ক
হামাগুড়ি দিয়ে সূর্যটা ওঠে, হাঁটে ধীরে ধীরে আকাশ দিয়ে, কচ্ছপের মতো। যেনতেন কচ্ছপের মতো নয়, ঈশপের কচ্ছপের মতো, যে কচ্ছপটা জয়ী হয়েছিল। ধীর কিন্তু জয়ী। সূর্যের হাঁটাটা ফিল্ডের বাজার থেকেও দেখা যায়। সূর্য সব জায়গার জন্য হাঁটে, ফিল্ডের বাজারের জন্যেও হাঁটে। পৃথিবীর যারা রাজা, তাদের জন্য সূর্যটা হাঁটে, যারা দাস তাদের জন্যও হাঁটে। যে অপমানিত হয়ে গেল আর যে অপমান করল, দুজনের জন্যই সূর্য হাঁটে। সূর্য হাঁটে এ বিশ্বহাটের সকল ক্রেতার জন্য এবং বিক্রেতার জন্যেও। হাঁটে মানুষের জন্য আর অন্য সকল জীব এবং জড়ের জন্যেও। সূর্যের হাঁটাটা ধীর, কোনো বৈচিত্র্য নেই, প্রতিদিন তার ওই একই পথ, এতটুকু এদিক ওদিক নেই, জয়ী কচ্ছপের মতো নির্দিষ্টভাবে এবং দিকে। পা পিছলে হড়কে পড়া নেই।
আর জগতে মানুষও বেড়েছে খুব, এদের আবার বৈচিত্র্যের শেষ নেই, চিত্রের শেষ নেই। মানুষেরা হাঁটতে হাঁটতে ভেঙে পড়ছে। দুশ্চিন্তায় বা হতাশায় ভেঙে পড়ে মানুষ। রোগের জ্বালায় ভেঙে পড়ে। আর চরম ভেঙে পড়া হচ্ছে মৃত্যুর মধ্যে পতিত হওয়া। মানুষের কাজই ভেঙে পড়া। জন্মানোর পর জীবের কাজ একটাই—মরা। মরবে বলেই তারা সবকিছু করে। বেঁচে থাকার ভেতর একজন মানুষ অন্য মানুষের ওপর, অন্য জীবের ওপর আয়ু ভোগের খেলা খেলে প্রতিটি শ্বাস দিয়ে। শ্বাসঘুড়ির সাথে শ্বাসঘুড়ির জটিল প্যাঁচ চলে। গাছের শ্বাসের সাথে চলে হরিণের শ্বাসপ্যাঁচ, হরিণের শ্বাসের সাথে সিংহের শ্বাস প্যাঁচ। আর মানুষতো সকল কিছুর শ্বাসসুতা ধরে আছে নিজের হাতে, এমনকি একটা মানুষ আর একটা মানুষের শ্বাসবাতাস দখল করে থাকে। একটা জীবন মানে একটা মৃত্যু। নিজের জন্য অন্যকে নিয়ে মানুষ ভাবনা শুরু করে, ভাবনার মাদুরে আয়েশ করে শুয়ে শুরু করে অন্যের প্রাণ পান করা, পৃথিবী পান করা। পৃথিবীর প্রতিটা জীব, অজীব একটা মানুষের কাছে নরম কাদা মাত্র। মানুষ চারদিক থেকে বিভিন্ন জীব-অজীব কাদা দিয়ে ভাবনার মূর্তি তৈরি করে। নিজের প্রয়োজন মতো অন্য মানুষের, অন্য জীবের বা অজীবের মূর্তিরূপ তৈরি করে, হত্যা করে বা বাঁচিয়ে রাখে আপন চিন্তার সুবিধা অনুসারে। ভাবনার পালা, পরিকল্পনার পালা শেষ হলে পর, বের হয়ে আসে নিজের চিন্তা সুড়ঙ্গ হতে, বের হয়ে আসে পৃথিবীর ভেতর তার বিমূর্ত ভাবনাকে মূর্তি দান করতে। সারা ঘণ্টার, সারাদিনের, সারাজীবনের কাজ এগুলোই মানুষের। ধ্বংস বা রক্ষার খেলায় নিজেকে সমর্পণ করা আর শেষে ভেঙে পড়া।
