা ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদদের কাছে অসহায়। হরতালের সময় তাদের কথায় প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে লাভের গোয়ামারা খাই, পিকেটারদেরকে গাড়ি ভাংচুর করার জন্য পয়সা দেই, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ডিউটিরত পুলিশদের তিন বেলা খাবারের পয়সা দেই, হোটেল বন্ধ থাকলে বাড়ি থেকে রান্না করে এনে খাওয়াইÑ তারপরও এসব অত্যাচার!
আমি এলাকায়ই ছিলাম না, কিন্তু দুর্নাম তো আমারই হলো! অথচ আমার কাছে যারা আসে, তাদের কারও সাথে জবরদস্তি করি না, তারা স্বেচ্ছায় আসে। সব কথাই বড়ভাইয়ের মুখে শুনলাম। বড়ভাই ক্রুদ্ধ হয়ে বলে, পাপ বাপকেও ছাড়ে না। এটা একটা বহুল আলোচিত প্রবাদ, কিন্তু সেখানে বাপের কথাটা থাকায় নিজেকে একটু হালকা মনে হয়েছিল সেদিন। কারণ, কাজের মেয়ে বরিশালনী আয়শা-ফায়শাকে আমি ইয়েও করি না, যা করেছে সেটা হয়তো আমার বাপ করেছে। আমি মায়ের মৃত্যুর পরেই বলেছিলাম বাবাকে যেন একটা বিয়ে করিয়ে দেওয়া হয়। আমাদের কারখানায় তখন কারেন্ট জাল বানানোর জাপান আর কোরিয়ার তৈরি ত্রিশটি নতুন মেশিন, সেই সাথে টুইস্টিং সাইডে প্লাস্টিকের দানা গলিয়ে সুতা বানানোর এক্সট্রুডার, টেকঅফ মেশিন, কাচা সুতা পাকানোর ডাবলা, প্রাইমারি এবং রিংটুইস্টিং মেশিনসহ অনেক কিছু। টাকা পয়সার কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না। কিন্তু পারিবারিক স্বার্থবুদ্ধিতে আমি ছিলাম অন্য ভাইদের কাছে বয়সের মতোই শিশু। বড় ভাইদের সবাই চিন্তা করেছে, বাবা যদি নতুন করে সন্তানের পিতা হয়ে যায়, বিশেষ করে পুত্রসন্তান, তাহলে যে আমাদের সম্পত্তির ভাগ ছোট হয়ে যাবে! এ কারণে বাবার নিঃসঙ্গ জীবনে কোনো সঙ্গী জুটল না। বাবা আরও একবার কাজের মেয়ের পেট তৈরি করে দিয়ে হাজিসাব পরিচয় নিয়ে মারা গেছে, আর মোটামুটি বিশাল একটা জানাজার আখেরি সংবর্ধনা নিয়ে কবরে গেছে। সে বার কেউ আমাকে সন্দেহ করতে পারে নাই, এরমধ্যে আমি রিমাকে বিয়ে করেছি। না রিমাকে ভালোবেসে বিয়ে করি নাই, বড়ভাইই দেখেশুনে সব ব্যবস্থা করেছিল।
বাবার মৃত্যুর পরে আমরা সবভাই পৃথক পৃথক কারণেই হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছি। কিন্তু বড়ভাইয়ের কোন ভুলে যেন ব্যবসায় ধস নামল। বাংকের ঋণ পরিশোধে গাফিলতি বা কোনো সমস্যায় ব্যাংক থেকে নিষোধাজ্ঞা দিয়ে কয়েদিনের জন্য কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হলো, নিয়মিত পার্টিগুলো