মোহাব্বত আলী একজন ফ্রিল্যান্স প্রুফ রিডার। বাংলাবাজার নীলক্ষেতের কয়েকটা প্রেসের সঙ্গে তার যোগাযোগের সুবাদে সপ্তাহে অন্তত ২/৩ দিন কোনো না কোনো কাজ তার মিলেই যায়। একা মানুষ তিনি। চোখে নরম পাওয়ারের কালো মোটা ফ্রেমের চশমা। বয়স হয়ে গেছে ষাটের কাছাকাছি। বিয়ে থা করবেন বলে ঠিক করেও কোনো এক তুচ্ছ কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি। সেই যে, সেই বছরটা। তখনো শরীরের রক্ত এতটা ঝিমিয়ে পড়েনি। রাতের বেলা এখনকার মতো মাঝে মাঝে ক্ষয়কাশ আর বুকের ব্যথাটাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠত না। সেই বছর তিনি ঠিক করেছিলেন বিয়ে করবেন। তার আপন ফুপাতো ভাই নেকবর কাঠগোলা গ্রামে বিয়েও ঠিক করে ফেলেছিল। বিয়ের দিন মোহাব্বত আলী নতুন অতিথির জন্য ঘোমটা দেওয়া রিকশা সাজিয়ে রওনা হয়েছিলেন। পথিমধ্যে সে কী বৃষ্টি! বিয়ের পাঞ্জাবি তার ভিজে একেবারে চুপচুপে। নেকবর বলেছিল—মোহাব্বত ভাই, বিয়ার দিন বৃষ্টি ভালো লক্ষণ। বউ সংসারী হয়। মোহাব্বত আলী সেদিন মোট ৪০জন বরযাত্রী নিয়ে বিয়ে বাড়ি গিয়ে দেখেন তার সম্ভাব্য সংসারী বউ আরেকজনের সংসার করতে চুপিসারে বাবার সংসার ছেড়েছে। সেটাই ছিলো তার বিয়ের প্রথম এবং শেষ চেষ্টা। এখন মাঝে মাঝে বুকের মধ্যে কারও সঙ্গ পাওয়ার জন্য যে হু হু করে না, তা নয়। এইতো সেদিন রাতে প্রেস থেকে ফিরে আলু কাটার সময় অকারণে চোখ দিয়ে জল চলে এলো। তারপরও মোহাব্বত আলীর মনে হয় তিনি সুখে আছেন। পৃথিবীর সব মানুষ কেবল যৌথ মধুতেই ডুবে থাকে। যে ডুবুরি একা সমুদ্রে ডুব দিয়ে মন্থনমধু খুঁজে আনতে পারে, সেই আসলে লুটতে পারে একাকিত্বের মজা।
মোহাব্বত আলী থাকেন নাখালপাড়ায়। এলাকার প্রায় সবার কাছেই তিন মোটামুটি প্রিয়। অবশ্য নির্বিরোধী শান্তি প্রিয় মানুষেরা সবার কাছে সবসময়ই প্রিয় থাকে। এলাকার চায়ের দোকানদার থেকে শুরু করে মুদি দোকানদারও তাকে সম্মান করে। সমবয়সী লোকেরা মাঝে মাঝে ডেকে চা খাওয়ায়। উঠতি ছেলেগুলোও তাকে চাচা সম্বোধন করে। সেদিন বড় মসজিদের হুজুর যেমন সন্ধ্যায় রাজুর টি স্টলে চা আর পান খাওয়ার সময় ধোপধুরস্ত’ দাঁড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বলছিল—মোহাব্বত আলী বলতো আল্লাহ কেন পুরুষ মানুষ আর মেয়ে মানুষ ভাগ কইরা মাটির পুতলা বানাইল? তুমি পড়ালেখা জানা মানুষ, শিক্ষিত। কও দেখি কুদরতি এই কারবারটা কী?
