গল্প লেখার গল্প
২০১২-১৩ সাল হবে। প্রথম সুন্দরবন যাব, চাপা একটা উত্তেজনা ঘিরে ধরেছে আমাকে। সাতক্ষীরার শ্যামনগর দিয়ে একটি দলের সঙ্গে নৌকা নিয়ে বনের দিকে যাত্রা শুরু হলো। সুন্দরবনে প্রথম আগত সবারই একটা বিশেষ লক্ষ্য থাকে, যদি একটু বাঘ দেখা যায়। দলের অন্যরা সেদিকে ব্যস্ত, তবে আমি আগেই জেনে গিয়েছিলাম বাঘ দেখা ভাগ্যের ব্যাপার। আর সে ভাগ্য পর্যটক নামক অধিকাংশ আগন্তুকেরই হয় না। শুধু যেসব বনজীবী কাঠ কাটতে বা মধু আহরণে বা রেণু পোনা ধরার সময় মা বনবিবি আর গাজী পীরের নাম নিয়ে বাদায় ঢোকে, তাদেরই কেউ কেউ সেই ভয়ঙ্কর ভীষণের দেখা পায়। তবে তাকে কাছ থেকে দেখে কেউ ফিরে আসে, কেউ ফেরে না। তাই আমিও বাঘ দেখার আশা বাদ দিয়ে মাঝি ও গার্ডদের কাছ থেকে বাঘের গল্প শোনার দিকেই মনোযোগ দিয়েছিলাম।
নদীপথে সুন্দরবন ঘুরে বেড়ানো কয়েকঘণ্টার মধ্যেই একঘেয়ে হয়ে যায়। তাই বনের দিকে মনোযোগ না দিয়ে গল্পে মন রাখাই শ্রেয়। কিন্তু ওদের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারি, বেশিরভাগ গল্পই অতিরঞ্জিত। তারচেয়ে আমি শুনতে চাই বাঘবিধবাদের কথা। সম্ভব হলে তাদের কারও সঙ্গে দেখা করতে চাই। কিন্তু চাইলেই তো আর সব কিছু ইচ্ছে মতো হয় না। আমারও হয়নি। শুধু শুনেছি শ্যামনগরের গাবুরা, বুড়ি গোয়ালিনি গেলে বিভিন্ন গ্রামে ওদের দেখা পাওয়া যায়। কিন্তু কোনো গ্রামেই যাওয়া হয়নি। শুধু কল্পনায় মনে হয়েছে হতভাগ্য কোনো নারী যেন আমাকে তার করুণ গল্প বলতে অধীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে নদীর পাড়ে। স্বামীকে বাঘে নেওয়ার দায় যার বয়ে বেড়াতে হচ্ছে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত দিয়ে।
এরপর আরও বেশ কয়েকবারই আমি সুন্দরবন গেছি, থেকেছি। দুবলার চরঘেঁষা বনে একটি খালের ভেতর গভীর রাতে বাংলা মদ খেতে খেতে মাঝির কাছে শুনেছিলাম এক উদাস মাদি বাঘের গল্প। যে নাকি প্রায়ই বনের ধারে এসে হেতাল ঝোঁপের মধ্যে বসে থাকতো। কাছাকাছি দিয়ে কোনো নৌকা গেলে হাই তুলে বাঘিনীটা ঢুকে পড়তো গভীরে। বেশ কয়েকবছর আগে সেই মাদি বাঘটার পচাগলা মৃতদেহ পাওয়া যায়। ওই সময় বাঘটা গর্ভবতী ছিল। একসময় সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়লো তখনই বনের অস্বস্তিময় অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আমার মাথায় এসেছিল সফুরা আর আনার মৃধার কথা। মনে হয়েছিল, সেই সব বাঘের কথা, যারা খাদ্যের অভাবে বন ছেড়ে লোকালয়ে ঢুকে পড়ে আর উন্মত্ত মানুষের হাতে বেঘোরে মারা যায়।
মনে আছে ঢাকায় এসে অনেকদিন এই গল্পটা লিখতে চেয়েও কেন যেন পারিনি। মনে পড়ে, কথাসাহিত্যিক ও একসময়কার সহকর্মী হামিম কামালকে বারবার বলতাম, আমি এমন একটা গল্প লিখতে চাই, কিন্তু পারছি না। তারপর একদিন সত্যিই মনে হলো গর্ভবতী এক বাঘবিধবার সঙ্গে যদি পেটে বাচ্চা থাকা একটা বাঘিনীর দেখা হয়, তাহলে দুই মা কী করবে! অতপর এক রাতের মধ্যে লিখে ফেললাম মরণখোর। সে রাতের উত্তেজনা আজও আমাকে শিহরিত করে। মনে পড়ে পেটে বাচ্চা নিয়ে একটু ভাতের জন্য সফুরার আকুতি লেখার সময় আমি কেঁদেছি। সব শেষে মনে হয়েছিল সফুরার রক্ত আর বাঘের রক্ত মিলে তৈরি হওয়া ছোট্ট চৌবাচ্চাটায় আসলে মন্টু শিকারির ছায়া পড়েনি, তাতে আমি আমাদের মতো শিকারি মানুষের ছায়া দেখতে পাচ্ছিলাম।
মরণখোর ॥ সুমন মজুমদার
