মরা পাখিটার মাথা নেই। মুণ্ডহীন পাখির গলার কাছে জমে আছে স্যাঁতসেঁতে কালচে রক্ত। ঝড়ে বক মরে, পাখি মরে, মানুষও মরে; কিন্তু কোনোটারই মাথা উড়ে যায় না তাতে। তাহলে পাখিটার এই হাল করেছে কে?
লুভানাদের এলাকা ও আশেপাশে গতরাতে উত্তাল ঝড় হয়েছে। কয়েকদিন আগে থেকেই আবহাওয়ার পূর্বাভাসে সতর্কবার্তা দেখানো হচ্ছিল। আর সকালে ঘরের দরজা খুলে সামনেই একটা মরা পাখি পড়ে থাকতে দেখে তবু তার বুক কেঁপে ওঠে। আর তারচেয়েও বড় কথা, একটা মুণ্ডুহীন পাখি, ঠিক দরজার বাইরের পাপোশটাতেই, নিঃসন্দেহে দৃশ্যটা ভয়ঙ্কর। অজান্তেই নিজের গলা আর ঘাড়ে হাত বুলিয়ে লুভানা নিশ্চিত হলো যেন, ওর মুণ্ডটা ঠিক জায়গাতেই আছে!
লুভানা সাহসী মেয়ে। নিজেকে সামলে নেয় সহসা। ভয়ের কাঁথা দিয়ে হৃদয়কে পুরোপুরি না জড়িয়ে বরং একটা উল্টো দৌড় দিলো। একটু আগে কেটেলের কাছে রাখা মোবাইল এনে ঝটপট মুণ্ডুহীন পাখির কয়েকটা ছবি তোলে। মৃত্যু বীভৎস, কিছু কিছু মৃত্যুর ছবি আরো ভয়ঙ্কর হয়।
মৃত পাখির ছবি তুলতে তুলতে লুভানা, সম্প্রতি বাংলাদেশি সংসদ সদস্য আনোয়ার উল আজিমের ভারতে খুন হওয়ার ঘটনাটি নিয়ে ভাবে। লোকটা মে মাসে কলকাতায় গিয়েছিল আর সেখানে খুন হলো। টিভি সংবাদ আর অনলাইন পত্রিকার পাতা থেকে লুভানা জেনেছে, ব্যাপারটা ছিল নারীঘটিত আর নগ্ন ছবি তুলে বড় অঙ্কের মুক্তিপণ আদায় সংক্রান্ত এক সাজানো আয়োজনে অকস্মাৎ ঘটে যাওয়া মৃত্যু, যাকে দুর্ঘটনা বলা যায়, কারণ সেটি আসলে সরাসরি খুনের জন্য পরিকল্পিত ছিল না।
রান্নাঘরের কেটেলে পানি গরম হওয়ার গমগম শব্দ শোনা যায়, নিথর পক্ষী-দেহের দিকে তাকিয়ে লুভানা মনে মনে বলে, ওরা তো বেঁচে ছিল, একটা মানুষের প্রাণহীন শরীর অকম্প হাতে কেটে টুকরো টুকরো করতে পারে যারা, তারা কি আসলে জীবিত প্রাণ, না কি জীবনের অপভ্ৰংশ, যারা আজরাইলের হাতে চূড়ান্ত মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পালন করে চলে একেকটা জীবন্মৃত জীবনাচার!
প্রথমে ছবিটা সে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে না। বরং ছবিটি সে পাঠায় তার একজন বিশেষ বন্ধুকে। আর ছবির সঙ্গে একটা ক্যাপশন লেখে: আমাকে যদি ছেড়ে যাও তুমি, তো এই পাখির মতো হাল করবো তোমার। জবাবে বিশেষ বন্ধু একটা মুখ হা করা ইমোজি রিপ্লাই দেয়, অর্থাৎ, বিস্ময়ের প্রকাশ।
লুভানা ফের মেসেজ পাঠায়: ঠাট্টা করছি না কিন্তু, এটাই সত্যি।
আচ্ছা, লিখে রাখলাম, আবার ভুলে যাই যদি! বন্ধুর জবাব আসে এবারে।
একটা লাল লাভ হার্টের ছবি পাঠিয়ে একটুখানি মুচকি হাসে লুভানা। পানির কেটেল অফ করে দুই হাতে দুটো গ্লাভস পরে নেয়। তারপর একটা পলিথিন ব্যাগে মুণ্ডুহীন পাখিটাকে ভরে বাইরে ময়লার বিনে ফেলে দেয়। মনে মনে বলে, যা কিছু অসুন্দর, অসম লাগে এই দৃষ্টির সামনে, সব নিপতিত হোক ওই আস্তাকুঁড়ে, আবর্জনার স্তূপে।
লুভানার বয়স পঁচিশ পার হয়েছে। দুই বছর আগে দেশ থেকে ইংল্যান্ডে এসেছে স্টুডেন্ট ভিসায়। একটা কোর্স করার পাশাপাশি পিকাডেলিতে একটা ফরাসি সলিসিটর ফার্মে পার্টটাইম অফিস সহকারী হিসেবে চাকরি করছে, যদিও সে বরাবর বিজনেস ম্যানেজমেন্টের স্টুডেন্ট।
