এদিক-ওদিক তাকায় আর হাঁটে। হাঁটে আর তাকায়। চাঁদটার বয়স সূর্যটার বয়স কত কে জানে। চাঁদ আর সূর্য বয়সের ফিতা দিয়ে পৃথিবীকে সাজাতে পারে। চাঁদের আর সূর্যের বয়সের তাবিজ কিভাবে গুনে তার হদিস নেই। রাস্তার ধারে কে যেন মোম জ্বেলেছিল, জ্বলে জ্বলে তার অল্পই বাকি আছে। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। সত্যের মৃত্যু যদিও হয় না তারপরও একটা জীবন সত্য না জেনেই শেষ হয়ে যেতে পারে। অবশ্য সত্যের সৎভাই মিথ্যা আবার অসৎ ভাইও মিথ্যা। যদিও বৃহত্তর অর্থে সত্য বলে কিছু নেই, মিথ্যা বলে কিছু নেই। শুধু আছে কথা, শুধু আছে ঘটনা। যদিও ক্ষুদ্রতর স্বার্থেও সত্য বলে কিছু আছে, মিথ্যা বলে কিছু আছে। সবাই কলমের খোঁচায় কত কী-ই না করে।
আশি বছর ধরে এ হাঁটা চলছে, উট-ঘোড়া নয়, পাখি বা ধাতব ডানাও নয়—নিজের পা। সোমবার, মঙ্গলবার, সববার স্পষ্ট না হলেও মনে পড়ে মেধাবী পা দুটোর। মানুষের দু’টা পা ঠিকই আছে কিন্তু একপায়েই থাকে পুরো মানুষটির হেঁটে যাওয়ার ভর। পায়ে ভর দিয়ে মাসের পর মাস কখনো চাঁদই দেখেনি সে, এত দ্রুত হেঁটেছে। মানুষ আর পাখির ডাকনাম একই ছিল কোনো এক সময়। মানুষ আর পাখির কোনো ঠিকানা নেই। যারা হাঁটে তাদের কোনো ঠিকানা থাকে না। তারা জটিল। বৃক্ষের ঠিকানা থাকে, তার জীবন সরল, সবল। মানুষেরও কি অদৃশ্য শেকড় বের হয় না? পাখিরও? তবে ফিরে আসে কেন কোনো এক স্থানে?
নদীর কিনারের গাছটা—ভাঙাপাড়—বুড়ো মানুষের শিরা উপশিরার মতো কিছু শেকড় বের হয়ে আছে, গাছটা নিচের দিকে তাকিয়েই দেখে না। দিলশাদ দেখে। নদীর জল থামে না। দিলশাদ থামে। কখনো কখনো এমন থামা থেমেছে সূর্য ডোবা দেখেনি বেশ কিছুকাল। থামার জন্য এমনই চলা। সাহেবগঞ্জ, পাকিপুর, বঙ্গপুর, সবই পা, সবই ক্লান্তিতা, সবই জিরোনো—আশি বছর, যখনই মনে পড়ে হাঁটে, ভুলে গেলে হাঁটে, ঘুম আসলে হাঁটে স্বপ্নে। হাঁটার ইচ্ছে হলে হাঁটে, বসার ইচ্ছে হলেও হাঁটে। বসার খুব বেশি ইচ্ছে হলে একটু আরাম নেয় হাঁটার গতিটা আরও একটু বাড়িয়ে দিয়ে।