সূর্য দিয়ে ভাবনা শুরু করতে পারে একটা মানুষ অথবা চাঁদ দিয়ে। যেকোনো আলো দিয়ে। অন্ধকার দিয়ে কেউ ভাবনা শুরু করতে চায় না সহজে। কিন্তু সূর্যের কাজটা নগ্নতাকে দেখিয়ে দেওয়া এবং নগ্নতাহীনতাকেও। যখন কেউ কারও সামনে দাঁড়ায় ছুরি হাতে করে তখন একই সাথে সূর্য ছুরিওয়ালার পক্ষে এবং বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যায়। যাকে সে খুন করবে তার ঠিক কোন জায়গাটাতে ছুরি চালালে কাজ সহজ হবে তা দেখিয়ে দেয় সুতরাং সূর্য তার পক্ষেই গেল। আবার সে যে হত্যা করল সেটাও অন্য মানুষকে দেখিয়ে দিয়ে সূর্য তার বিপক্ষে কাজ করে। আবার, অন্ধকার সমস্ত মানুষের জন্য বোরকার মতো। লুকিয়ে থাকতে পারে এই বোরকার নিচে। কিন্তু সূর্য তা করতে দেয় না। অবশ্য মানুষ চালাক, কখনো কখনো সূর্যের আলোর ভেতরেও বেশ চলনসই অন্ধকার তৈরি করে নিতে পারে। আলোর ভেতর অন্ধকার তৈরি করে, মানুষ তার ভেতর সেঁধিয়ে থাকে। তারপরেও কিছু কিছু ফুটে ওঠেই।
আজ সকাল ১১টার দিকে যে মুরগিটা আদুরি ডোমনি নিয়ে গেল তা সবাই দেখতে পেল। লোকজন কলা বেচতে বেচতে দেখছিল এসব ঘটনা। পোল্ট্রি মুরগির ব্যবসা আর মাংসভোজ বছর পাঁচেক থেকে জমে উঠেছে। কারণ মুরগিগুলো নিজেদের খুব তাড়াতাড়ি মানুষের খাওয়ার উপযোগী করে তুলতে পারে। কম সময়েই বেশি পরিমাণ নরম নরম মাংস জমায় শরীরে। তবে এদের দোষও আছে, মরে যায় যখন তখন বিনা নোটিশে। ফিল্ডের বাজার বসে খাস জমিতে। এ বাজার সরকার গুঁড়িয়ে দেবার পর পোল্ট্রি মুরগির বাজার সরে গিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই নেয় আমতলাতে। মানুষ ঠিকই খুঁজে নিয়েছে মুরগির ঠিকানা। আর যখন মুরগিটা মোজাম্মেলের হাত ফস্কে পড়ে গেল আর আদুরির কপাল তা ফস্ করে লুফে নিল তখন ইচ্ছে করলে সূর্যটা ডুবে যেতে পারত কিন্তু তা করল না। গনগনে আগুনের মত মাঝ আকাশে থেকেই গেল।
সুখ অনুভূতি তাকে একধরনের গাম্ভীর্য দান করে
মোজাম্মেল দোকানদারের উদ্দেশ্যে বলল—‘তুই ওজন করার পর মুরগিটাকে চালিয়ে মেঝেতে ফেলেছিলি, তাইতো এমন হলো—মুরগি মরে গেল।’ মালেক দোকানদার তার অকাট্য যুক্তি নিক্ষেপ করে তখনই, শুধু মোজাম্মেলের ওপর না, যারা কলা বেচছিল আর রথ দেখছিল এমন সব মানুষের ওপরেই। মানুষজন তার যুক্তির বাণে বুক চেপে ধরে ‘আহা হা হাঁ হ্যাঁ কথা ঠিক।’ মোজাম্মেলের হাতে মরা মুরগি ঝুলছে। চার কেজি ওজনের মুরগি। সে মুরগিটা নিয়ে বাড়ির দরজার কাছে পৌঁছেই গেছিল। দরজায় নক করতে যাবে এমন সময় দেখে মুরগি ওফাতপ্রাপ্তা। সে দরজায় নক না করেই ফিল্ডের বাজারে ফিরে আসে। ফিরে আসার পর এই বচসা শুরু। গুমোট গরম নেমেছে। এমন গোঁয়ার গরম তার ওপর তীক্ষ্ম রোদ। যারা কলা বেচছিল তারা এবার একটু সক্রিয় হয়। যেন এই রোদ আর গরমের তেজের কারণে রণে ভঙ্গ না দেয় মুরগিখোর আর মুরগিদোকানি। একটা বন্ধ দোকানের চালার নিচে তাদের টেনে নিয়ে গিয়ে বচসার সূচনাটা আবার করায় এককলা বেচা—‘হ্যাঁ কী হয়েছিল ভাই? আপনার কি মনে হচ্ছে মুরগিটা মারা যাবে জেনেই মালেক দোকানদার বিক্রি করেছিল?’ প্রশ্নটা মোজাম্মেলের কানে কোনো ক্রিয়া করার আগেই মালেক প্রতিবাদ করে। মোজাম্মেলকে কোনো কথা বলতে না দিয়েই তার মোম যুক্তির তীরটা ছাড়ে—‘আরে ভাই মানুষেরই গ্যারেন্টি নাই আবার মুরগির গ্যারান্টি। আপনিই যে জিন্দা বাড়ি ফিরতে পারবেন, নিশ্চয়তা আছে?’ ঠিক এই সময়েই মানুষজন তার এই যুক্তির থাবায় ব্যথা পেয়ে বুক চেপে ধরে, ‘আহা হা হাঁ হ্যাঁ কথা ঠিক’ বলে মালেক দোকানদারকে ভোট দিয়ে দেয়। হঠাৎ করে জোটা এসব বিচারকের ভোট নৌকা বা ভোট ধান বা ভোট মুদ্রা পেয়ে সুখী হয়ে ওঠে মালেক দোকানি। এ সুখ অনুভূতি তাকে একধরনের গাম্ভীর্য দান করে।
মোজাম্মেলের হাত টনটন করছে। ঘণ্টাখানেক ধরে সে চার কেজি ওজনের মুরগিটার পা দু’খান ধরে আছে। মুরগির পা ওপরে আর মাথা নিচে অর্থাৎ মুরগির মাথা নিচের দিকে আছে আর পা আছে ওপরের দিকে। মুরগির পা মোজাম্মেলের হাতে। ফিল্ডের হাঁট থেকে তার বাড়ি কিলোমিটার। এর ভেতর মুরগিটা কখন মরেছে তার চার কেজি ওজন নিয়ে তা বুঝতে পারে না সে। শুধু এটুকু জানে যে মালেকের থেকে যখন মুরগি নেয় তখন সেটি জিন্দা ছিল। কিন্তু কখন যে মুরগিটা চার কেজি মাংসকে হত্যা করেছে সেটা সে বুঝতে পারেনি। কারণ জীবিত মুরগির মরে যাওয়ার পর ওজনের তারতম্য হয়নি। হলেও সে বুঝতে পারেনি। পরীক্ষাটা করতে পারলে ভালো হতো। হতে পারে মুরগিটা তার চার কেজি মাংস খেয়ে ফেলেছে মালেকের দোকান থেকে নেওয়ার দু’কদম বা বিশ কদম বা চল্লিশ কদম হাঁটার পরই। অথবা বাড়ির দরজার কাছে পৌঁছানোর শেষ ধাপটি নেওয়ার সময় মরে গেছে ছয়শ টাকা। পথে যেতে যেতে অনেকেই মুরগির দাম জিজ্ঞাসা করেছে। তারা হয়তো মরা মুরগির দাম জিজ্ঞাসা করেছে আর মোজাম্মেল জিন্দা মুরগির দাম জিজ্ঞাসাকারীকে বলেছে। অথবা কোনো লোক যখন জিজ্ঞাসা করেছে তখন মুরগিটা জিন্দা এবং মোজাম্মেল যখন মুরগিটার দাম বলছিল তখন মুরগিটা মৃত। সুতরাং জিজ্ঞাসাকারী জিজ্ঞাসা করেছে জীবিত মুরগির দাম আর সে দাম বলেছে মৃত মুরগির। এসব ভাবনার কারণে বা অন্যকোনো কারণে বা অকারণে মোজাম্মেল যে অযথাই একটি চার কেজি ওজনের মৃত মুরগি হাতকে ব্যথা দিয়ে ধরে আছে তা বুঝতে পারে না। এ ব্যাপারে বোধশূন্য হয়েই সে ধরে আছে। মৃত মুরগির আর কোনো কাজ নেই। হাত বদল করার সময় মৃত মুরগিটা