আনার মৃধার মৃত্যু শোক দমে এলেও পেটের ক্ষুধার দাউ দাউ আগুন কোনোভাবে দমাতে পারছে না সফুরা। থেকে থেকে অতলস্পর্শী একাটা সর্বগ্রাসী অনুভূতি পাগল করে দিচ্ছে তাকে। ঘরের ফুটো হওয়া চাল দিয়ে এই ঘোর রাতেও আল্লাহ বৃষ্টির জল ঠিকই পাঠিয়েছেন। শুধু পাঠাননি এক থালা গরম ভাত। ক্ষুধার অনুভূতি তো বটেই তারপরেও নিজের জন্য নয় বরং পেটের অনাগত প্রাণীটার জন্য মনটা হু হু করে ওঠে সফুরার। সে বিড়বিড় করে, নিজে না খেলি, বাচ্চারে খাওয়ামু ক্যামন করি আল্লাহ। সফুরা গুনগুন করে কাঁদতে থাকে। পেটের ক্ষুধা সহ্য করতে না পেরে রাগে দুঃখে ক্ষোভে সে এখন তার হাত কামড়াচ্ছে। পৃথিবীর তাবৎ অভুক্তের জন্য সৃষ্টিকর্তা যেন খাদ্য হিসেবে তাদের নিজেদের শরীরকেই গড়ে দিয়েছেন। প্রবল ক্ষুধায় ইচ্ছে করলে যেন কামড়ে কামড়ে খেয়ে ফেলা যায় হাত, পা, আঙুল। সফুরার ঢোল হয়ে ফুলে ওঠা পেটটা নড়েচড়ে উঠেছিল কিছুক্ষণ আগে। খাবার না দেওয়ায় নাকি ডিম্বদাত্রীর অক্ষমতাকে বিদ্রূপ করে ছোটখাটো একটা লাথি কষিয়েছে ওটা। সফুরা তার ফুলে ওঠা পেটে হাত রাখে। অপুষ্টি ক্ষুধা দারিদ্র্যের চিহ্ন বহন করা তার ভাঙা চোয়াল বেয়ে দুই ফোঁটা চোখের জল নেমে আসে কণ্ঠার কাছাকাছি। তার পেটটা আবারও নড়েচড়ে। এবার সফুরার রাগ বেড়ে যায়। সে খামচে ধরে নিজের পেট। সর্বশক্তি দিয়ে দমাদম কিল বসায় আর বলে-মর, মর কুইত্তার বাচ্চা, মর হারামজাদা, মর মর।
সফুরা অনেকদিন থেকেই ভাবছে একমুট লবণ খেয়ে পেটের শয়তানটাকে শেষ করে দেবে কি না। এমনিতে নিজেই খেতে, নড়তে চড়তে পারে না, তার ওপর পেটে এমন বস্তা বেঁধে জীবনযাপন। সাড়ে নয় মাসের পোয়াতি সফুরার শরীরটা সকাল থেকে জ্বর জ্বর লাগায় আজ ঘেরে যেতে পারেনি। মস্তান শেখের ঘেরে নাকি কিছুদিন থেকে কি সব রোগ দেখা দিয়েছে। মস্তান শেখ তার ঘেরের চিংড়ি এখন বিক্রি করে দিচ্ছে স্থানীয় বাজারে কম দামেই। সফুরা সেখানে চিংড়ির মাথা ছাড়ানোর কাজ করে। গতকাল রাতে সাইজুনির দেওয়া এক থালা ভাত আর চিংড়ি শুটকিই ছিল তার শেষ খাবার। সকালবেলা পেটের ক্ষুধাটা ঠিকই জানান দিয়েছিল, সেইসঙ্গে কাজে না গেলে দুপুর আর রাতেও যে খাবার জুটবে না, সে কথাও মনে ভিড় করে এসেছে। কিন্তু জ্বরজুরে এই পোয়াতি শরীরটাকে সকালে বিছানা ছেড়ে টেনে তুলতে পারেনি ও। দুপুরে সেই ক্ষুধা সহ্য করেই বেঘোরে ঘুমিয়েছে। কিন্তু সন্ধ্যা থেকে আর থাকা যাচ্ছে না। বাচ্চাটা পেটে আসার পর এই হয়েছে এক সমস্যা। অন্যদের নাকি এই সময়ে খাবারে অরুচি হয়, কিন্তু সফুরার ক্ষুধা যেন দিন দিন বেড়েই গেছে। গরম ভাতের গন্ধ যেন তার শরীরে কেমন চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। যেমন চাঞ্চল্য হতো নিশুতি রাতে আনার মৃধা তার নাভিতে হাত রাখলে। আজ তার ফুলে ওঠা পেটটা যেন আবার পাগল করে দিচ্ছে খামখাম করে। অন্যান্য দিন সাইজুনি বা সুন্দুরি কেউ না কেউ এসে একবার হলেও তার খোঁজ নিয়ে যায়। কিন্তু এই অসময়ের বৃষ্টি চারদিক ভাসিয়ে দেওয়ায় তারাও কেউ আসেনি। হায়রে ভাগ্য! ভাগ্য খারাপ না হলে শুধু সফুরার সঙ্গেই এমন হবে কেন! আনার মৃধা শরীর তুলেছে তিন মাস হলো। তখন তার সাড়ে ছয় মাসের পেট। তারজালি জেলে আনার মৃধার শখ ছিল, ছেলে হলে নাম রাখবে গাউসুল আজম। আর মেয়ে হলে নাম হবে ফাতেমা। বদরবাড়ির হাটে সে বক্কার গাইনের সঙ্গে গাউসুল আজম মাইজভাণ্ডারির গান শুনেছিল। বড় আল্লাওয়ালা লোক নাকি তিনি চাটগার। তাই এত দূরদূরান্তেও তাদের জল-লবণের বাঘড়ীতে পৌঁছে গেছে মাইজভাণ্ডারির ভক্ত আশেকানরা। মানুষকে আল্লাহর পথে, মারফতের পথে টেনে আনতেন তিনি। সেই থেকে আনার মৃধার শখ হয়েছিল ছেলে হলে নাম রাখবে ওই আল্লাওয়ালার নামেই।