সরে গেল, অনেক পার্টিই পাওনা টাকা মেরে দিয়েছে। ব্যাংকঋণ পরিশোধ বরার জন্য কারখানার মেশিনগুলো বিক্রি করে দিতে হলো। ফাঁকা হয়ে গেল অর্ধ শত মেশিনের বিশাল শেড, এপার-ওপার ধূধূ করে। দিনের বেলাও সেখানে গেলে শূন্যতার আঘাতে কেউ চোখ তুলে তাকাতে পারবে না, এমন অবস্থা। ওপরে মাকড়শার ঝুল, নিচে সাবেক কালের তেল-কালি, দেয়ালে দেয়ালে শ্রমিকদের হাতের লেখার জীবন্ত সাক্ষ্য।
ভাগ্যিস আমি কারখানার কোনো দায়িত্বে ছিলাম না, বিরাট এই লোকসানের জন্য বড় ভাইয়েরা একে অপরকে দায়ী করে গালাগালি করতে থাকে, কেউ কারও নাম শুনতে পারে না। পুকুরে ফেলা ময়লার মতো সবাই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে গেল। আমি দায়িত্বে ছিলাম জেলার ছয়টি উপজেলার জন্য একটা পিকআপ গাড়িসহ তিনটি বেভারেজ কোম্পানির কোমল পানীয়ের জেলা এজেন্সি নিয়ে। বড়ভাই লাভের হিসাব চাইলে পরিষ্কারভাবে দিলাম, এরপর আমাকে বেতন ধরে দিল। আগের মতো যা খুশি করা, যত াটকা খুশি ভাঙা আর হয়ে উঠল না। আমার নতুন সংসারে একটা টান পড়লো।
এসময় শিহাব ভাইয়ের একটা প্রস্তাব পেয়ে লাভের আশায় অথবা লোভের টানে রাজি হয়ে গেলাম। শিহাব ভাইয়ের প্রস্তাবটি ছিল, আামদের পরিত্যক্ত বিশাল শেডের ভেতরে বিভিন্ন সময় ট্রাকে করে মাল এনে রাখা হবে, এজন্য তারা আামকে স্থানীয় দর অনুযায়ী শেডের ভাড়া দেবে। আমার খাতিরে একটু বেশিই দেবে। আামদের প্রতিষ্ঠানের সকল স্টাফ এবং ম্রমিকদের বিদায় কের দেওয়া হয়েছে কয়েক মাস আগে, কিন্তু একজন নাইটগার্ডকে আমার সুপারিশেই চাকরিতে রাখা হয়েছে, গরিব মানুষ যাবে কোথায়! তাছাড়া খালি পড়ে থাকলেও তো একজন নাইটগার্ড রাখতে হবে।
শিহাব চৌধুরী তার মালামাল এনে কখন রাখে, কখন নিয়ে যায় তা আমার ধারণায় ছিল না। মনে কোনো সন্দেহও ছিল না। কিন্তু দারোয়ান বিল্লাল, তাকে আমরা বিল্লাল ভাই বলতাম, সে একদিন আমার অফিসে গিয়ে যে কথা বলেছে তাতে আমার অবস্থা হলো ধাতব কৌটায় লবণের সাথে ঘষা খেয়ে ছালওঠা কালোজামের মতো। সারা শরীর থেকে যেন মাংস খুলে খুলে পড়ে গেছে অনেকখানি। কয়েক মাস ধরেই চলে আসছে নতুন ব্যবসা, এরমধ্যে শিহাবভাই আমাকে তার ব্যবসার পার্টনার করে নিয়েছে। তবে পার্টনার করলেও শেডের ভাড়ার টাকা দিয়ে যাবে, এমনটাই কথা রইল।
সমাজের ভালো মানুষ আর খারাপ মানুষের প্রচলিত যে ধারণা, সেটি পুরনো হয়ে গেছে, আমার ধারণা একেবারে ভিন্ন হয়ে গেছে।