মৃতচোখে, মৃততাকানো একটু তাকাল। সে মরে গেছে বলে লোক দুটো ঝগড়া করছে, ভাবতে খারাপ লাগছে না তার। আদুরি ডোমনি মুরগির দিকেই তাকিয়ে আছে। মুরগির শরীর ঠাণ্ডা হয়ে, পা আর ঘাড় শক্ত হয়ে আসছে। এমন সময় আকাশে মেঘ দেখা দিলে সবাই আকাশের দিকে তাকায়, বচসার মূল মাঠ সরু রাস্তায় ফিরে এসে দাঁড়ায়। কোনো কোনো কলা বেচা ফিরে যেতে চাইছে। এখানে তিনজন মানুষ শুধু কলা বেচা নয়। দোকানি, মোজাম্মেল আর আদুরি ডোমনি। আদুরি ডোমনি রথ দেখতে এসে কলা বেচল। মেঘ ঘনিয়ে এলে তড়িঘড়ি করে দাঁড়ানো মানুষজন রায় দিয়ে বসল—‘দোকানির কোনো দোষ নাই। মোজাম্মেল টাকা ফেরত পাবে না।’ মোজাম্মেল ভেবেছিল অর্ধেকও যদি পাওয়া যেত— ভালো হতো। মরা মুরগি সে ধরেই আছে। মুরগিটা মোজাম্মেলের চার কেজি মাংস খেয়ে নিয়েছে, টাকাটা গচ্চা গেল।
খুব দামি মুরগি, খুব দাম এ মুরগিটির
মুরগিটা ভাবতে পারল—‘তার জীবন তেমন কিছু নয়। তার জীবনের ওপর নির্ভর করছে দোকানি আর ক্রেতার সম্পর্কের ভালোমন্দ।’ এবার তার দাফন কেমন হবে, এ নিয়ে চিন্তিত হয় মৃত মুরগি। ঘাড় শক্ত হয়ে ত্যাড়া হয়ে গেছে মুরগিটার। রায় হয়ে গেলে দোকানি ফিরে যায় তার দোকানে। মোজাম্মেল সবার চলে যাওয়ার পরই দাড়ি চুলকায় বাম হাত দিয়ে আর চালাক চোখ দিয়ে সম্ভবত কোনো ফন্দি আঁটে—‘কোনো একদিন কিভাবে এই দোকনদারকে বাগে পাওয়া যায়।’ দোকানির চলে যাওয়ার পথের দিকে চেয়ে থেকে যখন দেখল, দোকানি অস্ত গেছে তখন প্রথমবারের মতো সে মুরগির দিকে তাকাল আর হাতের টনটনে ব্যথা অনুভব করল। মরা মুরগি খাওয়াতো হারাম বটেই এতক্ষণ যে ধরে আছে, একথা চিন্তা করে তার শরীর ঘৃণায় ভরে গেল। মুরগিটা কোনোদিকে ছুড়ে ফেলবে এমন ভাবনা নিয়ে এদিক-ওদিক তাকানোর সময় দেখল আদুরি ডোমনি তার শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে তার দিকে আসছে। সে এসে মরা মুরগিটা চাইল। দাড়ি চুলকিয়ে সরু চোখে তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল আর মৃত মুরগির স্বর্ণশরীর আর আদুরীর মাংসের শরীরের তুলনা করে ফেলল নিমিষেই। আদুরি ডোমনি মুরগির এবং তার মাংসের একটা তুলনামূলক আলোচনায় মোজাম্মেলের সাথে যোগ দিল এবং মাংস সম্পর্কিত মৌখিক একটা চুক্তি করে ফেলল। মুরগি রান্না করার মশলার জন্যেও কিছু টাকা যুক্ত হলো মাংস বিষয়ক চুক্তিতে। আদুরির ছেলেটা খুসি হয়ে ছোট হাতে মুরগিটা ধরে তার মায়ের সাথে হাঁটতে লাগল। মুরগিটা জানতে পেরেছিল তার মাংস মানুষের জন্য। মানুষেরা বৃক্ষ থেকে ফল পেড়ে খায়। নদী থেকে মাছ তুলে খায়। মানুষেরা মুরগির খামার, গরুর খামার