মাত্র হাজার পাঁচেক টাকার জন্য আমার রাতটা নির্ঘুম কাটে। মাত্র হাজার পাঁচ।
সমস্যাটা হুট করে সামনে এসে দাঁড়ায়। আমার বেমানান দরদিয়া মনের পথ ধরে। এই দরদিয়া মন আজীবন শত্রু আমার। নইলে শুধু আমাকে ছাড়া বাঁচবে না জেনে নিশ্চিত বেতনের ব্যাংকার, ক্যাডার অফিসারের প্রস্তাব ছেড়ে চালচুলোহীন সাহাবের হাত ধরে এই মফস্বলী অনিশ্চিত জীবনে ঝাঁপ দেই? যে জীবনে নুন আনতে পান্তা ফুরায় না বটে, পান্তা আনতে নুন ফুরায় আর নুনহীন আলুনি দিন কাটে। যাক, সে অন্য ইতিহাস। এখন বলার সময় নয়। এই অতিমারীর কালে এই পুরান কাসুন্দি ঘাঁটাঘাঁটি করতে আমারো ভালো লাগছে না। আপনাদেরও শুনতে ইচ্ছে করবে না।
সিদ্ধান্তটা আমি নিয়েই নিয়েছিলাম। আমার ওপরই ছেড়ে দিয়েছিল সাহাব। পেটে খিদে রেখে মুখে লাজ। পাঁচ হাজার টাকা। অনেকের কাছে মাত্রই বটে। আমার জন্য এই মুহূর্তে অনেক। আমি আর আমার বাচ্চাদের বাবা সাহাব দুজনেই একটা প্রাইভেট কলেজে পড়াই। দুজনে মিলে মাস শেষে যা টাকা ঘরে তুলি, তাতে টেনেটুনে সংসারবেলা কেটে যায়। খুব স্বাচ্ছন্দ্যে নয়। একবেলা মাছ তো অন্য বেলায় সবজি। পোলট্রি মুরগি। জন্মদিনে বাচ্চাদের চাইনিজ কিংবা এটা-ওটার বায়না নানা অজুহাতে এড়িয়ে যাই। টিচারের খরচ বাঁচানোর জন্য নিজেই পড়াতে নিয়ে বসি। বাড়তি গানের টিচার কিংবা আর্টের টিচার রাখি না। কত সমঝোতা। তবে আয়টা নির্দিষ্ট আর নিয়মিত বলে দিন আটকায় না। এই যা।
দুমাস আগে, সব বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে বেতন পেয়ে চাল-ডাল-আলু-পেঁয়াজ-তেল কিনে রেখেছিলাম। এদিক-সেদিক করে চলে যাচ্ছিল। হুট করে চা-পাতা চিনি, বিস্কুট ফুরিয়ে গেলে সঞ্চয়ের ভাঁড়ারে টান পড়ে। তাও আর কতই বা ছিল! খরচের টানাটানির পর যৎসামান্য।
শিক্ষিত হিসেবে বন্ধমহলে ওর ইজ্জতটা বেশ। সবাই সমীহ করে। কেউ নাম ধরে ডাকে না, মাস্টার বলে। আলাদা সম্ভ্রম দেখায়। সেই সম্ভ্রমের আঁচ আমার গায়েও লাগে। আমার সামনে তারা সম্ভ্রমে সালাম ভাবি বলে দাঁড়িয়ে যায়। ঠাট্টা মশকরা এমনকি স্বাভাবিক কথাবার্তা বন্ধ করে চুপ হয়ে যায়।
ম্যানেজিং কমিটির সেক্রেটারিকে ফোন করেছিলাম। দিন-কয়েক ধরেননি। অবশেষে একবার ধরে জানিয়ে দিয়েছেন, ছাত্রদের বেতন কালেকশন হচ্ছে না। শিক্ষকদের বেতন দেওয়াও সম্ভব নয়। আসলে আমরা ব্যাপারটা জানি।
কলেজটা এখনো এমপিও ভুক্ত হয়নি। ছাত্রদের বেতনই ভরসা। যে দুমাস যাচ্ছে, তার বেতন আমরা আদৌ আর পাবো না। কলেজ কবে খুলবে তার কোনো ঠিক নেই। খুললে আদৌ ছেলেরা আবার ক্লাসে আসবে কি না, তারও নিশ্চয়তা নেই। যে রকম আর্থিক মন্দা, অভাব, দুর্ভিক্ষের কথা বিশেষজ্ঞরা বলে যাচ্ছেন, তাতে কলেজটি টিকে থাকবে কি না, তাই বা কে জানে!
