এক.
তিলধারণের জায়গা নেই বাসে। একপ্রকার যুদ্ধ করেই ঠেলেঠুলে উঠে পড়ে তবু রিমি। সাড়ে ন’টা বেজে গেছে। এখন বাসে উঠতে না পারলে বাসায় পৌঁছতে কমসে কম রাত সাড়ে এগারোটা-বারোটা বাজবে। মিথুনের মুখের দিকে তাকানো যাবে না আর। মুখে যা নয়, তাই বলবে ও। এমনিতে মনে হয় না এগারোটার আগে ঢুকতে পারবে আজ বাসায়। আজ কপালে শনি আছে তার।
ভেতরের দিকে একটা সিটের কোণা ধরে কোনোমতে টাল সামলে দাঁড়িয়েছিল রিমি। একটাও সিট খালি নেই। মাঝখানের জায়গাটুকুতে গাদাগাদি দাঁড়িয়ে আছে তার মতো অনেকেই। এর মধ্যেই মানুষ উঠছে, নামছে। কন্ডাকটর ভাড়া তুলছে। পৌষের শীতেও মানুষের চাপে, গরমে, ঘেমে প্রায় নেয়ে ওঠে সে। তার সামনে বসে আছে কম বয়সী একটি জুটি। ফুসুর ফুসুর গল্প চলছে। একটু পর পর হাসির তুফান ছুটছে। রাগে গা জ্বলে যায় রিমির। প্রেম! শালা! প্রেমের খ্যেঁতা পুড়ি!—মনে মনে আওড়ায়।
—আপু, মহিলা সিটে গিয়া বন! মহিলা সিট খালি আছে না?
খরচোখে ছেলেটার দিকে তাকায় রিমি। ভস্ম করে। কণ্ঠে উষ্মা ঢেলে, গলা তুলে বলে, দেখছেন না, মহিলা সিটে মহিলা বসে আছে?
নিজে সরকারি গাড়ি চড়ে বলে কি রিমির অবস্থাটা বুঝতে নেই তার! দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রিমি। স্বার্থপর! সব স্বার্থপরের দল। বিড়বিড় করে আপন মনে।
উঁকি দিয়ে দেখে ফিক করে হাসে ছেলেটা। মুশকো লোকগুলো তবু ধেবড়ে বসে থাকে। কোনো বিকার নেই। মহিলা সিটে এমনিতেই বড় একটা বসে না রিমি। ইঞ্জিনের গরম, ধোঁয়া। তাই বলে মহিলা সিটে পুরুষ বসে থাকবে আর তারা দাঁড়িয়ে থাকবে—এটাই বা কেমন রীতি! বসার অযোগ্য সিটগুলোই এই মুড়ির টিনমার্কা বাসগুলোতে মহিলা সিট হিসেবে নির্ধারিত। সেগুলোও দখল করে বসে থাকে বেহায়া পুরুষগুলো! শালা!—অশ্লীল একটা গালি মুখের কাছে এসেও ফিরে যায় রিমির। থাক! না হোক মুখ নষ্ট!
—আপা, ভাড়াডি দেন!
—আগে তোমার মহিলা সিট খালি করো, বসার জায়গা দাও, তারপর ভাড়া নিও!
ম্যাজিকের মতো কাজ হয় এবার। ত্বরিতে খালি হয়ে যায় মহিলা সিট। রিমি বহু কসরৎ করে এগিয়ে যায়। বসে। ওড়নায় মুখ মোছে। ক্লান্ত লাগে। এতক্ষণে টের পায় ফোন বাজছে। হাতড়ে ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করতে না করতেই নীরব হয়ে যায় ফোন। স্ক্রীনে দেখায় 11 missed call! মিথুন! কেন যে বুঝতে চায় না! ঢাকা শহরটা তো তার বাপের নয়! কিংবা রিমিও প্রাইভেট কার নিয়ে ঘোরে না যে সন্ধ্যা হতে না হতেই লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে সে পৌঁছে যাবে বাসায়! আজকাল অফিসে যা কাজের চাপ! কিছুতেই আটটার আগে বেরোনো যায় না। তারপর আছে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকার হ্যাপা! অথচ মিথুন বুঝতে চায় না। কূট চোখে তাকায়। এমন বাঁকা করে কথা বলে যে রিমির মাঝে মাঝে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে। জীবনটা দিন দিন কেমন জটিল হয়ে যাচ্ছে। প্যাঁচালো। ভালো লাগে না আর।
মিথুন ফোন তুলেই রাগত কণ্ঠে জেরা করে—কোথায় তুমি? ক’টা বাজে এখন?
