অতপর প্রভু কহিলেন, নিশ্চয় আমি উহাদের স্বর্গে মিলিত করিব।—স্বপ্নে পবিত্র বাক্যটা শুনে কাসেম তালবেলেমের ঘুমের পাতলা সরটা ভেঙে ভেঙে যায়। অতপর প্রভু কহিলেন, নিশ্চয় আমি উহাদের স্বর্গে মিলিত করিব—বিড়বিড় করে ছোকরা তালেবেলেম কাসেম। তার ভাবনা ফেনাতোলা দুধের মতো ফুলেফেঁপে ওঠে।
আর সে যে মহিলার ঘরে ছিল, ও মহিলা তাহাকে ফুসলাইতে লাগিল এবং দরজাসমূহ বন্ধ করিয়া দিলো। সে মহিলা বলিল, শোনো! তোমাকেই বলিতেছি, এই দিকে আইস। সে বলিল, রক্ষা করো; তোমার স্বামী আমার মালিক।
কাসেমের চোখের সামানে ভেসে উঠল সাড়ে তিন বছর আগে দেখা বড়মার হাজার বছর আগেকার মুখ। নারিকেল পাতার ফাঁক দিয়ে ঝরে পড়া চাঁদের ফালি ফালি রূপালি আলোয় বড়মার মুখটা তালবেলেম কাসেমের কাছে মরুভূমির বহুদূর পথের মতো অস্পষ্ট মনে হলো। ইউসুফ জোলেখার কাহিনী বলতে বলতে বড়মা জরিনা বেগমের ফোঁকলা দাঁতের জানালা দিয়ে থুতুর বৃষ্টি ঝরে। জরিনা বেগম দলা করে থুতু গিলে ফেলে বলে, ‘অতপর তিনি শপথ কইরলেন, মরণের পইর উহাদেইর নিকা দেবেন এবং বেহেস্তোবাসীরা সেই নিকা খাইবেন।’
খাওয়ার কথা চলে আসায় বড়মার থুতুর বৃষ্টি দেখে কাসেমের মুখে জমা হওয়া অরুচির থুতুগুলোকে সে বেহেস্তী খাবার কল্পনায় গিলে ফেলে।
বড় মা, হামরাও কি বেহেস্তী খানা দিয়ে বিবাহ খাবো?
হ্যাঁ রে, ভ্যাদার ব্যাটা, হ্যাঁ। কিন্তু একটা শর্ত তিনার বান্দাদের দিয়াছেন।
কীগে শর্ত, বড়মা?
যাহারা গোটা জীবনে দাড়িতে খুর ঠেক্যাবে না তাহার্যা জাফতের দাওয়াত প্যাইবেন। তোর তো দাড়ি বাহির হোছেরে মরদ। বিহা খাবি তো কাটিস ন্যা। জরিনা বেগম কাসেমের লালচে দাড়ি চিমটি দিয়ে ধরে।
কাসেম শুয়ে থেকেই তার ফুরফুরে দাড়ি খিলাল করলো। নিজের হাতটা সে কমলাকে দান করে। কমলা তার দাড়ি খিলাল করে দেয়। তালেবেলেমের দাড়িতে বড় সুড়সুড়ি লাগে। ইউসুফ জোলেখা নয় কাসেম নিজেকে কমলার সঙ্গে একটি ঘরে বন্দি অবস্থায় আবিষ্কার করে। কাসেম তালেবেলেমের আঠারো বছরের তাজা রক্ত অবাধ্য হয়ে এদিক-ওদিক ছুটোছুটি শুরু করে দিলো। সে তার তিন নম্বর চোখ দিয়ে স্পষ্ট দেখে কমলাকে। সংসার নিয়ে ব্যস্ত কমলা—তার মুখে পরিশ্রমের ভাঁজ, মাথার চুলে মহানন্দার ঢেউ, বুকে বেয়াড়া বাতাসের দোল খেলা। তালেবেলেমের অবাধ্য রক্তে এখন উন্মাদ তুরঙ্গের দৌড়। কাসেম শীতলতার জন্য জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু শীতল বাতাসও উস্কে দিতে থাকে তার শরীরের তুষে চাপা আগুন। আকাশের চাঁদ জ্বলজ্বল করে কাসেমের চোখে। হঠাৎ কমলার মতো কালো নিতম্বিনী মেঘ এসে মাখামাখি হয়ে যায় চাঁদের রূপালি আলোর সঙ্গে। আম বাগানের ঝাঁকড়া চুলের পর্দা টেঙে চাঁদ উপগত হয় মেঘের ওপরে। কাসেমের তৃতীয় চক্ষু গিলে খায় কমলার রতিক্রিয়ার মগ্ন দেহটা। স্বয়ং কাসেমই তার শয্যাসঙ্গী।
মেঘের আড়াল থেকে চাঁদ সরে গেলে আকাশ থেকে ঝলমলে রূপালি জ্যোৎস্না ঝরে পড়ে ঘাসের ওপর। কাসেম বাইরে বের হয়ে আসে। সে এগুতে থাকে মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানটার দিকে।
কারণ আজ ছাড়া কোনো দিন কমলাকে পাবে না কাসেম। কমলার সুন্দর দেহটা পচে গলে মাটির সঙ্গে মিশে যাবে চিরদিনের মতো। কাসেম কবরস্থানটার দিকে এগিয়ে যায় ধীর পায়ে। তার জায়গীরদার একরাম মোল্লার যুবতী স্ত্রী কমলার মৃত্যু হয়েছে আজই। জিনের আছর ছিল তার ওপর। সেই নষ্ট জিনই আজ তার জীবন নিয়েছে। সকালে মারা গেছে—দাফন শেষ হয়েছে সন্ধ্যায়, এখন রাত পেরিয়ে চাঁদ বিদায় বিদায় বলছে। আর ধীরে নয় জোরে জোরে পা ফেলে কাসেম।
