তখন ঘোরলাগা ভোরের অপেক্ষা।
মহাভারতের মুনিবর ছিলেন মৃগীপুত্র ও একশৃঙ্গধারী, হরিণের মতো নাকি তার শিং ছিল, মানুষের শরীরে হরিণের শিং কেমন হতে পারে ভেবে তুমি ঘুমের ভেতর ইঁদুর হয়ে যাওয়া ক্লান্তিহীন রাত্রির শেষকালে প্রমোদের রা-রা বুকে নিয়ে বাড়ির উত্তর দিকে হাঁটতে শুরু করলে। যতই উত্তরে যাও কুয়াশা বাড়ছে, যত বেশি কুয়াশা তত বেশি সজলতা। পাহাড়ে হেমন্ত বলতে শুধু রক্তবর্ণ ঝরা পাতা নয়, মেঘ বৃষ্টিও কখনো। এদেশে বরফ না পড়লেও পার্বত্য বনুভূমির কাছে এগিয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে তুষারপাতের আসন্নতা তোমার মনে পড়ে। তুমি জানো না, কেন শুধু একা এগিয়ে যাচ্ছ উত্তরে, একশৃঙ্গধারী মুনিবরের মতো ঋষি হতে চাও? নাকি দেয়ালের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছ বলে অরণ্যকে প্রাচীর মনে করে সবুজের ভেতর পিছলে যেতে চাও? নাকি চলাচল আর উদ্যমের ভেতরই তোমার জীবন? তুমি জানো না, কিংবা সকাল বেলায় তোমার সেটা জানা সম্ভব হয় না। অন্যসব মানুষের মতোই তুমি ভ্রান্ত। গলায় ফুলের মালা ঝুলিয়ে রৌদ্র আর সৌরভ উদযাপন যায় না জেনেও তুমি বিরল আলো, বহুবিধ রঙ আর নির্জনতাকে কোমল করে বাঁচতে চাও।
কুয়াশায় কখনো কখনো মধ্যদিনেই সন্ধ্যা নামে, মাছের মতো মোলায়েম আবহাওয়া তোমাকে উদ্যমী করে। তুমি ভাবতে থাকো ক্রমাগত: একশিং শব্দের সমার্থক শব্দ হিসেবে ইংরেজিতে ‘য়ুনিকর্ন’ ব্যবহার করেছেন এক মার্কিনি কবি। জাপানি সাহিত্য কিংবা আমেরিকান, সবখানেই একশৃঙ্গ আছে। মনিবরের কথা নাকি তৎকালীন নিপ্পন পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। তুমি ভাবতে পারছ না, কীভাবে সব মিলে যায়। চলতে চলতে ভাবনার ভেতর এখন তোমার প্রশ্ন, এই যে ইংরেজি লোককথায় ‘য়ুনিকর্ন’ (লাতিন Uni-, এক + corn, শৃঙ্গ) একশৃঙ্গধারী শ্বেতবর্ণ অশ্বাকৃতির কাল্পনিক জন্তু, খ্রিষ্টান লোকশিল্পে পবিত্রতা এবং কৌমার্যের প্রতীক, তার সঙ্গে ঋষ্যশৃঙ্গের কোনো সম্পর্ক আছে কি না। কলাম্বিয়া বিশ্বকোষ বলছে ‘য়ুনিকর্ন’-এর উৎপত্তিস্থল ভারতবর্ষ, শর্টার অক্সফোর্ড অভিধানে দেখেছ ইহুদি পুরাণের ‘য়ুনিকর্ন’ ছিল বন্য বৃষ।
পরবর্তীকালে শব্দটি নাকের ওপরে শিংঅলা প্রাণী গণ্ডারের (গ্রিক rhino, নাক + keros শিং) অর্থেও ব্যবহৃত হতো। এদিকে মনিয়র-উইলিয়ামস-এর সংস্কৃত অভিধানে দেখেছ ‘শৃঙ্গ’ শব্দের নানা অর্থের মধ্যে একটি হলো শক্তিমত্তা বা কামোচ্ছ্বাস। ‘শৃঙ্গার’-এর (রতিক্রিয়া) আক্ষরিক অর্থ হলো শৃঙ্গধারী। প্রত্নতত্ত্বের বইতে তুমি দেখেছ, মোহেঞ্জোদারোর কথা, যেখান থেকে পাওয়া দুটি সিলমোহরে একটি একশৃঙ্গধারী চতুষ্পদ জন্তু চিত্রিত আছে। কিছুটা অশ্বাকৃতি কিন্তু পুরোপুরি নয়, তার পুরুষাঙ্গ বৃষের মতো সুচিহ্নিত বলে লেখক তাকে উদ্ধৃতিচিহ্নের মধ্যে রেখে ‘য়ুনিকর্ন’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। সবকিছু মিলিয়ে হরিণ নয়, গণ্ডার কিংবা তোমার সঙ্গে মিলে যায়। এশিয়ার প্রচলিত আছে যে, গণ্ডারের শিং গুঁড়ো করে খেলে যৌনক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, আর ইউরোপে বলা হয় গণ্ডারের শিং বিষের প্রতিষেধক। যৌন ক্ষমতা বৃদ্ধির খবর তোমার করটিতে কিছুক্ষণ সুড়সুড়ি দিয়ে মস্তিষ্কের এককোণে স্থায়ীভাবে শুয়ে থাকতে চায় কিংবা চেষ্টা করে।
অথচ ভোরের বেলা ওই কৌতূহলের অনুপ্রেরণায় নিজেকে বা আগুন্তুককে কিংবা সেই কৌতূহলকে খুঁজতে গিয়ে ডুবো পাথর পার হয়ে রাত্রি চিরে দিনের পর দিন পেরিয়ে ঘাসের শরীর মাড়িয়ে তিব্বতের পবিত্রতা তোমার একান্ত করে নিয়েছিল। স্বপ্ন পূরণ হয়ে গেলে উদ্যম কমে যায় কিংবা হতাশা গ্রাস করে কি না তোমার জানা নেই। এখন তুমি শুধু অপেক্ষা করো একটি সুন্দর ঘুমের।
এদিকে আরোগ্যের কথায় য়ুনিকর্নের সঙ্গে ঋষ্যশৃঙ্গের সম্পর্ক আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে—তিনিও মহাচিকিৎসক, তার স্তম্ভিত বীর্য স্খলিত হওয়ামাত্র প্রকৃতি আবার প্রজননশক্তি ফিরে পায়। যে শৃঙ্গ যৌনতার প্রতীক, তাই-ই রূপান্তিত হলো কৌমার্যের চিহ্নে, আবার সে গণ্ডারের মতো প্রাণীর নাকের ওপর প্রতীয়মান, যেন তোমারই প্রতিচ্ছবি। তবু তুমি ভাবতে গিয়েও অবাক হচ্ছ না, কেননা মানুষের কল্পনায় এই ধরনের বৈপরীত্য-আরোপ সহজেই ঘটে।
হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে ভাবতে তুমি লক্ষ করলে তোমার করোটিতে লালচে চিন্তার মতো সামনে অফুরান পাহাড়ের গিরিখাত। তুমি চলছ, দুলছ, কাঁপছ আর ভাবছ। যতটাই চলছ, ততটাই হারিয়ে যাচ্ছ। পাহাড়ের প্রাথমিক পর্যায়ে তুমি ভাবছ ওপরে তোমাকে উঠতে হবে। কুকুরচূড়া, পরশপিপলু আর কুরুক ফুলে ছেয়ে আছে চারপাশ। একটা ছোট ঘর দেখলে, ছাউনি দেওয়া গোলপাতার মতো পাতা দিয়ে, বেড়ায় কস্তুরিলতা বেয়ে উঠেছে। এখানে কি কোনো ঋষি থাকেন? তুমি নিজের কাছে উত্তর না পেয়ে, শিশুর মতো আবার চলতে শুরু করলে।
পাহাড়ে ভেতর দিয়ে সরু নদী, নদীর ধারে-ধারে পাহাড়েরা সারবেঁধে দাঁড়িয়ে, সবুজ পাতা হয়ে ওঠে লাল, তুমি হেমন্তের গান গাও কিংবা লুকিয়ে পড়ার খেলা খেলতে চাও। কিন্তু তুমি আসলে লুকোতে পারো না। কেউই নাকি তা পারে না। কোথায় লুকোনো যায়, কেউ হয়তো জানে কিংবা জানে না। ঘাসের দরজা খুলে তুমি এগোতে থাকে। সন্ধ্যা নেমে যেতে থাকে, কুয়াশা কমে আসে। দ্বিতীয়ার চাঁদ ভুরুর ভঙ্গির মতো করে আকাশে আঁকা—অঙ্গে যেন সাদা ঝালর মখমল, কস্তুরিপাতায় অল্প জমেছে শিশির, বিকেল নাকি সন্ধ্যা, কুয়াশায় ভালো করে বোঝা দায়, তোমার মাথার ওপরে হেমন্তের আকাশ জুড়ে গাভীর মতো চরে বেড়াচ্ছে পাহাড়ি পাখির দল। পাতলা স্বচ্ছ কুয়াশা ভেদ করে চিকন চাঁদের সঙ্গে ফর্সা হাওয়া করোটির ভেতর সুড়সুড়ি দিলে তোমার বড় হাসি পায়। তোমার মুখের হাসি আঠালো বলে জোরে হাসতে পারো না, কিন্তু দুধেল আলোর নিচে তোমার ভাবনা এলিয়ে পড়ে। তুমি হাঁটো কিংবা হাঁটতে চাও না। বীজের আবেগে একদিন নিটোল আপেল উজ্জ্বল হয়ে ওঠার মতো শেষমেষ তুমি আর না-চলার সিদ্ধান্ত নাও।