—বাসে। রাস্তায় অনেক জ্যাম। আসছি। স্বাভাবিক কণ্ঠে কথাগুলো বলে ফোন রাখে রিমি। মিথুন সরকারি চাকরিজীবী। তাই বলে রিমির সমস্যাটা কেন বুঝতে চায় না সে! না কি ঢাকা শহরের রাস্তাঘাটের খবর সে রাখে না আজকাল! নিজে সরকারি গাড়ি চড়ে বলে কি রিমির অবস্থাটা বুঝতে নেই তার! দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রিমি। স্বার্থপর! সব স্বার্থপরের দল। বিড়বিড় করে আপন মনে।
দুই.
রাতটা এত দীর্ঘ কেন আজ? দম বন্ধ হয়ে আসতে চায় মিথুনের। উঠে বসে বিছানায়। সাবধানে মশারি সরিয়ে নেমে পড়ে। হাতড়ে সিগারেট আর লাইটার নিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসে। বুকের ভেতরে ঘুণপোকাটা কুটুস কুটুস দাঁত বসায় অনবরত। জীবনটা অন্যরকম হয়ে গেলো। অথচ এমন কথা ছিল না। না। একদম কথা ছিল না। অশান্তির আগুন যে এতটা তীব্র হয়, এত যে পোড়াতে পারে তা হৃৎপিণ্ডের পলি, কে আর জানতো আগে! ঘড়ির কাঁটা যখন বারোটা ছুঁয়েছে প্রায়, ঠিক তখন বাসায় ফিরেছে রিমি। অর্পা ততক্ষণে চিৎকারে প্রায় পাগল করে তুলেছে মিথুনকে। কাজের বুয়ার কাছে সারাদিন থাকে মেয়েটা কিন্তু সন্ধ্যা পার হলেই রিমির জন্য অস্থির, অবুঝ হয়ে ওঠে। উৎকর্ণ হয়ে কলিংবেল এর অপেক্ষা করে। মিথুনও এসময় সামলাতে পারে না তাকে। সন্ধ্যা যত গড়াতে থাকে তত অস্থিরতা বাড়তে থাকে তার। হিংস্র হয়ে ওঠে রীতিমতো। চিৎকার করে, আঁচড়ে, কামড়ে পাগল করে তোলে মিথুনকে। এত অসহায় লাগে তখন মিথুনের! ইচ্ছে করে চিৎকার করে কাঁদে। অর্পার চিৎকারে, চেঁচামেচিতে আশপাশের ফ্ল্যাটের জানালায় কৌতূহলী মুখ উঁকি দেয়, জিজ্ঞাসু, বিরক্ত চোখে তাকায়। সে যে কী লজ্জা! কী যে অসহ্যরকম যন্ত্রণা! বুকের ভেতরটা পুড়ে যেতে চায়, জ্বলে যেতে চায়। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে অর্পাকে গলা টিপে মেরে ফেলে! রাগের মাথায় বসিয়েও দেয় দু চার ঘা! অর্পা তাতে আরও মরিয়া হয়ে ওঠে! চিৎকারের মাত্রা বেড়ে দ্বিগুণ হয় আরও। না পেরে সে রিমিকে ফোন দেয় তখন। রিমি বিরক্ত হয়। অন্য অর্থ করে। অশান্তি চরমে ওঠে অতপর।
কতটা বিকৃত হবে সে মুখ ঘৃণায়, যন্ত্রণায়? ভাগ্যিস ভাবনাগুলো পড়তে পারে না অন্য কেউ। নইলে যে কত অনাসৃষ্টি কাণ্ড ঘটতো সংসারে!