টাকমাথা খাতার পাতাও কিছু না কিছু দিয়ে ভরা থাকে। দেহের ভেতর ঢুকেও মানুষ দেহের সঙ্গে একাকার হতে পারে না। বড় জোর দেহের চাকর সে হয় বা তার চাকর হয় দেহ। বড় জোর দেহের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয় বা শত্রুতা হয়। বেশিরভাগ মানুষ হয়ে যায় দেহের চাকর। কিন্তু নামের ভেতর সেঁধিয়ে মানুষ তার নামের সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। মানুষের ভেতর নাম সেঁধিয়ে একাকার হয়ে যায়। মানুষটি হলো তার নাম। প্রত্যেক মানুষের জন্য একটা নাম থাকে। প্রত্যেক নামের জন্য একাধিক মানুষ থাকে। নামহীন কোনো মানুষ নেই পৃথিবীর ভেতর। কোনো মানুষেরই নাম ‘বেয়াদব’ নেই। ‘নৃশংস’ কখনোই কোনো মানুষের নাম নেই। মানুষে নাম আছে সুবোধ, নাম আছে উত্তম। তারপরেও পৃথিবীতে বেয়াদবি আর নৃশংসতার কোনো সীমা পরিসীমা নেই। তবে মনে হয় মানুষ তার নামের সঙ্গে একাকার হতে পারে না, নামের মন-মজ্জার সঙ্গে একাকার হতে পারে না। মানুষ একাকার হয় নামের চামড়ার সঙ্গে। মরে গেলে পৃথিবী মাটি হয়ে যাবে, চাঁদ হয়ে যাবে ছুঁচোর বিষ্ঠা। শীতের নরম রোদ হবে ঘোড়ার মূত্র।
নদীগুলো বেশ বালির আবাদ করে, সূর্য করে জলের জন্মগান। এ পারে দেখা গেল আরও একটা বড় ধরনের মাটির চাঁই নদীটা খসিয়ে নিল নিজ পোশাক থেকে। একটা দীর্ঘশ্বাস না ফেলে পারে না আশি বছর। দিলশাদ। দীর্ঘশ্বাসের খরচও করতে হয় হিসাব করে। ক্ষুদ্রশ্বাসের কোনো হিসাব নেই—বেহিসাব। যদিও ক্ষুদ্রশ্বাস মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। ক্ষুদ্রশ্বাসের চেয়ে দীর্ঘশ্বাসে বেশি আরাম পায় মানুষ। অবশ্য দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস কখনো কখনো মানুষকে ঠেলে দেয় মরণের দিকে। মানুষ দুঃখবিরোধী। সুখ মানুষবিরোধী। মানুষ রাম আরামপ্রিয়। আর শান্তি বা আরাম মানুষের সঙ্গে বাস করতে পছন্দ করে না। ‘চিরুনি চালিয়ে ক’টা বেশি হয়ত উকুন বের করা যায়, সব নয়’—এ রকম একটা কথা প্রতিদিন বসে ভাবছিল কিছু মানুষ। মানুষ জন্মের সময় ভাবতে পারে না আর জন্মানোর সময় ভাবে না। ভাবে মরণের সময়। মৃত্যুকে মানুষ সময় ভাবতে পারে না। মৃত্যু অসময়। একবার চাঁদ ডুবে গেলে, পাখি উড়ে গেলে কেমন করে ফিরে আসে সেটাও একটা না ভাবার বিষয়। কিছু একটা হবে। অন্তত সাবানের ফেনা, রেলের চাকা, বন্ধ ঘরের হুড়কো খোলার স্বাদ, নদী নদী লাগে। ‘সার্কাসের ছুঁড়ির শক্ত শরীর, বেগুন বেগুন দুধ আর পায়জামার ফিতার ফস্কা গেরো অতি সহজে এসেছে বলে মনে হয় না’ এমন কথা বলে গেছে অনেকেই, আজও বলে কিছু মানুষ। মানুষ বলতেই থাকে, বলতেই আছে কথা বা কথার কথা। লাল কথা, গোলাপি কথা, নীল কথা, কালো কথা। এত কথা হয়ে গেল কিন্তু কথা আর মানুষের মিশ্রণ হলো না, রসায়ন হলো না। কথা আর মানুষের মিশ্রণ হয়ে থাকল কাঁকর আর জলের মত, চিনি-জলের শরবতের মতো হলো না।
