‘আমি যে তোমাকে ভালোবাসি সেটা এক্ষণি বলব না কদিন পর বলব?!।’১ দারুণ ভীতি, শঙ্কা আর উত্তেজনা নিয়ে এ কথা বলে ফেলি। অনেকটা রিস্ক নেওয়ার মতো করে। অন্যদিকে মুখ করে এ কথা বলেই তার মুখের দিকে আমি তাকাই একঝলক। তার মুখে কী অভিব্যক্তি খেলা করছে, তা আন্দাজ না করে ফের সঙ্গে সঙ্গেই যেদিকে তাকিয়ে তাকে বলেছিলাম, সেদিকে চোখ ফিরিয়ে নেই। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আবার তার দিকে তাকালে দেখতে পাই, সে দারুণভাবে বিস্মিত হয়েছে। সে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বেপরোয়ার মতো হয়ে উঠি নিমেষেই। আমি অনেক সহজ আর সাহসী হয়ে উঠি। তাকে আবার এই কথাটা অর্থাৎ ‘আমি যে তোমাকে ভালোবাসি সেটা এক্ষুণি বলব না কদিন পর বলব’—কথাটা বলি। আমি আবার তার দিকে তাকাই, দেখি, সে হেসে উঠেছে। আমি তার দিকে তাকিয়েই থাকি। সে হাসে মৃদু। সে বললো—‘ঠিক আছে, এখন বলতে হবে না পরে বলো।’ হ্যাঁ, তাকে আর বলতে হয়নি। ব্যাপারটা তখন থেকেই কার্যকর হয়ে গেছিল। আমার কাছে পৃথিবী জয়ের আনন্দ। এখন, এখানেই বর্তমান বর্ণনাটা স্টপ থাকুক। এবার একটু গোড়ার দিকে যায়। অবশ্য জানি না যে, ঠিক এই বর্ণনার কাছে আর ফিরে আসা হবে কি না বা ফিরে আসার প্রয়োজন হবে কি না।
ক. প্রথম যেদিন তাকে কলেজের গেটে দেখি, তখন ভীষণভাবে আশ্চার্যান্বিত হই। কী সৃষ্টি! কী অপরূপ সৃষ্টি! আমার জীবনে এত সুন্দর মেয়ে আর দেখিনি। তার রূপ, তার যৌবন, তার হেঁটে যাওয়া, তার দাঁড়িয়ে থাকা—সবকিছুই অতুলনীয়। তার ঠোঁট তার হাসি, তার বুক তার দুলুনি, তার গাল তার গোলাপাভা। সে যেখানে থাকে, সেখানে সবার ভেতর একটা ত্রাস ছড়িয়ে যায়। সবার হৃৎপিণ্ডের ধ্বক ধ্বক শব্দ মিলে বেশ জোরালো একটা ভীতিকর সঙ্গীত বেজে ওঠে। সে একটা রূপসন্ত্রাসী। যেখান দিয়ে যায় একটা বিস্ফোরণ ঘটে যায়, ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে যায় চারপাশ। কারও কিছু বলার নেই। আর সে তার বুক নিয়ে, তার নরমতা নিয়ে দর্পে হেঁটে চলে। তাকে আমার আকাশের চাঁদ মনে হতো, আকাশের চাঁদের মতো মনে হতো।
খ. তার দিকে সবাই তাকাতো ভয়ে ভয়ে, যেন যে তার দিকে বেশিক্ষণ তাকাবে সে নিজেই ভস্মীভূত হয়ে যাবে। তার কাছে কেউ ভিড়ত না। এই ‘ভিড়ত না’ টার শক্ত ভিতের ওপর দিয়ে সবাই হেঁটে চলে যেতো। তাদের হাঁটা দেখে, তার দিকে না তাকিয়ে হাঁটা দেখে, মনে হতো—প্রাণপণে তারা চেষ্টা করছে এমন ভাবতে যে, সে নেই এই কলেজে, এই পৃথিবীতে, তার মতো সুন্দর পৃথিবীতে থাকা অসম্ভব। যে দিকে সে তাকাচ্ছে না সেখানে কেউ নেই, সেখানে অসীম নীরবতা বিরাজ করছে। অসীম শূন্যতার দিকে তাকানো ঠিক না।
তাকে দেখলে আমিও ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়ি, ভীত হয়ে যায়। আমার এ ভীতি, এ দুর্বলতা অন্যদের চেয়ে একটু বেশিই। ভীতির স্বচ্ছ কাঁচের গুঁড়ো পায়ের তলায় পড়ে রক্তাক্ত করে দিত আমার পা। পা হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ব্যান্ডেজ করতে হয়েছে অনেকবার। তারপরও প্রবল আগ্রহ তৈরি হয়। ‘তার সঙ্গে আমি কথা বলবই’—এমন একটা প্রবল ইচ্ছা সে যখন থাকে না তখন চাগা দিয়ে ওঠে। সে এলে এত শক্তিশালী ইচ্ছেটা মুহূর্তেই ছাই হয়ে যায়। কোনো কিছু ছাই হওয়ার আগে পুড়তে দেখা যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে পুড়তেও দেখা যায় না, দেখা যায় সরাসরি ছাই।
