গ্রীষ্মের দুপুর সবসময়ই খুব রহস্যময়। ভয়াল রোদে পুড়তে থাকা প্রকৃতির সঙ্গে-সঙ্গে মানুষেরও বোধ হয় এই দুপুরে অদ্ভুত কিছু প্রতিক্রিয়া হয়। মানুষ স্তব্ধ হয়ে যায়। শুধু গরমে নয়, আগাগোড়া ভেতরে-বাইরে। এই যেমন আজ তীব্র রোদে পুড়তে পুড়তে মাহবুবের মনে হয়, সে যেন সামনে রঙধনু দেখছে। সে সচেতনভাবেই চিন্তা করে, রোদের বন্যায় তো রংধনু দেখার কথা নয়। সাতরঙের এই মিশেল দেখতে বৃষ্টি শেষে ছাদে উঠতে হয়। কে জানে, দুপুরটা বোধ হয় মাঝে মাঝে এমনই বিভ্রম দেখায়। মাহবুব ভাবে, আচ্ছা, শুধু কি সেই বিভ্রম দেখছে! না কি পথ চলতি মানুষগুলোও এর শিকার। ওইতো ফুটপাতে ফলের রস বিক্রি করা লোকটাও রোদে পুড়তে পুড়তে কেমন শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। লোকটার জুলফি বেয়ে কেমন এঁকেবেঁকে ঘামের ধারা নামছে। মাহবুবের মনে হয়, ওগুলো আসলে ঘামের ধারা নয়, এক একটা জ্যান্ত হিসহিসানি সাপ। যার প্রত্যেকটির গন্তব্য শরীরের অলিগলি। মাহবুব নিজের কপালে হাত দেয়। তার কপালেও সেই সাপগুলো সক্রিয়।
সে টের পায়, শুধু কপাল নয়, অফিসের জন্য তার বাবুয়ানা মার্কা শার্টটার নিচেও সেই একই ধারা। মাহবুব আশপাশের আরও মানুষগুলোর দিকে তাকায়। রাস্তার মাঝখানের মাজারটার সামনে বসে লাল ন্যাকরা পড়া এক জটাধারী। খালি রাস্তাতেও নিজস্ব ভুলে আটকে পড়া রিকশাওয়ালা, অধৈর্য্য বাস কন্ডাকটর। ফুটপাতের ওপর দোকান সাঁজিয়ে বসা যুবক, ল্যেংচে ল্যেংচে দয়া ভিক্ষা করা ভিক্ষুক, সবার চেহারাই ঘর্মাক্ত। সবারই কপাল জুলফি বেয়ে ঘামের ধারা বইছে। একটু নড়চড় হলেই যেন সাপগুলো ছোবল দেবে মোক্ষম দাঁতে। মাহবুব তার ভারী ব্যাগটা বাম থেকে ডান হাতে নেয়। তার গন্তব্য আপাতত বাংলাবাজার। আজ ওই এলাকাতেই তাকে ঘুরতে হবে। দোকানে দোকানে গিয়ে বলতে হবে, রান্না নিয়ে গৃহিণীদের চিন্তার দিন শেষ। কারণ এসে গেছে রন্ধনশৈলী হলুদ, মরিচের গুড়ো, মাংসের মশলা। এছাড়া আছে ঘানি ভাঙানো এক নম্বর রন্ধনশৈলী সরিষার তেল। দোকানদার না করতে পারে, তাতে কী! মাহবুবের কাজই হলো তাদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে পণ্যটা গছানো। অবশ্য তার বস আফরার উদ্দিন বলেন, শুধু পণ্য গছানোই আমাদের একমাত্র কাজ নয়। গ্রাহকের সর্বোচ্চ তৃপ্তি নিশ্চিত করাই আসল। এজন্য আমাদের যতদূর ছোটার প্রয়োজন ছুটতে হবে। এখন বাজার ভয়ানক