একটা ছাগল ভাগ্যে বিশ্বাস করলে ছুরি দেখতে পায়, না করলে একটা মাঠ, সবুজ ঘাস, সবুজ গাছ, বন, নিজের যৌবন। বাঘের স্বাধীনতা সম্পূর্ণ আলাদা কথা। ইট পোড়ানোর সময় কত শামুক আগুনকে স্বাদ দেয়। তবুও তার ইচ্ছেটা কোনোমতেই অস্বীকার করলে চলবে না। আগুন জানে না তার কাজ, যে পুড়ে যায় সেও না জেনেই পুড়ে মরে। পোড়ানো প্রয়োজন আছে? পোড়ার প্রয়োজন আছে? সুতরাং ‘আছে’ বলে কিছু নেই, ‘নেই’ বলে কিছু আছে।
আকাশ আর মাটির পার্থক্য হচ্ছে—আকাশ আকাশ আর মাটি মাটি। দিলশাদ পা দিয়ে ভাবে আর মাথা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় বহুদূর। ষাট সত্তর পৃষ্ঠার বই ভদ্রলোকের কাছে হতে পাওয়া, তিনি নিজে অবশ্য দেননি, এ বইটা নিজ থেকে সহজে কেউ দিতে চায় না। এই শরীরবইটা খুলে রেখে চলে গেছিল ট্রেনের চাকার ঘর্ষণে বা হৃদ আর রক্তের অঘর্ষণে। আজরাইল আছে কি নেই সে কথা নয়, তার একটা পাতাও পড়তে পারে না কেউ স্পষ্ট বা অস্পষ্ট। শরীরপুস্তক। মরা শরীরপুস্তক। অথচ এতেই লেখা আছে সবকিছু। মানুষ বড়ই নিরক্ষর। অক্ষর ছাড়া পাঠ করতে পারে না কিছুই। এই যে, গাছ-পালার ডালপালা এঁকেবেঁকে আছে বিচিত্র ভঙ্গিমায়। একটা ডাল আর একটা ডালের মধ্যে ঢুকে গেছে, কোনো ডাল আর একটা ডালকে ছুঁয়ে আড়াআড়িভাবে চলে গেছে সামনের কোনো ডালকে ছুঁয়ে আর একটা ডালের সমান্তরালে চলে গেছে। পাতাগুলো বিচিত্র সজ্জায়, বিচিত্র ভঙ্গিমায় অবস্থান নেয়। কোনো পাতা তার পাশের পাতার ওপর এলিয়ে পড়ে আছে, কোনো পাতা একেবারে নিঃসঙ্গ। ঝরে গেল হলুদ পাতা। অথবা এই যে মাকড়সার জাল বিভিন্ন কোণ, বিভিন্ন আয়তন নিয়ে বুনে আছে, ঝুলে আছে। অথবা প্রজাপতির গায়ে নক্সা কাটা আছে নরম করে। অথবা মেঘের ভেতর বিদ্যুতের আঁকাবাঁকা শরীর নিয়ে মিলিয়ে যাওয়া। এগুলো কিন্তু একেবারে অর্থহীন নয়। এগুলোও একধরনের লেখা। সবাই পাড়তে পারে না। গাছগুলো, গাছের ডালগুলো, পাতারা, মাকড়সার জাল, প্রজাপতির পাখা, বিদ্যুৎচমক, নদীর ঢেউ—এরাও কিছু যেন বলে দিতে চায়। এসব ভাবে আর হাঁটে দিলশাদ। আশি বছর বয়স্ক পা তার। মানুষ অক্ষরহীন লেখা পাঠ করতে না পেরেই অহঙ্কারের বাসে ওঠে, ট্রেনে ওঠে, ধাতব ডানায় ভর করে। নিজেকে বিরাট জ্ঞানী ভেবে নিয়ে কপাল কুঁচকে বসে থাকে। মানুষ ঘোড়দৌড়ের প্রতিযোগিতার কথা দূরে পাঠায় কারেন্টে অথচ শরীরপুস্তক পাঠ করতে পারে না।