আর অল্প সময়ের ব্যবধানে পুরুষগুলোর ফুলের মতো স্বল্পায়ু ভালোবাসা মেখে গেছে কামনার লালায়। আর তাই লুভানা, প্রতিবারই ধনুকের ছিলা ছিড়ে ফস্কে গিয়েছে, ইচ্ছাকৃতভাবেই।
একটু আগে পাখির ছবি আর মেসেজ পাঠিয়েছে যে বিশেষ বন্ধুকে, তার নাম সরফরাজ। পুরো নাম, সরফরাজ খান। পাকিস্তানিদের মতো নাম হলেও বন্ধু সরফরাজ বাঙালি ছেলে। দেখতে পাকিস্তানি যুবকদের মতো হ্যান্ডসাম, মানে সম্পূর্ণ উল্টো অর্থে। আর কয়েক দশক ধরে ঠাণ্ডার দেশে থেকে প্রায় বামুনাকৃতির মানুষটার গায়ের ফর্সা রঙ ইটের নিচে চাপাপড়া হলদে ঘাসের মতো ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। যদিও তার শরীরে ঘাস শুধুই অভ্যন্তরীণ, মাথার তালুতে যে তৃণভূমি থাকার কথা ছিল, তা মরুভূমির বালুকা প্রান্তরের মতো চকচকে, আবাদহীন।
লুভানা মাঝেমাঝে চিকন সুরে বলে, ওহে আমার বিলাতি প্রেমিক, তোমাকে দেখলে শুধু ফিশ অ্যান্ড চিপস মনে আসে, ভর্তা আর কালিয়ার মতো প্রেমিক পাবো কোথায়?
লুভানার এমন কথাকে সরফরাজ বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নেয়। যদিও এসব মন্তব্যকে সে তার নিজের জন্য গৌরবের বলে মনে করে। অন্য ছেলেদের কেমন লাগে সরফরাজ জানে না, কিন্তু তার বেশ লাগে, নিজে একটা উইপোকার ঢিপি হয়ে শতফুলে ছাওয়া গোলাপ গাছের মতো অনিন্দ্য রূপসী একটা মেয়েকে পাশে নিয়ে জীবন পার করার প্রস্তুতি, তার কাছে আনন্দ আর অহঙ্কারের।
এই বাড়িতে শেয়ার কিচেনটা বেশ ছোট। চার বার্নারের চুলার একপাশে কোণায় রাখা আছে তিন ভাড়াটিয়ার আলাদা সরঞ্জাম, তিনটা আলাদা কৌটায়। প্রতিদিন সকালে এই বাড়ির অন্যান্য ভাড়াটিয়ার আগে ঘুম থেকে ওঠে লুভানা। কষ্ট করে রপ্ত করেছে এই অভ্যাস। উদ্দেশ্য, ঘুম থেকে উঠে পছন্দের কোনো গানের সঙ্গে মগ ভরা এককাপ ইংলিশ-টি পান করা। বলা যায় বর্তমান জীবনে এটাই তার একমাত্র বিলাসিতা।
অত ভোরে চা বানিয়ে উপরতলায় নিজের রুমে গেলে চায়ের সঙ্গে টা, মানে গান শোনার উপায় থাকে না, কারণ তখন বাকি দুটো রুমে ভাড়াটে দুই দম্পতি ঘুমিয়ে থাকে, তারা চারজন কাজ শেষে বাড়ি ফেরে অনেক রাত করে। এছাড়া সকালে দেরি করে উঠলে এই থ্রি-বেডরুম বাড়ির রান্নাঘর আর একমাত্র বাথরুমে অন্যদের সঙ্গে লাইনে দাঁড়াতে হয়। তাই প্রতিদিন সকালে সবার চেয়ে অন্তত একঘণ্টা আগে বিছানা ছাড়ে লুভানা, প্রাপ্তিযোগ, একমগ চা, আর প্রিয় কিছু কণ্ঠের উপস্থিতিতে বাগানের দরজায় দাঁড়িয়ে নিজেকে হালকা বেহেস্তি আমোদ উপহার দেওয়া।
ইউকে আসার পর প্রথম কয়েকমাস সে ইংলিশ-টি নামের ঢ্যালঢ্যালা উষ্ণ পানীয়টুকু একেবারেই খেতে পারত না। মন খুসখুস করতো, বাংলাদেশের মতো আলাদা করে চায়ের একটা হাড়ি থাকবে, সেই হাড়িতে ঘন করে দুধ জ্বাল দিয়ে পাতি ফুটিয়ে তৈরি হবে মনের মতো ঘন চা, তা না, কি এক মগ ভর্তি গরম পানিতে একটা টি-ব্যাগ ছেড়ে দিয়ে ফ্রিজের ঠান্ডা দুধ মিশিয়ে খাও চা নামের ইংলিশ-টি।
বালের ইংলিশ-জাত! বালের ইংলিশ-টি! তখন শুধু চা না, আরো অনেক ব্যাপারেই এটা ছিল লুভানার একমাত্র মন্তব্য।
