লন্ডন পিকাডেলি সার্কাস স্টেশন থেকে আন্ডারগ্রাউন্ডে হোয়াইট চ্যাপেলের দিকে যাচ্ছিলাম। ৪.২ মাইলের পথ যেতে পুরো আধঘণ্টা সময় লাগবে। ট্রেনের ঝাঁকুনিতে হালকা ঝিমুনি এসে গিয়েছিল। জোর করে চোখ খোলা রাখার চেষ্টা করছি কোনোমতে। একটু পর পর ট্রেনটি একেকটা স্টেশনে থামছে। প্রতিবার কিছু প্যাসেঞ্জার নেমে যাচ্ছে আর কিছু নতুন প্যাসেঞ্জার ট্রেনে উঠে বসছে। ট্রেনের রেকর্ডেড নারী কণ্ঠস্বরটি প্রতিবার বলে উঠছে, মাইন্ড দ্য গ্যাপ!
মাইন্ড দ্যা গ্যাপ, এই বাক্যটি আন্ডারগ্রাউন্ডের প্রতিটি নিয়মিত যাত্রীরই মস্তিষ্কে বিরামহীন বেজে চলে অটোমেটিক। বেইকারলু স্টেশনে কিছু প্যাসেঞ্জার নেমে যাওয়ার পর আমার বগিতে উঠেছে কয়েকজন যাত্রী। অনেকগুলো সিট খালি থাকার পরেও বেশিরভাগ আন্ডারগ্রাউন্ড যাত্রী কেন যেন দাঁড়িয়ে থাকতেই বেশি পছন্দ করে। ঢুলুঢুলু চোখে লোকটির দিকে চোখ গেলো আমার। লোকটির মুখের ছবি মস্তিষ্কে ধোঁয়ার মতো ছবি তৈরি করে নিয়ে আমার দুই চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল প্রায়, কিন্তু আচমকা বড় বড় চোখে তাকালাম আমি। কিভাবে সম্ভব? ইব্রাহিম, এখানে!
আমাকে সে দেখেনি তখনো। বগির মাঝের একটা রডে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে হাতের ম্যাগাজিনে মুখ গুঁজে ছিল ওঠার পর থেকেই। মুখের ডান দিকের অবয়বটা দেখেই চিনতে পেরেছি আমি। কোনো ভুল নেই। সেই ইব্রাহিম। ডান হাতের কব্জির গোল হাড়ের কাছাকাছি কাটা দাগটিও বেশ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। একবার ভাবলাম ডাকবো নাকি? পরে মনে হলো, থাক। এত বছর পর ডেকে আর কী লাভ! একদিন অনেক ডেকেও সঙ্গে রাখতে পারিনি যাকে, তাকে আর আজ এত বছর পর এই অন্যজীবনে অতীতের রাখি বাঁধা হাতে ডাকাডাকি করে কাজ নেই মোটে।
ইব্রাহিম তবু সিলভারের রডে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়েই থাকে ট্রেনের বগির ঠিক মাঝে। কয়েক মিনিট পরপর ট্রেনটি থামছে নির্ধারিত স্টেশনে। কেউ নেমে যাচ্ছে। কেউ প্ল্যাটফর্ম থেকে দ্রুত পায়ে ট্রেনের পেটে ঢুকে বসছে। আর আমি একটু পরপর ইব্রাহিমকে দেখছি। আগের চেয়ে স্বাস্থ্য বেড়েছে। দীর্ঘ শরীরের ছেলেটি আগে রোগা ঢ্যাঙা ছিল, এখন কেমন ব্যক্তিত্ববান সুপুরুষ লাগছে দেখতে। কয়েকবার সে ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক তাকানোর সময় আমার দিকেও তাকিয়েছে দুই বার। কিন্তু আমাকে চিনতে পারেনি। বুঝলাম, কারণ অপরিচিতের দৃষ্টি ঘুরিয়ে সে আবার চোখ রেখেছে হাতের ম্যাগাজিনে।