নিজে এমনি বনে-বাদাড়ে ঘুরে মাছ ধরে বেড়ায়। কখনো কখনো চিংড়ি ঘেরের শ্রমিক। হাত পায়ের আঙুলের ফাঁকে এখনো লবণপানির ঘা এর উপস্থিতি। তাই বলে তার ছেলের ভাগ্যও কি তেমন হবে! সে মাদ্রাসায় যাবে, আরবি পড়বে, হাফেজ হবে। তার গলার সুরেলা আজান মানুষকে আল্লাহর পথে টেনে আনবে গাউসুল আজম পীরের মতোই। আর যদি মেয়ে হয়, তাহলে সে বড় হবে ফাতেমা বিবি নামে। মা ফাতেমার নামে নাম। রূপে গুণে আদব কায়দা পর্দা পুসিদায় সে থাকবে ধনকাঠি গ্রামের এক নম্বর। একদিন তাই দুপুর বেলা বিড়িতে টান দিতে দিতে আনার মৃধা সফুরাকে বলেছিল, জানোস আমার না একখান সোপ্ন আছে। আমার পোলা হলি ভোঁদরগুলাক বাদায় ছাড়ি দিমু। এ্যারা দোয়া করবি। পশু পাকির দোয়া বড় দোয়ারে। বোবা জানোয়ারের দোয়া আল্লা ডাইরেক কবুল করি নেয়। আনার মৃধা তার শখ পূরণ করার সময় পায়নি। তার আগেই কোনো এক পাপের শাস্তি হিসেবে তিনি আনার মৃধাকে এই করুণ বিভৎস মৃত্যু দিয়েছেন। এখন বেঘোভূত হয়ে নিশ্চই লোকটা ঘোরাঘুরি করছে ধনকাঠির আকাশে বাতাসে। কিন্তু সফুরাতো কোনো পাপ করেনি। তাহলে কেনো তার আজ এই পরিণতি? কেনও এই বয়সেই তাকে হতে হলো বাঘবিধবা। স্বামীর এমন বিভৎস মৃত্যুর পর অপয়া হিসেবে শ্বশুর বাড়ির কেউও আর নিলো না তাকে। আর নিজের বাপের বাড়ির লোকজনের কথাতো সে মনেও করতে পারে না। গ্রামের লোকেরা বার বার এই ভিটা ছেড়ে চলে যাওয়া খোটা দিলেও সে যায়নি কোথাও। বরং এই পোয়াতি শরীর নিয়েই সে পেট বাঁচাতে কাজ করেছে মস্তান শেখের ঘেরে। ক্ষুধাটা আবার সফুরার ভেতর চিড়বিড়িয়ে ওঠে। সে ঠোঁটে ঠোঁট চেডে সহ্য করার চেষ্টা করে জ্বালাটা।
বাদা থেকে তখন নদীতে জোয়ারের জলে ভেসে এসেছে মরা হরিন, বানর, সাপ এমনকি বাঘও। তারা শুধু সেসব চেয়ে চেয়েই দেখেছে। সেসময়ই নাকি পশ্চিমপাড়ের দুটি গ্রামে হামলে পড়েছিল ডোরাকাটা।
বৃষ্টি হওয়ায় রাত তখন শুনশান। এছাড়া আনার গাজীর ঘটনার পর থেকে লোকজন রাতে ঘর থেকে বেরও হয় কম। গত সপ্তাহেও হোসেন আলীর গোয়ালে হামলে পড়েছিলেন তিনি। মোট তিনটের মধ্যে দুটোকে মেরে একটা গরুকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়েছিলেন মান্দারভাঙ্গা খালের পাড়ে। পরদিন হায় হায় করা হোসেন আলী আর লোকজন খোঁজাখুজির পর আধখাওয়া গরুর মড়াটা খুঁজে পেয়েছিল একটা কেয়া ঝোঁপে। এসব অজানা আশঙ্কা আর ভাবনা ভাবতে ভাবতেই সফুরা উঠে দাঁড়ায় দুর্বল শরীরে। সারাদিন না খাওয়ায় তার শরীর টলছে, মাথাটা ঘুরছে যেন একটু একটু। এই ভিটা থেকে বের হলে বেড়িবাঁধের ওপরেই খোদেজাদের বাড়ি। সেখানে গিয়ে তাদের কাছে খাবার কিছু একটা চাইবে কি না, ভাবে সে। ভাত না হোক, একটু খুদ বা মুড়ি যদি পাওয়া যায়। কিন্তু এত রাতে খোদেজাকে ডাকাডাকি করলে ওর বাপ বিশ্রী বিশ্রী সব খিস্তির ফোয়ারা ছুটিয়ে দেবে। তারপরও সফুরার এই ক্ষুধা যেন আর সহ্য হচ্ছে না। অবশেষে সে মনস্থির করে খোদেজাদের বাড়িই যাবে। টলতে টলতে ভেজা উঠোনে পা বাড়িয়েই আবার থমকে দাঁড়ায় সে। না, এত রাতে ওদিকে যাওয়াটা বোধয় ঠিক হবে না। বেড়িবাঁধের রাস্তাটা এমনিতে খুব অন্ধকার। তার ওপর চারপাশে ঝোঁপঝাড়ও কম নয়। কখন তিনি এসে ঘাঁড়ে লাফিয়ে পড়েন। সাইজুনি কাল বারবার তাকে বলে গেছে, ‘ভাবি রাইতে বাইর হইয়ো না। তেনারে নাকি অনেকেই দেখেছেন খাল পাড়ে, ঘেরের মাথায়। মেচি বাঘ, ভাটার মতো গনগইন্যা চোখ। ভাইজানরে কি ইনিই ধরেছিল কি না কে জানে! অবশ্য বন অপিসের সাইবগোরে হারুন মোল্লারা জানাইছে। তারা বলছে, বন্দুক নিয়া আসব। তুমি ঘরে একলা থাকো। সাবধানে থাইকো, ঘরের দরজা ভালোমতো বন্ধ কইরো। হাতের সামনে দা রাইখো।’ সাইজুনির কথাগুলো মনে পড়তেই সফুরার বুকের ভেতর ধরাস করে ওঠে। সে ভয়ে পেটের ওপর হাত রাখে। নিজের জন্যিতো চিন্তা নেই, আল্লাহ ভাইগ্যে যা রেখেছে তাই হবি। কিন্তু…।
