ঘুটঘুটে অন্ধকারে ওদের নিঃশ্বাসের আওয়াজে বাতাস ভারী হয়ে আসছে। চারপাশের নীরবতাই এই আওয়াজটাকে আরও উস্কে দিচ্ছে কি না, তা বোঝার মতো অবস্থায় এখন রাবেয়া বেগম নেই। তার মনে হচ্ছে, সে মরে যাচ্ছে। মরে যাওয়াই এখন তার ভাগ্য। এমন সুখের জীবন তার চায় না আর। চায় না আর। কী হবে এত সুখে থেকে! কিছুটা বেদনা তো প্রয়োজন। কিছুটা ভয়-ডর, উৎকণ্ঠা,শিহরণ।
ক্রমাগত বাড়তে থাকা অন্ধকারে রাবেয়া চোখ খুলে ফরিদের মুখটা দেখতে পায় না, শোয়া থেকে উঠে বসে ঘর্মাক্ত হাত বাড়ায় ফরিদের নিঃশ্বাসের দিকে। ফরিদ ওই হাতে চুমু খেয়ে বলে, বসবে একটু?
ফরিদ একটা ম্যাচের কাঠি বারুদে জ্বালায়। হঠাৎ আলোয় চমকে ওঠে রাবেয়া। দুই হাত দিয়ে আটকে দিতে চায় আলোটা। ইতি-উতি মোমবাতি খুঁজতে খুঁজতে ফরিদের আঙুলে ধরা কাঠির আলোটা নিভে যায়। রাবেয়া বলে ওঠে, থাক। আলো নাই থাক। আমি যাই। ফরিদ তার হাতের মুঠোয় ধরে থাকা রাবেয়ার হাতটা আরও শক্ত করে ধরে বলে—কোথাও যাবে না তুমি। চুপিচুপি উইঠা আসছি। বাড়ির কেউ জানে না আমি ঘরে নাই। এক্ষুনি যাইতে হবে—রাবেয়া ফিসফিস করে বলে।
কোথাও যাবে না তুমি। বলো, কাল এমন সময়ে আবার আসবে।
কোনো উত্তর না দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নেয় রাবেয়া। উঠে দাঁড়ায়। দরজার দিকে পা বাড়ায়। ফরিদ অভিমানে আগের মতোই বসে থাকে অন্ধকারে। চেনা পথ বলে রাবেয়ার ঠাহর করতে মোটেই কষ্ট হয় না। এছাড়া ফরিদের ঘরটা দূরে তো নয়, রাবেয়ার ঘরটার দুই ঘর পরেই। দিনের বেলা যখন-তখন আসা-যাওয়া চলে। রাবেয়া বেগমের স্বামী হাসমতের দূর সম্পর্কের ভাই এই ফরিদ হোসেন এই গ্রামের স্কুলের মাস্টার। সবার প্রিয় মাস্টার কখন যে রাবেয়াকে আসর করলো, রাবেয়া সেসব বলতে পারবে না। হঠাৎ একদিন রাবেয়া খেয়াল করলো, তার যখন-তখন ফরিদের কথা ভেবে কান্না পায়। ফরিদের ঘরের দিকে নিজের অজান্তেই হেঁটে যায় সে।
ফরিদকে একনজর দেখলে তার প্রাণটা জুড়ায়। আর ফরিদও যেন কেমন করে আড়চোখে তাকে দেখে। ডেকে ডেকে কথা বলে। গা ছমছম করা সেসব কথা। এসব কথা এর আগে কেউ তাকে বলেনি। দুই বছরের সংসারজীবনে হাসমতও না।
এই কথার জালে রাবেয়া আটকে গেলো একদিন। সমাজের ভয়কে উপেক্ষা করে, সংস্কারকে মুছে ফেলে ফরিদের ডাকে সে সাড়া দিয়ে ফরিদের আধচালা ঘরটায় ঘুটঘুটে রাতে হেঁটে আসে। কিন্তু ফেরার সময় তার পা কেন যে চলতে চায় না, অবসাদে শরীরমন অবশ হয়ে আসে।