দিলশাদ ঝোঁপঝাড়ের কচি গাছের পাতায় হাত বোলায় হাঁটতে হাঁটতে আর ভাবে—কে বলেছে, সূর্য আর চাঁদ একে-অন্যের ওপর এমনি এমনি ওঠাওঠি করে? না, ওরা স্বামী-স্ত্রীর রাত করে তখন-তখন। মানুষ বেলজ্জা, বেঁচে থাকতে চায় সন্তানে। চাঁদের, সূর্যের একটা সন্তানও যদি পাওয়া যেত অন্তত বেজন্মা বলে গাল দেওয়া যেত না। ম্যাচের কাঠি, জমির ফসল বেশ ব্যাপার। ইউরিয়া, বৃষ্টি, বিদ্যুৎ, মাথাল, মেলা, কিছু নায়ক, জণ্ডিস রোগের বাচ্চা এভাবে পৃথিবী এবং পৃথিবী পর্যন্ত।
‘ভালোবাসব এমন হতে পারিনি কিন্তু ভালোবাসিয়ে নেওয়ার লোভ খুব বেশি—একথা স্বীকার করে নিয়ে মনে মনে জুতোজোড়া—কে যেন দিয়েছিল—ঝোঁপের মধ্যে ফেলে দেয় দিলশাদ। কাঁচা কাঁচা টমেটো, লাল-লাল রং, সন্দেহ হতে বাধ্য—মানুষ কেমন যেন, খাবারের শ্বাসজমিনে করে বিষের বাগান। সাহেবগঞ্জ বা পাকিপুর পার হয়েও কেন যে এমন করে। মানুষ পড়ে আছে লোভের জঙ্গলে। মানুষ মানবিক নয়, মানুষ পারমানবিক।
যেখানের মানুষেরা পোশাকি সেখানে পোশাক পরে আর যেখানের মানুষ ন্যাংটা সেখানে ন্যাংটা হয়ে দেখেছে। আবার যেখানে মানুষ পোশাক পরা সেখানে ন্যাংটা হয়ে আর যেখানে মানুষ ন্যাংটা সেখানে পোশাক পরেও দেখেছে। একটা গামলার জলে গোসল করার মতো ব্যাপার। দিলশাদ চৌবাচ্চার তলা কে করেছে, তাই নিয়ে ভাবে আর হাঁটে, হাঁটে আর ভাবে। মানুষ যেখানে থাকবে সেখানেই মানুষের বাস। যেখান দিয়ে যেতে চাইবে সেটাই তার পথ। বাদামওয়ালার ঠোঙা, দারওয়ানের ক্যাঁড়া-ক্যাঁড়া মোচ সব কিছু ডালিম, কমলা, পোলাও ইত্যাদিভোজির আরাধনা বলে মনে হয়। বুধবার, বৃহস্পতিবার, এসব বার, বারের নাম। মানুষের নাম যেমন কমল বা গোলক হতে পারে।
সেদিন হাটে চিংড়ির বড়া আর বাজারিয়া গান বেশ একটা ভাল সময় কেটেছিল। লাটিম হয়ে থাকার মজা সেই প্রথম সেই শেষ। তারপর আবার বিড়ির জ্বলে ওঠা বা ড্রেনকাটা। মধুপুকুরে যার বাড়ি সেখানেই সে থাকবে এমন কথা ভাবতে পারে না দিলশাদ।