একদিন স্বপ্নের ভেতর লোকমান হেকিম আসেন। ‘আমার ইচ্ছে বার বার পুড়ে যায়, আমি কী করব?’—এ রকম একটা প্রশ্ন করে তার পাগড়ির ওপর রাখি। তিনি প্রশ্নটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে আর আমাকে বলেন, ‘আগুন থেকে তৈরিকৃত জল আর জল থেকে তৈরিকৃত আগুন সংগ্রহ কর বেটা। এগুলো সংগৃহীত হলে তুই আগুন থেকে তৈরিকৃত জল, জল থেকে তৈরিকৃত আগুন দিয়ে গরম করবি। গরম হয়ে গেলে তোর ইচ্ছে পোড়া ছাইগুলো দিয়ে শরবত তৈরি করে পান করবি। এতেই তোর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে।’ তিনি চলে গেলেন নিমিষেই।
আমি প্রথমেই আমার ইচ্ছেপোড়া ছাইগুলো কলেজের রাস্তা, মাঠ, বারান্দা, সিঁড়ি থেকে খুঁজে খুঁজে বের করি। এরপর দিনের পর দিন রাতের পর রাত আগুন ভেঙ্গে জল তৈরি করার চেষ্টা করি। হয় না। শরীরের ঘাম, মনের ঘাম ঝরে ঝরে বন্যা বয়ে যায় কিন্তু আগুন থেকে জল তৈরি করতে পারি না। তারপরেও হাল ছাড়ি না, আগুনকে জল করার আমার সাধনা চলতে থাকে। বহুদিন এভাবে পার হলে একদিন দেখি আগুন থেকে জল বের করতে পারছি। আমি দারুণ খুশি হয়ে উঠি। একগ্লাস জল তৈরি করে রাখি আর এবার শুরু করি জল থেকে আগুন তৈরি করার চেষ্টা। আবার পরিশ্রম। জল থেকে আগুন তৈরি করা দেখি আরও বেশি কঠিন। আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ি পরিশ্রম করতে করতে, ঘাম ঝরাতে ঝরাতে দুর্বল হয়ে পড়ি। তারপরও বাদ দেই না। একদিন জল ঘষতে ঘষতে একটু আগুনের ফুলকি বের হতে দেখি। আমি আরও জোরে জল ঘষতে থাকি। শরীর থেকে দরদর করে ঘাম ঝরতে থাকে। তারপরেও থামি না ঘষেই যাই, ঘষেই যাই। একসময় আগুন জ্বলে ওঠে। আমি ঘেমে চুবচুবে হয়ে যাই। কিন্তু আগুন জ্বলা দেখে আর একটুও তর সয় না আমার। আমি তাড়াতাড়ি উঠে যায় জলের কাছে। জল হাতে নিয়ে গ্লাসের দিকে তাকানোর সময় কপাল চুঁয়ে, কপোল চুঁয়ে থুতনির কাছে জমা হওয়া একফোটা ঘাম জলের গ্লাসে পড়লে জলের রঙ পরিবর্তন হয়ে যায়। আমি বুঝলাম জলের গুণ নষ্ট হয়ে গেলো। আমি কাঁদব না মাথার চুল ছিঁড়ব বুঝতে পারি না। মাথা গরম হয়ে যায়। কিন্তু তারপরও আমি আবার শুরু করি। আবার জল তৈরি করি। এবার আগুন তৈরি করার পর মুখ থেকে হাত থেকে শরীর থেকে সব ঘাম, সব পরিশ্রমের দুঃখ চিহ্ন মুছে ফেলে তারপর জলের কাছে যাই। ইচ্ছেপোড়া ছাই মিশিয়ে শরবত তৈরি করে পান করি। তারপরেও খুশি হয়ে উঠি। ইচ্ছাটাকে আরও আরও শক্তিশালী হতে দেই। একদিন তার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। কোনোরকমে তার দিকে তাকিয়ে বলি—‘কেমন আছ?’ সে কেমন আছে, এটা বলার আগে খুবই অবাক হয়। বিস্ময়টা তার এজন্য সম্ভবত যে, এ পর্যন্ত তার এত কাছাকাছি এসে কোনো ছেলে কথা বলার সাহস করেনি। তার বিস্ময়ের ভাব কাটলে বলে, ‘ভালো আছি।’ সে হাঁটা ধরে। তাকে আমার পৃথিবীর সেরা হিরকখণ্ড কোহিনুর বলে মনে হতো।