আসলে এতদূর ভাবতে চাই না। বর্তমানটাই কিভাবে কাটাই তার হিসাবে মত্ত থাকি। প্রতিবেলায় ডাল আলুভাজি কিংবা আলুভর্তা প্লেটে দিয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে অহেতুক গল্প জমাই, খাবার নিয়ে কমপ্লেইন করার সুযোগ দিতে চাই না। আচ্ছা বাবু দেখেছিস সাব্রিনা ফ্লোরার মনটা আজ বেশি খারাপ মনে হচ্ছিল না? আসলে পরিস্থিতি ভালো নয়। প্রতিদিন রোগী বাড়ছে। গার্মেন্টস শ্রমিকদের এভাবে কেন ঢাকা নিয়ে এলো বলো তো, সরকারকে চাপে ফালানোর জন্য। বাচ্চাদের তেমন আগ্রহ দেখি না। এসব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ওদের বিরক্ত করে টের পাই, ভদ্রতার মূল্যবোধ চোখেমুখে বিরক্তির স্পষ্ট ছাপ আটকাতে ব্যর্থ হয়। ওরা চুপচাপ ভাত নাড়াচাড়া করে। এক দুই গ্রাস মুখে দেয়। ওরা কি আমার চাতুরি ধরে ফেলে? আমি প্রসঙ্গ ঘোরাই। আচ্ছা প্রমী ফোন করেনি আর? তুমি একবার খবর নিও কেমন আছে। ওরা তবু চুপ করে থাকে। ওদের এই চুপ করে থাকা যে এই পরিস্থিতি মেনে না নেওয়ার নীরব প্রতিবাদ, আমার বুঝতে বাকি থাকে না।
এই সময়ে ঘরে পাঁচ হাজার টাকার প্রস্তাব। মাত্রই বটে। হিসাব করে দেখি মাছ খাওয়া হয় না, তাও প্রায় চল্লিশ দিন। প্রস্তাবটা দেয় সাহাবের বন্ধু রিশাদ। রিশাদ নিচ্ছে। আমরাও চাইলে নিতে পারি। দিচ্ছে লন্ডনপ্রবাসী ওদেরই বন্ধু আসগর। শুধু বন্ধুদের জন্য। রোজায় খরচের জন্য। সাহাব যখন প্রথম প্রস্তাবটা আমাকে দেয় আমার প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হয়। আমরা কি ভিক্ষুক যে, ওদের টাকা নেবো! সাহাব চুপ করে যায়। নাকের ডগায় ভুলে থাকা জরুরি প্রয়োজনগুলোর কথা উল্লেখ করে না। আর উল্লেখ করবে কী, আমি কি জানি না?