আমার গন্তব্য হোয়াইট চ্যাপেলে পৌঁছাতে আর যখন দুটি মাত্র স্টপেজ বাকি আছে, তখন মনে হলো ইব্রাহিম আমাকে দেখেছে। কিছুটা অবিশ্বাস আর আশ্চর্য দৃষ্টি ওর চোখে। এবার আমি ওর দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে মোবাইলে ব্যস্ত থাকলাম। যদিও ট্রেনের জানালার কাচে আড়চোখে দেখছিলাম ইব্রাহিমের বারবার আমার দিকে তাকিয়ে থাকা। আচ্ছা ইব্রাহিম যদি কথা বলতে চায় তাহলে কি আমি ওকে চিনবো? জানি না। আমার গন্তব্য স্টপেজটি আসার আগে যান্ত্রিক নারী কণ্ঠটি জানান দিলো ট্রেন এখন থামবে, হোয়াইট চ্যাপেল স্টেশন এসেছে।
কাঁধের ব্যাগটিকে তুলে নিয়ে ধীরে নেমে গেলাম আমি ট্রেন থেকে। আগস্ট মাস। ক্যালেন্ডারের হিসাব অনুযায়ী এখন ব্রিটিশ সামার থাকার কথা। কিন্তু থেকে থেকেই আকাশের মন মেজাজ খারাপ যাচ্ছে এই বছর। সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে বৃষ্টি আর বাতাস। স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে দেখি যা আশঙ্কা করেছিলাম, তাই। গুঁড়ি-গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। রাত নয়টা বাজে। আকাশের অবস্থা ভালো থাকলে এখনো বাইরে আলো থাকতো। কিন্তু কী আর করা! ব্যাগ থেকে ছাতা বের করে দ্রুত পায়ে হাঁটতে আরম্ভ করলাম। আমার ফ্ল্যাটে পৌঁছাতে মিনিট দশেক হাঁটতে হবে এখান থেকে।
ইট বিছানো ভেজা রাস্তায় দ্রুত পায়ে কিছুটা হাঁটার পর ডাকটি শুনতে পেলাম। পেছন থেকে আমাকেই ডাকছে। কারণ, আমার নাম ধরে ডাকছে সে।
-এই যে একটু শুনবেন, প্লিজ। নিরু, নিরুপমা। একটা মিনিট দাঁড়ান প্লিজ।
পেছনে না ঘুরেও আমি বলে দিতে পারি এটি ট্রেনের সেই লোকটি, যাকে আমি একটু আগেই বেশ কয়েক মিনিটের জন্য আমার পূর্ব পরিচিত ইব্রাহিম মনে করে মনে মনে পুলকিত হয়েছি। লক্ষ করলাম, আমার পা দুটি আর আগাতে পারছে না। দাঁড়িয়ে পড়েছি আমি।
-আপনি নিরুপমা না? সত্যি করে বলুন তো, আপনার নাম কি নিরুপমা চৌধুরী?
এমন আগ্রহ আর অধীরতা নিয়ে প্রশ্নটি করলো ইব্রাহিম, যে আমার কেমন মায়া লেগে গেলো। মাঝেমাঝে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ভেতর থেকেও একটি শিশুর চাঞ্চল্যকর অস্থিরতা উঁকি মারতে দেখা যায়। আমি যেন একটি টিনেজ ছেলেকে দেখছি ত্রিশ পেরুনো ইব্রাহিমের মধ্যে।
-কিছু বলবেন আমাকে? আপনি কি কোনো ঠিকানা খুঁজছেন?
যথাসম্ভব নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললাম আমি। হালকা জমতে থাকা রাতের কৃষ্ণ চাদরের গভীরেও আমি আড়াল করার চেষ্টা করি আমার চোখের দৃষ্টি। বুকের ভেতরে দুলে ওঠা বায়বীয় পর্দার কাঁপন কিছুতেই বুঝতে দেবো না ইব্রাহিমকে।
-আগে বলুন, আপনি সত্যি নিরুপমা কি না। তারপর আমার কথা বলবো। অনেক কথা বলার আছে আমার। আপনি, মানে তুমি নিরু না!