অর্পা অটিস্টিক। জন্মের সময় বোঝা যায়নি কিছুই। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই আচরণে অস্বাভাবিকতা দেখে উদ্বিগ্ন রিমি ডাক্তারের কাছে ছুটেছিল তাকে নিয়ে। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর গম্ভীর, নির্লিপ্তমুখো ডাক্তার যখন বলেছিল অর্পা আর দশটা স্বাভাবিক শিশুর মতো নয়, সে আসলে একটা ‘special child’, মিথুন আর অর্পার সামনে পৃথিবীটা যেন দুলে উঠেছিল সেদিন। চোখের সামনে ঝলমলে পৃথিবীটা হয়ে উঠেছিল রঙচটা, বিবর্ণ। ফ্যাকাশে, ভীত মুখে ভীষণ অবাক হয়ে তাকিয়েছিল রিমি। যেন তার ফাঁসির রায় এইমাত্র পাঠ করেছে কেউ, কিংবা তার চোখের সামনে থেকে হঠাৎই সরে গেছে জীবনের সমস্ত রঙ ও ঔজ্জ্বল্য। আর মিথুন মাথা নিচু করে, দণ্ডিত আসামির নিরুপায় নিস্পৃহতায় বসে ছিল নির্বাক। কিন্তু তার বুকের মধ্যে যে তাণ্ডব চলছিল তখন, তা কি টের পেয়েছিল সামনে বসা ওই ডাক্তার ভদ্রলোক, কিংবা রিমি? সে মুহূর্তে মিথুনের ইচ্ছে করছিল একছুটে চলে যায় ডাক্তারের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ওই চেম্বার ছেড়ে, এই শহর ছেড়ে কিংবা ভুলে ভরা এই জীবন ছেড়ে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল, তছনছ, ধ্বংস করে দিতে ইচ্ছে করছিল চারপাশের ভীষণ শান্ত, স্বাভাবিক, বহমান সেই পরিবেশ। কোনো স্পেশাল চাইল্ডের বাবা তো সে হতে চায়নি কোনোদিন! বরং সে ভীষণই সাধারণ, সুস্থ একটি শিশুর স্বপ্ন দেখেছে এতদিন! তবে? ভীষণ অচেনা এক ক্রোধ, অজানা এক উন্মত্ততা উথলে উঠছিল বুকের ভেতর। পৃথিবীসুদ্ধ মানুষের স্বাভাবিক, আটপৌরে জীবনের মাঝে সে কেন অটিস্টিক একটি শিশুর বাবা হিসেবে উপহাসের পাত্র হবে বাকিটা জীবন, কেন তার একমাত্র কন্যাসন্তানটি বয়ে বেড়াবে অভিশপ্ত এক অটিস্টিক জীবন—ইত্যাকার ভাবনা পাগল করে দিচ্ছিল তাকে। এবং তার সব রাগ, ক্ষোভ, ক্রোধ সব জমা হচ্ছিল ওই শালা শুয়োরের বাচ্চা ঈশ্বরের প্রতি, যে তাকে এহেন একটি প্রতিকূল পরিস্থিতির সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে আড়ালে বসে মজা দেখছিল। আর তখনই তার মনে হয়েছিল এসব তারই কৃতকর্মের ফল! ঈশ্বর মূলত তার কৃতকর্মের শাস্তিই তাকে কড়ায়-গণ্ডায় ফেরত দেওয়ার বন্দোবস্ত করেছেন পাকাপাকিভাবে! যেমনটি পরবর্তী সময়ে আরও অনেকেই ইশারা-ইঙ্গিতে বলেছে তাকে, এমনকি মিথুনের গর্ভধারিণী মা, তিনিও এমনই বলেছেন, সচরাচর বলেন!