করেছে। একটা গরু মানে একটা মাংসবৃক্ষ, একটি মুরগি মানে একটি মাংসের গুল্মবৃক্ষ। জবাই করে মারা যাওয়ার পর মানুষের পেটে সৎকার হয় মুরগির কিন্তু জবাইহীন মরে যাওয়ার পর মানুষের পেটে তার সৎকার হবে—এ কথা ভাবতে পারেনি। আদুরি ডোমনি চার কেজি ওজনের মুরগির স্বর্ণশরীর নিয়ে যাওয়ার সময় একবার আকাশের দিকে, একবার মুরগির দিকে আর একবার মোজাম্মেলের দিকে চেয়ে দেখল। আকাশের দিকে তাকানোর সময় সে তার পাকে চিন্তা করালো—একটু জোরে হাঁটতে হবে, আকাশে মেঘ করেছে। মুরগির দিকে তাকানোর সময় সে ভাবতে পারল—অনেকদিন পর আজ মুরগির মাংস খাওয়া যাবে। মোজাম্মেলের দিকে তাকানোর সময় সে একটু হাসে এবং মুখ ফিরিয়ে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস নিক্ষেপ করে। হাসি আর দীর্ঘশ্বাসের মিশ্রিত অভিব্যক্তি থেকে মোজাম্মেল শুধু ছেঁকে হাসিটুকু গ্রহণ করতে পারে এবং সেও এক চিলতে কামমাখা হাসি তাকে দেয় এবং এই হাসিটা তার গোঁফদাড়ি চুঁইয়ে বাতাসে ব্যাপিত হয়। মনে মনে খুশি হয়েই মোজাম্মেল আর একটা মুরগি কিনে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরল। মালেক দোকানি তার কাছে আর মুরগি বিক্রি করেনি, অন্য দোকান থেকে সে মুরগি কিনেছে।
এত বড় একটা মুরগি নিয়ে অল্প একটু হেঁটে যেতেই আদুরির ছেলেটির কচি হাত টনটন করে ওঠে। ‘খুব বেশি ভারী মুরগিটি’ বাচ্চাটি ভাবতে পারল। ‘মুরগিটি দুনিয়ার ভারী’ একথা বলে বড়-বড় চোখ করে তার মায়ের দিকে এগিয়ে দেয়। মরা মুরগি আদুরি ডোমনির দিকে এগিয়ে যায়। আদুরি ডোমনি হাতে নিয়ে মুরগির ওজনের কথা চিন্তা করল আর ভাবলো—‘খুব দামি মুরগি, খুব দাম এ মুরগিটির’।
খ.
মুরগির স্বর্ণমাংস মাটির হাঁড়িতে টগবগ করে ফুটছে, আদুরির কালো মুখে লাল আগুনের আঁচ। ঘর্মাক্ত মুখ। হাঁড়ির ঝোলে তার মুখের ছায়া পড়ছে। আদুরির মুখের ছায়াসহ মরা মুরগি ফুটছে, মাঝে মাঝে মুরগির মাংস হাঁড়িতে পড়া আদুরির ছায়াকে ঠোঁকর পাড়ছে। তার মুখের ছায়ার মাংস আর মুরগির মাংস মিশে একাকার। এবার একটা চামচে আদুরি তার মুখের ছায়াসিদ্ধ আর মরা মাংসের ঝোল তুলে স্বাদ চেখে দেখে, ‘বেশ স্বাদ হয়েছে’ এমন নিশ্চয়তা পেয়ে নামিয়ে রাখল। নীলন্ত ডোম তার বউয়ের মুখের ছায়ার মাংস আর মরা মুরগির মাংস দিয়ে ভাত খেয়ে বেরিয়ে গেল কাজে। বাচ্চাটা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। বৃষ্টি হব হব করে হয়নি। রোদ থেকে মেঘ, মেঘ থেকে রোদ, এভাবেই চলছে। নীলন্ত ডোম বাইরে যাবার পর, বাচ্চাটা ঘুমিয়ে যাওয়ার পর, আদুরি খেতে বসেছে। সে ভাত খাচ্ছে তার মুখের