সারাদিন ভাবি, একাজ-ওকাজ করতে করতে ভাবি। নিলে আপাতত বেশ কিছু সমস্যার সমাধান হয়। রোজার বাড়তি খরচটুকু। ছোলা, খেজুর, তেল, পোলাও চাল। বাচ্চাদের জন্য সামান্য মাছ৷ অনেকগুলো প্রয়োজন সারি সারি সামনে দাঁড়ায়। তালিকার শুরুটা দেখি, শেষ দেখি না। আসলে সাহাবের বন্ধুদের মাঝে সাহাবই একমাত্র ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি নিয়েছে। বাকিরা সব স্কুলের গণ্ডি ডিঙিয়ে হয় ব্যবসা-পাতি, নয় বিদেশ। মিডল ইস্ট, লন্ডন আমেরিকাও কেউ কেউ। শিক্ষিত হিসেবে বন্ধমহলে ওর ইজ্জতটা বেশ। সবাই সমীহ করে। কেউ নাম ধরে ডাকে না, মাস্টার বলে। আলাদা সম্ভ্রম দেখায়। সেই সম্ভ্রমের আঁচ আমার গায়েও লাগে। আমার সামনে তারা সম্ভ্রমে সালাম ভাবি বলে দাঁড়িয়ে যায়। ঠাট্টা মশকরা এমনকি স্বাভাবিক কথাবার্তা বন্ধ করে চুপ হয়ে যায়।
মেম্বার বার দুয়েক প্রস্তাব পাঠিয়েছে বাসায়। বলো কী! আমি আঁৎকে উঠি। নেশাগ্রস্ত ছেলেটার অত্যাচার সইতে না পেরে আগের বউটা গলায় দড়ি দিয়েছে, সে কি থানা পুলিশ সাংবাদিক হৈ চৈ গ্রামে। অঢেল অর্থে সেবার ধামাচাপা পড়েছিল সব। এই তো সেদিন। বড় জোর বছর দুই।
আজ তাদের কারো টাকা হাত পেতে নিতে কেমন অহমে বাঁধে। কিন্তু বেঁচে থাকার প্রয়োজনের চেয়ে তো অহম বড় নয়। বিকেল নাগাদ নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে সিদ্ধান্ত নেই টাকাটা নেবো। সাহাবকে বলি। সাহাব ক্ষানিকক্ষণ থ মেরে চেয়ে থাকে আমার দিকে। ও কল্পনা করেনি সকালে যে এমন ক্ষেপে গেলো, বিকেল না গড়াতেই সে এমন নমনীয় হয়ে যাবে। সাহাব জিজ্ঞেস করে, তবে রিশাদকে বলি আমরা টাকাটা নিচ্ছি।
এ পর্যন্ত ঠিক ছিল। সমস্যাটা শুরু সন্ধ্যা থেকে। সেদিন ক্যালেন্ডারের তারিখে ৮ মে। বঙ্গাব্দে ২৫ বৈশাখ। ঘরে ঘরে সেদিন অমৃতসদন, পিতার ভবন। সাহাব খুব গানপাগল ছেলে নয়। তবু অলস সময় কাটানোর জন্যই কিনা সকাল থেকেই রিমোট নিয়ে চ্যানেল ঘোরাচ্ছে। ঘর ভাসছে অপার্থিব সুরে, ‘হে নতুন দেখা দিক আরবার।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতি করতাম আমরা। আবৃত্তি, অভিনয়, বিতর্ক যা যা করলে রবীন্দ্রনাথ শোনার অভ্যাস হয়, সুকান্তর কবিতা পাঠ করা হয়, সলিল চৌধুরীর গান গাওয়া হয়। যার সবকয়টি এই মোটিভেশনাল স্পিকিং আর লাইভ শোর-কালে বেমানান। আমরাও সময়ে এক অসময়ের বেমানান পরিবার।
গান শুনতে শুনতে আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরি। কত রকম আলোচনা পর্যালোচনা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পীরের জানাজায় লাখো মানুষ। নারায়ণগঞ্জের চাষাড়ায় সিঁড়িতে মরে পড়ে থাকা খোকন সাহার মৃতদেহ সৎকারে এগিয়ে আসেনি কেউ৷ ইউপি চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে কয়েক শ বস্তা চাল উদ্ধার। নিজেকে স্থির করতে চাই। নিজের ভেতরের দুগ্ধতা ভুলতে চাই।
বন্ধ ঘরের জীবন, ৫৩ দিন হতে চললো। চল্লিশ বছরের জীবনে প্রথম প্রথম এই অনাকাঙ্ক্ষিত অপ্রত্যাশিত ছুটি পেয়ে আমাদের এক অপার আনন্দ। কেমন একটা উৎসব উৎসব ভাব ছিল। ইউটিউব। নতুন রেসিপি। নতুন সিনেমা। ভালোই কাটছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঘটনা এমন দাঁড়াবে ভাবিনি। আমাদের ভাঁড়ারে টান পড়বে। বাচ্চারা খালি ডাল আলু খেতে খেতে টেবিলে বসে চোখ মুছবে। আমরা দেখেও না দেখার ভাণ করে টিভিতে সাউন্ড বাড়িয়ে দেবো। যেন কিচ্ছু হয়নি মতো ওদের বলবো, দেখ দেখ টিয়া পাখিটা কেমন তুই রাজাকার, তুই রাজাকার বলছে!