-আমার নাম নিরুপমা। নাম ঠিক আছে। কিন্তু আপনি কে?
-৩৬/৫ ভুতের গলি। বাড়ির নাম ‘গল্প কথার আঁচল’, তিন তলার ডান দিকের ফ্ল্যাট! ঠিক?
-হুম। ঠিক। আমার আগের ঠিকানা। সাত বছর আগের ঠিকানা আপনি জানলেন কেমন করে?
-তাহলে তো ঠিকই চিনেছি আমি তোমাকে নিরু। তুমি আমাকে চিনতে পারছ না? আজব তো! আমি ইব্রাহিম। ইব্রাহিম শামস। চিনতে পারছ না আমাকে? অবশ্য কেন চিনবে আমাকে তুমি! আমাকে তোমার ভুলে যাবারই তো কথা। সেই সাত বছর আগের আমি। সাত বছরে মানুষের জীবনে কত কিছু ঘটে যায়!
একই সময়ে তৈরি হওয়া আলো আর শব্দ একই সঙ্গে দৌড়াতে আরম্ভ করলে আলো শব্দের অনেক আগেই পৌঁছে যায় গন্তব্যে।
কষ্টের তীব্রতায় ইব্রাহিমের কণ্ঠস্বর বুঁজে আসতে চায়। আমি জানি আমার মনে আজ ইব্রাহিমের জন্য ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই জাগ্রত হওয়া উচিত নয়, কিন্তু আমার কেমন চোখ ভিজে উঠতে চাইছে। বৃষ্টির ছাঁট হবে, আর কিছু নয়। ধীরে পা বাড়ালাম আমি। এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভেজার কোনো মানে হয় না।
-আমি জানি তুমি আমাকে চিনতে পেরেছ। হয়তো ট্রেনেই চিনেছিলে। শুধু অভিমান করে কথা বলছ না আমার সঙ্গে। নিরু, আমার হাতে সময় কম। প্লিজ, কিছু বলো।
আমার পেছনে হাঁটতে আরম্ভ করেছে ইব্রাহিম আর কথা বলে যাচ্ছে। আমি বললাম, বরাবরই তোমার সময়ের খুব দাম ইব্রাহিম। তুমি হচ্ছ অতি মূল্যবান একজন রাজনীতিবিদ। আমার মতো সাধারণ একটি মেয়ের জন্য তোমার হাতে অঢেল সময় আসবে কোথা থেকে! কী ভীষণ বোকা ছিলাম আমি, আহা!
ব্যঙ্গ করে বললাম আমি। সেই ট্রেনে দেখার পর থেকে নিজেকে ভেতরে ভেতরে যেমন শাসন করে রেখেছিলাম, কিছুতেই চিনবো না আমি ইব্রাহিম নামের এই যুবককে আমার অতীতের অতি প্রিয়জন হিসেবে, সেই প্রতিজ্ঞায় অটল থাকতে পারলাম না। মানুষের মনের ভালোবাসাও যেমন একদিন মেয়াদোত্তীর্ণ হয়, ঠিক সেই রকম মনের সমস্ত রাগ, ঘৃণা, অভিমানেরাও হয়তো একসময় জোরহীন হয়ে আসে। অথবা সময়ের জোয়ারে ভেসে ভেসে একদিন মানুষ জেনে যায়, কোনো স্মৃতিই বাস্তবের সামনে অমোচনীয় নয়। তাই তো ফিকে হয়ে আসে দুঃখ, বেদনার নির্মম আঘাতের দহনও একদিন শেষ হয়।
-তুমি আমাকে অনেক কথা শোনাতে পারো নিরু। আমি তোমাকে খুব অপমান করেছি। কষ্ট দিয়েছি। তোমার কাছ থেকে আসা উত্তাল লাঞ্ছনা আমার পাওনা।
-কবে এসেছ তুমি লন্ডনে? কোথায় থাকছ? কী করছ? একসঙ্গে তিনটি প্রশ্ন করে বসলাম আমি পরপর।
-সব কথা বলবো। কিন্তু এখানে না। কাছাকাছি একটা কফি শপ আছে। চলো ওখানে বসে দুটো কফি নিয়ে বসি আগে। তারপর আমরা কথা বলি। এমন ওয়েদারে এককাপ গরম কফি কিন্তু মাস্ট!