প্রতিযোগিতার। টিকে থাকতে হলে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যেতেই হবে। তার কথায় মাহবুবও প্রাণপনে হেঁটেছে, খেটেছে। তবু লাভ হয়নি। নিজস্ব চিন্তার গণ্ডি ভেঙে কথার বাজারি পসরা বসাতে তার ভালো লাগে না। কোম্পানি থেকে এ মাসে যে টার্গেট বেঁধে দিয়েছে, তা পূরণ না হলে কমিশন তো দূরের কথা, বেতনটাও আটকে যেতে পারে। গতকালই আফরার উদ্দিন তাকে ভদ্রভাবে শাঁসিয়েছেন। দুপুরের রোদে পুড়ে মাহবুব তখন মাত্র অফিসের ছায়ায় ঢুকেছে। চেয়ারে বসে ফ্যানের ঘুর্ণায়মান বেগের দিকে তাকিয়ে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল। ঠিক তখনই পিয়ন এসে জানালো আফরার উদ্দিন তাকে ডাকছেন।
অবশ্য বসের রুমে ঢুকে মাহবুবের আরামই লেগেছিল। শীত আর তাপ নিয়ন্ত্রণ করে আফরার উদ্দিন মনোযোগ দিয়ে ক্যালকুলেটরে তার নিয়ন্ত্রিত হিসাবে ব্যস্ত। মাহবুবকে দেখেই হাসলেন। বসো মাহবুব, তোমার গত এক সপ্তাহের সেলের হিসাব দেখছিলাম। হ্যাঁ বলো এবার কী অবস্থা? মাহবুব ইতস্তত করে, ঠিক কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না। বস খানিকক্ষণ তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। যেন বোঝার চেষ্টা করছে, তাকে দেখে মাহবুবের হৃদপিণ্ডটা কতটুকু কাঁপছে। তারপরও অভয় মাখানো হাসি হাসলেন। দেখো মাহবুব, তোমরা ইয়াং ছেলে। শরীরের রক্ত এখনো গরম। এখন পরিশ্রম না করলে চলবে! গত দু’মাসেও তুমি টার্গেট ছুঁতে পারোনি। যাই হোক, আজ তোমার অর্ডার কেমন এসেছে? মাহবুবের মনে হয়, পৃথিবীটা যেন আবার মুড়ে নিচ্ছে বরফ যুগ। হাড় ফুটো করা কোনো আতঙ্কের বাতাস তীব্র বেগে চারদিকে বইছে হুহু করে। যেন মুহূর্তেই বাতাসের তোড়ে উড়ে যাবে সে। আফরার উদ্দিন কী বুঝে নেন, মাহবুব জানে না। সম্বোধনের ধরন পাল্টায়, তুমি থেকে সম্পর্ক আপনিতে উঠে আসে। দেখেন মাহবুব, আপনাকে যখন চাকরিটা দিয়েছিলাম, তখন মনে হয়েছিল আপনি লম্বা রেসের ঘোড়া। মুহূর্তের সংকেতে আপনি দৌড়াবেন সব কিছু ছাড়িয়ে। কিন্তু এখনো তার কোনো লক্ষণই দেখতে পাচ্ছি না। মাহবুবের মনে যেন সেদিন কথাটা গেঁথে গিয়েছিল- লম্বা রেসের ঘোড়া। আফরার উদ্দিন মাঝে মাঝেই কর্মীদের এই কথাটা বলেন। আজ দুপুরে হাঁটতে হাঁটতে মাহবুবের আবার মনে মনে আওড়ায় সেই কথাটা। মনে হয়, সত্যিই সে যেন একটা লম্বা রেসের ঘোড়া। রোদে পুড়ে তার কালো চামড়া আরও নিকষ কালো হচ্ছে, মাথার চুলগুলো হচ্ছে রঙচটা। যেন চুলগুলোকে কেশরের মতো একবার ঝাঁকুনি দিয়ে তপ্ত পিচের পথ মারিয়ে মাহবুব নামের ঘোড়াটা দৌড়াতে শুরু করবে।