রাজুর বানানো গরুর খাঁটি দুধের চায়ে চুমুক দিতে দিতে মহব্বত আলী হেসেছিল। আমার কি হুজুর এত জ্ঞান আছে? যে সৃষ্টি করে, সৃষ্টির উদ্দেশ্য শুধু সেই বোঝে। মনে হয় আল্লাপাক শুধু বংশগতির জন্য নয়, মানুষে লিঙ্গ ভাগ করেছিলেন কোনো একটা পরীক্ষা করতে।
বড় মসজিদের তসলিম হুজুর উপস্থিত সবার দিকে তার দরবেশি হাসি হেসে বললেন, জানতাম, তুমি মিয়া এই রকম কথাই কইবা। কঠিন ছাড়া তুমি মোহাব্বত সহজ করে কিছু বলতে পারো না। আল্লাপাক পরওয়ার দিগারের কুদরত বোঝা মানুষের কি সাধ্য! আর কিছু না বুঝি মিয়া, এইটুকু ঠিকই বুঝি মেয়ে মানুষেরে তিনি বানিয়েছেন পুরুষের বুকের বাম পাশের হাড় থেকে। মেয়েছেলে তাই পুরুষের ভেতরেই সৃষ্টি। মেয়েরা পুরুষের সঙ্গী হিসেবে আর তার সেবা করার জন্যই তৈরি।
হুজুর আমার মনে হয়, বিষয়টা ঠিক তেমন নয়। আল্লাহপাক পরীক্ষাপ্রিয়। তিনি তার নানা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে বান্দার পরীক্ষা নিয়েছেন বার বার। আমার মনে হয় আল্লাহপাক তার ভালোবাসা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্যই মানুষ সৃষ্টি করে তারপর ভাগ করেছেন পুরুষে, নারীতে। তাই সবার আগে আমরা মানুষ। তারপর পুরুষ ও নারী। আল্লাহ্ যদি ভালোবাসার পরীক্ষাই না করতেন, তাহলে নারীর প্রতি পুরুষের টান অথবা পুরুষের প্রতি নারীর মোহ তৈরি হতো না। শরীরের ভালোবাসা রক্তে রক্তে শিরায় শিরায় পৌঁছায় মনের চোরা কুঠুরিতে। যদি তা না হতো তাহলে অকারণ কেন কেউ কেউ শুধু ভালোবাসার জন্যই ফেরার হয়ে যায়? সে কি শুধু বংশ রক্ষার টানে!
মোহাব্বত আলী সব কিছু সহজ নয় এত। দুই কলম পড়ালেখায় কি সাধ্য বুঝবা উপরওয়ালার ইচ্ছা? তোমার সঙ্গে একটা মজা করলাম। তুমি কি ভাবছ, এই বিষয়ে আমিও কম জানি? শুধু তোমারে একটু বাজায়ে দেখলাম। কথা তুলতে দেরি, ঝুপ কইরা ধোইরা ফালাইতে তোমার দেরি নাই।
তসলিম হুজুর এমনভাবে কথাগুলো শোনালেন চায়ের দোকানে উপস্থিত সবাইও হেসে উঠলো। মোহাব্বত আলী নিজেও বোকার মতো হাসছিলেন। তা দেখে সবার মজা যেন তিনগুণ বেড়ে গিয়েছিল। হুজুরের গালে, সফেদ দাড়িতে তখনো কৌশলে টোপ ফেলে পুঁটি মাছের আশা করে রুই মাছ ধরার আনন্দ।
মহাবয়ান দাও মোহাব্বত আলী। মহাবয়ান। এত ছোটখাটো বয়ানে কি কাজ হবে?