সত্য-মিথ্যার ঘটনাকে আপেক্ষিক ধরে নিয়ে সিদ্ধান্ত বদলাও: চলাচল মানেই শুধু বেঁচে থাকা নয়, অপব্যয় পেরিয়ে আগুনে ভেসে যাওয়া গভীর ঘুমও হতে পারে বেঁচে থাকা। একশৃঙ্গের কথা তোমার মাথায় এলে তুমি বদলে তাকে বহুশৃঙ্গ করে ফেলো। ‘ক্লান্তি নাকি চিন্তা’ এই সংশয় তোমাকে বহুবিধ চিন্তার ভেতর ফেলে চেনাফুলের গন্ধ বাঁধনের ভেতর থেকে বেরিয়ে শোনা আর বোঝার ফারাক বাতলে দেয়, কিন্তু তুমি তা বুঝতে পারো না, শুধু দৃশ্য হত্যার স্বরকম্পনে বসে পড় এবং কয়েকগজ দূরেই আরেকটি কুটির তোমার নজরে আসে। যেকোনো আশ্রয়েই আক্রমণ আসতে পারে বলে তুমি নিজেকে আর সতর্ক করো না। যে অমূল্য কৌতূহল তোমাকে কুটিরের কাছে এগিয়ে নিয়ে যায় তাকে শূন্য কিংবা মহাশূন্যে অর্পণ করলে মুহূর্তরা মুহূর্তের শত্রু হয়ে ওঠে কিনা তোমার জানা নেই বলে তুমি এগিয়ে যাও—মৃত্যুর মতো কৌতূহল চলাচল হয়ে বাঁচিয়ে রাখে কিংবা তুমি বেঁচে থাকো এবং এগিয়ে যাও। কখনো পৌঁছে যাওয়ার বাসনাও সত্য হয়।
তখন বিকেলটা একেবারে পড়ে গেছে। সন্ধ্যাকে হিরণবর্ণে চেখে দেখার বদলে তুমি কুটিরের দরজা ধীরে সরাও। ভেতরের অন্ধকার থেকে কলা আর কাঁচা নারিকেলের লুকোচুরি গন্ধ বুদবুদ শব্দের মতো তোমার নাক আর পাকস্থলীর গভীরে খোঁচা দেয়। ক্রমশ আকাশ হয়ে আসে তোমার বিবিধ চিন্তা। ক্ষুধার কাছে দুরন্ত জলরাশি, উদ্যান, তরল হয়ে আসে নির্ভেদ, কনকবর্ণ।
তুমি বসে থাকো ছোটো ঘরের খোলা দরজার কাছে, কেউ হয়তো আসে কিংবা অন্ধকার তোমার সঙ্গী হয়। খড়ের ছাওয়া সেই কুটিরের পাশে সন্ধ্যার প্রাক্কালে নিজেকে খুঁজে পাও চারপাশে উঁচু বনের গাড় সবুজ প্রাচীর দিয়ে ঘেরা একফালি উঠানের মতো ঘাসের ওপরে। কিছুক্ষণ পর অন্ধকার থেকে বাবলা ফুলের নতুন হলুদের মতো তোমার সামনে প্রতীয়মান হয় মুনিবর বা মনি, অথবা একজন নতুন মানুষ, আগুন্তুক কেউ, বা যাকে তুমি খুঁজে ফিরছ কিংবা সেই ঋষি। কিন্তু আগের মতো এ ব্যাপারে তুমি কৌতূহল হারিয়ে ফেলো। গোলাপের শরীরে ভাঁজের মতো স্নিগ্ধ কৌতূহল যেন মাউথ অর্গানের শব্দের মতো উড়ে গেছে। অথচ ভোরের বেলা ওই কৌতূহলের অনুপ্রেরণায় নিজেকে বা আগুন্তুককে কিংবা সেই কৌতূহলকে খুঁজতে গিয়ে ডুবো পাথর পার হয়ে রাত্রি চিরে দিনের পর দিন পেরিয়ে ঘাসের শরীর মাড়িয়ে তিব্বতের পবিত্রতা তোমার একান্ত করে নিয়েছিল। স্বপ্ন পূরণ হয়ে গেলে উদ্যম কমে যায় কিংবা হতাশা গ্রাস করে কি না তোমার জানা নেই। এখন তুমি শুধু অপেক্ষা করো একটি সুন্দর ঘুমের।
আরও পড়ুন: ভদ্রমহিলা ॥ নুসরাত রীপা