তবে মানুষ যে অভ্যাসের দাস, সেই বাণীর মর্ম বজায় রাখতে ধীরে ধীরে খাদ্যাভ্যাসের দাসত্ব মেনে নিয়েছে লুভানা।
তবে তার মনের মধ্যে খোঁচাতে থাকে মরা পাখিটার মুখ। ধুর, মুখ হবে কীভাবে, পাখির তো মুণ্ডুই ছিল না। বলা যায়, মরা পাখির এইটুকুন শরীর।
সাত সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই একটা ডেডবডি দেখা, সেটা পাখি আর মানুষ যাই হোক না কেন, দুটো তো একই স্রষ্টার সৃষ্টি। একবার সে ভাবে, এটা কি কোনো অলক্ষণের লক্ষণ! কিন্তু তার শিক্ষিত মনে কুসংস্কারের চিন্তা প্রশ্রয় দিতে ইগোতে বাঁধে। অন্যমনস্কভাবে গান বন্ধ করে লুভানা আজ বরং নিজের রুমে চলে যায়।
আজ শনিবার। সন্ধ্যায় একটা পার্টিতে যাওয়া আছে। ইলেন পেনডেলবেরি, অফিসের একজন ইংলিশ এডভোকেট, রিটায়ার করবে সামনের মাসে, তার জন্য রিটায়ারমেন্ট পার্টি। তবে এটা যেহেতু ফরাসি ফার্ম, তাই লুভানার কলিগদের বেশিরভাগই ফরাসি। লুভানা নিজে, সরফরাজ, আর দুজন এপ্রেন্টিজ ছাড়া আর কোনো এশিয়ান নেই ওদের ফার্মে।
দুজনের সম্পর্কটাও হয়েছে এখানেই, ছয়মাস আগে লুভানা এই অফিসে জয়েন করার পর। আর সরফরাজ এখানে কাজ করছে আরো কয়েকবছর আগে থেকে।
পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী, সন্ধ্যায় ম্যাকেঞ্জি পাবে কলিগদের প্রথম-পর্বে মোলাকাত হয়। পাবে একটা দুটো ড্রিঙ্কস পান করে তারা পাশের ইতালিয়ান রেস্তোরায় যাবে খাবার খেতে। লুভানা অর্ডার করেছে ব্লাডি মেরি। ভদকা, টমেটো জুস, আর কয়েকপ্রকার স্পাইসেস দিয়ে বানানো এই ককটেল ড্রিঙ্কসটা তার প্রিয়।
পাবে সরফরাজ বসেছে লুভানার পাশে। কাকতালীয়ভাবে আজ ওদের দুজনের পোশাকের রং মিলে গেছে- বেগুনি। চাকরির কারণে সপ্তাহে কয়েকদিন দেখা হয় অফিসে, তবু সন্ধ্যার পার্টিতে দেখা হওয়াটা অন্যরকম পুলক জাগায় লুভানার মনে!
তুমি যদি একশ বছর বাঁচো, তাহলে আমি একশো বিয়োগ একদিন বাঁচতে চাই, কারণ তোমাকে ছাড়া আমি একটি দিনও বাঁচতে পারব না, এমন রোমান্টিক একটা সংলাপ আছে কারো, লুভানা নাম মনে করতে পারে না, কার। শুধু সরফরাজের পাশের চেয়ারে বসে চুপচাপ স্ট্র দিয়ে ব্লাডি মেরি খায় সে।
আজ রাতে তোমার প্ল্যান কী? কানের কাছে মুখ রেখে সরফরাজ বলে।
রোজ রাতের মতো আজ রাতেও ঘুমের ভেতর তারার দেশে ঘুরে বেড়াব, অন্য প্ল্যান করব কেন? লুভানা জবাব দেয়, আর কানের কাছে মুখ আনায় সরফরাজের মুখের বাজে গন্ধটা আবার তার নাকে এসে লাগে। যে গন্ধটা তাকে বাংলাদেশে অতিরিক্ত বিড়ি টেনে অভ্যস্ত কিছু বয়স্ক মানুষের মুখের গন্ধের কথা মনে করিয়ে দেয়, আবার এমন গন্ধ সে বাসের কন্ট্রাক্টরদের মুখেও পেয়েছে কয়েকবার। কিন্তু লুভানা কপাল না কুঁচকে বরং ঠোঁটে হাসি প্রসারিত করে।
আজ রাতে ডিনার সেরে তোমাকে আমাদের বাড়ি নিয়ে যাব। আমার ভাই আর ভাবি তোমার সঙ্গে কথা বলবে।
এই সেরেছে, আগে বলতে পারতে! একটা শাড়ি নিয়ে আসতাম ব্যাগে করে।
লাগবে না। এইদেশে ওসব দরকার হয় না।
তাই বলে উজবুকের মতো এমন ছিঁড়াফাড়া স্কার্ট-টপস পরে বিয়ের ইন্টারভিউ দিতে যায় কেউ?