দেব হুজুর, আমি একটা মহাবয়ানই লিখতেছি।
মোহাব্বত আলী তার টিনের ঘরটিতে রাতে ফিরে এসে প্রতিদিন কী যেন লিখতে বসেন। তখন যতটা না লেখেন সাদা ওই রুলটানা খাতাটায় কলম ছুঁইয়ে, ভাবেন তার চেয়ে বেশি। কী যে ভাবেন তিনি মোহাব্বত আলীর নিজেরও জানা নাই। কতসব আজগুবি ভাবনা। তিনি কূল-কিনারা খুঁজে পান না। শুধু জানেন, এটি তার একটা মহাবয়ান লেখার চেষ্টা। জীবন, দর্শন, বিজ্ঞান মিশিয়ে মোহাব্বত আলীর প্রকৃত বয়ান হবে সেটি। সেদিন নীলক্ষেতে মৌমিতা প্রিন্টার্সের মালিক মোস্তফা সেলিম মোহাব্বত আলীকে ডেকে বলছিলেন— মোহাব্বত সাহেব, আপনিতো মোটামুটি সব খবরই রাখেন। রাজনীতি বিষয়ে কী চিন্তা করেন?
মোহাব্বত আলী স্বভাবসুলভ লজ্জিত হাসি হেসে মাথা নেড়েছিলেন। আমি রাজনীতি বুঝি না, আগ্রহও নেই।
বলেন কী? রাজনীতির বাইরে মানুষ হয় নাকি? পৃথিবীতে কোন নীতি নিয়ে সব চেয়ে বেশি খেলতে মজা জানেন? রাজনীতি। আর আমাদের দেশের রাজনীতির মতো টুইস্টার কিছুতো সারাপৃথিবীতে নাই। দেখেননা একদল দেশটারে উন্নয়নে ভাসায় তো আর একদল ডোবায়। আবার ডুবন্ত দল ভাসতে ভাসতে পাল্টা প্লাবন ডাকে মরা গাঙ্গে। সব চাইতে উঁচু জায়গায় আছে রাজদণ্ড। সেটা ভাসেও না ডোবেও না। ওইটারে ধরার জন্যই তো এত মারামারি!
মোহাব্বত আলী সবার কথাই মনোযোগ দিয়ে শোনেন। মনোযোগী শ্রোতা হিসেবে তার খ্যাতি আছে। মোস্তফা সেলিম আবারও বলেন, আচ্ছা বুঝলাম, আপনি দেশের রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামান না। কিন্তু বিদেশি রাজনীতি নিয়ে তো ভাবেন? কমিউনিস্ট। পুঁজিবাদ, আমেরিকা, রাশিয়া, ইরাক, চীন, জাপান?
মহাব্বত আলী উত্তর দেন না। রাজনীতি যেন ভয়ঙ্কর একটা একচোখা সাইক্লপস। মোস্তফা সেলিম তাকে হারকিউলিকস সাজিয়ে ধাক্কা দিয়ে পাঠিয়ে দিতে চাইছেন ওটার সামনে—কী বলেন মোহাব্বত ভাই? দুনিয়ার আসল মজাগুলোই টের পান না। এত কিছুর ওপর বয়ান লেখেন, একটা বয়ান দেন।
সেলিম ভাই, রাজনীতিটা আমার কাছে যতটা না রাজার নীতি, তারচেয়ে বেশি পুরনো দিনের হাজামাজা ডোবার মতো মনে হয়। ওই ডোবার মধ্যে তাবৎ এই নীতিবিদরা ডুবিয়ে ডুবিয়ে শরীরে প্যাঁক কাদা লেপেন। যার শরীরে যত বেশি ময়লা কাদা, তার দেখি তত বেশি আনন্দ। নীতি এখন হতে হবে প্রজার। আমি নিজেও প্রজা তো। তাই প্রজার নীতি ব্যতিত ভালো লাগে না কিছু ।
ওই সময় ঘরে ঢুকেছিলেন লেখক কবি আবগার আওয়াল। আবগার আওয়ালের কবিতার বই ছাপা হচ্ছে মোস্তফা সেলিমের প্রেসে। আবগার আওয়াল মাঝে-মাঝেই এসে বসেন এখানে। তাকে দেখে কবি মনে হয় না কিছুতেই। বরং কোনো কোর্টের নামজাদা উকিলের মুহুরি হলেই তাকে ভালো মানাতো বলে মনে হয় মোহাব্বত আলীর।
কী ব্যাপার, কী নিয়ে কথা হচ্ছে? তিনি তার মুহুরি টাইপ হাসি হেসে বসে পড়েছিলেন চেয়ারে। আলোচনার বিষয় কী? শিল্প, সাহিত্য, রাজনীতি না কি নারীঘটিত!