তখনো আমাদের ফ্ল্যাটের মেইন গেটে তালা পড়েনি। হঠাৎ সন্ধ্যায় কলিংবেল বাজলো। নতমুখে দরজায় দাঁড়িয়ে যে নারীটি, তাকে আমি চিনি না। আমাকেই সে জিজ্ঞেস করে, শামীমা ম্যাডাম আছেন? আমি একটু দেখা করতে চেয়েছিলাম। ভেতরে আসতে বলি কিছুটা শঙ্কা নিয়েই। ক্রমাগত নিউজ আপডেট সংক্রমণের সন্দেহরোগ ঢুকিয়ে দিয়েছে ভেতর। দূরেই বসতে বলি নারীটিকে। আলাদা চেয়ারে। সমস্যা শুনতে চাই। মহিলা বলে, আমার কাছে বলা অনর্থক জেনে ট্রেইলারের দোকান মহিলার। নিত্য আনি নিত্য খাই৷ দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। ঘরে খাবার যোগান নেই। শামীমা ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করতে চান। বুঝতে পারলাম আমিই যে শামীমা ম্যাডাম, না চিনেই কথা বলছে সে। তার মেয়ে পাঠিয়েছে। মেয়েটি আমার ছাত্রী।
মার্চে দ্বিতীয় সপ্তাহে মেয়েটির সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল আমার। তখনো ইতালির মৃত্যুর সংখ্যাটাই মূল নিউজ। যুক্তরাষ্ট্রের খবরে মৃতের সংখ্যা বাড়ছে ধীরে ধীরে। বাংলাদেশকে নানা পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। কোয়ারেন্টাইন, লকডাউন, আইসোলেশন শব্দগুলো শুনছি কেবল। মসজিদগুলো বন্ধ হবে কি না, পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা চলছে। দিল্লির নিজামুদ্দিন তখনো খবর হয়নি।
আসলে এ ঝক্কি আমি ডেকে এনেছি। ওকে কয়েকশ টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিলাম। ফরম ফিলাপ করতে পারছিল না। গোমরা মুখে দাঁড়িয়ে ছিল বারান্দায়। সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসার সময় চোখে পড়ে আমার। নত মুখে কান্নারত মেয়েটি। বৃত্তান্ত শুনে নিজে কয়েকশ টাকা দিয়ে আরও দু-চার জনকে ফোন দিলাম। কলেজের ভেতরেই ছিলেন তারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। বিরক্ত হলেও তারা এক দুই শ দেন। মেয়েটার ফর্ম ফিলাপ হয়ে যায়। মফস্বলের কলেজ। এমন প্রায়ই দু-চার জনকে সাহায্য করতে হয়। আমিও এ ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত। মানুষকে সাহায্য করতে আমার জুড়ি নেই। নিজের দুটাকার জীবন, সেখান থেকেই একটাকা দেওয়ার অভ্যাসটা মায়ের কাছে পাওয়া। এজন্য বাবার কাছেও কত খোঁটা শুনতেন মা! আমিও শুনি। তবু বিপদগ্রস্ত কাউকে দেখলেই হাত নিশপিশ করে সাহায্য করার জন্য। মেয়েটিকেও করেছিলাম। এরকম সাহায্যপ্রাপ্তরা কৃতজ্ঞতা জানিয়েই দায়িত্ব শেষ করে। কিন্তু মেয়েটি শেষ করেনি। চেম্বারে এসে আগবাড়িয়ে নিজের অনেক কথা বলেছিল। মেম্বারের