শাড়িটা হাতে নিয়ে চোখ ছলছল করে উঠলো মজিতনের। একমাত্র ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে চোখের জল লুকাতে হলো। মুখটা হাসি হাসি করলো। তবু চোখের কোণে আনন্দের জল চিকচিক করে উঠলো। নীরবতা ভেঙে মজিতনই বলে উঠলো, অনেক সুন্দর হইছে রে। কত নিছে বাজান?
-তোমার পছন্দ হইলেই হইলো মা। দাম দিয়া তুমি কী করবা?
-এহেন তো ঈদ না। তয় শাড়ি আনতে গেলি ক্যান?
-কী যে কও মা? আমি এহন চাকরি করি। শাড়ি কিনতে ঈদ লাগে না কি?
-লাগে রে বাজান, লাগে। তুই এতসব বুঝবি না। আইচ্ছা বাদ দে, তোর বাপের লাইগ্যা কী আনছোস?
-আব্বার লাইগ্যা তো ফতুয়া আনছি।
-যাউক, ভালো করছোস। যেই গরম পড়ছে। অতে বড় বড় পাঞ্জাবি পইরা সবসময় থাহোন যায়?
-আব্বায় কই গেছে?
-মনে অয় কালামের দোকানে চা খাইতে গেছে। তুই যা, হাত-মুখ ধুইয়া আয়। আমি নাস্তা-পানির ব্যবস্থা করি।
ছেলে প্রথম ছুটি পেয়ে বাড়ি এসেছে। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কর্মী। বেতন খুব বেশি নয়। বিক্রি ভালো হলে কমিশন মোটামুটি খারাপ না। বাড়ি আসার সময় মায়ের জন্য শাড়ি, বাবার জন্য ফতুয়া এনেছে। বিএ পাস করে দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়ের মাধ্যমে চাকরিটা পেয়েছে। যদিও এইচএসসি পাস বলেই চাকরিটা নিতে হয়েছে। এ পদে বিএ পাস প্রয়োজন নেই। বেতন ধরেছে দশ হাজার। তবে কমিশন, টিএ-ডিএ মিলিয়ে তেরো-চৌদ্দ হাজার হয়। বাসাবোর একটা মেসেই থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। ছয় মাস চাকরির পর কনফারমেশন হলো। তাই তিন দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি আসা।
গলায় আওয়াজ করতে করতে ঘর থেকে বাটি হাতে বের হয় মজিতন। মাকে আসতে দেখে দ্রুত পা চালায় আজম। শিউলি তা দেখে ওড়নায় মুখ ঢেকে মুচকি মুচকি হাসে।
বাবা মকবুল প্যাদা পেশায় কৃষক। তবে নিজের জমিজমা বেশি নেই। ধান, পাট, সরিষা চাষ করেই বছর টেনেটুনে চলে। একমাত্র ছেলে আজমকে তবু কষ্ট করে পড়িয়েছে। বাড়ির কাছেই ডিগ্রি কলেজ। পড়াশোনার পাশাপাশি আজম প্রতিবেশীর তিন-চারটা বাচ্চা পড়াতো। তাতে আজমের হাতখরচ হয়ে যেতো। মাঝে মাঝে বাবাকেও সাহায্য করতো।
আজম ঢাকা থেকে বাড়ি আসার সময় ফল নিয়ে এসেছে। মজিতন ফল কেটে প্লেটে সাজিয়ে রেখেছে। সঙ্গে নিজেদের গাছের দুটা পেয়ারা রেখেছে আস্ত। আজম হাত-মুখ ধুয়ে এসে ফল কাটা দেখে বলে, এইসব ফল আনছি তোমাগো লাইগ্যা। আমি তো প্রতিদিনই খাই। এগুলা তোমরা খাইবা।
একটা পেয়ারা হাতে নিয়ে বের হতে হতে বললো, ‘আমি বাজারে যাই মা। কিছু মাছ-মাংস কিনে আনি। তোমরা কী না কী খাও।