মোস্তফা সেলিম নড়েচড়ে বসেন। আওয়াল আমাদের মোহাব্বত আলীর নাকি রাজনীতি নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই। সেটা নিয়েই কথা চলছিল।
তাই না কি মোহাব্বত সাহেব? এটাও কি একটা কথা? দিননা একটা বয়ান ঝেড়ে।
মহাব্বত আলী কেবলই হাসেন। আবগার আওয়াল আর মোস্তফা সেলিম যেন আরও মজা পান।
তা রাজনীতি সম্পর্কে না হোক, শিল্প, সাহিত্য, কবিতা সম্পর্কে তো আপনার অনাগ্রহ নেই। আচ্ছা বলুন তো গত এক দশকের কবিতায় আমিত্ববাদ আর পারিযায়ী দর্শন কার প্রভাব কতটুকু? আচ্ছা থাক। তার চেয়ে আসুন আলোচনা করি সমকালীন প্রোথিতযশা কবিদের কবিতায় রবীন্দ্র দর্শনের প্রভাব নিয়ে।
মহাব্বত আলী ঠিক কী বলবেন, বুঝে উঠতে পারেন না। কবিতা তিনি পড়েছিলেন সেই ছোট্ট বেলায়। বড় হয়ে শুনলেন, তার সেই সব কবিতা নাকি সব হয়ে গেছে ছড়া। তার মনে পড়ে নিজের শৈশবের কথা। টিনের চালা দেওয়া ঘরে দাওয়ায় বসে মা কুপির আলোয় কাঁথা সেলাই করতেন। পাশের বাঁশবাগানের ঝাড়ে যখন চাঁদ লুকোচুরি খেলতো তখন সেই ছোট্ট বালক মোহাব্বত আলী সাদাকালো ছবিওয়ালা ক্লাস টুর বইয়ে সুর করে কবিতা পড়তেন—
আচ্ছা মাগো বল দেখি রাত্রি কেন কালো
সুয্যি মামা কোথা থেকে পেলো এত আলো
ফুলগুলো সব নানান রঙের, পাতা কেন সবুজ?
এখন মোহাব্বত আলীর সেই ছড়া-কবিতার জন্য প্রাণ কাঁদে। তার সামনে বসে থাকা আবগার আওয়ালকে মনে হয় নিরেট বাটখারা। যে শব্দ মেপে মেপে দেখছে কবিতার ওজন কতটুকু হলো। তারপর ঝপ করে ফেলে দিচ্ছে তার ওপর। তিনি কবিতার নিচে চাপা পড়ে হাসফাঁস করছেন নিঃশ্বাস নিতে।
কী ব্যাপার মোহাব্বত ভাই, কথা বলছেন না যে? কী ভাবছেন? মোস্তফা সেলিম তাকিয়ে আছে তার দিকে। মোহাব্বত ভাই একটা অন্তত বয়ান দেন।
মহাব্বত ভাই, শিল্প, সাহিত্য এমন একটা জিনিস, যা না বুঝলে মানুষ পুরোপুরি আধুনিক হয় না। প্রতিনিয়ত পড়বেন। তাহলে, স্বর্ণ যেমন যত ঘষবেন, তত চকচক করবে তেমনি শিল্প সাহিত্যও মনের ঔজ্জ্বল্য বাড়াবে।
মোহাব্বত আলী মুখ খোলেন। কিন্তু মুখ থেকে লাজুক হাসিটা মুছে যায় না। আওয়াল ভাই, আমি আপনার কথার সঙ্গে একমত। আপনারা বড় বড় কবি সাহিত্যিক মানুষ। শিল্প সাহিত্যের মর্ম আমার চেয়ে আপনারাই ভালো বোঝেন। তবে কি, মনে হয়, শিল্পী যতদিন না শিল্পকে শৈল্পিক ভাবধারা না দেবেন, ততদিন ওটা নিশ্ছিদ্র শিল্পই রয়ে যাবে। শিল্পিত হবে না। শিল্পকে শৈল্পিক করতে চাই সরল ভাবধারা। কঠিন