অস্ট্রেলিয়া থাকার সময় একদিন দেখলাম আবীর একটা তেলচিটে প্লেটে কোয়েলের তিনটে ডিমের ছবি নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছে। ডিম দেখার আগেই দেখলাম, আমার দীর্ঘ চেনা সে প্লেটের চল্টাওঠা দাগ, আমার বাড়ির জানালা, দরজা, বারান্দার গ্রিল। আর গ্রিলের জন্য আকাশ-টুকরোকেও মনে হচ্ছিল আবার বড় চেনা এক পরিসর!
আমি কমেন্ট বক্সে লিখলাম, এমনিতে বাড়িতে কাজের লোক নেই, তার ওপর আবার এই আপদ কে জুটালো?
উত্তরে আবীর লিখলো, ‘আমি কিনছি, আমিই পুষবো!’
আবীরের উত্তরটা মুখ ফসকে যে কাউকে যা তা বলা স্বভাবের রূঢ় আমাকে কিছুটা নমনীয় করলো। ভাবলাম, কোনো কিছু পুষলে মানুষের অন্তর তৃপ্ত হয়। বোধের উন্মেষ ঘটে। পোষাপুষি সেই অর্থে ঠিক আছে। আবীর আমার ছোটবোন শারমিন সুলতানা রীনার পুত্র। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়ে।
আবীরদের বাসায় তার বড়বোন বাঁধনের বিড়াল পোষার অস্বাভাবিক নেশা। নিজের টাকায় খাবার কিনে দাঁড়িয়ে থেকে রাস্তার কুকুরদেরও খাওয়ায়।
ভাগ্যিস বাসাটা দোতলা বলে বাসায় কোনো কুকুর এনে তুলতে পারেনি। তবে বিড়ালে তাদের বাসা ঠাসা বলে আমি নিজেই ও বাসার পথ মাড়াই না। আর আবীরও আমাদের বাসায় এসে থাকে বিড়ালের উৎপাত ছাড়া নির্বিঘ্নে বসবাস করতে। সেই নির্বিঘ্ন অবস্থাকামীর দ্বারা যদি আমার নির্বিঘ্ন অবস্থায় বিঘ্ন ঘটে, বাড়ির অভিভাবক হিসেবে যত দূরেই থাকি না কেন, একটু শঙ্কা তো মনে বাজেই!
যথাসময়ে দেশে ফিরে দেখি, কূজন নয়, রীতিমতো একলার চেঁচামেচি! বললাম, চেঁচানোর শব্দ আসে কোত্থেকে? বাসার কর্ত্রী চাকরিজীবী আমার ছোটকন্যা ফারজানা রহমান। তিনি বললেন, ‘আবীরের কেনা দুটি কোয়েল থেকে একটা মরে গেছে। আগে কোনো চেঁচামেচি ছিল না। একটা মরার পর আরেকটা এইভাবে চেঁচাচ্ছে!
কন্যার উত্তর শুনে মনে মনে ভাবলাম, এমন অবস্থায় মানুষ চেঁচালে যারা দোষ দেয়, তাদের সব বাড়ি একবার করে এই পাখিকে পাঠানো উচিত। কারণ প্রকৃতির শিক্ষাই হলো আসল শিক্ষা। এর বাইরের শিক্ষা আরোপিত এবং অসম্পূর্ণ শিক্ষা!
একবার ফেনীর নতুন বাড়িতে ক’টা দেশি মোরগ-মুরগির সমাগম চাইলাম। এ-বাড়ি ও-বাড়ি খবর দিয়ে ক’টা সুস্থ মুরগি জোগাড় করতে পারলাম বটে। কিন্তু তাদের বিস্তার লাভের জন্য একটিও বীর্যবান মোরগ আর পাই না। শেষে পালে কয়েকটা মোরগ আছে, চেনা এমন একজনকে ডেকে এনে, সুগন্ধি জর্দ্দায় পান খাইয়ে, হাতে তিনগুণ দাম ধরিয়ে দিয়ে বললাম, তোমাদের বাড়িতে মোরগ আছে জানি। একটি মোরগ পাঠিয়ে দিও।
মোরগ বিক্রি করলে অন্যের উপকার হবে বলে বিক্রিতে তার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু হাতে তিনগুণ দাম কড়কড়ে নোটটা ফেরতও দিতে ইচ্ছে করছে না। এমন দশার ভেতর মোরগ একটা এনে দিলো বটে। কিন্তু সে মোরগ আমার নানান বয়সী একপাল মুরগি পরিবেষ্টিত থেকেও, একেবারে ধারেকাছে কোনো বাড়ি নতুন বাড়িতে নেই, তবু দূরের প্রতিবেশীর কোনো মুরগির কুনকুন একটু ডাক শুনে, ককক্ক ককক্ক ক করতে করতে দৌড়ে চলে যায়। যেতে যেতে গ্রীবার পেখমে যে ভাবখানা তার ফোটে, যেন ভীষণ মহৎ উদ্দেশ্যে যাত্রা করছেন তিনি! মনেপ্রাণে তীব্রপণ, যেন আমি আসছি তোমাদের সব যাতনা বধে।
বাড়ির মুরগিগুলো যেমন দানা খুঁটে খাচ্ছিল, তারা তেমনি খেতে থাকে! কোনোটাই তাদের সে সবেধন নীলমনি মোরগের পথ আটকায় না। পেছনে পেছনেও যায় না!