ওই পার্টনারশিপই আমার কাল হয়েছে। বিল্লাল ভাই গোপনে যে কথা বলেছে, প্রথমে বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও অবিশ্বাস করতে পারি নাই। একদিন দৈনিক পেপারে দেখলাম চালককে হত্যা করে ট্রাক লুটের খবর। বিস্তারিত পড়ে জানা গেল, চট্টগ্রাম রোডের কোন জায়গা থেকে যেন এক ট্রাক চিনিসহ ট্রাক ছিনতাই হয়েছে, ছিনতাইকারীরা ট্রাকের চালককে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে লাশ ফেলে রেখে গেছে। রাত আটটার দিকে আমার পানিরগুদাম বন্ধ হয়ে যায়। ম্যানেজার হোসেন চলে যায় আগে, সুপারভাইজার দিদার তালা দিয়ে বন্ধ করে চলে যায় পরে। তার যাওয়ার একটু আগে বিল্লালভাই গিয়ে মাঝে মাঝে পেপারটা নিয়ে যায় তার সেন্ট্রিবক্সে। সেখানে সে পেপারটা পড়ে পড়ে নির্ঘুম রাতের নদীগুলো পার করে। সেদিন আমি শ্বশুরবাড়ি থেকে বাড়ি ফিরছিলাম, রিমার পেটে তখন আমার মেয়ে, সে তখন বাপের বাড়ি থাকে। আনমনেই শেডের ভেতর যাওয়ার জন্য লোহার গেটে নক করতেই বিল্লালভাই গেট খুলে দেয়। ভেতরে যাওয়ার পরে দেখলাম বিল্লালভাই কেমন অস্থির এবং গম্ভীর। কারণ জিজ্ঞাসা করতেই সে বলল যে আর চাকরি করবে না। সে তার গ্রামের বাড়ি চলে যাওয়ার অনেকগুলো কারণ দেখাল, বেশি কারণ দেখালে যে বিশ্বাস হারায় তা সে বুঝতে পারে নাই। এবার আসল কারণ জানতে চাইলাম, সে ইনিয়ে বিনিয়ে বাইন মাছের মতো পিছলাতে চেষ্টা করল। সবশেষে সে পেপারটা খুলে আমাকে খবরটা দেখালে, ওটা সকালেই পড়েছি বলে জানালাম। এবার সে গেট ভালো করে বন্ধ করে কতগুলো চাবি হাতে নিয়ে আামকে সাথে যাওয়ার অনুরোধ করল, গেলাম তার সাথে। গিয়ে দেখলাম শেডের ভেতরে এক ট্রাক পরিমাণ চিনির বস্তা!
বুঝতে বাকি রইল না ব্যাপারটা তাহলে কী! ভারী ঘুমের মানুষ আমি, তবু সেদিন রাতে ঘুম হলো না। পরদিন পানিরগুদামে আমার অফিসে গিয়ে বিল্লালভাইকে বলে দিলাম, প্রতিদিনের খবর যেন যে কোনো একটা নির্জন সময়ে আমাকে এসে জানায়। বিল্লালভাই যদি চাকরি ছেড়ে চলে যেতে চায়, তাহলে সে এ মাসটা শেষ করে যাক। ছিনতাইকৃত মালের মামলায় এই গরিব মানুষটা ফাঁসবে কেন, আগে তাকে মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। শিহাব ভাইকে বলতে হবে তারা যেন নতুন দারোয়ান নিয়োগ দেয়। বিল্লালভাই আমাদের নানাবাড়ির পক্ষের আত্মীয়ও, এ লোকটাকে সবার আগে মুক্তি দিতে হবে। তাকে আমার প্রস্তাব জানিয়ে, শিহাব ভাইকেও বললাম। তাকে সচরাচর পাওয়া যায় না, তখন মোবাইল ফোন অ্যাভেইলেবল ছিল না, ল্যান্ডফোন থেকে ফোন করে কথা বলতে হয়েছে।