কথার ভার শিল্পকে অযথাই ভারী করে তুলছে বহুগুণে। তারচেয়ে মনে হয় সরল মনের শিল্প অনেক বেশি জীবন্ত, নির্ভার। দেখেন, আর্ট গ্যালারির বিমূর্ত ছবির চেয়ে আস্তাকুঁড়ে ময়লা খুটে খাওয়া কাকের চকচকে রঙ কত বেশি নির্ভার। কত বেশি সুন্দর। আর সাহিত্যের কথা বলছেন? সাহিত্যের পৌরহিত্য সবাই পারে না। পুরহিতের মনোযোগ দিয়ে যে সাহিত্য দেখতে পারে, লক্ষ্মী দেবী তাকে দুহাত ভরে সহজ সোনা তুলে দেন। বাকি সব ভং, মিথ্যা ছলাকলা।
মোস্তফা সেলিম চিৎকার করে ওঠেন শিশুর মতো। এইতো খুলছে। অবশেষে মোহাব্বত ভাইয়ের মুখ খুলছে। দারুণ, দারুণ মোহাব্বত আলী। দারুণ বয়ান। এক কাজ করেন, আপনি একটা মহাবয়ান লিখে ফেলেন। ছাপানোর দায়িত্ব আমার।
আবগার আওয়ালের হাসিও গালকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়। সত্যি মোহাব্বত ভাই, আপনি কেন যে কবিতা বা গল্প লেখেন না। লিখে ফেলেন একটা কষ্ট করে।
আউয়াল ভাই, কবিতা বা সাহিত্য যে আমি লিখতে পারি না, এত জ্ঞান কি আমার আছে? আমার দুনিয়াটা আপনাদের চেয়ে কত ছোট। এতেই আমি সন্তুষ্ট। তবে লিখব, একটা মহাবয়ান লিখে যাব।
মোহাব্বত আলী তার মহাবয়ান লিখতে বসেন প্রতিরাতে। কলমে কাগজ ছোঁয়ালেই কত ভাবনা এসে ভিড় করে। লেখা হয়ে ওঠে না কিছুই। মাঝে মাঝে তার মনে হয়—মৃত্যু যখন তাকে ডাক দেবে এপার থেকে তখন তার এই মহাবয়ান অলিখিতই রয়ে যাবে। কত দীর্ঘ হবে তার ভাবনা? মহাকালের মহাবয়ান কি তিনি ধরতে পারবেন তার ক্ষুদ্র কলমে?
সেদিন পুরো শহর জুড়ে বৃষ্টির তাণ্ডবে মোহাব্বত আলী নীলক্ষেত থেকে ভিজে একসা হয়ে নাখালপাড়া ফিরে এলেন। বাইরে তখন ক্রুদ্ধ মোষের গর্জন করছে বাতাস। বাড়িওয়ালা সুধীন্দ্র শীল তাকে কাক ভেজা হয়ে ঘরে ফিরতে দেখে এগিয়ে এলেন।
হায় ভগবান, কি ভেজাটা ভিজছেন? যদি ঠাণ্ডা লাগান এই বয়সে তাহলে কিন্তু সারানো মুশকিল হবে মোহাব্বত ভাই। সেবা যত্ন করারও কেউ নাই।
কিছু হবে না সুধীন্দ্র দা। আরে আপনিও তো ভিজে যাচ্ছেন। ঘরে যান। আমি ঠিক আছি।
আচ্ছা ঠিক আছে, লাগলে পরে ডাইকেন আমারে। সুধীন্দ্র শীল চলে যান।