অথচ অধিকারবোধের মতো প্রবল মর্মজ্বালাটি আমার একলার প্রাণে ভীষণ তড়পাতে থাকে। আমি আমার মমতাময়ী সহকারিণী মমতাজকে ডেকে বলি, বিধাতা পুরুষ তাহলে নারীর ভেতর কেন এত ঈর্ষা দিয়েছেন? স্বামী বা প্রেমিকপুরুষের মনোযোগ, ভালোবাসা, যৌনসক্ষমতা সব তার স্ত্রী বা প্রেমিকা নিজের সুরক্ষায় রাখতে চায়!
নারী-পুরুষ উভয়েরই সম্পর্ক ও জীবন বেদম ভারাক্রান্ত এই এমন একটি বিষয়ের অধিকার নিয়ে, যা শতবার দলিল করিয়ে নিয়েও নিশ্চিত থাকার উপায় নেই! তবু, শুধু একে ঘেরাটোপে বাঁধতে এ নিয়ে কত হাদিস-কালাম, আইনের প্রয়োগ। এসব দেখেশুনে আমার তো ইচ্ছে করছে, জোর গলায় বলি, এই মোরগের প্রবণতা দিয়েই তো বিধাতা পুরুষমানুষ গড়েছেন। তাহলে আইনকানুন সেই ধাতে ফেলে, সে রকম আরও খোলাসা হতে পারতো। আর মেয়েগুলোকে বিধাতা কেন শুধুই মুরগিই বানাতে পারলো না! যাদের শেয়াল-বেজি, কাক-চিলের সঙ্গে লড়াইয়ের তাগদ থাকলেও ঘরের পুরুষকে আটকানোর কোনো প্রবণতা, কোনো আগ্রহ-ভালোবাসা থাকবে না! পুরুষকূলকে কেবল সন্তানের বীজদাতা করে রাখা ছাড়াও হেলায়ফেলায় মাঠের ফসল তোলার চাষি, চাক ভেঙে মধু আনার মৌয়ালগিরির মতো আরও এমনি সব কাজের জন্য যদি রাখা যেতো, সেটাই বেশ হতো! ঘরের বাইরে থেকে পাখা টানতে টানতে বুঝতো স্ত্রী’র ভালোবাসা কী রক্ষাকবচ!