তুমি যাবে। তুমি একটা নতুন রেকর্ড করতে পারো এই ব্যাপারে। পাত্তাহীন কণ্ঠে বলে সরফরাজ। তার চোখ ঘুরছে পাবের ভেতরে অন্যান্য লোকজনদের দিকে, বিশেষ করে নারীদের দিকে।
ওদের আলাপের মাঝেই একেকজন করে কলিগ এসে যুক্ত হচ্ছে পাবে। ছেলেদের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে সরফরাজ আর মেয়ে কলিগদের গালে গালে ছুঁয়ে চুমু খায়। প্রতিবার লুভানা সরফরাজের এই সম্ভাষণ বিনিময়ের দিকে তাকিয়ে থাকে, তীক্ষ্ণ চোখে। বিশ্রী রকম অসহ্য লাগে ওর, বিড়বিড় করে বলে, তুমি একটা হ্যাংলা সরফরাজ, সাদা চামড়া আর মেয়ে দেখলেই তোমার বেলাল্লাপনা চুলকে ওঠে।
কিছুক্ষণ পর সরফরাজকে মেয়েদের মধ্যে ফেলে রেখে লুভানা ব্যাগ হাতে করে লেডিসরুমের দিকে যায়। টয়লেটের একটা কিউবিক ঘরে তালা লাগিয়ে ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে। তার স্যামসাং মোবাইলে জমে থাকা আনসিন মেসেজের সংখ্যা অন্তত পাঁচশো হবে। যেসবের আশিভাগ ভাগ এসেছে লুভানার বাড়ি থেকে। বাবা মা ভাই বোন ছাড়াও বগুড়ায় ওদের আত্মীয়স্বজনের অনেকের অনেক রকম বায়না, আবদার, দাবি এসে প্রতিনিয়ত জমা হতে থাকে ওর হোয়াটস আপ আর মেসেঞ্জার ইনবক্সে। লুভানা সবাইকে জানিয়ে রেখেছে, একদিন সে সবার সব আবদার পূরণ করবে, ঠিক। একদিন এই দুনিয়ায় আকাশ আর মাটি মিলেমিশে এক হয়ে যাবে, আর একদিন লুভানা সবার সব রকম চাহিদা পূরণ করে সব্বাইকে এই দুনিয়াতেই বেহেস্তবাসীর মতো সুখী আর পরিতৃপ্ত করবে।
মোবাইলের মেসেজগুলো একটাও খুলে দেখে না সে। শুধু সাদা আলোয় মোবাইলের ক্যামেরা অন করে মুখের দাঁতগুলো দেখে, ঠোঁট ফাঁকা করে। বিকেলে বাড়ি থেকে বের হবার আগে ক্ষুধার কারণে কিছু বাদাম খেয়েছিল, আর সেই বাদামের পেস্ট এখনো লেগে আছে দাঁতের ফাঁকে। সময় নিয়ে বা হাতের কনিষ্ঠাঙ্গুলির নখ দিয়ে খুঁটে খুঁটে দাঁতের ফাঁক থেকে ময়লা পরিষ্কার করে। একই সময়ে তার বামদিকের কানটাও চিড়চিড় করে, আর একই আঙুলে লুভানা কানের ফুটোয় কয়েকটা চক্কর দেওয়ায়। তারপর ঠোঁটের লিপস্টিক লক্ষ করে, ঠিকই ছিল, তবু আরেকবার দুই ঠোঁটে রং মাখায়, হালকা গোলাপি শেড। এই দেশে আসার পর লুভানা দেখেছে, ইংলিশ মেয়েগুলো মুখে ফাউন্ডেশন দেয়, কিন্তু ঠোঁটে লিপস্টিক দেয় না, সাধারণত। লুভানার ধারণা, ওরা হয়তো লিপগ্লস বা ট্রান্সপারেন্ট কিছু জেল মাখে ঠোঁটে।
ফের, লেডিস থেকে বেরিয়ে পাবের নির্ধারিত জটলার কাছাকাছি যেতেই লুভানা দেখতে পায় ওর প্রেমিক, সরফরাজকে। গত প্রায় অর্ধ-বৎসর যাবৎ যে লোকটা তার প্রেমিক, হয়তো সহসাই যে তার স্বামী হবে, আর সেটা হয়তো পাকা হবে আজ রাতেই।
ঠিক এই সময়, উফ, পাবের কাউন্টারে, কারো হাত ফস্কে একটা কাচের গ্লাস পড়েছে পাথরের মেঝেতে, হয়তো, ঝনঝন কাচ ভাঙার শব্দে চমকে ওঠে সবাই। আর একটা বিরাগ ও বিস্বাদে মন তাতিয়েও ওঠে লুভানার। ওদের কলিগ জেনিফার চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছে, সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে জানায় রাতে আরেকটা ডিনারে যেতে হবে বলে কলিগদের সঙ্গে রেস্তোরায় যেতে পারছে না সে। সরফরাজ আবার চুমু খায় জেনিফারের গালে, জেনিফারকে বিদায় জানাতে। জেনিফারকে পাবের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে যায় লোকটা, যার প্রতিটি পদক্ষেপে রানীর প্রতি সম্মাননার নিদর্শন ফুটে ওঠে। অস্ফুটে লুভানা শুধু নিজেকেই শুনিয়ে বলে, ফাজিলটা বিলাতি কায়দা দেখায়, তুই একটা লুজ! এক নাম্বারের ঢিলা, ব্যাটা।
এরপর, পলকা বকের মতো, প্রায় বাতাসকেও না কাঁপিয়ে, ব্লাডি মেরির গ্লাসের সামনে গিয়ে বসে লুভানা। ছোট্ট একটা সিপ নেয়। অন্যপাশে কলিগরা আলোচনা করছে আসন্ন নির্বাচন নিয়ে।
তোমার কী মনে হয়, লুভানা, ঋষি শোনাক কি আবার প্রাইম মিনিস্টার হবে?