মাংস আর মুরগির মাংস দিয়ে। মুরগিটা ভাবতে পারল তার মাংস এখন পর্যন্ত তিনজনের পেটে সৎকৃত হয়েছে। আদুরি খাওয়া শেষ করে উঠেছে। তার ঠোঁটে আর ঠোঁটের চারধারে মুরগির ঝোলের তেলতেলে হলদে ভাব লেগে আছে। মোজাম্মেলের জুতো মচমচ করে উঠল। মোজাম্মেল তার কালো জুতোর তলাতে সূর্যটাকে লুকিয়ে ফেলেছে। আদুরি হাত ধোবার সময়ও পেল না। পাশের দড়ির খাটে মোজাম্মেলের চুক্তিকুস্তির আহ্বানে সাড়া দিতে হলো। মুরগিটার সামান্যতম মাংসাংশ যখন আদুরির দাঁতের ফাঁক থেকে উন্মত্ত চুম্বনের সাথে মোজাম্মেলের ভেতরে যেতে থাকল তখন মুরগিটা ভাবতে পারল তার মাংস সৎকৃত হলো চারস্থানে। আদুরি হাসতে হাসতে পরনের শাড়ি সামলে নিল আর মোজাম্মেল দাড়ি সামলে বাড়ি ফিরে গেল। ‘তুমি মুখ না ধুয়ে কোথায় বেরিয়ে গেছিলে, মুখে মুরগির ঝোলের তেলতেলে হলদে দাগ লেগে আছে’ বলতে বলতে মোজাম্মেলের বউ বদনায় পানি আর সাবান এগিয়ে দিল মোজাম্মেলকে। ‘মোজাম্মেল দুপুরে খেয়ে, বাড়ি থেকে বেরিয়ে, প্রায় অর্ধ কিলোমিটার হেঁটে ফেলেছে’ দাড়ির গায়ে তেলহলুদে লেখা এ বাক্য পাঠ করতে পারল না মোজাম্মেলের বউ।
এ কি আমার মুখ কোথায় গেল
আদুরির ছেলেটা ঘুম থেকে উঠে তার মাকে ডাকল—‘মা, মা।’ ‘কী হয়েছে বাবা, ঘুম থেকে উঠে গেছ?’ বলে আদুরি ডোমনি তার ছেলের কাছে গেল আর ‘ওরে আমার সোনা, ওরে আমার ধন’ বলে কোলে নিয়ে আদর করতে লাগল। তার ছেলেটি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে, সে বলল—‘মা, তোর মুখ কই? মুখের জায়গাতে, আমিতো তোর মুখ দেখতে পাচ্ছি না।’ আদুরি বলে—‘ঘুম থেকে উঠেছ তো বাবা তাই তোমার এমন মনে হচ্ছে, এসো তোমার মুখ ধুয়ে দেই।’ আদুরি ডোমনি তার ছেলের মুখ ধুয়ে দেওয়ার জন্য এক বদনা জল নিয়ে বসেছে, এমন সময় তার স্বামী নীলন্ত ডোম বাড়িতে আসে। সেও অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে আদুরির দিকে—‘কী ব্যাপার তোমার মুখ কই?’ ছেলের প্রশ্নটাই ছেলের বাবার মুখেও শুনে মনে একটা খটকা লাগে আদুরির। খটকাটাকে এক ঝটকায় ছিঁড়ে ফেলে, আদুরি বলে—‘আজকে মেলাই মদ গিলেছ মনে হয়, নেশা ছুটুক তখন আমার মুখ দেখতে পাবে।’ নীলন্ত ডোম তার দিকে তাকিয়েই আছে, বাচ্চাটা তার দিকে তাকিয়েই আছে। সে তার ছেলের মুখ ধুয়ে দেয়। এরপর সে ঘরে গিয়ে নিজে চুল আঁচড়ানোর জন্য আয়না সামনে নিয়ে বসে। ‘এ কি আমার মুখ কোথায় গেল!’ সে টলমল পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল কি না দেখতে পাওয়া গেল না, কারণ, ততক্ষণে সূর্য তার ফিল্ডের বাজার হাঁটা শেষ করেছে, অন্ধকার পরে নিয়েছে সময়।