তার মনে হয়, এটা ঠিক গুলিস্তান নয়, বরং বিশালাকার এক রেসের ময়দান। সে সহ অসংখ্য কুচকুচে ঘোড়া দৌড়ে চলেছে প্রাণপনে। সবারই লক্ষ্য শীর্ষ, কেউ থেমে থাকতে রাজি নয়। চারদিকে অসংখ্য দর্শকের কোলাহল। তারাও উত্তেজনায় ফুটছে, কেউ শীষ দিচ্ছে, কেউ চিৎকার। সবাই যার যার প্রিয় ঘোড়াকে বিজয়ী দেখতে চায়। এই রেসে হেরে যাওয়ার অর্থ জীবন থেকেও হেরে বিদায় নেওয়া। মাহবুব কপালের ঘাম মুছে নেয়। হারলে চলবে না, শীর্ষে থাকা চাই। সে জোর কদমে এগিয়ে চলে। ভারী ব্যাগটা এ হাত থেকে ও হাতে নেয়। অবশ্য অফিস থেকে যে মাহবুবকে টিএডিএ দেয় না এমন নয়। কিন্তু তারপরও এই সামাণ্য কটা টাকাও সে রেখে দেয়। মাস শেষে ক’টাকাই আর বেতন পাওয়া যায়। তারচেয়ে বাস রিকশার আরাম এড়িয়ে এই সামাণ্য দূরত্বে পায়ের ওপর ভরসা করলেই আরও কিছু টাকা জমে যায়। আর দুপুরবেলা আসলেই খুব রহস্যময়। নইলে বাসের ভেতর ভ্যাপসা গরমে তেলে ভাজা হতে হতেও কেনও মানুষ ঘুমোবে! প্রচণ্ড ভিড়েও মাহবুব দেখেছে, কেউ কেউ বাসে দাঁড়িয়ে থেকেও ঝিমুতে থাকে, এর ওর গায়ে মাথা এলিয়ে দেয়। ঠিক যেন ঘোড়া। ছোটবেলা তমিজ স্যার পড়াতে এসে সাধারণ জ্ঞান শিখিয়েছিলেন, বলতো কোন প্রাণী দাঁড়িয়ে ঘুমায়? দাঁড়িয়ে ঘুমায় ঘোড়া। এইসব ঘাম, স্পর্শ, চাপাচাপি, খিস্তি খেফড় মাহবুবের ভালো লাগে না। তাই গুলিস্তান টু বাংলাবাজার দূরত্বে তার বাসে না চড়ার এটাও একটা কারণ। কিন্তু আজ তার বড্ড ক্লান্ত লাগে। মাহবুবেরও ইচ্ছে হয়, চোখ বন্ধ করে খানিকটা বিশ্রাম নিতে। এতে তাকে লোকে ঘোড়া বা যাই বলুক, কিছুই যায় আসে না। সুর্যের গনগনে প্রতিশোধের মধ্যেও মাজার ছাড়িয়ে একটু সামনে রাস্তার দুপাশের নানা জিনিসের বিকিকিনি চলছে। এরইমধ্যে ভিড়ে মাথা উঁচিয়ে হাঁক ছাড়ছে তিনটি ঘোড়ার গাড়ি। ওদেরও গন্তব্য বাংলাবাজার। কতগুলো হাড্ডিসার ঘোড়া এই তপ্ত গরমে চোখ পিটপিট করছে। মাহবুব সেগুলোর সামনে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। ঘোড়াগুলোর পিঠে অসংখ্য দাগ। অনিচ্ছা আর পরাধীনতা যেন জায়গায় জায়গায় কামড় বসিয়েছে। গাড়ির পাটাতনে বসা কোচয়ান হাঁক দিচ্ছে জোরেসোরে যাত্রীর আশায়। তার