সেদিন বাসায় ফিরে অর্পাকে জড়িয়ে হু হু কান্নায় ভেঙে পড়েছিল রিমি। পাশে বসে শুকনো, জ্বালাধরা চোখে রিমিকে দেখছিল মিথুন। মনের মধ্যে কূট সন্দেহ কিংবা পাপ উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল তার। পরক্ষণেই, নিজের মনেই ভাবছিল, সে কি তবে মিথ্যেই বড়াই করে শিক্ষার, প্রগতির, উদারতার! তার শিক্ষায়, প্রগতির পাঠে তবে ফাঁক আছে বিস্তর, গলদ আছে তার সংস্কারমুক্তির অহঙ্কারে, খাদ আছে রিমির প্রতি তার ভালোবাসায়! নইলে আর দশটা অশিক্ষিত, সাধারণ, ছা-পোষা মানুষের মতোই তারও ভাবনায় কি করে ঢুকে পড়ে এমন অশুচি আবর্জনা! কেন সে মনে মনে রিমিকে দাঁড় করিয়ে ফেলে অপরাধীর কাঠগড়ায়! নিজেকেই বা কেন সে ভাবে দাগি আসামি! তার শিক্ষা, তার রুচি, তার সংস্কারমুক্ত যুক্তিবাদী মন তো জানে, যা হয়েছে তাতে তার বা রিমির কারও হাত নেই, কেউ তারা অপরাধী নয়! তবে? নিজের মনের এহেন স্থূল ভাবনায়, সীমাবদ্ধ কল্পনায় নিজেই সে কুঁকড়ে গেছিল সেদিন লজ্জায়, ঘৃণায়। রিমি যদি ঘূণাক্ষরেও জানতে পারে, কী সে ভাবছিল মনে মনে; তবে কেমন হবে তার মুখটা? কতটা বিকৃত হবে সে মুখ ঘৃণায়, যন্ত্রণায়? ভাগ্যিস ভাবনাগুলো পড়তে পারে না অন্য কেউ। নইলে যে কত অনাসৃষ্টি কাণ্ড ঘটতো সংসারে!
তিন.
অফিসের জন্য তৈরি হতে হতে চোখের কোণায় মিথুনকে দেখে রিমি। গম্ভীর মুখে খবরের কাগজ পড়ছে। পাশে ঠাণ্ডা হচ্ছে চা। অর্পা তখনো ঘুমুচ্ছে। বেলা করে ওঠার অভ্যেস তার। শনিবার হওয়ায় মিথুনেরও অফিস নেই আজ।
বাসায় থাকছো তো সারাদিন?—আয়নায় চোখ রেখে মিথুনের দিকে প্রশ্নটা ছুড়ে দেয় রিমি।
—হুঁ। খবরের কাগজে ডুবেই সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয় মিথুন।
—অর্পার দিকে খেয়াল রেখো। আমি তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করবো।
—তাড়াতাড়ি ফিরবে? হা হা! বলে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে মিথুন।
গায়ে জ্বালা ধরে যায় রিমির। আগুনচোখে তাকিয়ে বলে, আমি কি তোমার মতো সরকারি চাকরি করি, যে চাইলেই যখন খুশি চলে আসতে পারবো?
—চাকরি কেন করতেই হবে তোমাকে? প্রয়োজনটা কী?
—তোমার জ্বলুনিটা তো ওখানেই, না? আমার চাকরি করাটা! চাকরি ছেড়ে দিলে খুশি হও খুব? সব ছেড়ে তোমার সংসারে ঝিয়ের কাজ করি, আর হাত পেতে তোমার কাছ থেকে ভিক্ষে নেই, এই তো চাও?
—সংসারটা আমার হবে কেন শুধু? তোমার নয়? আমার টাকা তোমার টাকা নয়?
—না, আমার নয়। তোমার সংসারও আমার নয়, টাকাও আমার নয়। সেটা যখন আমার চাকরি ছিল না তখন হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছ। একটাকা খরচ করলেও পইপই করে হিসাব নিয়েছ, পান থেকে চুন খসলে ঘর থেকে বের করে দেওয়ার প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়েছ। ভুলে গেছি ভেবেছ? হুঁহ! তুমি আবার মুখে কত উদারতার বুলি আওড়াও! মানুষকে নারী স্বাধীনতার ছবক দাও! তোমাদের পুরুষদের এই ভণ্ডামি খুব চেনা আছে আমার! আমি শুধু জানি অর্পা আমার! যেহেতু সে অসুস্থ, তাই তার দায়িত্ব একা আমার! সুস্থ হলে সে তোমার হতো, তাই না? —একনিশ্বাসে কথাগুলো বলে হাঁপায় রিমি। উত্তেজনায় নাকের পাটা ফুলে ওঠে তার। লাল হয়ে ওঠে মুখ।
—পুরুষদের তুমি একটু বেশিই চেনো! দাঁতে দাঁত চেপে, চিবিয়ে চিবিয়ে বলে মিথুন। চোখ তখনো দুই হাতে মেলে ধরা খবরের কাগজে।
—মিথুন! ধমকে ওঠে রিমি। আহত বাঘিনীর চোখে তাকায়।
—নাটক করো না সাতসকালে। যেখানে যাচ্ছ, যাও। কণ্ঠে উষ্মা নিয়ে বলে মিথুন।
—ছিঃ! অসভ্য একটা মানুষ তুমি! জঘন্য!