বুঝতে পারছি না।
ওহ ঋষি শোনাক আর কিয়ার স্টিমার এর মধ্যে লড়াই হবে এবার। কনজারভেটিব আর লেবার পার্টি, মুখোমুখি আবারো, আমাদের দেশের আওয়ামীলীগ আর বিএনপির মতো। যদিও আমি এশিয়ান বলে ঋষি শোনাকের পক্ষে, কিন্তু আমি চাই এবার ব্রিটেনে লেবার পার্টি ক্ষমতায় আসুক। কথাগুলো সরফরাজ পেছনে দাঁড়িয়ে বলে, তারপর আবার সে লুভানার পাশের চেয়ারে বসে পড়ে।
এরপর কিছুক্ষণের জন্য ওদের টেবিলে উড়ে বেড়ায় বিশ্বের নানা ধরণের খাবার, হলিডে স্পট, মিউজিক শো, বিখ্যাত আইনজীবীদের বর্তমান খবরাখবর। যদিও সব সংবাদই একসময় আকর্ষণ হারায়, তবু সেটি যখন নতুন থাকে, মানুষকে তা উদ্দীপ্ত করে। সবার কথা শুনতে শুনতে লুভানা অন্যমনস্ক হয়, আগেরদিন বাড়িতে টেলিফোনালাপের কথা মনে পড়ে যায় তার। মা আবদার করেছে মৃত্যুর আগে একবার অন্তত কাবাঘর দেখতে চায়, নিজের চোখে। আর পিতা বলেছে, লন্ডন শহর না দেখা পর্যন্ত সে মরতে পারবে না। এরপর তারা দুজন জানতে চেয়েছে, লুভানার ব্রিটিশ পাসপোর্ট হতে আর কত দেরি! প্রতিবার ব্রিটিশ পাসপোর্টের জন্য তাদের এমন আকুতি লুভানাকে কবিতার লাইন মনে করিয়ে দেয়, রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি? লুভানা ভাবে, সেই ব্রিটিশ পাসপোর্ট, যেটি আগে নীল ছিল, তারপর ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যুক্ত হয়ে সাময়িকভাবে লাল হয়েছিল, আর কয়েকবছর আগে ব্রেক্সিট হবার পর আবার যা পুনরায় ফিরে গেছে নীলে, যদিও এখন সেটা এত কালচে নীল যে এটাকে কালো বলা যায়, যেটি তৃতীয় বিশ্বের অনেক মানুষের রক্ত ঢেলে দেয়া সংগ্রাম, তাদের অপূর্ণ স্বপ্ন, তাদের ঐকান্তিক আকাঙ্খার মতো জমাট বাঁধা এক অমূল্য রত্নের মতো, যা প্রত্যাশার দীর্ঘশ্বাস ধারণ করতে করতে ব্যথায় কালো হয়ে গেছে!
ইংল্যান্ডে শ্লথ গতির শীতকালের মতো দীর্ঘ একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে লুভানার বুক থেকে। এই দেশে থাকার পার্মানেন্ট ভিসা-ই হয়নি এখনো তার, পাসপোর্ট তো অনেক পরের কথা। স্টুডেন্ট ভিসার মেয়াদ আছে আর নয় মাস, এরমধ্যে একটা কিছু ব্যবস্থা না হলে, হয় দেশে ফিরে যেতে হবে, অথবা ইল্লিগ্যাল হয়ে পালিয়ে বাঁচো ইংল্যান্ডের অন্ধকার গলি ঘুপচিতে।
কিন্তু দেশের কেউ জানে না এসব কথা। সবাই জানে তাদের মেয়ে লুবনা ইয়াসমিন বিলাতে বেশ জাঁকিয়ে বসেছে, যে ফরাসি অফিসে বড় চাকরি করে, অফিস থেকে তাকে পায়ে সেধে ওয়ার্ক পারমিট দিয়ে দিয়েছে, আর খুব সহসাই সে একে একে পরিবারের সবাইকে বিলাতের ঠান্ডা চাদরের নিচে নিয়ে ঢোকাবে, একদিন।
আর বলা বাহুল্য, পরিবারে একমাত্র এই মেয়েটাই বিদেশ যাবার পর থেকে দেশে গ্রীষ্মের উত্তাপ যেন কয়েকশ গুণ বেড়ে গেছে। এত গরম, এত উত্তাপ, যে আজকাল তারা কেউ যেন সেটা আর একদমই সহ্য করতে পারছে না।
বিকেল ছয়টার মধ্যে ওরা ম্যাকেঞ্জি থেকে বেরিয়ে ইতালিয়ান রেস্তোরায় প্রবেশ করে। আগে থেকে ওখানে অপেক্ষা করছিল আরো কিছু কলিগ। বেশ কয়েকজন পুরোনো কলিগ এসেছে ডিনারে যোগ দিতে। সবার মধ্যে ইলেন পেনডেলবেরির মুখটি ব্লাডি মেরির টমেটো জুসের মতো কমলা লাল হয়ে আছে, লাজুক হেসে মৃদুস্বরে সে কথা বলছে সবার সঙ্গে। লুভানার মনে হতে থাকে, সরফরাজের সঙ্গে প্রেমের প্রথম দিকে তাকেও হয়তো এমনটাই দেখাত!