ছেলের কথা বলেছিল। হিরোইন খেয়ে যে রাস্তা আগলে দাঁড়িয়ে থাকে কলেজ থেকে ফেরার পথে। আমি গভীরভাবে মেয়েটিকে দেখি। রূপের সঙ্গে লাবণ্য তো বটেই, সঙ্গে মেধার ঔজ্জ্বল্য হীরের মতো চকচকে দ্যুতি দিয়েছে মেয়েটিকে। মেম্বারের ছেলের বোতাম খোলা, লালচে চুলের, অনিয়ম অত্যাচারের ছাপ মাখা দৃষ্টিটা মনে পড়তেই গা ঘিনঘিন করে। জিজ্ঞেস করেছিলাম কে কে আছে পরিবারে। স্বাভাবিক কৌতূহল। মাসহ পাঁচ জন। মেয়েটি জানিয়েছিল। একটু প্রশ্রয়ে বলে দিয়েছিল স্বপ্নের কথা। জেলা সদরে গিয়ে কোচিং করা, বিসিএসে পাস করার স্বপ্ন। আমার কয়েকশ টাকার সাহায্য মেয়েটির মধ্যে একটা বিশাল নির্ভরতা তৈরি করেছে টের পাই৷ মেয়েটি নতমুখে বলে যেতে থাকে আয়-রোজগারহীন সংসারে মা মেম্বারের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিতে চায়। মেম্বার বার দুয়েক প্রস্তাব পাঠিয়েছে বাসায়। বলো কী! আমি আঁৎকে উঠি। নেশাগ্রস্ত ছেলেটার অত্যাচার সইতে না পেরে আগের বউটা গলায় দড়ি দিয়েছে, সে কি থানা পুলিশ সাংবাদিক হৈ চৈ গ্রামে। অঢেল অর্থে সেবার ধামাচাপা পড়েছিল সব। এই তো সেদিন। বড় জোর বছর দুই।
দাফনের জন্য খাটিয়া দিচ্ছে না মসজিদ কর্তৃপক্ষ। সারা গিলবার্টের টিকা সাফল্যের মুখ দেখলো বলে। আশার আলোগুলো শেয়ার করার চেষ্টা করি নিজের টাইমলাইনে। বিসিজি টিকা বাঁচিয়ে দিতে পারে এদেশের মানুষকে।
মেয়েটিকে ওর মতো বখাটের কাছে জবাই করা! মানতে পারি না। কিন্তু আমার ক্ষমতা যে ওই আঁৎকে ওঠা পর্যন্তই। তবু চুপ করে শুনি, সহমর্মিতা নিয়ে শুনি। বুঝি মেয়েটি এভাবে আর কাউকে কোনোদিন নিজের কথা বলতে পারেনি। কতটা পারবো, কতটা পারবো না, অনিশ্চয়তা নিয়েই মেয়েটিকে সান্ত্বনা দেই, তোমার মাকে নিষেধ করে দেবো, কাজটি যেন তিনি না করেন। মেয়েটির কাছে নাম্বার নিয়ে ফোন দিয়ে না করেছিলামও। কড়া করেই নিষেধ করেছিলাম। বলেছিলাম, অন্তত পড়াশোনাটা শেষ করতে দিন। মেধাবী মেয়ে। ভালো চাকরি হবে ওর। মেয়েটির মা আমার কথায় ভরসা করেছিলেন। তার কণ্ঠে ভণিতা ছিল না। জি ম্যাডাম, জি ম্যাডাম বলে আমাকে আশ্বস্ত করেছিলেন।
আজ করোনাকাল এই মেয়েটির মাকে আমার দরজায় নিয়ে এলো! পূর্বাভিজ্ঞতার ভরসাতেই আমার কাছে চলে এসেছেন সম্ভবত। সাহাব যেন বুঝে ফেলে আমি মহিলার ইনিয়েবিনিয়ে কান্নাতে ভুলে যাচ্ছি৷ ভেতর থেকে চোখ রাঙায়। আমি শক্ত অবস্থানেই আছি। নিজের ভাঁড়ার শূন্য। আত্মসম্মান বিকিয়ে দিচ্ছি ভিক্ষুকের মতো। ইশারায় আশ্বস্ত করি সাহাবকে। নারীটিকে বলি, না একদম পারবো না, কত ত্রাণ-সাহায্য চারদিকে, খোঁজ নিন। পাবেন৷ নিজের চারিত্র্যিক স্বাভাবিকত্বের খোলস ছেড়ে একটু কি রেগেও যাই? আপনারা তো ত্রাণের জন্য লাইনে দাঁড়াতে পারেন। আমরা তো তাও পারি না।