কেন যে ঈশ্বর স্বামীর বীর্য রক্ষায় জীবন বিপন্ন করা অমন শাঁখের করাতের মতো দামি ঈর্ষাটুকু গুঁজে দিলেন নারীর অসহায় প্রাণে! যার মাত্রাতিরিক্ত প্রয়োগে সমাজও তাকে কখনো খল ঠাওরায়। তাহলে শুরু থেকে নারীকে মানবতাবোধের চেয়ে পাখবতাবোধটা বেশি শেখাতে পারলে, পুরুষের সঙ্গে নারীর সম্পর্কের আটোঁসাঁটো ভাবটা কমে আসবে।
এসব ভাবনার ভেতরে একদিন আজিজ সুপার মার্কেট যাওয়ার দরকার হলো। ড্রাইভার বাংলামোটরের জ্যাম এড়াতে কাঁটাবন হয়ে ঘুরে গেলো। এতে করে রাস্তার পাশে পাখির দোকান দেখে অপ্রত্যাশিতভাবে গাড়ি থামাতে বললাম।
কয়েক দোকানে খুঁজেও কোয়েল পেলাম না। শেষে এক দোকানে আধাখাস্তা তিনটে পেলাম। আমার দরকার একটি নারী কোয়েলের। ও, আমারই বা দরকার কোথায়? দরকার তো ওই বিপত্নীক কোয়েলটার। যে আস্ত পৃথিবীর প্রতি মারমুখী হয়ে আছে! দোকানি নারী কোয়েল বলে যেটা দিল, আমার সন্দেহ যাচ্ছিল না কোয়েল-নারীর আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য না জানা থাকায়। তাই দুটো একসঙ্গে নিলাম।
সদ্য কেনা কোয়েল দু’টোই মুমূর্ষু ছিল। তবু অনন্যোপায় হয়ে কেনা! দুপুর পেরিয়ে বাসায় এনে সদ্য কেনা কোয়েল দুটোকে খাঁচার ভেতর ঢোকাতেই পুরনো কোয়েলটা মুহুর্মুহু একটা ছেড়ে আরেকটা যেভাবে ধরছে, তাতে আমি তো আমি, যে কারও তাজ্জব না বনে উপায় ছিল না!
আবারও ভাবতে লাগলাম, তাহলে সেই তো মানুষেরই আর দোষ কী!
শেষে মানবিক আর পাখবিক দুই রকমের দুটি বিষয় রজ্জুর মতো আমার সমস্ত চৈতন্য এক করে একটানা পাকাতে লাগলো।
সেদিন দিনের বাকি সেটুকু বেলা আর চেঁচামেচি শোনা গেলো না। কিন্তু রাত একপ্রস্থ পার হতেই আবার একটার প্রাণঘাতী চিৎকার! চিৎকারের কারণ জানতে চাইলে, মাত্র একদিন আগে কিশোরগঞ্জের কোনো এক গ্রাম থেকে আসা কাজের ষাটোর্ধ্ব মহিলা, যাকে ইতোমধ্যে খালা বলে ডাকতে শুরু করেছি, সে-ই বললো, এইহানো ব্যাডা দুইডা, আর মাইয়া একটা! এক মাইয়ারে লইয়া, দুই ব্যাডার খুনাখুনি!
আমি সে মৃত্তিকাঘনিষ্ঠ জীবনের অধিকারিনীকে সাক্ষী মেনে বললাম, কিন্তু তুমিও তো দেখলে, আনার সঙ্গে সঙ্গে পুরনো কোয়েল যা আচরণ করলো, তাতে তো মনে হলো, নতুন দুটোই মেয়ে!
খালা বললো, তহন কি আর ব্যাডা চোউখ দিয়া দ্যাকছে? এহন যহন মাথার আগুন কমছে, এহন দিশা বাইরাইছে!
আমি বললাম, তাহলে ঠ্যাকায় পড়লে পাখিও সমকামী হয় বলছো?
সমকামী শব্দটি আগে না শুনলেও খালা ফেরে পড়ে বুঝে গেছে। শেষে আমার দিকে তাকিয়ে সরুচোখে বললো, দ্যাকলা তো নিজের চোউখকে!
এরপর আর সময়ক্ষেপণ চলে না। আমি খাঁচার কাছে গিয়ে দেখলাম, নতুন দুটোর একটার মাথা বেয়ে রক্ত পড়ছে এবং যন্ত্রণায় সে মাথা তার ঘাড়ের ভেতর সেঁধিয়ে আছে। বুঝলাম ঘায়েল হওয়াটা নতুন পুরুষ! যদিও এই কতল হওয়া মাথা নিয়ে নারীঘটিত বিষয়ে এর পুরনোটার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যাওয়ার সাহস-ক্ষমতা কোনোটাই আর হবে না, তবু জহীরকে ডেকে বললাম, এটাকে জবাই করে আনো।
জহীর সেটা জবাই করে চামড়া ছিলে, একটুকরো কাগজে মুড়ে ঢিল ছোঁড়ার মতো করে ফ্রিজে ছুঁড়ে মারলো। আর খালা ছুটে এসে তু তু করে বললো, জবাই না কইরা ছাইড়া দিলে কী অইলো অইলে?
আমি বললাম, মায়া লাগতেছে?
খালা উত্তর দিলো, অয়ও!
বললাম, মুরগি খাও না? গরু? হরিণ? মোষ? তখন মায়া লাগে না? এটাও তো টাকা দিয়া কিনছি! তাই একসময় ভেজে খেয়ে ফেলবোনে!