দক্ষিণে বয়ে চলা কংশগাঙের আষাঢ়মাসের কাঁচাজলধোয়া বাতাসে তার শরীর জুড়িয়ে আসছে, নদীটার কথা মনে হতেই এর জলে গা ডোবাতে ইচ্ছা করে রাবেয়ার। গতবছর এক ভোরবেলা সবার অলক্ষে হাসমত আর সে গিয়েছিল কংশগাঙে গোসল করতে। ভোরের এই গাঙ খুব মায়াবতী। হাসমত এমনিতে তেমন কথা বলে না। কিন্তু সেদিন তার কথাই থামছিল না। রাবেয়া তাকে বার বার থামিয়ে দিচ্ছিল। পাছে গ্রামের মানুষ তাদের দেখে ফেলে। কানাঘুষা করে। হাসমতের উচ্ছ্বসিত মুখটা রাবেয়ার চোখে ভেসে উঠতেই ওর পা দুটো আবার শ্লথ হয়ে আসে।
নিজের ঘরে গিয়ে রাবেয়া এক নিঃশ্বাসে গ্লাসভর্তি পানি শেষ করে যখন বিছানায় আসে, হাসমত তখন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। রাবেয়া পাশে শুতেই হাসমত তার ডানহাতে বউকে জড়িয়ে ধরে ঘুমায়। সঙ্গে সঙ্গে চোখজুড়ে ঘুম নামে রাবেয়ারও।
কাকভোরে যখন হাসমতের ঘুম ভাঙে, রাবেয়াও জেগে ওঠে। খাওয়া-দাওয়ায় সৌখিন হাসমত রোজকার মতো বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে পীরগঞ্জ বাজারের দিকে যায়। বাজারে ওর ছোট্ট একঘর মুদির দোকান। সে রোজ সকালে বাজারে গিয়ে রুটি খেয়ে ধীরে-সুস্থে বাজার করে ছেলে ছোকড়াদের কাউকে দিয়ে বাজারের ব্যাগটা বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে দোকানে বসে। দুপুরে সময় করে বাড়িতে একবার আসে। যেদিন কাজের চাপ বেশি থাকে, সেদিন বাজার বয়ে আনা ছেলেটার কাছে দুপুরে না আসতে পারার খবর পাঠায়।
এই সময়টুকুতে রাবেয়া ঘরের সবকিছু গোছগাছ করে নেয়। বাজার এলেই রান্না করতে বসে। পাশের ঘরের চাচিও তখন হাত লাগায় রাবেয়ার রান্নাবান্নায়।
অন্যদিনের মতো আজ সকালেও তেমন কোনো কথা হয়নি তাদের। হাসমত সেই যে সাতসকালে বাজারে গেলো আর ফেরার নাম নাই। হয়তো সময় করে উঠতে পারেনি। এরইমধ্যে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। পাশের ঘরের কমলা চাচিও এসে গেছে গল্প করতে।
ও বউ, বাইগনগুলাইন দিয়া হুন্নামাছ রাইনদালা। হাসমত যে কুনশুমবালা আইবো…।
বুড়ি একা একাই বলে যায়। সূর্যের তাপ বাড়তে থাকে। রাবেয়া ততক্ষণে চুলায় ভাত দিয়েছে। টুকিটাকি রান্না করেছে। কমলা চাচির চোখের সামনে শুটকিও সে রেঁধেছে। আজকাল কিছুই মনে থাকে না চাচির। প্রায় প্রতিদিন একই গল্প করে। সেই কবে মরে যাওয়া পীরের অলৌকিক ক্ষমতার কথা তার গল্পে ঘুরেফিরে আসে। একটু পর পর রাবেয়া শুধু বলে ওঠে, হুম।