দ্বীধাগ্রস্ত সফুরা ঠিক কি করবে বুঝতে পারে না। তাই ক্ষুধায় অবশ দেহ নিয়ে সে আবার কাঁদতে বসে। পরক্ষণেই আবার মনস্থির করে। নিলে না হয় নিবেই। আল্লাহ যার কপালে মরণ লেখে সিটা কি কেউ খণ্ডাইতে পারে? আনার গাজীর মতো ব্যাটা পেরেছিল? অথচ প্রতি চৈত্রে ভোঁদরগুলোকে খাঁচায় রেখে জালটাল গুটিয়ে রাখতো আনার। লক্ষীন্দর বাওয়ালের সঙ্গে বাদায় যাবে সে মধু চাক ভাঙতে। এই যেন জাত জাইল্যা লোকটার এক মাত্র শখ। পুরুষালী ভাব দেখানোর উপায়। সফুরা কত কেঁদেছে, অনুনয় করেছে, মাথার দিব্যি দিয়েছে বাদায় না ঢুকতে। কিন্তু লোকটার ছিল ওই এক নেশা। সে বলতো-চৈত্রে বাদায় খালিশা আর কালীলতার যে ফুল ফোটে সেগুলো গন্ধ ছড়িয়ে তাকে যেন ডাক দেয়। মন উচাটন লাগেরে বউ। প্যাক আর শুলের কামড় খায়ে, হেতাল কাঁটায় চামড়া ছিলি যখন তুই কালীলতার ফুল দেখবি তখন মনে হবি আল্লা যেন দুনিয়ার এর চেয়ে সোন্দর আর কিচ্ছু পাঠায়নি। বেহেস্তের ফুলের চায়া সোন্দর জানোস! আমারও ইচ্ছা করে মধুপোক হতি। তালি পরে কালীলতার ফুলে বসি মধু খেতাম। আর আছে সুন্দুরীর ফুল। মনে হয় যেন, মনিকারের হাতে গড়া অলঙ্কার। তোর জন্য দেখি নিয়াসবোনে। স্বামীর কথা শুনে সফুরা গাল ফোলাত। লাগবি না আমার মনিকারের অলঙ্কার। বাদায় সাপ আছে, বাঘ আছে, কুম্বির আছে। আনার মৃধা কেবল হা হা করে হাসতো। বলতো-আমি হলাম গাজী পীরের মুরিদ। খোয়াজ খিজির আমার ওস্তাদ। আমারে ধরবি এমন হুলো বাদায় নাই। থাকলি তোর মতো দু চারটে মেচি থাকতি পারে। আর তাছাড়া লাগলি যাবার সোময় লখিন্দরদের সাথে বনবিবির থানে সিন্নি চড়ালাম। শোন, বাদায় মধু কাটলিতো দুই চারটে পয়সাও রোজগার হয় নাকি?
লোকটা সফুরার ওজর আপত্তি কানেই তুলতো না। মেয়েমানুষের ন্যাকান্যাকা ভয় পুরুষের কানে না নিলেও চলে। কেবল বাদায় ঢোকার আগে লক্ষীন্দর বাওয়ালীরা সুর করে যে মন্ত্র পড়তো, রাতে বউকে জড়িয়ে ধরে আনার তার পুনরাবৃত্তি করতো। লোকটার চোখে সফুরা তখন দেখতে পেতো চিরল চিরল সবুজ আর অজানা বাদারের ডাক। লোকটা বিড়বিড় করতো মন্ত্র-‘আকাশের তারা বন্ধন, পাতালে বারী বন্ধন, সাতষট্টি কোটি দেবতা বন্ধন, নদীতে কুমির বন্ধন, ডাঙ্গায় বাঘ বন্ধন। আমার এই বন্ধন যদি লড়ে, বনবিবির মস্তক ছিঁড়ি যেন জমিনেতে পড়ে।’ তারপর লোকটা ট্যাক করতো সফুরার শরীরে। হাতে ধোঁয়া ওঠা মশাল নিয়ে যেন এক পাকা জহুরি বাওয়াল সফুরার শরীর বন চিঁড়ি চিঁড়ে খুঁজে নিতো মধুর সন্ধান।
কই এমন সাহসী লোককেও তো বাঁচাতে পারেনি তার গাজী পীর বা গাউসুল আজম আল্লাওয়ালা। সেইতো বাঘের হাতে প্রাণ গেলো। তাও যদি বাদায় হতো তাহলে এক কথা ছিল, প্রাণ গেলো লোকালয়ে। তাহলে কেন সফুরা ভয়ে গরে বসে আছে ক্ষুধা নিয়ে। আল্লাহ যা কপালে রেখেছে তাই হবে। সে খোদেজাদের বাড়ির পথে পা বাড়ায়। বৃষ্টিভেজা পথে কদম ফেলার শব্দও কেমন বড় মনে হয়। মনে হয় যেন ছায়ার পাশে আগোচড়ে কোনো এক প্রচ্ছায়া সঙ্গ নেয় রসাতলের পথে। রাস্তার পাশে হারগাজার ঝোপ। কয়েকটিতে অপূর্ব বেগুনী রঙ ছড়িয়ে ফুল ফুটেছে। সফুরার মনে হয় ওই ফুলগুলো ছিঁড়েই খেতে শুরু করে। ক্ষুধা পেটে সুন্দরও আর সৌন্দর্য থাকে