খালার চোখ ভিজে উঠলেও এতটা ভয় পেতাম না! কিন্তু দাবানল শেষের বন আমি দেখেছি। পুড়ে কয়লা হওয়া গাছ থেকেও ডাল জন্মে। তাই আপাতত সেখান থেকে সরে গিয়ে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঠেকালাম।
এরপর এক খাঁচায় সুখে-শান্তিতে বাকি কোয়েলদ্বয় বসবাস করলেও আবীরের তাতে আর আগের মতো আগ্রহ টের পেলাম না। জীব-জন্তু, পশু-পাখি পুষতে আমারও ভালো লাগে। কিন্তু তা মনে মনে। কারণ অত বাহুল্য সময় আমার জীবনে কোনোকালে ছিল না যে, নিরালায় বসে পাখির অধিক নিজের সঙ্গেও দুটো অনিবার্য কথা বলি!
এই ক’দিন আগে আবীরকে বললাম, একমাস না যেতেই খালা তো তার নাতিপুতির টানে চলে গেছে। তুমি যেহেতু কিনেছ, এখন পাখিকে ঠিকভাবে খাবার দেওয়া, মাঝে মাঝে তোমার সঙ্গে বাথরুমে নিয়ে তাদের গোসল করানো এবং সাধারণভাবে পরিষ্কার করার দায়-দায়িত্ব তোমার। না হলে কিন্তু গোনাহ হবে। পশু-পাখি পুষলে তা দরদ দিয়ে পুষতে হয়। আর গোসল মানে তো, তুমি নিজের গোসলের সময় খাঁচাসহ ওদের তোমার পায়ের কাছে রেখে দিলে শাওয়ারের ছিঁটে আসা পানিতেই ওদের গোসল হয়ে যায়।
আবীর গলা ঝাড়া দিয়ে বললো, এবার তো আপনি কিনছেন! আমি আগেরবার কিনছিলাম!
আমি বললাম, ওম্মা, তাই নাকি? তোমার কেনা পাখি একটা মারা যাওয়াতে আরেকটার চিৎকারে টিকতে না পেরে বিরহী সে পাখির প্রতি মায়া, আর তোমাকে সম্মান করেই না এত হ্যাপা করে আমি কিনলাম, আর তাতেই আমার দোষ?
আবীর বললো, তয় কী? আমি আবার কিনতে গেছিলাম নাকি? বুঝলাম, তার মোহ টুটগিয়া! তবু খাবার ফুরিয়েছে দেখে, সে দু’দিন আগে পান্থপথ বাসা থেকে হেঁটে হেঁটে যাওয়া-আসা কওে কাঁটাবন থেকে পাখিদের খাবার এনেছে। কিন্তু খাবারই তো শেষ কথা নয়! পাখি বেচারিদের পুরোপুরি যত্ন হচ্ছে না দেখে আমার মনটা খুব কাতরাচ্ছিল। কী করি, কাকে দেই! যাকে তাকে দিলে তো পোষা পাখি দিলে হবে না। দিতে হবে যে এগুলোকে ভালোবাসবে। আবার যাকে দেবো, সে হতে হবে আমাদের ভালোবাসার মানুষ!
একটি চ্যানেলের নামকরা সাংবাদিক, আদিত্য শাহীন ও ‘পারি’ পত্রিকার সম্পাদক লাইলা খালেদার বৃক্ষপ্রেম দেখে, আদিত্য’র স্ত্রী লাইলাকেই বললাম, আমার একজোড়া কোয়েল আছে। তোকে দিতে চাই।
সে বললো, দেন আপা, খাবার কিনে নিচে কেয়ারটেকারদের কাছে রাখবো। লাইলার কথায় মনটাতে একটু মোচড় দিয়ে উঠলো। মনে মনে ভাবলাম, এত কম যে ভালোবাসবে, তাকে এতদিনের পোষা পাখি সমর্পণ করা যাবে না! লাইলাকে দিলে নতুন কিনে দেওয়া যায়।
পথের ভেতর আবীরের মাকে ফোন দিয়ে বললাম, আবীরের পাখি তোমরা রাখো। এই ছড়াসাহিত্যিক বললেন, আমাদের ঘরভরা বিড়াল। সমবেত হয়ে তারা খাঁচার শিক ভেঙে একলহমায় ও দুটোকে খেয়ে ফেলবে!