-এহেন আবার বাজারে যাবি? আমরা তো আল্লাহর ইচ্ছায় ভালোই খাই। তোর লাইগা পালের মোরগটা বাইন্দা রাখছি। রাইতে জবা দিমু।
-তাইলে দেখি, ইলিশ মাছ পাইনি? আটটার মধ্যে চইলা আসবো মা।
-একটু খাড়া বাজান। বলতে বলতে ফলের একটা প্যাকেট আজমের হাতে দিয়ে বলে, যাওনের সময় তোর খালারে দিয়া যাবি। আর শিউলিরে আমাগো বাড়ি পাঠায়া দিবি। রাইতে তোর খালা-খালুরে আমাগো লগে খাইতে কইবি।
প্যাকেটটি হাতে নিতে নিতে আজম বলে, আইচ্ছা মা। এহন যাই।
আজম ঘর থেকে বের হয়ে যায়। মজিতন প্যাকেট থেকে শাড়িটা আবার বের করে। কী সুন্দর ভাঁজে ভাঁজে রাখা। একবার খুলতে ইচ্ছে হয়। মন চায় গায়ে জড়িয়ে রাখতে। কেমন একটা ভালোবাসার গন্ধ মাখা। পাট ভেঙে যাবে বলে আর খোলে না। মকবুলের ফতুয়ার পাশে সাজিয়ে রাখে শাড়িটা। যেন দু’জনে নতুন পোশাক পরে শুয়ে আছে পাশাপাশি। ভাবতেই লজ্জা পায় মজিতন। মনে মনে ভাবে, ওর বাপের সামনেই খুলুম নে।
আজমের কাছে খবর পেয়েই শিউলি এসে হাজির। খালাকে সাহায্য করতে বসে পড়েছে রান্নাঘরে। মসলা বাটার ঘ্রাণ আসতে সেদিক থেকেই। সন্ধ্যা পড়তেই মাগরিবের নামাজ পড়ে বাড়ি আসে মকবুল। মজিতনও শিউলিকে রান্নাঘরে রেখে নামাজ পড়তে যায়। নামাজ শেষ করে কেবল দাঁড়ায়। বারান্দায় পায়ের আওয়াজ পেয়ে বলে, আইছেন?
-হঅ।
-দেহেন আপনের পোলায় কী আনছে।
-আজম আইছেনি? কহন আইলো?
-এই তো ঘণ্টাখানি অইবো। আইয়াই বাজারে গেলো।
-কই, কী আনছে?
মজিতন প্যাকেট দুটি এগিয়ে দেয় মকবুলের দিকে। শাড়ি ও ফতুয়া দেখে খুশির ঝিলিক খেলে যায় মকবুলের চোখেমুখে। প্যাকেট থেকে ফতুয়াটা বের করে গায়ে দেয়, সুন্দর মানাইছে না আজমের মা?
-হঅ। এক্কেলে রাজ্জাকের মতো লাগে।
-তুমিও শাড়িডা পর। তোমারে কবরীর মতো লাগবো।
-ধুর যা, খালি ফাইজলামি করেন। আমার এহন পরার সময় নাই। মেলা কাম পইড়া আছে। শিউলিরে রান্নাঘরে রাইখা আইছি। আপনে আমার লগে আহেন, মোরগডা জবা দিয়া যান।
বলে হাসতে হাসতে বের হয়ে যায় মজিতন। মকবুল ফতুয়াটা খুলে ফেলে। আবার সুন্দর করে ভাঁজ করে রাখে। মোরগ জবেহ দেওয়ার সময় যদি রক্ত লাগে, এই ভয়ে।
অসময়ে যেন ঈদের আনন্দ মকবুল-মজিতনের ঘরে। বাজার থেকে দুটো ইলিশ মাছ এনেছে আজম। এক কেজি পোলাও চালও এনেছে। পুরোদমে রান্না হচ্ছে। মকবুল আবার ফতুয়াটা গায়ে দিয়ে উঠানে একটা চেয়ার নিয়ে বসেছে। আজম বসেছে টুলে। মকবুল ছেলেকে চেয়ারে বসতে বলেছিল। আজম বসতে রাজি হয়নি। বাপ-বেটা মিলে রাজ্যের গল্প। মজিতনের মনটা খুশিতে ভরে ওঠে। দুই ঈদ ছাড়া এমন আনন্দ আর কখনো অনুভূত হয়নি তার। কিভাবেই বা হবে? বছরে দুইখান শাড়ি আর উপলক্ষ ছাড়া পোলাও-মাংস তো কল্পনার বাইরে। ছেলেকে নিয়ে আজ মজিতনের গর্ব হয়। ভাবতে ভাবতে উঠান থেকে ডাক পড়ে, কী গো, রান্ধন কদ্দুর?