রাত বেশ বেড়েছে একটু ঘুমোনো দরকার। এইকালে কোকিল সড়কের পাশ দিয়ে রাত আর বসন্ত বওয়ে ফেঁসে গেছে সময়। সভ্যতার জন্য উগ্রতার কোনোই প্রয়োজন নেই। অন্যমনস্ক রাত। সততা থাকলেই উন্নতি সম্ভব, ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, দেশ, পৃথিবীর। এমন রোদেলা দিনের ঝাঁঝ শেষে তেমন মনঃপূত হয় না দিলশাদের। আশি বছরের। দিন আর রাত দুটা ডায়েরি। দিনের ঘটনা রাতের ডায়েরিতে আর রাতের ঘটনা দিনের ডায়েরিতে আসে, হাসে, বড়জোর কাঁদে তাও উচ্চ স্বরে নয়। লুকিয়ে লুকিয়ে ডায়েরি লিখে আবার লুকিয়ে লুকিয়েই ছিঁড়ে ফেলে মানুষ। মানুষ প্রকাশ্য হাসে আর সে হাসির সময়টুকু বাদ দিয়ে কাঁদে সমগ্র সময়। সমগ্র সময়ের গায়ে কান্নার দাগ। যেমনভাবে পৃথিবীর সমস্ত মাটির গভীরে আছে মানুষের হাড়-মাংস আর সমস্ত মাটির উপরে আছে মানুষের পায়ের ছাপ। ইতিহাসের পাতায় হাঁস চরে, বাঘ-সিংহ মাংস খুঁজে, গরু-ছাগল ঘাস খুঁজে। ইতিহাসের পাতা ভরা নরমু-, যোনিযুদ্ধ, ক্ষুধাকাণ্ড, জমিযুদ্ধ, তরোয়ালে কাটা ঘোড়ার পা। ১ম যুদ্ধ, ২য় যুদ্ধ, মতের যুদ্ধ, পথের যুদ্ধ, কথার যুদ্ধ, লেখার যুদ্ধ। নিয়মের যুদ্ধ। অনিয়মের যুদ্ধ। এসব বলে, এসব ভেবে লাভ বলতে—পুকুরের ফাটা তলা।
মাঘ মাসে ঠাণ্ডার খবরটা যেদিন পাওয়া গেল সেদিনও চাঁদটাকে কেন যেন আশ্বিন মাসের, কার্ত্তিক মাসের ঝোলকান্নার মতো লেগেছিল। চাঁদের দিকে তাকিয়ে কুকুর কাঁদে, কুকুরের দিকে তাকিয়ে চাঁদ হাসে। বরিনপুরের মাথায় একটা সাপ আর একটা সাপের লেজ কামড়ে দিল। অন্যদিকে, গরুর চোখ বাঁধা ঘানি আজও টানে সবাই। ‘জবাই করে বুড়া গরুর গলা অথচ কেউ নিষেধ করে না’ এটা বড় কথা নয় বড় কথা হচ্ছে ‘একটা হাড়েও কোনো মাংসের টুকরো লেগে থাকতে দেখা যায়নি।’
দিলশাদ যেকোনো গ্রামে ঢুকেই সে বর্ষাসিক্ত মাঠের একমুঠো মাটি তুলে গভীরভাবে নাকের কাছে ধরে গন্ধ খায়। শহরে গেলে গোলাপগাছের ফুল না দেখে মনোযোগ দিয়ে গাছের গোঁড়া দেখে। সে পৃথিবীকে বলে—‘ঝিনুক যেমন মুক্তা লুকিয়ে রাখে তেমনই তোমার দেয়া দুঃখগো…।’ শেষ না হতেই অনেক কেঁদেছে কাঁদার প্রয়োজন না থাকলেও। কাঁদতে কাঁদতে হেঁটে চলে গেছে। মানুষ শুধু চোখ দিয়ে কাঁদে এমন নয়, দুঃখ পেলে পা দিয়েও কাঁদে। হাঁটে। হাঁটাটা পায়ের হাসি, বেশি হাঁটাটা পায়ের কান্না। কান দিয়েও কাঁদে। গান শুনে। পেট দিয়েও কাঁদে। রাগ করে ভাত খায় না। প্রাণ দিয়েও কাঁদে। আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যা