কফি শপটি আমার ফ্ল্যাটের পথে উল্টো দিকে। তবু আমার তাড়া নেই যেহেতু, তাই ইব্রাহিমের সঙ্গে পা বাড়ালাম। কফি শপের ভেতরে হালকা সাউন্ডে এড শেরনের পারফেক্ট গানটি বাজছে। আরও কিছুক্ষণ পর বিশালাকৃতির দুটি সাদা কাপে কফি নিয়ে জানালার কাছে একটি ছোট টেবিলে বসলাম আমরা। মুখোমুখি। লক্ষ করলাম ইব্রাহিমের চোখের দুই পাশে চামড়ায় সামান্য ভাঁজ পড়েছে। কপালের দিকের চুলগুলো আগের মতো বড় হয়ে ভ্রূ ঢেকে দেয় না এখন আর। মাথার চুল ছোট করে ছেঁটে রাখে এখন, বুঝলাম সাজসজ্জায় পরিবর্তন এসেছে তার। হয়তো চিন্তা ভাবনাতেও!
অনেকগুলো টিস্যু পেপার আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে ইব্রাহিম বললো, নাও, তোমার মুখ আর হাত দুটি মুছে নাও। মাথাও ভিজেছে অনেকটা। মুছে ফেলো। নইলে আবার ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে।
আমি হাত বাড়িয়ে টিস্যুগুলো নিলাম। যতখানি সম্ভব টিস্যু চেপে চেপে নিজেকে শুষ্ক করে আরামে কফির গ্লাসে চুমুক দিলাম। ইব্রাহিমের দিকে তাকাতে এখন আর অস্বস্তি হচ্ছে না আমার। বললাম, কেন এসেছ ইউকে? রাজনীতি করো না এখন আর?
-রাজনীতির করি। পলিটিক্যাল একটা এসাইনমেন্ট নিয়েই এসেছি এখানে। খবর পেয়েছি আমাদের দলের একজন ডাবল এজেন্ট হোয়াইট চ্যাপলে আস্তানা গেড়েছে। সম্প্রতি সে আমাদের সঙ্গে বিট্রে করে শত্রুদলের গুপ্তচর হয়ে তথ্য পাচার করছে। তার সঙ্গে কাজ আছে।
-কী কাজ? খুন করতে এসেছ তাকে!
-প্রয়োজন হলে করতেও পারি। তবে আপাতত পরিকল্পনায় সেটি নেই।
-এত বছর পর আমাকে পেয়েছ, তাহলে আমাকেই খুন করে ফেলো না হয় এবার! আগেরবার তো যা করেছিলে তুমি, সেটি খুন করে ফেলার চেয়েও খারাপ ছিল। এখনো যে আমি কিভাবে বেঁচে আছি এই বিদেশ বিভুঁইয়ে, তুমি যদি সেসব কথা জানতে ইব্রাহিম!
একটু আগে মাথার চুল মোছার টিস্যু পেপারগুলো দিয়ে এবার চোখের পানি মুছলাম আমি। সাত বছর আগে একদিন প্লেনের জানালার পাশের সিটে বসে ঠিক এভাবেই দীর্ঘসময় ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলাম। আমার মাথায় হাত রাখে ইব্রাহিম। বহু বছর পর আমি ওর গায়ের গন্ধ পেলাম। আমার কান্নার বেগ আরও বেড়ে গেলো। আমার ইচ্ছে করছে আমার ভেতরের শিশুটি যদি এখন পূর্ণ স্বাধীনতা পেতো, তাহলে কতই না ভালো হতো! মাটিতে গড়িয়ে গড়িয়ে কাঁদতাম আমি। হাউমাউ করে বিলাপ করতে করতে কাঁদতাম!