মহিলাটি আবার বলে, শামীমা ম্যাডাম নেই? মেয়ে কইছে শামীমা ম্যাডামের কাছে গেলেই হবে। কলেজে নিজের এই গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করেছি নিজেই। মফস্বলের এই কলেজটাতে আমি যখন যোগ দেই, তখন আমার বয়স ২৫। টগবগে বিপ্লবের চেতনা। মিছিল-মিটিং করেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে সরাসরি এই চাকরি। স্বভাব ছাড়তে পারিনি। আমি স্বভাব বিরুদ্ধ কণ্ঠ রূঢ় করে বলি, আমিই শামীমা ম্যাডাম। শালীনতার বেড়া ভেঙে চলে আসে আমার বাচ্চাদের বাপ সাহাবও। আমার ওপর ভরসা পায় না। সেও রূঢ় হয় মহিলার সঙ্গে, যান তো যান৷ নিজেদেরই চলে না। আবার উটকো ঝামেলা। মহিলার নত মুখে চলে যাওয়া দেখে এবার কষ্ট লাগে আমার। কত হবে মহিলার বয়স, ৪০/৪৫। হয়তো যৌবনের শুরুতে বিয়ে বাচ্চা। যৌবন মাঝামাঝি না যেতেই স্বামীর মৃত্যু।
মহিলার চলে যাওয়ার ভঙ্গিতে আমার খারাপ লাগে। আমি রাগ করি সাহাবের সঙ্গে। আমি তো বলেছি, তুমি আবার এভাবে ঝগড়া করতে এলে কেন? সাহাব নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে। আর তুমি, তোমাকে আমার চেনা আছে মহিলা আরেকটু কান্নাকাটি করলেই ঠিক গলে যেতে।
ভালোই চলছিল সংসার আমার। এই অতিমারী কাল এসে হঠাৎ সব হিসাব গণ্ডগোল পাকিয়ে কেমন অস্বাভাবিক করে দিয়েছে। সাহাব রিশাদকে ফোন করে, টাকাটা তুই দিয়ে যাবি নাকি আমি নিতে আসবো? দেখিস কিন্তু কেউ জানে না যেন। চাওয়ার এই গ্লানি না শোনার জন্য আমি আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় ডুব দেই। অসুস্থ মাকে জঙ্গলে ফেলে গেছে সন্তানেরা। দাফনের জন্য খাটিয়া দিচ্ছে না মসজিদ কর্তৃপক্ষ। সারা গিলবার্টের টিকা সাফল্যের মুখ দেখলো বলে। আশার আলোগুলো শেয়ার করার চেষ্টা করি নিজের টাইমলাইনে। বিসিজি টিকা বাঁচিয়ে দিতে পারে এদেশের মানুষকে।
আত্মীয়-পরিজন-বন্ধু-স্বজনদের পরিচিত মণ্ডলে এখনো কোভিড পজেটিভ কিংবা মৃতের হিসাব এসে পৌঁছায়নি। রিশাদ জানায়, সে নিজেই আসতেছে টাকা দিতে। আমরা টিভির সামনে বসে অপেক্ষা করি আর মনে মনে তালিকা করি, কী কী লাগবে ঘরে, সবার আগে কয়েক হালি ডিম। অনেকদিন ডিম দেওয়া হয় না বাচ্চাদের। তালিকার শুরু আছে শেষ নেই। মেয়েটির মায়ের চলে যেতে যেতে ফেলে যাওয়া দৃষ্টি উদ্বায়ী হয়ে ঘুরে বেড়ায় আমার চারদিকে। আমি ঝেড়ে ফেলে দিতে চাই বারবার। কতদিন বাচ্চাগুলো মাছ-মাংস খায় না!