এত কী চিন্তা করো তুমি সারাক্ষণ, চিন্তুনি বুড়ি? লুভানার হাতের ওপর একটা টোকা মেরে ঠাট্টার সুরে বলে সরফরাজ।
আমি তো শুধু তোমাকেই ভাবি। মুচকি হেসে শব্দ করে বলে লুভানা, আর নিঃশব্দে বলে, আমার বাল তুমি, কী চিন্তা করি সবকথা তোমারে বলতে পারলে তো ভালোই হইত!
ভাগ্যিস মানুষ অন্তর্যামী না, তাই সরফরাজ লুভানার মনের কথাটি জানতে পারে না। বরং তার মনে বেশ একটা প্রেম-ভাব জেগে ওঠে। বলে, তুমি টেনিসন পড়েছ না?
কে এটা?
আলফ্রেড টেনিসন, বিখ্যাত ইংরেজ কবি। এখন যদি বলো যে আমি টেনিসন পড়ি নাই, তাহলে তোমার ব্রিটিশ নাগরিকত্ব পাওয়ার সম্ভাবনা সম্পূর্ণই বাতিল হয়ে যাবে।
তা কেন, তুমি আছো না! মাথা যেদিকে যায়, ল্যাজও সেদিকে ধায়, বলে হাসতে থাকে লুভানা, যা অনেকটা পুরুষ পটানো বেশ্যা-হাসির মতো শোনা যায় রেস্তোরার ধূসর আলোয় ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতে থাকা মৃদু মিউজিকের সঙ্গে।
আবেগে ঘন হয়ে বসে সরফরাজ। লুভানার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে, আমি তো তোমার জন্য আছিই, ডার্লিং। আমি থাকতে তোমার চিন্তার কোনো কারণ নাই।
আমি সেটা জানি, ডার্লিং।
ফাঁপা আস্ফালন ভেতরে ঢেকে রেখে ওপরে খিলখিল হাসে লুভানা, আর কৌশলে গাল সরিয়ে নেয় আরেকটু বামে, যতদূর ঝুঁকতে পারে না সরফরাজের এগিয়ে আসা ঠোঁট। বামের ছাদের দিকে চোখ রেখে বিড়বিড় করে, দাঁতে দাঁত ঘষে লুভানা সাপের মতো হিসহিসে বলে, সেই থেকে তুই জনে জনে বিলিয়ে যাচ্ছিস যে আহ্লাদ, সেই আহ্লাদে আমার আগ্রহ নেই মোটেই, বালের বাল!
সরফরাজ তবু লুভানার একটা হাত ধরে থাকে, বলে, যতবার আমি তোমার কথা ভাবি, ততবারই যদি একটা করে গোলাপ পেতাম… তাহলে আমি চিরদিন আমার গোলাপ বাগানে হেঁটে বেড়াতাম, জানো তো, এটা আলফ্রেড টেনিসন এর একটা বিখ্যাত উদ্ধৃতি।
সুন্দর!
হুম, একটা সুন্দরের জন্য আরেকটা সুন্দর উপহার, এ শুধু তোমার জন্য, মাই লাভ।
ওদের কথার ফাঁকে রেস্তোরার কয়েকজন ওয়েটার টেবিলে খাবার পরিবেশন করে যায়। স্টার্টার, মেইন কোর্স, আর ডেজার্টের পালা শেষ করে রাত দশটার মধ্যে সবাই একে একে বিদায় নিতে আরম্ভ করে। ওয়েটারের হাতে কার্ড মেশিন, সবাই যার যার খাবারের বিল পরিশোধ করছে। লুভানার মনে হালকা আশা ছিল, সরফরাজ হয়তো আজ ওর বিলটা দেবে। বিলেতে থাকলেও তারা দুজন এসেছে এমন একটা দেশ থেকে, যেখানে পুরুষ নিজের উপস্থিতিতে নারীকে টাকায় হাত দিতে দেয় না, এটা নারীর প্রতি পুরুষের একটা সম্মান জানানো, আর সেই নারীটি যদি সেই পুরুষের হবু-স্ত্রী হয়, তাহলে তো খাবারের বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে এই নিয়ে কোনো কথাই আসতে পারে না। কিন্তু, শেষপর্যন্ত দেখা গেল সরফরাজ শুধু নিজের অর্ডার করা আইটেমগুলোর নাম জানিয়ে ওয়েটারের বাড়িয়ে রাখা মেশিনে কার্ড ছোঁয়ায়।