ডাল ভাঙা শব্দে কাসেম চমকে পেছনে ফেরে। একটা গাছের ডালে ঝুলে থাকা বাদুড় ওকে ভেঙচি কাটে। চারদিকে এখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। জ্যোৎস্না মাঝে মধ্যে মেঘের আঁধারে হারিয়ে যাচ্ছে। উইপোকা উড়ছে প্রজাপতির মতো। কাসেমের গায়ে এসে বসছে বার বার। পোকাগুলোর পাখার স্পর্শে তার শরীর শিরশিরিয়ে উঠছে। আমবাগানের পড়শী লেবু বাগানটার কাছে আসতেই কাসেমের চোখ আঁধার রাতের কুমিরের চোখের মতো জ্বলতে লাগল। খানিক দূরে একটা লাশ। সাদা কাপড়ে জড়ানো টাটকা লাশ। ওটা কি কমলারই! চোখ দুটো জ্বলে কাসেমের। তার হৃৎপিণ্ড দ্রিম দ্রিম করতে থাকে। পা দুটো পাথর হয়ে যায়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে কমলার মুখ। সুন্দর, সবল, সুঠাম দেহের নারী কমলা। একরাম মোল্লার দ্বিতীয় স্ত্রী। এই সেই কমলা! যাকে পাওয়ার কল্পনায় বিভোর হয়ে কাসেম বার বার হনন করেছে নিজেকে।
ঐ তো সাদা কাপড় জড়িয়ে লেবু গাছের তলায় শুয়ে আছে কমলা। মুখটা কাপড় থেকে বের করা। ঝিরঝির বাতাসে কেঁপে কেঁপে উঠছে তার চুল। মুখটায় চকচকে জ্যোৎস্না গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। চোখ দুটো বোজা। কাসেমের পাথর হয়ে থাকা পা দুটোর তলা থেকে খস খস শব্দ বের হচ্ছে। সে শব্দে কমলার চোখ দুটো খুলে গেলো। কাসেমের কামনার দেহটা কমলাকে আড়াল করে নেয়। কাসেমের পিঠে অথৈ জ্যোৎস্নার ঢেউ বয়ে যায়। চাঁদ এসে বিশ্রাম নেয় কমলার চোখে।
কাসেম লাশটার পাশে এসে দাঁড়ালে অথৈ জ্যোৎস্না এক লাফে লেবু ঝাড়ের ওপরে গিয়ে বসে। ওটা লাশ নয়—চুন মাখা ঢেউ টিন। পাশে মসজিদে চুনকামের কাজ চলছে, সেখান থেকে এসে থাকবে।
কাসেম কবরস্থানের দিকে এগিয়ে যায়। কমলার কবরের ঢিবিটার কাছে এসে কাসেম তার সঙ্গে নিয়ে আসা খুনতি দিয়ে ওটা খুঁড়তে থাকে। এখন তার শরীরে সিংহের শক্তি। খুনতির এক/একটা জোরালো আঘাতে কবরের আলগা নরম মাটি ধসে ধসে পড়ে।
হঠাৎ কাসেমের পেছনে পায়ের শব্দ। খুনতি তুলে মারমুখী হয়ে এক ঝটকায় পেছন ফিরে দাঁড়ালো। পেছনে ভয়ঙ্কর অন্ধকার। পুরনো একটা কবরের গর্ত থেকে শেয়াল বেরিয়ে পালায়। শেয়ালটার চোখে কাসেমের চোখ পড়তেই কাসেম দেখলো, শেয়ালের চোখ ঠিক তার চোখের মতোই জ্বলজ্বলে। এই মুহূর্তে সে শেয়ালের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়। পরিশ্রম আর উত্তেজনায় কাসেমের সমস্ত শরীর দিয়ে দরদরিয়ে ঘাম ঝরছে। খোঁড়া শেষ। কাসেম এবার সাদা কাফনে জড়ানো কমলার লাশটা বের করে আনে। কাফনের কাপড় খুলে সে কমলার মুখটা বের করে।
কমলার মুখটা এখন বেশ ফোলা। লাশটার ঘাড় উঁচু করতেই মুখ দিয়ে গল গল করে খানিকটা কালচে ফেনা বেরিয়ে আসে। তার খানিকটা কাসেমের হাতে লেগে গেলে হাতটা কেমন চটচটে হয়ে যায়। একটা বোটকা গন্ধ তার নাকে ধাক্কা মারে। মাথা চিন চিন করে ওঠে কাসেমের। চারপাশ থেকে আধাঁর ঘেরা আতঙ্ক কাসেমকে ঘিরে ফেলে। সে ভয়ে পাথর হয়ে যায়। তার পেটের ভেতর থেকে সবকিছু যেন বের হয়ে আসতে চায়। কাসেম ‘আল্লাহ’ বলে চিৎকার দিয়ে লাশটা ফেলে দৌড় দেয়। তার মনে হয় পেছন থেকে লাশটা তাকে ডাকছে। যেন দোজখের আগুন তেড়ে আসছে তার দিকে।