মোহাব্বত আলী সাফসুতরো হন। তারপর ভাত চড়িয়ে দেন তেলকালি মাখানো চুলাটায়। ঘরের চালে বৃষ্টির শব্দ কমে এসেছে। মোহাব্বত আলী চুলায় চড়ানো ভাতের দিকে আনমনে তাকিয়ে থাকেন। আগুনের আঁচে ভাত ফুটছে। হঠাৎ মোহাব্বত আলীর মনে হয় তার জীবনটা আসলে সুখের। এই সুখ সব কিছু ছেড়ে থাকার সুখ। আর পৃথিবীর সব সুখের মূল কণা যেন লুকিয়ে আছে ওই ফুটতে থাকা ভাতের হাঁড়িতে। তার মনে হতে থাকে অন্য সব কথা। ফেলে আসা কথা, ফেলে যাওয়া কথা, সুখের কথা, দুঃখের কথা, নিজের যৌবনের কথা। তিনি যেন মহাবয়ানের জন্য প্রস্তুত। মোহাব্বত আলীর ঘোরের মতো মনে হয় সব। তিনি চৌকিতে বসে বের করেন তার রুলটানা খাতাটা। সেখানে কলম চলতে থাকে বাইরের ঝড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। মোহাব্বত আলী লিখতে থাকেন তার মহাবয়ান। নিজেকে কখনো বুদ্ধের মতো মনে হয়, কখনো মনে হয় সক্রেটিস। মনে হয় এথেন্সের এক উঁচু মঞ্চে দাঁড়িয়ে সমবেত জনতার উদ্দেশে বলছেন তিনি। পাশে দাঁড়িয়ে প্লেটো, ক্রিটো, ফিডো আর অ্যাপোলোডারাস। মোহাব্বত আলীর মনে হয় তার কানে কানে কে যেন বলছে বারংবার—নো দাইসেলফ। নিজের ভেতর লুকিয়ে থাকে সব সত্য। ধর্ম, শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান সব। তার কানে কানে যেন সক্রেটিস আবার জীবন্ত হয়। কণ্ঠস্বর পৌঁছে যায় গভীর থেকে গভীরে। তিনি যেন বলছেন—আমি চাই না, আমার শেষ কৃত্যের সময় অথবা আমার সমাধি প্রান্তে দাঁড়িয়ে কেউ মর্মাহত হয়ে বলুক, হায় কি নির্মম ভাগ্য!
বাইরে বৃষ্টি বাড়ছে। মোহাব্বত আলী তখনো লিখে চলেছেন। লিখতে লিখতে মোহাব্বত আলীর চোখ ঝাপসা লাগে। তবু লেখা হয় অবিরত—‘যদি বিধাতা পুরুষ জিজ্ঞেস করেন, ডান হাতে অনন্ত সুখের ও পূর্ণ জ্ঞানের ভাণ্ডার এবং বাম হাতে আছে সত্য সন্ধানের জন্য অনন্ত প্রয়াসের দুঃখ, বলো তুমি প্রসন্নচিত্তে কোনটিকে বেছে নেবে? আমি অবনত মস্তকে মহান বিধাতা পুরুষের কাছে বাম হাত চেয়ে বলব, হে পিতা, প্রমোদহীন পরিপূর্ণ জ্ঞান একমাত্র তোমারই জন্য। আমাকে তুমি দান করো সত্য সন্ধানের অনন্ত প্রয়াস।’
পরিশিষ্ট
বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল। সকালের সূর্য গত রাত্রির তাণ্ডবের জন্য লজ্জিত মুখে তখন ঠিকই ছিল পূর্বাকাশে। ছিলেন না শুধু মোহাব্বত আলী। সারাজীবন নিভৃতে কাটিয়ে দেওয়া মানুষটি জীবনের শেষসময়ও একাই করে গেছেন জীবনকে জয়। নতুন সে জীবন অনন্তের। ঘরময় তার ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল কাগজ। না, মোহাব্বত আলীর মহাবয়ান পাওয়া যায়নি সেখানে। শুধু একটা কাগজেই লেখা ছিল তার শেষ বয়ান—সর্বে সত্তা, সুখিতা ভবন্তু। জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক, মঙ্গল লাভ করুক।