-নিরু, এভাবে আর কেঁদো না প্লিজ। কান্না থামাও।
ইব্রাহিম আমার কথা না রাখলেও আমি ওর কথা রাখি। কান্না থামিয়ে এক সময় স্বাভাবিক হলাম। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলাম।
-বিয়ে করেছ? ইব্রাহিম প্রশ্ন করে আমাকে।
-না। তুমি?
-আমিও না। বয়ফ্রেন্ড আছে তোমার?
-না। তোমার গার্লফ্রেন্ড?
-না।
-কেন?
ফ্যাকাশে হাসি হাসে ইব্রাহিম। বললো, প্রেম, বিয়ে, ওসব আমার জন্য নয়। রাজনীতি হচ্ছে অনিশ্চয়তা আর মৃত্যুর খেলা। মৃত্যু আর সংসার-জীবন একসাথে যায় না।
আমি প্রশ্ন করলাম, কেন সংসারী মানুষেরা বুঝি অমর হয়? সংসার করে যারা তাদের কখনো মরতে দেখোনি?
-অযথা তর্ক করতে চাইলে তুমি রাতভর তর্ক করে কাটাতে পারবে নিরু। তারচেয়ে অন্য কথা বলো।
-কী কথা শুনতে চাও? কী কথা শোনানোর জন্য তুমি আমাকে এখানে বসালে, সেসব কথা বলো। আমি শুনছি। আমি কান পেতে আছি।
-সেদিন কিন্তু তোমাকে আমি একা ইউকে পাঠিয়ে দেবার কোনো চক্রান্ত করিনি নিরু। আমি জানতাম যে আমিও তোমার সঙ্গে একই ফ্লাইটে ইউকে আসব। এখানে তোমাকে সবকিছু সেট করে দিয়ে তারপর আবার দেশে চলে যাব।
-কিন্তু আমি জানতাম যে তুমি আমার সঙ্গে একেবারেই দেশ ছেড়ে চলে আসবে। আমাদের তো তেমনটাই প্ল্যান হয়েছিল, তাই না? আমি আমার পরিবার ছেড়ে চলে আসব। আর তুমি ছাড়বে তোমার রাজনীতি।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইব্রাহিম। বলে, রাজনীতি এমন একটা চক্র নিরু, এখানে একবার কেউ ঢুকে গেলে সে চাইলেই আর বেরিয়ে আসতে পারে না যেকোনো সময়। তাছাড়া তুমি জানো, রাজনীতি করতে আমার ভীষণ ভালো লাগতো। আর এখনো লাগে।
কেমন অসহ্য লাগে ওর কথাগুলো আমার। বিরক্ত কণ্ঠে বললাম, আমাকেও তো তোমার ভালো লাগত ইব্রাহিম! সেদিন এয়ারপোর্টে ভিআইপি লাউঞ্জে বসে তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম যখন, ফ্লাইটের অল্প সময় বাকি ছিল, তখন একটি লোক এসে আমার হাতে তোমার লেখা চিঠিটি দিলো। চিঠিতে তুমি দুঃখ প্রকাশ করে জানিয়েছিলে, জরুরি কাজে আটকে যাওয়ায় আমার সঙ্গে যেতে পারছ না তুমি! ভাবতে পারো, আমার তখন কেমন লেগেছিল? নিজের বাড়িতে আমি চিঠি লিখে এসেছি, আমাকে যেন কেউ না খোঁজে। চিরদিনের মতো গৃহত্যাগ করেছি আমি। অথচ যার হাত ধরে চলবো বলে ঘর ছাড়লাম, সেই মানুষটা আমার সঙ্গে এমন মিথ্যাচার করেছে, এটা বুঝে কার মাথা ঠিক থাকে বলো!