না, তখন কেবলই সব জাগতিক। এদিকে রাতের অন্ধকারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঝিঁ ঝিঁর ডাক। সে দুরুদুরু পা এগোয়। সফুরার মনে হয়, আশেপাশের প্রতিটি ঝোপ থেকে যেন ওর দিকে নজর রাখছে কোনো ভয়। জোনাকির দুটি আলোও বুকের ভেতর যেন ধরা দেয় কাঁপন হয়ে। জোনাকির ক্ষীণ দুটি আলোর বিন্দু যেন পরিণত হয় অশরীরী গনগনে চোখে। খোদেজাদের বাড়িটা অন্ধকার। চারপাশে সুন্দরীর খুঁটি পুতে বেড়া দেওয়া। তবু কাদাভরা উঠোন পেরিয়ে সফুরা দুর্বল গলায় ডাক দেয়-খোদেজা, ও খোদেজা। কিন্তু তাতে কোনো জবাব আসে না। কেবল মরার মতো একটা নিস্তব্ধতা ঘিরে থাকে ওকে। সে আবার ডাক দিতেই ভেতর থেকে জবাব আসে। তবে তা আমন্ত্রণ নয় বরং হাড় জ্বালানো খিস্তি।
খোদেজার বাপ গলা চড়ায়— এই সন্ধ্যা রাইতে খোদেজা, খোদেজা, কুয়ারা না কি? গেলিরে ছিনালমাগী। সোয়ামির মতো ভাতারখাকির শখ হইছে তেনার পেটে যাওয়ার। সফুরা অন্ধকারের মধ্যেই খোদেজাদের উঠোনে পা ছড়িয়ে বসে। খোদেজার বাপের খিস্তির মধ্যেও তার মনে হয় কোথাও যেন কোনো শব্দ নেই। তাহলে কি বাচ্চা বিয়ানোর সময় চলে এলো, এখনই কি ব্যথাটা উঠবে। কিন্তু ক্ষুধা যেন তার শরীরের সব শক্তি শুষে নিয়েছে। আচ্ছা এক মুট লবণ খেয়ে পেটের শয়তানটাকে মেরে ফেলা যায় না? নিজে না খেয়ে হয়তো থাকা যাবে। আগেও সে অনেকদিন অনাহার অর্ধাহারে কাটিয়েছে। তখনো এত কষ্ট হয়নি। মনে পড়ে, কয়েক বছর আগে যখন উত্তরমুখ থেকে বান ধেয়ে এলো, যখন ক্রুদ্ধ নাগের ফনার মতো লবণ জল এসে তছনছ করে দিলো সব কিছু, তখন একবার এমন অবস্থা হয়েছিল। ডাঙ্গায় তখন লাশ আর লাশ। ঘেরের সব চিংড়ি তখন ভেসে গেছে কোথায় না কোথায়। নদীতে মাছ ধরার উপায় নেই। আর উৎলানো জলে মাছ থাকবেই বা কোথায়! যদিও লোকে বলে, ডাঙা আর বাদায় যেসব মানুষ পশু পাখি নদীতে ভেসে গিয়েছে, সেসব লাশ এখন খাচ্ছে মাছগুলো। তবু বানের জল আর ক্ষুধার সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে ছিল আনার মৃধা ও সফুরা। কিন্তু জল নেমে যেতেই সবাই সর্বশান্ত। গ্রামের মানুষ তখন কচু ঘেচু আর কলার মোথা খেয়ে দিন পার করেছে। বাদা থেকে তখন নদীতে জোয়ারের জলে ভেসে এসেছে মরা হরিন, বানর, সাপ এমনকি বাঘও। তারা শুধু সেসব চেয়ে চেয়েই দেখেছে। সেসময়ই নাকি পশ্চিমপাড়ের দুটি গ্রামে হামলে পড়েছিল ডোরাকাটা।
কে যেন ভিড় থেকে বলে ওঠে-ভগবান, মরণ দিবা দ্যাও, কিন্তু এমন মরণ দিও না। একটু পর পুলিশ বন কর্তারাও আসেন, গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন।
দশদিনে জান গেছে চার জনের। বন অফিসের মনসুর মিয়া নাকি তখন গুলি করে মেরেছিল তাদের একটাকে। অবশ্য তেনারাও কি করবেন, বানের জলের তাণ্ডবে বাদায় তখন লঙ্কাকাণ্ড। উঁচু উঁচু গাছগুলো ভেঙে গেছিল ঝড়ে। পশু পাখিরাও ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল চেনা জায়গা থেকে। লোকালয়ের মতো তখন বাদায়ও যে চলছে খাওয়ার জন্য হাহাকার। এমনকি লবণপানি ঢুকে নাকি বন্ধ হয়ে গেছিল পাখপাখালির তৃষ্ণা মেটাবার জায়গাটুকুও। কিন্তু তখন তো হয়েছিল দুর্যোগ, কিন্তু এখন আল্লাহ কেনো তার সঙ্গে এই খেলা খেলছেন। মানুষ হয়ে জন্ম না দিয়ে যদি মেচি করেও জন্ম দিতেন, তাহলে অন্তত ক্ষুধার সময় হাড় জ্বালানো দু একটার ঘাঁড় মটকেই জ্বালা মেটানো যেত। সফুরা বসে বসে মাটি আঁচড়ায়। যেন সে মানুষ নয় বরং একটা বাঘিনী। পেটে সাবক নিয়ে যে বাঘিনী ক্ষুধার জ্বালায় ফুঁসছে নির্দয় আল্লার অবিচারের জবাব দিতে। যেন এক্ষুণি এক থাবায় সে চিঁড়ে দিতে পারে সাজানো সভ্যতার রঙচঙে পর্দা। চারদিকে এত খাবার অথচ এই দুর্বিনীত ক্ষুধায় তার জন্য এতটুকু রিজিক নেই কোথাও। সফুরা মনে সব শক্তি জড়ো করে উঠে দাঁড়ায়। অন্ধকারে ফিরে চলে সে হেরে যাওয়া মানুষের মতো। অন্যদিকে অন্ধকার আর ঝিঁঝির ডাক তখন ঐকতানিক। তার মনে হয়, এই নিস্তব্ধতা আর ঝিঁঝির ডাক শুধু অক্ষমতা আর দুর্ভাগ্যের আবহ সঙ্গীত। জোনাকিগুলো আরও জ্বলজ্বল করে।