—সভ্যদের কাছে যাচ্ছ তো, তাড়াতাড়ি যাও। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
মিথুন রঙ পেন্সিল নিয়ে বসলো গিয়ে তার পাশে। দেখে হাসি ছড়িয়ে পড়লো অর্পার চোখ-মুখে। হেলেদুলে এসে বসে পড়লো বাবার পাশে। আধো আধো বুলিয়ে চোখ দুটো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বললো, আমলা এথন থবি আঁতবো, তাই না বাবা?
কানে যেন গরম সিসা ঢালে কেউ। ছিটকে ঘর থেকে বের হয়ে যায় রিমি। যত দিন যাচ্ছে মিথুনটা তত অসহ্য হয়ে উঠছে। কথাবার্তা তত সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। যত রাগ রিমির ওপর। যেন অর্পার এই অসুস্থতার জন্য রিমিই দায়ী! যেন রিমি চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে বাসায় বসে থাকলেই অর্পা ভোজবাজির মতো সুস্থ হয়ে উঠবে! অথচ বিয়ের আগে এই মিথুনই কত আধুনিকতার বুলি আওড়াতো! নারী স্বাধীনতার পক্ষে কত না যুক্তি দিয়ে রিমিকে মুগ্ধ করতো সে! তখন অবশ্য একটু আধুনিকও ছিল সে, ভাবনায়, কর্মে। নইলে রিমির সঙ্গে তার বিয়েটা তো হওয়ারই কথা নয়! না কি সব তার ভড়ং ছিল? রিমির প্রতি জন্মানো মোহ থেকেই সে বিয়েটা করেছিল আসলে? এখন মোহ কেটে গেছে, অমনি উবে গেছে তার আধুনিকতার ভড়ং? না কি সব বিরক্তির কারণ অর্পা? অর্পার অসুস্থতাই কি মিথুনকে এমন হীনম্মন্য করে তুলছে দিনকে দিন? কিন্তু সেজন্য রিমির দায় কোথায়? অর্পা অটিস্টিক, তাতে তার বা মিথুনের কারোই কোনো দায় নেই—এই সহজ, স্বাভাবিক কথাটা কেন বুঝতে পারে না মিথুন? অথবা সে ইচ্ছে করেই বুঝতে চা্য়ই না আসলে? পাবলিক বাসের ভিড়ে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে অফিসের পথে এগোয় রিমি, অন্যদিনের মতোই। বিক্ষিপ্ত, অস্থির মনে ভাসে অর্পার কোমল, কচি মুখ। আহ্! কেন যে ঈশ্বর এই শাস্তি দিলেন তাকে! কী ক্ষতি হতো যদি অর্পাটা অন্য আর দশটা বাচ্চার মতোই সুস্থ, স্বাভাবিক হয়ে জন্মাতো! তখনো কি এমনি করে মুখোশ সরে বেরিয়ে আসতো মিথুনের কদর্য, নোংরা রূপ? না কি তখন সে সেই আগের মতো প্রগতিশীল, মানবিক, উদারতার প্রতিমূর্তি হয়ে বেঁচে থাকতো রিমির চোখে? জীবন যে কতকিছু শেখাচ্ছে তাকে এই এক জীবনে! এক অর্পার কারণেই কতকিছু যে জানা হলো তার, শেখা হলো কত বিচিত্র পাঠ, চেনা হলো মানুষের কত বহুরূপী মুখ!
চার.