অস্থির দেখায় ইব্রাহিমের হাত পায়ের নাড়াচাড়া। রাজনৈতিক নেতাদের মতো দৃঢ়কণ্ঠে বলে ওঠে, পারি। আমি বুঝতে পারি। জানি আমি তোমাকে খুব আঘাত করেছি নিরু। কিন্তু এরপর তুমি কোথায় এমন নিরুদ্দেশ হয়ে গেলে যে আমি তোমাকে কোথাও খুঁজে পেলাম না আর! কত খুঁজেছি তোমাকে! কত লোক লাগিয়েছি তোমাকে খুঁজে বের করার জন্য! বোকা সোকা সাধারণ মেয়েটি তুমি একেবারে যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিলে! অথচ এতগুলো বছর পর এখানে এসে আবার যেন তোমাকে হাওয়ার মাঝেই খুঁজে পেলাম! কী বিচিত্র আর রহস্যময় এই পৃথিবী, খোদা!
ইব্রাহিমের দুঃখ আমাকে স্পর্শ করলো। ম্লান কণ্ঠে বললাম, আমার খুব রাগ হয়েছিল তোমার ওপর। তুমি যেন আমাকে খুঁজে বের করতে না পারো সেই জন্য নিজেকে আমি লুকিয়ে রেখেছিলাম তোমার রেডিয়াসের বাইরে। তোমার দলের লোকজন কেমন করে কাজ করে সেসব কথা তো তোমার মুখেই শুনেছিলাম। তাই খুব একটা কষ্ট হয়নি নিজেকে তোমার গোয়েন্দাদের নেটওয়ার্কের বাইরে গায়েব করে ফেলতে।
আরও কিছুক্ষণ এভাবে পুরনো দিনের কথা বলতে বলতে ঘড়িতে সময় দেখলাম রাত এগারোটা বেজেছে। আমি বললাম, এবার তাহলে উঠি!
-চলো তোমাকে পৌঁছে দেই তোমার ঠিকানায়। ইব্রাহিম বলল।
-অনেক রাত হয়েছে, তুমি বরং তোমার ঠিকানায় চলে যাও। এসব রাস্তা আমার খুব চেনা। আমি নিরাপদেই যেতে পারব। পনেরো বিশ মিনিটের পথ মাত্র। আমি বললাম।
-ভয় পাচ্ছ, আমি তোমার বাড়ির ঠিকানা জেনে যাবো তাই?
-সেটাও একটা কারণ বৈকি!
কথা শেষ করে হাসলাম আমি। বাইরে এখন বৃষ্টি থেমেছে। কিন্তু বাতাস বেড়েছে খুব। একটু পরপর আকাশের একেক পাশে আলো জ্বলে উঠছে নিঃশব্দে। বিদ্যুৎচমক হচ্ছে, কিন্তু বজ্রপাতের আওয়াজ শোনা গেলো না কোথাও। কাছাকাছি পা ফেলে হাঁটছি আমরা দু`জন। হাঁটতে হাঁটতে একসময় ইব্রাহিম আমার হাত ধরে। আমরা দু`জন হাত ধরে হাঁটতে থাকি। ইব্রাহিম গুনগুন করে গাইছে, ডার্লিং ইউ লুক পারফেক্ট টু নাইট।
-বিদ্যুৎচমক আগে নাকি বজ্রপাত আগে হয়? প্রশ্নটা আমি করি ইব্রাহিমকে।
ইব্রাহিম শব্দ করে হাসে। বলে, ছোটবেলার পড়া ভুলে গেছ? আগে আলো তারপর শব্দ।
-মনে করতে পারছি না। তোমার মনে আছে, কেন?