কে, কে—হাঁক ছেড়ে শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে ঘর থেকে বের হয়ে আসে মেম্বারের ছেলে। তার চোখেও আমার মতো রাত জাগার ক্লান্তি স্পষ্ট।
রাতে মেয়েটি আবার ফোন দেয়, ম্যাডাম। লাইনটা কেটে যায়। নাকি কেউ কেড়ে নেয় ফোনটা? নিজের ভেতর অস্থিরতা শুরু হয় আমার। অস্থিরতা গলা চেপে ধরি। বাড়তে দেই না। হাতে কড়কড়ে পাঁচটি হাজার টাকার নোট। জোর করে টিভিতে দৃষ্টি রাখি। প্রধানমন্ত্রী একের পর এক প্রণোদনা ঘোষণা করছেন। ব্যবসায়ীদের জন্য, ১০ টাকা কেজি চাল, পৌরসভার ত্রাণ, কিন্তু আমি সামান্য কলেজ শিক্ষক সত্যি জানি না মেয়েটিকে কী করতে বলবো, কার কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেবো, যেতে বলতে হয়!
রাত দশটায় সাহাব ভিডিও কলে কথা বলে বন্ধুদের সঙ্গে আমেরিকা কানাডার বাংলাদেশের গল্প। সরকার কেন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলো, লকডাউন দিলো না। আসলে সরকার দায় নিতে চায়নি। নিউইয়র্কে কেন এত আক্রান্ত হচ্ছে, কেন এত মানুষ মরছে! ট্রুডোর বউ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে।
দীর্ঘকাল পর আমাদের মেয়েদেরও একটা ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ হয়। স্কুলের সিঁড়ি ডিঙানোর ত্রিশ বছর পর। আজ আমরাও টুকটাক কথা বলি। কার মেয়েটার জন্য কেমন পাত্রী চাই, কার ছেলের কোথায় পড়ছে। টিকা কবে আবিষ্কার হবে। আদৌ হবে কি না! আগামী কয়েক বছর এর সঙ্গেই কি থাকতে হবে?
রাতে ঘরের এ মাথা-ও মাথা হাঁটি আমি। মেয়েটার অবনত দৃষ্টি, মেয়েটার মায়ের আহত চলে যাওয়া আমাকে ঘুমাতে দেয় না। কাল টাকাগুলো নিয়ে সকালে সাহাবের বের হওয়ার কথা। জরুরি জিনিসগুলোর তালিকাটা করে ফেলা দরকার। মেয়েটা কেন আবার ফোন দিয়েছিল? বাচ্চাদুটো কাল একমাস পর ডিম খাবে। মাংসও। টিভিতে প্রতিদিন বলছে ব্যালেন্সড ডায়েট খেতে। বেশি করে মাছ-মাংস খেতে।
শেষ রাতে হঠাৎ ঘুম ভাঙে সাহাবের। আমাকে মশারির বাইরে দেখে চমকে যায় ও, সারারাত ঘুমাওনি? আমার নিরুত্তর দৃষ্টি সাহাব পড়তে জানে। কাকডাকা ভোরে দুটি হাজার টাকার নোট নিয়ে বলে, চলো তুমিও সঙ্গে। সাহাবকে আনুষ্ঠানিক কিছু জানানো বাহুল্য মনে হয়। দুজন বেরিয়ে পড়ি।
সাতসকালে আমাদের দেখে মেয়েটির মা ততটাই বিরক্ত হয়, যতটা আমরা কাল হয়েছিলাম ওকে দেখে। আমি হাজার টাকার নোটগুলো বাড়িয়ে দেই, মহিলা স্পষ্ট উত্তর দেয় লাগবে না। আমরা থতমত খেয়ে একজন অন্যজনের দিকে তাকাই। জিজ্ঞেস করতে চাই, কেন লাগবে না, মেয়েটি কই? সুযোগ না দিয়ে ঘরে ঢুকে যায় সে, ঘর কোথায়, একচালা ছাপড়া। কে, কে—হাঁক ছেড়ে শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে ঘর থেকে বের হয়ে আসে মেম্বারের ছেলে। তার চোখেও আমার মতো রাত জাগার ক্লান্তি স্পষ্ট।