অর্পা সকালের দিকটাতে বেশ শান্ত থাকে। নাস্তা শেষে কার্টুন নিয়ে বসে। সঙ্গে ছড়ানো থাকে হরেক খেলনা। অর্পা অস্থির। কোনো কিছুতেই বেশিক্ষণ মনোযোগ নেই। কিছুক্ষণ কার্টুন দেখে তো পরক্ষণেই টেডিবেয়ার নিয়ে ব্যস্ত হয়। একটু পরেই আবার অন্যকিছু। কাজের মেয়েটাকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে। অর্পাকে শান্ত রাখা এক কঠিন যুদ্ধ। মেয়েটা তবু অর্পাকে বেশ ভালোমতোই সামলাতে পারে। এখানে কাজে আসার আগে ছয়মাসের একটা ট্রেনিং করেছে সে। স্পেশাল চাইল্ডকেয়ারের ওপর একটা ট্রেনিং করা আছে তার। মিথুন আর অর্পা মেয়েটাকে একটা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কাজে নিয়েছে। টাকা একটু বেশি গেলেও অর্পার দেখাশোনাটা সে বেশ ভালোই করছে, এটুকুই স্বস্তি।
নাস্তা সেরে কিছুক্ষণ অর্পার সঙ্গে খুনসুটিতে কাটালো মিথুন। ছবি আঁকায় মেয়েটার আগ্রহ মাত্রাতিরিক্ত। এই একটা ব্যাপারই সে সম্ভবত আগ্রহ নিয়ে, মন থেকে করে। মিথুন রঙ পেন্সিল নিয়ে বসলো গিয়ে তার পাশে। দেখে হাসি ছড়িয়ে পড়লো অর্পার চোখ-মুখে। হেলেদুলে এসে বসে পড়লো বাবার পাশে। আধো আধো বুলিয়ে চোখ দুটো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বললো, আমলা এথন থবি আঁতবো, তাই না বাবা?
—হ্যাঁ মা, আমরা এখন ছবি আঁকবো। হেসে মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললো মিথুন। স্পষ্ট কথা বলতে পারে না অর্পা। বেধে যায়। থেমে থেমে বলে। কথা বলার সময় তার মুখ দিয়ে হালকা লালা ঝরে। সস্নেহে পাশে রাখা তোয়ালে দিয়ে অর্পার মুখটা মুছিয়ে দেয় মিথুন। অর্পা ঝুঁকে ড্রইং খাতায় আঁকিবুকি করে। অর্পার পছন্দ একটু অদ্ভুত কিসিমের। শিশুরা সাধারণত গাঢ় রঙ পছন্দ করে, বিশেষত লাল। অর্পা উল্টো। তার পছন্দ হালকা রঙ। ড্রইং খাতায় সে বেশি ব্যবহার করে হালকা রঙ, বিশেষ করে আকাশি রঙের প্রতি তার দুর্বলতা সীমাহীন। যা-ই আঁকুক তাতে আকাশি ছোঁয়া থাকা চাই।
বুকের মধ্যে পুষে রাখা সাপটাকে আপাতত শীতঘুমে পাঠায় মিথুন। তোয়ালেটা নিয়ে এগিয়ে যায়। জীবনের অন্য নাম সম্ভবত মায়া। অর্পার মুখে এই মুহূর্তে ভর করেছে এসে!
কতক্ষণ কী সব আঁকলো অর্পা, মিথুনকে বলল, বাবা, দেথো! দাদুবালি এঁতেথি। থুন্দল, না বাবা?
—হ্যাঁ মা। খুব সুন্দর। দাদুবাড়ি এঁকেছ, দাদুকে আঁকোনি?
সঙ্গে সঙ্গে অস্থির হয়ে উঠলো অর্পা! দুই দিকে মাথা নাড়িয়ে বললো, না। দাদু পতা! দাদুতে আঁতবো না! দাদু পতা! দাদুতে আঁতবো না! আঁতবো না! আঁতবো না!
প্রমাদ গুণলো মিথুন। একবার ক্ষেপে গেলে অর্পাকে শান্ত করা কঠিন। এক্ষুনি তাকে থামাতে হবে, নইলে আঁচড়ে-কামড়ে অস্থির করে তুলবে। অনেকগুলো আকাশি রঙা পেন্সিল তার দিকে দ্রুত হাতে বাড়িয়ে দিলো মিথুন। হাসিমুখে বললো, এসো আমরা ফুল আঁকি, পাখি আঁকি, আকাশ আঁকি। অর্পা সোনা কি ফুল আঁকতে পারে?