কান্নার সবচে বড় রূপ। চোখ ছোট কী তারা ছোট বোঝা দায়। ‘আমড়া কাঠের ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে যতদিন থাকা যায়’ এ মনোভাব খুব বেশি ভালো নয়। শাপলা ফুলের অভাবের সময়ের খাবার ঘাঁটিও হয়, পুকুরের মাটিও হয় আবার ফুলদানিতে শোভাও অস্বীকার করা যায় না। শুক্রবার, শনিবার, সববার, বারগুলোর নাম অদ্ভুত। শুক্রবারে টুপির ব্যতিক্রম হয় না। রহমান সাহেব বা রহমত সাহেব বা লোকমান সাহেবের বুক লোমশ হলেও নামটা বুকের কোথায় লুকিয়ে থাকে খুঁজে পাওয়া যায় না।
যে জিনিস লুকিয়ে করতে হয় তা অন্যায় কিন্তু দিলশাদ এ কাজটা অর্থাৎ হাঁটা, কেন হাঁটা? তা লুকিয়ে রেখেছে হাঁটা বছর থেকেই। মানুষ পাগল ভাববে। মানুষ সবসময় ভাবতেই ব্যস্ত, কাউকে মন্দ ভাবতে, কাউকে বেকুব ভাবতে, কাউকে জ্ঞানী ভাবতে, কাউকে ধনি ভাবতে। মাঝে মাঝে মানুষের সহানুভূতি গোগ্রাসে গিলতে ইচ্ছে করে। নদীও সাম্যবাদী নয়, পেছনে যায় না। ফুলও যদি গন্ধ ফিরিয়ে নিত তবে একটা কথা ছিল। কথা থাক আর না থাক দিলশাদ হাঁটবে, খুঁজবে। মানুষের দিকে তাকিয়ে বা না তাকিয়ে। সে হাঁটছে, হাঁটছে, হাঁটছে… তার মাথার মধ্যে হাঁটে খাঁ খাঁ রোদ, গাঁ গাঁ মানুষ, নদী, পুকুর। তার মাথার মধ্যে হাঁটে চন্দ্র, সূর্য, তারা, সাগর, পাহাড়। পৃথিবীর গতির একটা ঘূর্ণি ছিটকে এসে তার মাথার ভেতর ঢুকে। বৃদ্ধ দিলশাদের মাথার মধ্যে বা মগজকে কেন্দ্র করে ঘুরে পৃথিবীর আলো, বাতাস, জল, সাপ, বাঘ, বিচ্ছু, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ। সেও তার মাথার মধ্যের জলঘূর্ণিতে, বায়ূ ঘূর্ণিতে, রোদঘূর্ণিতে পড়ে। ঘূর্ণিতে পড়ে তলাতে থাকে। তলাতে থাকে অতলে, বিতলে, সুতলে, পাতালে। তালে তালে তলাতে থাকে…
পরদিন, জটলাটা বেশ বড়ই হয় বৃদ্ধ দিলশাদের বাড়িতে। একজন বলল—‘লোকটা বড় ভালো ছিল গো, বড় শান্ত স্থির মানুষ।’ আর একজন বলল—‘লোকটা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল দিন চারেক থেকে, কোথাও বের হয়নি, তাকে সেবা করার কেউ ছিল না। ছেলে মেয়েরাও দূর বিদেশে চাকরি করে, তারা কেউ আসেনি অনেকদিন। আহারে, লোকটা নিঃসঙ্গে মারা গেল, এসো আমরা গাঁয়ের মানুষ মিলে তার দাফনের ব্যবস্থা করি।’ অন্য একটা লোক কথা ক’টা বলল। কবরস্থান থেকে ফেরার পর গ্রামটা আবার চঞ্চল হয়।
মন্তব্য