পরের কয়েকদিনে বিল্লালভাই আমাকে জানাল, একদিন পরেই চিনি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তিন দিন পরে এক ট্রাক থাই অ্যালুমিনিয়াম শিট এনে রাখা হয়েছে, পরদিন যথারীতি পেপারে সেই পণ্যসহ ট্রাকছিনতাইয়ের নিউজ, অমুক পাহাড়ের ঢালে বা খাদে পরিত্যক্ত ট্রাক পাওয়ার নিউজ সাথে ইনসেটে নিখোঁজ ট্রাকচালকের ছবি। তিন-চারদিন পরে সে মাল চলে গেছে। এরমধ্যে সবুজরঙের সিএনজিচালিত অটোরিকশা এসে ঢোকে, এক রাতেই সেই সিএনজি ধোয়া- মোছা এবং নতুন করে রং দেওয়া হয়। দুদিন পরে আর সিএনজি থাকে না, নতুন একটা আসে। নানা রকম দুশ্চিন্তায় আমার মাথা জটিল আকার ধারণ করতে যাচ্ছে। শিহাবভাইকে কারেন্টজালের মেশিন ভাড়া নিয়ে আবার কারখানা চালু করার একটা মিথ্যা কথা বলে তাকে সরানোর একটা ববস্থা করতে হবে। একদিন সময় করে আলাপ করলামও, সে আমাকে বলল, মেশিন চালিয়ে যে লাভ হবে, সেই পরিমাণ টাকা সেই দেবে। পাল্টাপ্রস্তাবে আমি হতবুদ্ধি হয়ে পড়লাম, নিজেকে বরফের দেশে শীতল এক পরিবেশে অসহায় মনে হলো।
এরমধ্যে ঘটনাগুলো মোটা বোতল থেকে চিকন মুখ দিয়ে পানীয় বের হওয়ার মতো সশব্দ হয়ে যাচ্ছিল। একদিন বড়ভাই বিল্লালভাইকে বলে গেছে তার পুরনো সেই ডায়লগ, পাপ বাপকেও ছাড়ে না। দুইদিন পরে এক শক্তিশালী প্রতিমন্ত্রীর বন্ধুর চামড়া ফ্যাক্টরির গেট থেকে পাকা চামড়াবোঝাই একটি ট্রাক ছিনতাইয়ের ঘটনার খবর পাওয়া গেল। এ ঘটনার পরে পুলিশ আর আগের মতো অলস আর নিষ্ক্রিয় রইল না। দুই দিন পরেই নারায়ণগঞ্জের একটি গুদাম থেকে সেই ছিনতাইকৃত চামড়ার কিছু অংশ উদ্ধার করা হলো। পুলিশ একদিন আমাকে ধরে নিয়ে গেল আমার অফিস থেকে। থানায় যাওয়ার পর দেখলাম আমার বাপ আমার সম্পর্কে যা জানে, পুলিশ জানে তারচেয়ে বেশি। এত কিছু জেনে কেন এতদিন তারা নিষ্ক্রিয় ছিল? সে প্রশ্ন করার সময় পেলাম না। তিন দিনের নিযাতনে আমার ভারী শরীর একেবারে জর্জরিত আর হালকা করে ফেলল। পুলিশের সেসব নির্যাতনের কথা আপনারা জানেন, সেগুলো আর বলার প্রয়োজন নাই, কিন্তু যা বলার তা হলো, আমি যেসব ঘটনায় জড়িত না, যেসব ঘটনা জানি না সেসবও আমার ঘাড়ে চাপানো হলো। মারধর করে, রিমান্ডের নামে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করা হলো। একদিন গভীর রাতে মনির দারোগা আর কে কে যেন আমাকে গাড়িতে তুলে চোরাইমাল, লুকানোঅস্ত্র কোথায় আছে বের করে দেওয়ার জন্য চোখ বেঁধে নিয়ে গেলো। তখনো দেশে ক্রসফায়ার শব্দটি চালু হয় নাই, কিন্তু আমাকে আল্লাহ বললেন, “সাবধান হ। ক্ষমা চা।” আমি আস্তাগফিরুল্লাহ পড়তে লাগলাম। পড়তে পড়তে মুখে ফেনা উঠে গেলো।