উঠানে মেলে দেওয়া কাপড়গুলো দুই হাতে গুটিয়ে ঘরে রেখে রাবেয়া জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়।
চালতার ডালে ঝোপ হয়ে যাওয়া জানালার ওপাশটা ভেদ করে রাবেয়া দেখে নেয় হাসমতের বাড়ি আসার পথটা। না কেউ তো আসছে না। দুপুরে খাবে না মানুষটা! সূর্যের বাড়াবাড়ি রকমের তাপ সয়ে সয়ে দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। হাতমুখ ধুয়ে পরনের শাড়িটা গুছিয়ে নেয় রাবেয়া। কমলা চাচিকে খাবার বেড়ে দিয়ে নিজেও খেতে বসে। খেতে খেতে চাচি পীরবাবার গল্প করে। এক ঝড়ের সন্ধ্যায় পীরবাবার দাওয়ায় গিয়ে কী কী আজব ব্যাপার সে দেখেছে, সেসব। রাবেয়া একমনে খেয়ে যায়। হাসমতের পাশে বসে খেতে তার ভালো লাগে। হাসমতই তাকে মাঝে মাঝে শেখায় কোন খাবারটা কিভাবে খেলে স্বাদ অসাধারণ হয়। ঝাল তরকারি দিয়ে মাখা ভাত মুখে পুরতে পুরতে ফরিদকে মনে পড়ে রাবেয়ার। ফরিদ খেয়েছে কি না, কে জানে! ফরিদের বউটা ঝগড়া করে বাপের বাড়ি গেছে সেই কবে। ফরিদও বউকে আনতে যায় না, বউটারও রাগ পড়ে না। ফরিদ কদিন ধরে ঘুরেফিরে একটা কথাই শুধু রাবেয়াকে বলছে—চলো আমরা দূরে কোথাও চলে যাই।
রাবেয়া উশখুশ করে।
দুপুরে খাওয়ার পর অলস সময়টায় টিয়ে রঙের সুতোয় নকশি কাঁথা সেলাই করে সে। দিন ফুরিয়ে এলে শরীরে আঁধার মেখে যখন সন্ধ্যা নামে রাবেয়া আধসেলাইয়ের কাঁথাটা গুটিয়ে রাখে জলচৌকির ওপর। ঘরে আলো জ্বালে। আশপাশের বাড়িতেও এক এক করে বাতি জ্বলে ওঠে। ঘরের বাইরে নীরবতা জমাট বাঁধে আঁধারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। কমলা চাচির ছেলে হামিদ বাইরে থেকে ফেরে। হাসমতেরও এখন ফেরার সময়। আজ এত দেরি হচ্ছে কেন! ভাবতে ভাবতে দিন শেষে উঠোনে ফিরে আসা মুরগিগুলোকে সে ঘরে তুলে একমুঠো খুদ ছিটিয়ে দেয়। বাড়ির পেছনের পুকুরঘাট থেকে হাঁসগুলোকে ডেকে ডেকে ঘরে তোলে। এরপর যায় কেবলই বাজার থেকে ফেরা হামিদের কাছে। হামিদকে হাসমতের কথা জিগ্যেস করলে যে উত্তর মেলে, তা শুনে তো রাবেয়া আকাশ থেকে পড়ে। হাসমতকে নাকি আজ বাজারে সে দেখেইনি। তবে বাজারের ব্যাগ নিয়ে হাসমত গেলো কোথায়! রাবেয়া এখন তাকে কোথায় খুঁজবে? সে বরং এখানেই অপেক্ষা করুক। যেন হাসমত এসে তাকে ঘরেই পায়।