-হইয়া গেছে। সাদা ভাতটা গড়ে বহায়া আইতাছি।
-আমরা তাইলে এশার নমাজটা পইড়া হালাই।
-হয়, আমনেরা নমাজ পড়েন। আমি সব জোগাড়যন্তর কইরা রাহুম।
-কি রে মা শিউলি, তোর বাপ-মায় কখন আইবো? জানতে চায় মকবুল।
-এশার নমাজ পইড়াই আইসা পড়বো খালু। বাড়ি তো আর বেশি দূরে না। পাঁচ মিনিটের পথ।
-আইচ্ছা, আমি মসজিদে গেলাম। কই আজম, লও আমার লগে।
-আব্বা, আপনে যান। আমি অজু কইরা আইতাছি।
আজমের কথা শুনে শিউলি মুচকি মুচকি হাসে। আজম রান্নাঘরের দিকে আগায়। আজমের মা বাটি আনতে ঘরের দিকে যায়। এ সুযোগে আজম বলে, শুভকামডা আইজই তো করা যাইতো। বলে শিউলির দিকে আগায়।
-ইস, এত তাড়াতাড়ি? শখ কত! যান নমাজে যান। খালা আইয়া পড়বো।
গলায় আওয়াজ করতে করতে ঘর থেকে বাটি হাতে বের হয় মজিতন। মাকে আসতে দেখে দ্রুত পা চালায় আজম। শিউলি তা দেখে ওড়নায় মুখ ঢেকে মুচকি মুচকি হাসে।
মকবুল মুহূর্তের মধ্যে চুপসে যায়। বুকের ভেতরটা কেমন খচখচ করে। তবু মজিতনের আনন্দ দেখে চোখটা অন্ধকারেও চিকচিক করে ওঠে।
খেতে বসতে বসতে রাত এগারোটা বেজে যায়। খেতে বসে আজমের বাবা শিউলির বাবাকে বলে, ভাইসাব, পোলা তো মাশাআল্লা চাকরি পাইছে। ছয় মাস পরে বাড়ি আইলো। এহন তো আমরা কিছু ভাবতে পারি।
-সেইটা আপনে যা ভালো মনে করেন। তয় ওরাও তো বড় হইছে। ওগো কাছে ভালো-মন্দ শুইনা নেওয়া ভালো। বললো শিউলির বাবা।
-হঅ। ভালো কথা কইছেন। তা বাবা আজম, তুমি কী কও? আজমের কাছে জানতে চায় মকবুল।
-আমি কই কী, তাড়াহুড়া কিসের? কেবল চাকরি হইলো। দু’এক বছর যাউক। শিউলিরও কলেজটা শেষ হউক।
-বাহ। মাশাল্লাহ। ভালো কথা বলছো বাজান। আমার কোনো আপত্তি নাই। বললো শিউলির বাবা।
-ঠিক আছে। এই কথাই রইল। এই ভাইয়ের পাতে আরেকটা ইলিশ মাছ দাও। হাসতে হাসতে বললো মকবুল।
আজমের খালা-খালু খেয়ে-দেয়ে গল্প-গুজব করে সাড়ে বারোটার দিকে বাড়ি চলে যায়। শিউলিকেও সঙ্গে করে নিয়ে যায়। আজম বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসে। খালা-খালু সামনে সামনে হাঁটে। আজম আর শিউলি পেছন পেছন হাত ধরে হাঁটে।
রাতে ঘুমাতে গিয়ে শাড়িটা বুকে জড়িয়ে রাখে মজিতন। তা দেখে মকবুল মিটিমিটি হাসে। মজিতনের শিশুসুলভ আচরণে টিপ্পনিও কাটে, পোলাপানের মতো করতাছো যে।
-আপনে বোঝবেন না। শাড়িডার দাম কত জানেন?
-কত আর অইবো? চাইর-পাঁচশ।
-এহ। খাওয়াইবো। যাইতে কইছে। বারোশ পঞ্চাশ টাহা।
-কেডা কইছে তোমারে?
-শিউলি কইছে। ও প্যাকেটের গায় লেখা দেখছে।
-ওরে আল্লা। কও কী?
-হঅ। হাঁচা কতা। হারা জীবন তো তিনশ টাহার কাপড় কিন্না দিছেন। এইবার আমার পোলায় বারোশ টাহা দিয়া কিন্না দিছে। আইজই আমার ঈদ। আইজই আমার মহাখুশির দিন।
মকবুল মুহূর্তের মধ্যে চুপসে যায়। বুকের ভেতরটা কেমন খচখচ করে। তবু মজিতনের আনন্দ দেখে চোখটা অন্ধকারেও চিকচিক করে ওঠে।