ক্ষুধা পেটে সফুরার চোখে সেগুলো কখনো বড় হয়, কখনো বা ছোট। সে কেমন হতাশায় নুয়ে পড়া কালীলতার মতো টলতে টলতে হাঁটে বাড়ির পথে। এখন সে টের পায় না কাদা, পথের অন্ধকার, হারগাজার ফুল, ঝোপের ডোরাকাটা ভয়। সফুরার মন হয়তো বুঝে গেছে, এই রাতে আর জুটবে না কিছু। তার ঘরের চারপাশেও সুন্দরীর বেড়া। পর্দা রাখতে আনার মৃধা তাতে ঝুলিয়ে দিয়েছিল গোলপাতা। সে ওই বেড়া পার হয়ে সামাণ্য উঠানেই আবার পা ছড়িয়ে বসে। সফুরার পেটে তখন কেমন শিরশিরে অনুভূতি। সে পেটে হাত দিয়ে বিড়বিড় করে আপনমনেই-বাপরে আমি অক্ষম মা, খাইতে দিতে পারি না। তুই বাইর হইসনারে বাপ। নিজেই খাইতে পারি না, তোরে কি খাওয়ামু। তার চেয়ে প্যাটের ভিতরেই তুই মর। পরক্ষণেই সফুরার রাগ যেন আরও চড়ে যায়। সে আবার দমাদম কিল মারে-মর মর মর। তবু গর্ভ থেকে তার সাড়া আসে না।
এবার চোখে আবার জল আসে। আল্লা ক্যান এমন হইলো! সাড়ে তিন মাস আগে আল্লা এমনই এক অন্ধকার রাতে করেছিলেন তার সর্বনাশের শুরুটা। সেদিন দুপুরেই ঘরে ফিরেছিল আনার মৃধা। খেতে বসে কুচো মাছের চচ্চরির সাথে ভাত মাখতে মাখতে সে সফুরাকে বলছিল বাদায় যাবার কথা। এবারও যাবার পরি আল্লায় বাচাইলে। আলিম শেখ আর আমি ওগের সঙ্গে যাব ঠিক করেছি। কাটা মধুর ভাগ পালি আগামী কটা মাস নিশ্চিন্তে চলা যাবি। সফুরা সবসময়ের মতোই চোখ মুখ কালো করলেও লোকটা যেন আষাঢ়ে মেঘ পাত্তাই দিলো না। শোন, ঘরে নতুন ছাওয়াল আসবি। কটা বাড়তি টাকা পয়সাতো লাগবি নাকি? সফুরা সমান খেদে বলেছিল, লাগবি না আমার টাকা পয়সা। বাদার জলে জঙ্গলে সাপ কুমিরের মধ্যি থাকি টাকা পয়সা আমার ছাওয়ালরে না খাওয়ালিও চলবি। আনার স্ত্রীর কথা শুনে কেবল হেসেছিল। সেদিন সন্ধ্যার আগেই তেল দেওয়া চুলটা আরেকটু পরিপাটি করে, পাতলা গোঁফটায় একটু চিরুনি চালিয়ে দুই ব্যাটারির টর্চ নিয়ে বেড়িয়ে গিয়েছিল সে। সফুরা তখন কুপির ধারে নতুন কাঁথায় ফোঁড় দিতে ব্যাস্ত। রাত একটু ধরে এলেই লোকজনের শোরগোল শুনেছিল সে। সাইজুনি কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে এসে তাকে খবরটা দেয়-ভাবিগো ভাবি, আনার ভাইরে লয়া গেছে। সফুরার মাথা ঘুরে ওঠে, কে কে তার স্বামীকে নিয়ে গেছে! ঘটনাটা একটু পরই সারা গ্রামের কাছে চাউর হলো। সেদিন রাতে কাশেমের ট্যাক থেকে খাল পাড় দিয়ে ফিরছিল আনার আর আলতাফ মৌয়াল। পথে একটি ঝোপের পাশে পেশাব করতে করতে গান ধরেছিল আলতাফ। আর আনার দাঁড়িয়ে ছিল খানিকটা দূরে।
হঠাৎ একটি কেয়া ঝোপ থেকেই বিকট গর্জনে গজব নেমে এসেছিল আলতাফের ওপরেই। কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রচণ্ড থাবায় মুখের একপাশ ছিঁড়ে গিয়েছিল মৌয়ালের। সেই পিলে চমকানো ডাক শুনেই টর্চ জ্বেলে এগিয়ে গিয়েছিল সাহসী আনার। তখন মূর্তিমান ডোরাকাটা গজব আলতাফকে ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে আনারের ওপর। আলতাফ মৌয়াল আর কিছু কাউকে বলতে পারেনি। শুধু সে নাকি শুনেছে, ডোরাকাটা দানবটা যখন আনারের ঘাড় কামড়ে ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন সে চিৎকার করে বলছে, আল্লা আমার বউ আর সন্তানটারে দেইখো। সেদিন রাতে গ্রামবাসী তন্ন তন্ন করে খুঁজেও খোঁজ পায়নি আনার মৃধার লাশ। গাল আর চোখ হারানো আলতাফকে পাঠানো হয় থানা সদরে। খবর যায় স্থানীয় বন কর্তাদের কাছে। সকালে তারা বন্দুক নিয়ে গ্রামে এসে আবার খাল পাড় ধরে চলা রাস্তা, ঝোপঝাড় খুঁজে দেখেন।