সব শেষে মন এক ভিন্নমুখ খুঁজে পেলো, কোয়েল গ্রহীতা হিসেবে যে হবে সেরা উপযুক্ত—কবি অঞ্জনা সাহার তিন বছরের পৌত্রীর মুখ মনে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয়, তৃতীয় মনও, মানে একটা মানুষের যে ক’টা মন থাকে তার সবই এসে এইমুখের পক্ষে সায় দিলো।
আবীরকে ডেকে বোঝালাম, পাখি পোষা দোষের নয়, যদি তুমি তাকে ভালোবাসো। পাখির কাছ থেকে আকাশ ছিন্ন করে খাঁচায় ভরেছ, ঠিক আছে। কিন্তু তাকে ভালোবাসা দিয়ে তো তা পুষিয়ে দিতে হবে! বন্দিত্বেও যে কেউ কিছুটা সার্থকতা খুঁজে পেতে পারে। যদি তার মনে হয়, শুধু আমাকেই ভালো বাসতে কেউ আমাকে বন্দি করেছে। কিন্তু ভালো না বেসে অবারিত স্বাধীনতা থেকে যে কাউকে বন্দি রাখলে তো নিজেরও একটি যাতনা তৈরি হয়। না কি?
আবীর বললো, ঠিক!
আমি আবীরের অনুমতি পেয়ে কবি অঞ্জনা সাহাকে বললাম, আমি যেকোনো সময়ে তোমার বাসায় একটি জিনিস দিতে আসবো। এইকথা বলার পর সময়ের অভাবে তাকে দু’দিন অপেক্ষায় রাখতে হলো। তারপর যখন গেলাম, পৌত্রী অদ্বিতীয়া রাই দরজার কাছেই ছিল। আগে খাঁচাটা নজরে পড়তেই ওইটুকু রাই, সেও বুঝতে পারলো ভেতরে পাখি আছে!
তারপর তার বাড়ানো দু’হাতে গ্রহণের ভেতর দিয়ে আমার পাখি সমর্পণের কাজটি মধুরভাবে সম্পন্ন হলো। বুঝিয়ে দেওয়া হলো পাখির বাকি খাবারও। যা সে এ বাড়িতে থাকলে আরও ক’দিন খেতো।
এদিকে চাকরিজীবী মেয়ে-জামাই দুজন দু’দিন রান্নাঘরের বারান্দায় গিয়ে কোয়েলদ্বয়কে দেখতে না পেয়ে পেয়ে, আলাদাভাবে একই কায়দায় অবাক চোখে জানতে চাইলো, পাখি গেলো কই? আমি দু’জনকে একইরকম করে উত্তর দিলাম, কবি অঞ্জনা সাহার পৌত্রীকে গছিয়েছি!
দুজনেই সেই একইভাবে অনিবার্য আরেকটি প্রশ্ন করলো, আবীর কিছু বলেনি?
আমি সেই একইরকম করে দ্বিতীয়বার আরেকটি যে উত্তর দিলাম, আবীরকে বুঝিয়েছি, ভালোবাসার বিনিময়ে কাউকে বন্দি রাখা যায়। কিন্তু অবহেলা করে তো বন্দি রাখার দরকার নেই! কোয়েল দু’টিকে তাকেই দেই, যে ওদের ভালোবাসবে!
কথা শেষ না হতেই দু’জনেই তাদের শেষের প্রশ্নটি ঝেড়ে দিয়েছে, আবীর কী বললো? তিন নম্বর প্রশ্নের উত্তরটিও সেই আমার একইরকম। বলি, ও তো এমনভাবে ‘দ্যান’ বললো, যে দিতে পেরে বাঁচলো মনে হলো।
আর যেটুকু শোনার জন্য কেউ-ই অপেক্ষা করে না, তা হলো, যে কাউকে প্রতিদানহীন একটানা ভালোবেসে যাওয়া সোজা কথা নয়। সে পাখিই হোক, গাছ কিংবা মানুষ! কোয়েল অবশ্য মাঝে মাঝে একটি করে ডিম দিতো। কিন্তু নর্থ সাউথে লাস্ট ইয়ারে পড়া একজন ছাত্রের প্রতিদিন অনেকখানি করে অভিনিবেশ পেতে মাঝে মাঝে পাড়া সে ডিম আর প্রতিদান হিসেবে কতটুকু!