গ. এরপর থেকে একটু একটু করে তার সঙ্গে কথা বলা শুরু করি। তেমন কিছু না, জাস্ট, কেমন আছ, কেমন আছি টাইপ কথাবার্তা। এসময় তাকে আমার ঈশপের আঙুরলতায় ঝুলে থাকা চমৎকার সবুজ আঙুরের মতো মনে হতো।
ঘ. কিন্তু এতে আমি আর সন্তুষ্ট থাকতে পারিনি। তার সঙ্গে প্রেম করার একটা ইচ্ছে তৈরি হয়। এই ইচ্ছেটা তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীর কেঁপে ওঠে। নিজেকে বলার চেষ্টা করি—‘তুমি জানো না, তুমি কতবড় দুঃসাহসের বিষয়কে নিয়ে ইচ্ছে তৈরি করেছ।’ আমি তার কাছে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করি, আমার মনটাকে বেঁধে রাখার চেষ্টা করি। পারি না। মনে মনে আবার প্রতিরাতে ঘুমানোর সময় লোকমান হেকিমকে ডাকি। কিন্তু তিনি আর আসেন না। শেষে একদিন এলেন।
এবার আমি বলি—‘বাবা, আমার ইচ্ছে মেয়েটির সঙ্গে আমি প্রেমমিথুন গড়তে চাই, কিন্তু তার কাছে দাঁড়ালেই আমার ইচ্ছেটা পুড়ে যায়।’ লোকমান হেকিম মৃদু হেসে বললেন—‘এসব ইচ্ছে পোড়া ছাই তুমি একটা ময়ূরের স্পার্ম ভর্তি গ্লাসে গুলে শরবত করে পান করবে।’ আমি তাকে ‘ময়ূরের স্পার্ম জীবনেও সংগ্রহ করতে পারব না’ বললে তিনি বলেন, ‘সে তবে কিভাবে হবে। তোমাকে সংগ্রহ করতেই হবে। তোমাকে আমি পথ বাতলে দিচ্ছি, সেখানে গেলেই ময়ূরের স্পার্ম পাবে। ওটা ময়ূরেরই বন। ময়ূর বন। সেখানে তোমাকে যেতে হবে ইচ্ছে স্বপনের ভেতর দিয়ে। এই ইচ্ছে স্বপনে একটা পথ দেখতে পাবে। সে পথ দিয়ে হাঁটলে প্রথমে আসবে একটা শেয়াল বন। সে শেয়াল বন যদি পার হয়ে যেতে পারো তবে আসবে বাঘ বন। এই বাঘ বন পার হয়ে গেলে দেখতে পাবে সিংহ বন। এই সিংহ বনের পরে ময়ূর বন। ওখানে পৌঁছতে পারলেই তুমি পেয়ে যাবে, তখন আর খুব কষ্ট হবে না।’ তিনি চলে গেলেন। আমি পরদিন ইচ্ছে স্বপনের ভেতরে সত্যি একটা পথ দেখতে পেলাম। বাঘ সিংহদের সঙ্গে যুদ্ধ করে পরে ময়ূর বীর্য সংগ্রহ করে, গ্লাসভর্তি ময়ূরের স্পার্ম আমার টেবিলের ওপর রাখি। সকালে ঘুম ভেঙে উঠে গেলে আমার মনটা একটা আনন্দ আর একটা বেদনার গরুর গাড়িতে পরিণত হয়। গরুর গাড়ি থেকে কিভাবে নামব সেটা ভাবছি এমন সময় স্পার্মের গ্লাসটা টেবিলের ওপর দেখতে পাই। তখন গরুর গাড়িটা আর আনন্দবেদনার বেদনার গাড়ি হয়ে থাকে না, দুটো গরুই আনন্দ গরু হয়ে টেনে নেয় আমাকে কলেজের দিকে। আর স্পার্মের সঙ্গে মিশিয়ে পান করি। পান করি বিস্বাদ স্পার্ম—ছাই শরবত। তারপর শুরুতে যে কথা বর্ণনা করছিলাম, সে ব্যাপারটা ঘটিয়ে দেই। তখন তাকে দেখতে মনে হয়েছিল মানবপরি, চমৎকার রঙিন মাংস।
ঙ. সে আমার সংসারে আসে। কিছুদিনের মধ্যে অনুভব করি, এমন সাধারণ আর ঝগড়াটে নারী আমি আর একটাও দেখিনি জীবনে। তাকে আমার মনে হয় পৃথিবীর সেরা এক জঞ্জাল। সেও একদিন আমার প্রতি ক্ষোভ ছুড়ে দেয়—‘তোমার মতো অকেজো আর অকৃতজ্ঞ পুরুষ আর একটাও দেখেনি।’
টীকা:
১। এখন মনে করতে পারছি না আসলে কথাটি বলার পর কোন যতিটা ব্যবহার করেছিলাম।