অবশেষে দানবটার পায়ের ছাপ আর ধস্তাধস্তির চিহ্ন অনুসরণ করে আনারের আধ খাওয়া মড়া খুঁজে পাওয়া যায় বেড়িবাঁধের ধারে ঘন হেতাল কাঁটার জঙ্গলে। মুখটা অবশিষ্ট থাকলেও ততক্ষণে আনার মৃধার তলপেট, পাছা আর দুই রানের মাংস উধাও। খোলা মুখের ভেতর লাল পিঁপড়ের ঝাঁক। লোকজন একটা বস্তায় পেঁচিয়ে লাশটা এনে সফুরাদের উঠানে রেখেছিল। সফুরা তখন সাইজুনি আর সুন্দুরির কোলে বার বার জ্ঞান হারাচ্ছে। বাড়ি ঘিরে যেমন মানুষের জটলা যেমন বাড়ছে, লাশ ঘিরে তেমনই বাড়ছে মাছির ভনভনানি। কে যেন ভিড় থেকে বলে ওঠে-ভগবান, মরণ দিবা দ্যাও, কিন্তু এমন মরণ দিও না। একটু পর পুলিশ বন কর্তারাও আসেন, গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন।
তারপর বাঘটার পেটেও কঞ্চি দিয়ে খোঁচা দেয়। আহারে মেচিটাও পোয়াইত্তা আছিল। বাচ্চাগুলা পাইলে ভালো দামে বিক্রি হইতো। যাই হোক-চামড়া আর দাঁতগুলান কিন্তু আমার লাগবে।
গত ১০ দিনে বাঘটার হাতে এই নিয়ে দুজন মারা পড়েছে। আরেকটি ঘটনা ঘটেছে পশ্চিম পাড়ার দরাজখালি গ্রামে। বন কর্তারা গ্রামবাসীকে সাবধান করেন যেন বাঘটাকে দেখা গেলে তাদের খবর দেওয়া হয়। আর সবাই যেন সাবধানে থাকে, রাতে যেন অযথা একা একা বাইরে বা খাল পাড়ে না বের হয়। পুলিশের হাঙ্গামা শেষে পরেরদিন গ্রামবাসীই কবর দিয়েছিল আনারের লাশটার। সেই থেকে যে সফুরার দুর্ভাগ্য শুরু হলো তা এখনো চলছে। এই অন্ধকার রাতে নয় মাসের পেট নিয়ে স্বামীর কথা মনে করে আবার চোখে জল আসে। দক্ষিণ থেকে ফুরফুরে বাতাস খেলে যায়। সফুরার পেটের ক্ষুধাটা জানান দেয় আবার। হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে যায় মেয়ের মাথায়। আল্লা যদি তার সঙ্গে এমনই অবিচার করবেন, তাইলে আল্লার প্রতি খানিকটা অবিচার করতে দোষ কী? চুরি করা পাপ জানি, কিন্তু এই চুরিখানই হয়তো বাঁচাইতে পারে প্যাটের বাচ্চাটারে। তারজালি জেলে আনারের স্বপ্ন সাধের গাউসুল আজম বা মা ফাতেমা। খানিকটা আশার আলো দেখেই হয়তো সফুরা শরীরে শক্তি অনুভব করে। সে চোখ বন্ধ করে কল্পনায় দেখে-তার মাটির চুলায় আগের মতো টগবগ করে ফুটছে ভাত। তার মিষ্টি গন্ধ আর ধোঁয়ার যুগলবন্দী রূপকথার মতো উবে যাচ্ছে বাতাসে। পাশে থালায় লবণ-মরিচ মাখানো সাদা চিড়ি। তেলের কড়াইয়ে সেগুলো ছাড়া মাত্র ছ্যাঁৎ করে তুলবে আওয়াজ। আর আছে লুঙ্গিটাকে গুটিসুটি মেরে হাসিমুখে বসে থাকা আনার মৃধা। পাতলা গোঁফের নিচে অদ্ভূত হাসি ছড়িয়ে সে বলছে-তোর দোষ কিরে বউ, ক্ষুধার জ্বালা যে বড় জ্বালা এই কথা সবাই বুঝে। ক্ষুধার জ্বালাতো আমারও মরণের কারণ। বাদায় খাওয়া না পায়াইতো ডোরাকাটাটা এইদিকে আইছে। দে, এখন ভাত দে…। সফুরার কল্পনা ভেঙে যায়। ঢোলের মতো ফোলা পেট নিয়ে সে উঠে দাঁড়ায়। দূরে ককর্ষ শব্দে কোনো একটা পাখি ডাকে অমঙ্গলের মতো। সফুরা এই নিশুতি ভয়ঙ্করেও পা বাড়ায় ঘরের বাইরে।