নির্জন একটা জায়গায় নিয়ে আমাকে আবার নির্যাতন করে বলে যে, যা তোকে ছেড়ে দিলাম, তুই দৌড়ে চলে যা। আমার মনে হলো সময় আমার শেষ, দৌড় দিলেই পেছন থেকে ঠাস, ব্যস, পৃথিবীর সকল পিনিয়াম থেমে যাবে। দৌড় দিতে পারলাম না, পারলেও দিতাম না। আমার ভীষণ কান্না পেল। তখন একজন দুইজন করে কয়েকজন লোক সেখানে এসে জড়ো হওয়ায় পুলিশ দ্রুত আমাকে গাড়িতে তুলে থানায় নিয়ে গেলো।
দেড় বছর জেলে রইলাম, ট্রাক ছিনতাই, চালক হত্যা, চোরাইমাল রাখা, সিএনজি চুরি এবং রং পাল্টিয়ে নতুন বানিয়ে বিক্রয় এমন অনেক মামলার আসামি আমি। সাথে মাদকগ্রহণ, মাদকব্যবসা, নারীর দেহব্যবসা করানো, অশ্লীল ভিডিও বানানো, ভিডিও দেখিয়ে ব্লাকমেইলসহ আরও অনেকগুলো মামলার আসামি হলাম। দেড় বছরের অবিরাম চেষ্টায় আমি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে সক্ষম হওয়ায় জামিন পেয়ে মুক্ত হলাম। বাড়ি গিয়ে ঘরে না ঢুকেই শুনি অন্তত ছয়মাস বয়সের একটি শিশুর কান্না। ঢুকে দেখি আমার ঘরে এক নতুন মানুষ, আমার মেয়ে, ঘরের এটা-ওটা ধরে হাঁটতে শিখেছে।
শিহাবভাইয়ের খবর পেলাম না অনেক দিন। তাকে নিয়ে প্রচলিত হয়েছে অনেকগুলো মিথ। এরমধ্যে সবাই জেনে গেছে আমাদের কারখানায় ঘটা অপরাধগুলোর নাটেরগুরু কে, যদিও পুলিশ আমাকে নাটেরগুরু বানাতে চেষ্টা করেছিল। প্রচুর টাকা-পয়সা নিয়ে গোপনে দেশত্যাগ করেছে, ক্রসফায়ারে মারা গেছে, অন্য এক অপরাধীচক্রের হাতে গুম হয়েছে, ইন্ডিয়া চলে গেছে, আজমির শরিফে আছে, ক্যানসারে মারা গেছেÑএমন অনেক রকম কথা প্রচলিত হয়েছে। কিন্তু পাঁচ বছর পরে সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথেই শুনলাম আবার দেশে এসেছে শিহাবভাই, ঢাকা-কক্সবাজার রোডে বিলাসবহুল কোন বাসসার্ভিসে ড্রাইভারের চাকরি নিয়েছে।
মাকড়শার রঙিন ও বিষধর জালের মধ্যে আটকে থেকে আমি যে জীবন যাপন করেছি, সেটি থেকে আমি মুক্তি পেতে অনেক বার আল্লাহকে স্মরণ করেছি। তবে মুক্তি পাওয়ার পরে আমার ভেতরে নানা অপরাধের প্রতি সমর্থন বেড়ে গেছে, যা আগে ছিল না। নিজের অজান্তে যে অপরাধচক্রে জড়িয়ে পড়েছিলাম, সেটি ছিল একেবারেই আমার মনের বাইরের, কিন্তু পুলিশ আমাকে মিথ্যা অপরাধে অভিযুক্ত করায় অনেক অপরাধের প্রতি আমার গোপন সমর্থন তৈরি হয়েছে। আমার মূল্যবোধ অনেকটাই বদলে গেছে। সমাজের ভালো মানুষ আর খারাপ মানুষের প্রচলিত যে ধারণা, সেটি পুরনো হয়ে গেছে, আমার ধারণা একেবারে ভিন্ন হয়ে গেছে।