-কারণ আলোর বেগ শব্দের বেগের চেয়ে বেশি। একই সময়ে তৈরি হওয়া আলো আর শব্দ একই সঙ্গে দৌড়াতে আরম্ভ করলে আলো শব্দের অনেক আগেই পৌঁছে যায় গন্তব্যে।
-হুম। মনে পড়েছে এখন।
আর আততায়ীর আক্রমণের সাড়ে চার ঘণ্টা পর পুলিশ বুকের বাঁ দিকে ছুরি গাঁথা অবস্থায় মৃত দেহ উদ্ধার করে। ফরেনসিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ইব্রাহিম শামসের মৃত্যুর সময় ছিল রাত এগারোটা বেজে আঠারো মিনিট!
আবার কিছুক্ষণ নিঃশব্দে হাঁটি আমরা। যদিও রাত বেশ অন্ধকার, তবু থেকে থেকে স্ট্রিট লাইট আর কয়েকটা অফ-লাইসেন্সের দোকানের ঢিমে আলোয় বারবার তাকাচ্ছিলাম ইব্রাহিমের দিকে। একসময় আমি নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতাম এই মানুষটাকে। এখনো বাসি নিশ্চয়, নইলে দেশ থেকে আসার পর সাতটি বছর কেটে গেলো আমার একাকী সন্ন্যাস যাপন করে। কোনো ছেলেকেই মনে ধরলো না আর। অবচেতন মনে আমি হয়তো ইব্রাহিমের জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম! কে জানে! ওর বেসুরো গলায় গানের সুর শুনতে ভালোই লাগছিল আমার। অন্তরে প্রেমের উচ্ছাস কলকল ধ্বনি শুনতে পাচ্ছি স্পষ্টভাবে। আর, আমার ফ্ল্যাটের সামনে পৌঁছে গেছি আমরা। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আঙুল তুলে ছয় তলার একটি অনির্দিষ্ট ফ্ল্যাটের দিকে নির্দেশ করে বললাম, ওখানে থাকি আমি। ওই যে, সবুজ বাটারফ্লাই ঝুলছে যে বারান্দায়, ওইটা আমার নিবাস।
ইব্রাহিম বলল, আচ্ছা।
ঠিক এই সময় চোখ ধাঁধিয়ে আকাশে বিদ্যুৎ চমকালো। আলোর তীব্রতা এত বেশি ছিল যে আমি চমকে একটু লাফিয়ে উঠলাম। ঝট করে তাকালাম ইব্রাহিমের দিকে। কিন্তু ইব্রাহিম কোথায়? কয়েক সেকেন্ডের ঝকঝকে উজ্জ্বল আলোয় পরিষ্কার দেখলাম, আমি একটি কঙ্কালের হাত ধরে আছি। লিকলিকে হাড়ের কঙ্কালটির বুকে গেঁথে আছে একটি একহাত সাইজের চকচকে ছোরা। আকাশের আক্রোশে ঝলকে উঠলো সে ছোরাটি ঠিক হিন্দি সিনেমার ক্লাইমেক্স সিনের মতো। বিদ্যুৎচমকের আলোটুকু নিভে যাওয়ার আগের সেকেন্ডে দেখলাম সাদা কংকাল শরীরের বুক থেকে ঝরছে লাল রক্তের ধারা। এরপর প্রচণ্ড বজ্রপাতের শব্দে আমার কানে তালা লেগে গেলো। বেহুঁশ হয়ে মাটিতে পড়ে যাই আমি।
পরদিন সকালে নিজের বিছানায় ঘুম ভেঙে টের পেলাম ভীষণ গা ব্যথা করছে। ধীরে ধীরে গত রাতের সব কথা মনে পড়তে থাকে। কয়েক মিনিট এদিক ওদিক তাকাতেই খাটের পাশে একটা নোট আবিষ্কার করলাম। নোটের লেখা দেখে বুঝলাম নিজের ফ্ল্যাটে আর নিজের খাটে কেমন করে এসে পৌঁছেছিলাম কাল রাতে।