সকাল থেকেই ধনকাঠি গ্রামে উত্তেজনা শোরগোলের নহর বয়ে গেছে। বন ঘেঁষা ছোট্ট এই প্রত্যন্ত জনপদের মানুষদের জীবনে প্রতিদিন সাধারণত এত উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনা ঘটে না। তাই আলো ফুটতে না ফুটতেই ছেলে বুড়ো, কাচ্চা বাচ্চা সব এসে হাজির হয়েছে মান্দারভাঙ্গা খালের পাড়ে বটতলায়। ঘটনা ঞলো, গতকাল ভোর রাতের দিকে হঠাৎ গোয়ালে গরুর গোঙানি আর ধস্তাধস্তির শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল পলান ঘোষের। গোয়ালে রাখা তিনটি গাভীই তার সারা জীবনের সম্পদ। তার মধ্যে আবার একটি কদিন পরেই বিয়োবে। তাই প্রথমে ভয় পেলেও পরে তা উপেক্ষা করে ভাই ছোটন ঘোষকে নিয়ে টর্চ সমেত বের হন তিনি। গোয়ালের কাছে যেতেই রক্তের ধারা আর বোটকা গন্ধ পেয়ে যা বোঝার বুঝে যান তিনি। হঠাৎ চারদিক কাঁপিয়ে দেয় গর্জনের শব্দ। চালের মাচাঙয়ের ওপর থেকে বিশাল একটি বাঘ ঝাঁপ দিয়ে পড়ে পলানের কাঁধে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ছোট ভাই ছোটনের দায়ের কোপ খেয়ে বাঘটি পালিয়ে যায় পাশের ঝোপে। ততক্ষণে ছোটনের বাঘ বাঘ চিৎকারে পাড়ার লোকজন জেগে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দা, কুড়াল, সড়কি, বল্লাম নিয়ে হাজির তার। উন্মত্ত উত্তেজনায় জনতা তখন ঘিরে ফেলেছে ঝোপঝাড়। চলছে টিন বাজিয়ে বাঘ খেদানোর মহড়া। কিন্তু কোথায় ডোরাকাটা? আলো ফোটার একটু আগে একটা কেয়া ঝোপ থেকে বাঘটি গর্জন ছেড়ে রইসউদ্দিনকে কুপকাত করার চেষ্টা করে। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। তাগড়া জোয়ান গোপালের মুগুরের বারি খেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে বাঘটি। আর সঙ্গে সঙ্গেই সেটির ওপর সমান হিংস্রতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে উন্মত্ত জনতা। অজ্ঞান পশুটি হয়তো টেরও পায় না কখন তার শরীর দা-বল্লমের কোপ আর ঘায়ে মোরব্বা হয়ে গেছে।
অন্যদিকে দানব বধের উত্তেজনার বাইরে মানব বধের চাঞ্চল্যও কম হয়ে বাজে না চারদিক। ‘গত রাতে খোদেজাদের পাকের ঘরের ওপরে ঝোলা লাউ চুরি করতে গিয়ে ধরা খেয়েছে আনার মৃধার বউ। তাড়াহুড়ো করে মই বেয়ে নামতে গিয়ে ওপর থেকে মাটিতে পড়েছে ডাইনি মাগীটা। আর তাতেই পেট খালাস হয়ে খোদেজাদের উঠানে রক্তারক্তি। রক্ত বন্ধ না হওয়ায় সকাল থেকেই খিচুনি হচ্ছিল মেয়ে মানুষটার। এই কিছুক্ষণ আগে তা চিরতরে থেমেছে। ভালোই হয়েছে, ভাতারকে খেয়ে এবার জ্বালিয়ে খাচ্ছিল গ্রামটাকে। আল্লার মাইর যদি দুনিয়ার বাইর হয়, তবে চুরি করার শাস্তি মাগীটা হাতেনাতেই পেয়েছে।’ এখন সফুরার রক্তাক্ত প্রাণহীন দেহটা আর কুপিয়ে ঝাঁঝরা করা বাঘটিকে এনে রাখা হয়েছে খালপাড়ের বট তলায়।
পুলিশ যেমন আসছে, আসছেন বন কর্তারাও। দুটি ঘটনারই নিশ্চিন্ত তদন্ত চাই। আশ্চর্যভাবে বাঘটার কোপান শরীর থেকে চুঁইয়ে গড়ানো একটি রক্তের ধারা এসে মিশেছে সফুরার কালো রক্তের ধারার সঙ্গে। মিশে যাওয়া দুটি রক্তের ছোট্ট লাল চৌবাচ্চায় ছায়া পড়েছে মন্টু শিকারির। পশ্চিমপাড়ায় বাড়ি তার। বাঘ আর হরিণ মারায় সুখ্যাতিও তার ভালো। সে একটা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে সফুরার লাশের পেটে খোঁচা দেয়। তারপর থু করে পাশে একদলা থুথু ফেলে। ও আইচ্ছা এই চোর মাগীও তাইলে পেটওয়ালা আছিল। ভিড় থেকে কেউ গলা চড়ায়-আরে হেইলাতো আনার মৃধার বউ, হেই যে যারে বাঘে নিলো। মন্টু শিকারি আবার থুথু ফেলে একটা বিড়ি ধরায়। তারপর বাঘটার পেটেও কঞ্চি দিয়ে খোঁচা দেয়। আহারে মেচিটাও পোয়াইত্তা আছিল। বাচ্চাগুলা পাইলে ভালো দামে বিক্রি হইতো। যাই হোক-চামড়া আর দাঁতগুলান কিন্তু আমার লাগবে।