লুভানা বিরক্তি অথবা বিস্ময় প্রকাশ করে না। কারণ সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্রিটিশ পাসপোর্ট না হওয়া পর্যন্ত কিছুতেই সে আশ্চর্য, অবাক, হতবাক, আহত অথবা ব্যথিত হবে না। তাই ইত্যবসরে যার কাছে থেকে যাই ব্যবহার আসে, তাই সই। রাস্তার আবর্জনা সই, ময়লার দুর্গন্ধ সই, কথার খোঁচা সই, এমনকি সরফরাজের চারিত্রিক লাম্পট্যও, সই বরাবর। লুভানার আগে অফিসের আরেকটা ফিলিপিনো মেয়ের সঙ্গে সরফরাজের তুঙ্গে ওঠা প্রেমের গল্প সবাই জানে। শেষমেশ মেয়েটা কী কারণে যেন চাকরি, লন্ডন শহর, প্রেম আর প্রেমিক সব ছেড়ে দূরে কোথায় চলে গেছে। প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে কোথাও শূন্যস্থান পড়ে থাকে না, আর সরফরাজের প্রেমিকার শূন্যস্থানে অভিষেক ঘটেছে, লুভানার।
যদিও লুভানার হৃদয়ের পাড় এখনো ছুতে পারেনি এই পৃথিবীর কোনো পুরুষ। যতবার সে নতুন কাউকে দেখে মুগ্ধ হয়েছে, ততবার সে ধনুকের ছিলায় তিরের মতো নিজেকে পেছনে টেনে ধরেছে, ভেবেছে, আগে আরেকটু যাচাই করে দেখি, এই সেই সত্যিকার পুরুষ কিনা! আর অল্প সময়ের ব্যবধানে পুরুষগুলোর ফুলের মতো স্বল্পায়ু ভালোবাসা মেখে গেছে কামনার লালায়। আর তাই লুভানা, প্রতিবারই ধনুকের ছিলা ছিড়ে ফস্কে গিয়েছে, ইচ্ছাকৃতভাবেই।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে ভোর হতে যাওয়া এমন একটা মুহূর্তে, একটা পাখির মুণ্ডুহীন মৃতদেহ, কেন যে বারবার ওর মগজ ঠোকরাতে থেকে, কিছুতেই বুঝতে পারে না সে।
অফিসের সবাই জানে, সরফরাজ তার প্রেমিক। বাহ্যিকভাবে বেমানান একটা যুগল সেজে ওরা দুজন ঘুরে বেরিয়েছে লন্ডন আর আশেপাশের কিছু শহরে। হয়তো অল্প কিছুদিনের মধ্যে তারা বিয়েও করবে। কিন্তু লুভানা বুঝে পায় না, সরফরাজ আসলে তার কে হয়? এটা অন্তত ভালো যে, বিয়ের পর নির্দিষ্ট করে বলা যাবে, এই লোকটা তার স্বামী হয়, কিন্তু তার আগপর্যন্ত, নিজের কাছে সে কোনো নাম দিতে পারে না এই সম্পর্কের। না প্রেম, না বন্ধুত্ব, না ভালোবাসা, না কোনো এক প্রগাঢ় আস্থা আর বিশ্বাসের সম্পর্ক।
যতবার সে সরফরাজের প্রাক্তন প্রেমিকাদের কথা মনে করে, যতবার সে সরফরাজকে মেয়েদের সামনে শাহরুখ খানের মতো মাটিতে প্রায় শুয়ে পড়তে দেখে, ততবার এক প্রবল ঘৃনায় কুঁকড়ে যায় তার মন। নিম পাতার কষ ডলে দিয়ে যায় আবেগের কোমলতাকে। মনে মনে কতবার ভেবেছে লুভানা, আমরা একবার জন্ম নিই, একবার মরে যাই, একবার বিয়ে করি আর একবারই প্রেমে পড়ি— হিন্দি সিনেমা কুছ কুছ হোতা হ্যায়-এর ডায়ালগ কি তাহলে পুরোটাই মিথ্যা। হায়!