থেমে গেলো অর্পা। স্থির চোখে দেখলো রঙপেন্সিলগুলো। ধীরে ধীরে হাসি ফুটলো আবার মুখে। হাত বাড়িয়ে পেন্সিলগুলো নিতে নিতে বললো, আমি ফুল আঁতবো। অনেত ফুল আঁতবো। অনেত ফুল আঁতবো। আমি ফুল আঁতবো।
স্বস্তির বড় একটা শ্বাস ছাড়লো মিথুন। আপাতত শান্ত করা গেছে। ভুলটা মিথুনেরই। মিথুনের মাকে সহ্য করতে পারে না অর্পা। তার নাম শুনলেও ক্ষেপে ওঠে। শিশুরা সম্ভবত ষষ্ঠেন্দ্রীয় নিয়ে জন্মায়। মিথুনের মা যে অর্পাকে সহজভাবে নিতে পারেন না, অর্পার অসুস্থতাকে তাদের প্রতি ঈশ্বরের নেওয়া প্রতিশোধ মনে করেন, সেটা সম্ভবত কোনোভাবে বুঝে গেছে অর্পা। ভদ্রমহিলার ছায়াও সহ্য করতে পারে না মেয়েটা। অস্থির হয়ে ওঠে ভীষণ, অস্বাভাবিক হিংস্রতা চলে আসে তার আচরণে তখন।
অর্পার সঙ্গে আরও খানিকটা সময় কাটালো মিথুন। উঠে পড়লো তারপর।
ল্যাপটপে বসে অফিসের কাজ করলো কিছুক্ষণ। মন বসছে না কিছুতেই। মেজাজটা সকাল থেকেই খিঁচড়ে আছে। রিমির সঙ্গে অতটা নির্দয় না হলেও চলতো তার। বেচারা সারাদিন কী করে অফিস সামলাবে, কে জানে। রিমির সবচে দুর্বল জায়গায় ঘা দিয়েছে সে। আজকাল প্রায়ই হচ্ছে অমন। মেজাজটা কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না মিথুন। রিমির অন্ধকারতম অধ্যায়, যা প্রাণপণে ভুলে থাকার লড়াই করে যাচ্ছে রিমি প্রতিদিন, ইদানীং মিথুন সুযোগ পেলে সামনে আনছে সেটা। সঙ্গে তার মাও আছেন। তার মা সোহাগী খাতুনের বদ্ধমূল ধারণা রিমিকে বিয়ে করে চরমতম পাপ করেছে মিথুন। গ্রুপ রেপড হওয়া অশুচি মেয়েকে ঘরে তুলে যে চরম পাপ করেছে মিথুন, তারই প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ অর্পাকে পাঠিয়েছেন ঈশ্বর। মায়ের এই বিশ্বাসে বিরক্ত হয় মিথুন। ধমকে তাকে থামিয়েও দেয়, কিন্তু রিমির সঙ্গে খিটিমিটি বাধলে মায়ের কথাগুলোই চাবুকের মতো ফিরে আসে তার মনে। সে জানে, এটা অযৌক্তিক, অমানবিক। কিন্তু মানুষের মন তো! অর্পার মুখের দিকে তাকালেই আজকাল রিমির প্রতি বিরক্তি মাত্রা ছাড়িয়ে যায় তার। বুকের ভেতর এক বিষধর সাপ ফণা তুলে ওঠে। অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করে মিথুন। বুকের মধ্যে সাপটা দিনদিন মাথা তুলছে আরও, টের পায় মিথুন। একদিন ছোবল বসিয়ে দেবে, বিষে ভরিয়ে তুলবে চারপাশ। না কি এখনই ভরিয়ে তুলেছে? সাবধানে ড্রইংরুমে উঁকি দেয় মিথুন। অর্পা ঝুঁকে বসে কিছু একটা করছে। সম্ভবত পাজল মেলাচ্ছে। মুখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে লালা। বুকের মধ্যে পুষে রাখা সাপটাকে আপাতত শীতঘুমে পাঠায় মিথুন। তোয়ালেটা নিয়ে এগিয়ে যায়। জীবনের অন্য নাম সম্ভবত মায়া। অর্পার মুখে এই মুহূর্তে ভর করেছে এসে!