কতক্ষণ অজ্ঞান হয়ে বাইরে পড়েছিলাম বলতে পারছি না, কিন্তু আমাদের ফ্ল্যাটের দু`জন ভাড়াটিয়াও তখন বাড়ি ফিরছিল। আমাকে তারা চেনে। ঘাসের ওপর আমাকে অচেতন পড়ে থাকতে দেখে অ্যাম্বুল্যান্স কল করে। পরে আমার ব্যাগ থেকে ফ্ল্যাটের চাবি বের করে প্যারামেডিক্সরা আমাকে আমার খাটে শুইয়ে রেখে গেছে।
ইব্রাহিমের কথা মনে হতেই ভীষণ অস্থির হয়ে ওঠে আমার মন। কেমন আছে ইব্রাহিম? গতরাতের সমস্ত ব্যাপারটাই যদি আমার কল্পনা হয়ে থাকে, তাহলে ইব্রাহিম কেমন আছে? ওর কী কোনো বিপদ হয়েছে? নিজেকে টেনে নামালাম বিছানা থেকে। কাঁপা কাঁপা হাতে ড্রয়ার থেকে পুরনো একটা ডায়েরি বের করে কয়েকটা ফোন নাম্বার খুঁজলাম। সিম্পল কলে বাংলাদেশের কোড নাম্বার দিয়ে কয়েকটি নাম্বারে কল করে একটিতে ইব্রাহিমের দলের একজন বড় ভাইকে পেয়ে গেলাম।
-আমি নিরুপমা বলছি। ইব্রাহিমের কোনো মোবাইলফোন নাম্বার আছে আপনার কাছে? ওর আগের নাম্বারটিতে কল যাচ্ছে না।
-আপনি নিরুপমা? সেই নিরুপমা?
-জি। আপনি কি জানেন ইব্রাহিম এখন কোথায় আছে?
-জানি।
-কোথায় আছে?
-লন্ডনে।
-লন্ডনে? কবে এসেছে লন্ডনে? অবাক আর বিস্মিত হলাম আমি। নাকি লোকটির সামনে আবার হবার ভান করলাম, ঠিক জানি না।
-গত সপ্তাহে গিয়েছিল আমাদের দলের একজন গুপ্তচরকে ধরতে। কিন্তু বেচারার কপালটা খারাপ ছিল এইবার।
-কেন?
-আপনি কি টিভিতে সংবাদ দেখতে পারবেন? এইমুহূর্তে লাইভ দেখাচ্ছে ওখানে।
দ্রুতহাতে রিমোট খুঁজে টিভি অন করলাম আমি। অনলাইনে একটি চ্যানেলে গিয়ে স্ক্রিনে স্ট্যাম্প করে রাখা ইব্রাহিমের রক্তাক্ত মুখের ছবিটি দেখতে পেলাম। ধীরে বসে পড়ি আমি আমার ব্যাচেলর ফ্ল্যাটের অগোছালো সোফায়। বুকের ভেতর কাঁপুনি অনুভব করতে পারছি। সমস্ত শরীর কাঁপছে আমার। টিভি সংবাদের নেপথ্যে সাংবাদিক বলে চলেছেন, গতকাল রাতে হোয়াইট চ্যাপেল এলাকায় ছদ্মনামে লুকিয়ে থাকা বাংলাদেশের এক রাজনৈতিক ক্যাডারকে ধরতে গিয়ে ছুরির আঘাতে মৃত্যুবরণ করেন আরেক রাজনৈতিক কর্মী, ইব্রাহিম শামস। ইব্রাহিম শামসের বুকে খুনি মোট আটবার ছুরিকাঘাত করে। আর আততায়ীর আক্রমণের সাড়ে চার ঘণ্টা পর পুলিশ বুকের বাঁ দিকে ছুরি গাঁথা অবস্থায় মৃত দেহ উদ্ধার করে। ফরেনসিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ইব্রাহিম শামসের মৃত্যুর সময় ছিল রাত এগারোটা বেজে আঠারো মিনিট!