রাতে যখন সরফরাজ লুভানাকে বাড়ি নামিয়ে দিয়ে গেছে, তখন ঘড়ির কাঁটা রাত দুটোয় গড়াচ্ছিল। ফাইন্যান্সে কেনা ব্র্যান্ড নিউ বিএমডব্লিউটা রাতের নির্জনতা ভেঙে হাই ভলিউমে একটা জমজমাট অশ্লীল লিরিক্সের পাঞ্জাবি গান শোনাচ্ছিল লুভানা আর আশেপাশের ঘুমন্ত সব মানুষদের। লুভানার ধারণা, গানটা হয়তো অমর সিং চমকিলার কোনো গান হবে, যাকে অশ্লীল গানের জনক অভিযোগে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছিল, সস্ত্রীক। তবু গাড়ি থেকে নামার সময় লুভানাকে সন্তুষ্ট দেখায়। তবু, গাড়ি চালিয়ে চলে যাবার সময় সরফরাজকে সফল আর আনন্দিত দেখায়।
অন্ধকারে ব্যাগের ভেতর থেকে বাড়ির চাবি বের করতে মোবাইলের সাহায্য নেয় লুভানা। বাড়ির ভেতরে তখন ছোট্ট বসার ঘরে উঁচুস্বরে টিভি চলছে। ছেঁড়া আর পুরোনো সোফায় বসে নেটফ্লিক্সে ক্রাইম সিরিজ দেখছে ভাড়াটিয়া দুই স্বামী। আর তাদের দুই স্ত্রী কিচেনে রান্না বসিয়েছে। গভীর রাতে বাড়ি ফেরার পর রান্না করে না রাখলে, পরদিন কাজ থেকে ফিরে খাওয়ার মতো কিছু থাকে না তাদের।
লুভানা নিঃশব্দে উপরতলায় নিজের রুমে চলে যায়। ঘরে বাতি জ্বেলে জানালার পর্দা টেনে দেয়। টয়লেটে গিয়ে দ্রুত হালকা হয়ে এসে ঝটপট কাপড় বদলে নিতে দেরি করে না। কাল রবিবার, কলেজ অথবা অফিস নেই, ভাবতেই বিরক্ত লাগে তার, সারাটা দিন কাটাতে হবে এই বাড়িতে, যা নিজের ছোট রুমটাতে একরকম বন্দি হয়ে থাকার মতো।
একসময় লুভানা পা ভাঁজ করে খাটে বসে, ভাবতে থাকে সরফরাজের ভাই আর ভাবীর কথা। লুভানাকে তারা ভীষণ পছন্দ করেছে। হয়তো এখানে তাদের অপছন্দ বিশেষ কোনো তফাৎ করত না, তবু হবু স্বামীর একমাত্র গার্জিয়ান হিসেবে এই দেশে উপস্থিত আছে তার ভাই। তাই ছোট ভাইয়ের জন্য কনে দেখা ইন্টারভিউ নেয়ার দায়িত্ব তারই।
নানা রকম প্রশ্ন করেছে তারা লুভানাকে। বেশিরভাগ প্রশ্নই ছিল বাংলাদেশে ওদের পারিবারিক ও আর্থিক অবস্থা সংক্রান্ত। লুভানা বুঝতে পারছিল, ওরা আসলে হিসাব করতে চাইছিল বিয়ের পর লুভানা তার বেতনের টাকা দেশে পাঠিয়ে দেবে কিনা! সরফরাজের ভাই ও ভাবি, দুজনকেই লুভানার কাছে ভীষণ টিপিক্যাল মিডলক্লাস মেন্টালিটির মানুষ বলে মনে হয়েছে। তবে জলে বাস করতে হবে যাকে, তার আবার কুমিরের ভয় পেয়ে কাজ কী? আর সরফরাজের মতো পুরুষের সঙ্গে সংসার করতে হবে যাকে, তার আবার ভাসুর অথবা জা বিবেচনা!
একসময় রাত আরো গভীর হয়। নিচতলায় ভাড়াটিয়াদের রান্না, খাওয়া, টিভির শব্দ সব বন্ধ হয়ে যায়। বাড়ির প্রতিটি আলো নিভে যায়। একে একে তারা সবাই নিদ্রাদেবীর করতলে সমর্পিত হয়েছে। পাশের ঘরের দম্পতিরা একসময় আর্তনাদ করে ওঠে, সুখ অথবা দুঃখের নিশা-স্বপ্নের অতল থেকে।
লুভানার চোখ বুঁজে আসে। খুশি না, আমোদ না, মেহেদির রং-নকশা না, লাল বেনারসি অথবা কাবিননামায় একটা স্বাক্ষরের বদলে ভবিষ্যৎ বিলাত জীবনের নিশ্চয়তার প্রশান্তিও না, তার বন্ধ চোখে ভেসে ওঠে একটা পাখির ছবি। যে ছবিটা সে আজ সকালে তুলেছিল তার স্যামসাং মোবাইলে। যে মোবাইলটা সে চুরি করেছিল একটা পার্কের বেঞ্চিতে বসে থাকা এক সদ্য আগত হাঙ্গেরীয়ান যুবতীর ব্যাগ থেকে, যে মেয়েটা তখন শরীর বাঁকা করে প্রামে বাচ্চার মুখে দুধের বোতল ধরেছিল।
তার দুই চোখ থেকে মৃদু উষ্ণ ধারা গড়িয়ে পড়ে, টপটপ, টপাটপ, বালিশের ওপর, প্রায় ভোর হতে যাওয়া এমন শান্ত প্রহরে অশ্রুর ফোঁটাগুলো শব্দ করে ঝরে। পাখিটার মুন্ডু ছিঁড়েছিল কে, সেকথা কেউ জানবে না কোনোদিন। হয়তো একটা শেয়াল, অথবা কোনো শয়তানের পূজারী, কিংবা কোনো প্রেতাত্মা, কে জানে! অথবা কী কারণে মুণ্ডুহীন পাখির দেহটা পড়েছিল বাগানের দরজায়, ঠিক বাইরে রাবারের পাপোশটার ওপর, তাও হয়তো জানা যাবে না কোনোদিন। অতি সামান্য জানা আর বেশিরভাগ অজানা নিয়েই পার হয়ে যায় মানুষের জীবন। মাথার নিচ থেকে বালিশ তুলে লুভানা নিজের মুখের ওপর চেপে ধরে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে ভোর হতে যাওয়া এমন একটা মুহূর্তে, একটা পাখির মুণ্ডুহীন মৃতদেহ, কেন যে বারবার ওর মগজ ঠোকরাতে থেকে, কিছুতেই বুঝতে পারে না সে।