রিটায়ার্ডের পর হাসনাত সাহেব এখন তার সম্পূর্ণ সময় লেখালেখিতেই ব্যয় করেন। লেখক হিসেবে হাসনাত আমজাদের বেশ পরিচিতি রয়েছে। ফলে প্রকাশক-সম্পাদকের ফরমায়েশ-চাপ সারাবছরই থাকে। বয়স হয়েছে, লেখার টেবিলে একটু বেশি সময় দিলেই তিনি ক্লান্ত-অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাবার এই অবস্থা দেখে তার একমাত্র ছেলে সোহেল আমজাদ প্রায় বলে, বাবা, তোমার কিসের অভাব? এত কাজ করো কেন? সারাজীবন তো লিখলে, এখন একটু বিশ্রাম নাও।
হাসনাত সাহেব বলেন, সে কী! তুই কি ভাবিস আমি টাকার জন্য লিখি? আরে পাগল এই সমাজ, এই সভ্যতার কাছে আমার অনেক ঋণ, তা শোধ দিতেই সামান্য চেষ্টা।
ঋত্বিক হচ্ছে হাসনাত আমজাদের একমাত্র নাতি। দিনের যে মুহূর্তটা হাসনাত সাহেব ঋত্বিকের সঙ্গে কাটান। সেটাই তার দিনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত। ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র ঋত্বিক। মেধাবী, বুদ্ধিমান। সে স্কুলের সাইন্স ক্লাবের সক্রিয় সদস্য।
একদিন বিকেলে ঋত্বিককে প্রায় জোর করেই হাসনাত সাহেব সোসাইটির পার্কে বেড়াতে নিয়ে গেলেন। পার্কে হাঁটতে হাঁটতে তিনি বলেন, আচ্ছা, তুমি যে বাড়িতে বসে বসে কম্পিউটার, ট্যাব, ল্যাপ্টপ আর হিজিবিজি কিসব ভাঙা-চোরা যন্ত্রের সঙ্গে সময় কাটাও, মাঠে এসে বিকেলে খেলতে ইচ্ছে করে না?
ঋত্বিক বলে, দাদু, আমার বন্ধুরা তো মাঠে খেলা করে না। বাসায় ভিডিও গেম খেলে।
এই ধরো তুমি বিষয়, চরিত্র, প্লটগুলো ইমপুট করবে সফটওয়ারটি নিজে নিজেই গল্প লিখে ফেলবে। তাহলে তোমার আর কষ্ট করা লাগবে না
মাঠে খেলাধুলো করলে শরীর ভালো থাকে, মেধার বিকাশ হয়। এই যে তোমদের ওবেসিটি, এর কারণ কিন্তু তোমরা কায়িক পরিশ্রম করো না। আমরা ছোট বেলায় কত দৌড় ঝাঁপ করেছি।
আমি না হয় আসব কিন্তু আম্মু আসতেই দেবে না।
কেন?
যদি হাত-পা ভেঙে যায়, তাহলে স্কুল যেতে পারব না। আর বিকেলে খেলতে এসে যদি ক্লান্ত হয়ে পড়ি, রাতে হোমওয়ার্ক করতে পারব না। তাছাড়া দেখোনা প্রতিদিন কোচিং-এ পরীক্ষা থাকে।
তা বটে, তা বটে। তোমাকে যে ঠাকুমার ঝুলি দিয়েছিলাম, পড়েছ?
না। মা বলেছে, বার্ষিক পরীক্ষার পর পড়তে।
তুমি কার্টুন আর গেম কম খেলে সময় বের করে বইটা পড়তে পারতে। এভাবে চলতে থাকলে একদিন তোমরা হৃদয়হীন রোবটে পরিণত হবে। তোমাদের মধ্যে মানবিকতা বলতে কিছুই থাকবে না।
ঋত্বিক চুপ থাকে।
ডিসেম্বর মাস। সামনে বই মেলা। লেখার টেবিলে হাসনাত আমজাদ সাহেব রাত জেগে কাজ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। লেখার বিষয় ছিল: ‘শিশুদের মানসিক বিকাশে সহায়ক পরিবেশ।’ কিন্তু লেখাটা শেষ করার আগেই তিনি শয্যাগত হন। ছয় দিন পর আজ তিনি সামান্য সুস্থতা বোধ করছেন। এ কদিনে ঋত্বিক একদিনও তার সঙ্গে দেখা করতে আসেনি। অথচ বেশ কদিন আগেই ঋত্বিকের পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। হাসনাত সাহেব চেয়েছিলেন ঋত্বিক নিজে থেকেই তার কাছে আসবে, পাশে বসবে, গল্প করবে। তিনি ভাবেন, আজকালকার ছেলে-মেয়েরা সম্পর্কের সৌন্দর্যগুলো ভুলে যাচ্ছে। তিনি আজ নিজেই ঋত্বিকের খোঁজে তার ঘরে গেলেন।
পৌত্রের কক্ষে গিয়ে দেখেন, সে নানা ধরনের যন্ত্রাংশ, কম্পিউটার সামগ্রী ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিয়ে বসে আছে। ল্যাপ্টপে একটা ভিডিও চলছে, সেই ভিডিওতে দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী ঋত্বিক একটা তারের সঙ্গে আরেকটা তার জুড়ে কিসব বানাচ্ছে। হাসনাত সাহেব বলেন, কী করছ দাদু?
ঋত্বিক দাদুর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলে, আচ্ছা দাদু, একটা লেখার মধ্যে কী কী থাকে?
কেন দাদু? বিষয়, চরিত্র, কাহিনী, প্লট; এইসব।
ঋত্বিক বলে, দাদু, আমি এমন একটা সফটওয়ার বানাতে যাচ্ছি, যেটা নিজে নিজেই গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস লিখতে পারবে। এই ধরো তুমি বিষয়, চরিত্র, প্লটগুলো ইমপুট করবে সফটওয়ারটি নিজে নিজেই গল্প লিখে ফেলবে। তাহলে তোমার আর কষ্ট করা লাগবে না। তুমি আর এভাবে অসুস্থও হবে না।
হাসনাত সাহেব ছলছল চোখে নাতিকে জড়িয়ে ধরেন।