হাতে চাবুক। মাহবুবের নিজেকেও এই গোড়াগুলোর একজন বলে মনে হয়। অনিচ্ছার এই তীব্র দুপুরে তার চোখও ঘুমে পিটপিট করে। চোখটা বুজে আসে, কিন্তু পরক্ষণেই পিঠে যেন দিনযাপনের চাবুক আবার তাকাতে বাধ্য করে। মাহবুব একবার ভাবে আজ না হয় টাকার চিন্তা নাই বা করা গেল, বরং ঘোড়ার গাড়িতে করেই যাওয়া যাক। সর্বোচ্চ সওয়ারি নিয়ে তীব্র তেজে রোদেও দরজা ফুটো করে দিয়ে ঘোড়াগুলো যখন ছুটবে তখন কপাল আর পিঠে কিলবিল করতে থাকা ঘামের সাপেরা নিশ্চই ভয়ে গর্তে লুকাবে।
মাহবুব যেন চোখ বন্ধ করে ছুটন্ত ঘোড়াগুলোকে দেখতে পায়। ওরা যেন আর চাবুকের ঘায়ের পরোয়া করে না। বরং তীব্র জিঘাংসা নিয়ে ওরা ছুটে চলেছে সব পেছনে ফেলে। ওদের নিশ্বাসে উড়ে যাচ্ছে পথের সব খড়কুটো। দৌড়ের দমকে হার মানছে দৈনন্দিন সব পরাজয়। মাহাবুবেরও ইচ্ছে করে সেই ঘোড়াগুলোর মতো হতে। হাতের ব্যাগটাকে ছুড়ে ফেলে দৌড় দিতে ইচ্ছে করে পেছনের দিকে। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে পৌছে যাওয়া যাবে বাড়ি। সেখানে তপ্ত দুপুরের হাওয়া মেখে ঘরের ঠাণ্ডা মেঝেতে আলুথালু বেশে শুয়ে থাকে মা। চুপটি করে না হয় তার পাশেই শুয়ে পড়া যাবে। ছোটবেলায় মা এই দুপুরেই তো ধমকে দিত, এমন রাক্ষস খোক্ষস রোদে কোনো মানুষ সাধ করে পুড়তে বের হয়! কথাবার্তাতো শুনিস না, কেবল গায়ে গতরে লম্বাই হয়েছিস ঘোড়ার মতো। কী বিচ্ছিরি বোটকা ঘামের গন্ধ। তারচেয়ে যা, হাতমুখ ধুয়ে এসে আমার পাশে শুয়ে থাক। দেখবি ঘুম এসে যাবে। তখন মাহবুব মায়ের কথা শুনতো না। এক ছুটে পালিয়ে যেত অন্য আকর্ষণে। অথচ আজ সেই দুপুরবেলার ঘুম চাইলেও আর ফিরে পাওয়া হয় না। মাহবুব গাড়ির সঙ্গে বাঁধা হাড় জিরজিরে ঘোড়াগুলোর গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। ওদেরও আশপাশের বিচ্ছিরি বোটকা গন্ধ। সে যেন তার ঘামে ভেজা বাবুয়ানা শার্টটা থেকেও একই গন্ধ পায়। মাহবুব ঠিক করে হেঁটেই সে বাংলাবাজার যাবে, গাড়িতে চড়বে না। তার মতো একজন যাত্রী শূন্যতায় কোচয়ান না হয় আর খানিকক্ষণ ঘোড়াগুলোকে বিশ্রাম দিক। তারচে এমন কোনো দিন ঘোড়াগুলোর সঙ্গে ওর আবার দেখা হবে, যেদিন দুপুরে পৃথিবী ভাসিয়ে দেবে এমনই লাভার মতো রোদের স্রোতে। তারপরও ভরপেট দানাপানি খেয়ে এক চিলতে ছায়া খুঁজতে বের হবে ওরা। সেদিন দুপুরে সত্যিই ক্লান্ত ঘোড়াগুলো ঘুমোবে।