হাসমতের মোবাইলে ফোন করে ওকে পায়নি হামিদ। হাসমতের নম্বরে রিং বেজেছে কিন্তু কেউ ধরেনি শুনে রাবেয়া নিজের ঘরে এসে বারান্দায় পিঁড়ি পেতে বসে। কমলা চাচি পান চিবাতে চিবাতে বিড়বিড় করে কী যেন বলে। রাবেয়া বসে বসে হাঁটুতে থুতনি ঠেকিয়ে সেসব শোনার চেষ্টা করে। কিছুই বুঝতে পারে না। কোথায় গেলো মানুষটা! একটা খবর তো পাঠাতে পারতো। একটা মোবাইলফোন রাবেয়ার কাছেও থাকা দরকার। তাহলে যখন তখন খোঁজ খবর নেওয়া যায়। সারাদিন একজন মানুষের কোনো খবর নাই এটা কেমন কথা? উঠানের কলতলায় টিউবওয়েল চেপে ঠাণ্ডা পানি জগে ভরে ঘরে নিয়ে রাখতেই বাইরের অমাবস্যার দিকে চোখ যায় রাবেয়ার। অন্ধকার পেছনে ফেলে হাসমত আসে না। সুনসান ঘরটা রাবেয়ার কাছে অসহ্য লাগে। ছিটকে বেরিয়ে এসে হামিদকে বলে সে যেন আবার একবার ফোন করে যেন হাসমতকে।
রাত গভীর হতে থাকে। রাবেয়ার মনে দুশ্চিন্তা দানা বাঁধতে থাকে। মোবাইলে ফোন করে হামিদ হাসমতকে পায়নি এবারও। শাশুড়ি বেঁচে থাকলে এখন কী করতো, ভাবার চেষ্টা করে রাবেয়া। তার বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। দুই মাস আগে মরে যাওয়া শাশুড়ি এখনো মনে মনে ছায়ার মতো তার পাশে থাকে। রাবেয়া কলতলায় গিয়ে অজু করে এশার নামাজ আদায় করে তাহাজ্জুতের নামাজ পড়ে।
মা মরে যাওয়ার পর একমাত্র সন্তান হাসমত উঠতে বসতে মায়ের কথাই শুধু বলে। প্রায়ই মনমরা হয়ে থাকে। কথা কম বলা মানুষটার মনের কথা কি রাবেয়া কখনো বুঝতে চেয়েছে? হঠাৎ নীরবতা ভেঙে শেষরাতে জেগে থাকা একটা পাখির ডাক শুনে রাবেয়া জায়নামাজ গুটিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়েও ফিরে আসে বিছানায়। শুয়ে পড়ে। পাশে না থাকা স্বামীর শরীরের গন্ধ গায়ে মেখে কখন যেন ঘুমিয়েও পড়ে।
হাসমতের ডাকে যখন তার ঘুম ভাঙে তখন সকাল। চমকে জেগে উঠে রাবেয়া দরজা খোলে। চোখেমুখে ক্লান্তি নিয়ে বাড়ি ফেরা স্বামীর মুখহাত ধোয়ার পানি কলতলা থেকে এনে দেয়। খাবার বেড়ে দেয়। হাসমত ঘরে এসে গায়ের সবুজ শার্টটা খুলে আলনায় রাখতে রাখতে লজ্জিত গলায় বলে—বাজারের একটা মরা মানুষরে বাড়িতে পৌঁছাইয়া দিতে অনেক দূরে গেছিলাম। তোমারে কইয়া যাইতে পারি নাই। সারারাত খালিবাড়িতে একলা ছিলা। ঠিক করি নাই কাজটা।
কথাগুলো রাবেয়ার কানে যায়নি এমন নয়। কিন্তু স্বামীর কথার পিঠে কথা বলতে সে ভুলে যায়। তার বুক থেকে কতটা ওজনের একটা পাথর নেমে গেছে তা সেই জানে। হাসমতকে কিছু না বলে গতরাতের পান্তাভাত বেড়ে দেয়। হাসমত নিঃশব্দে হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসে। রাবেয়াকে বলে—আমার সাথে কয়ডা খাও, রাবু।