গল্পপাঠ প্রস্তুতি
[যাঁরা গল্পটি পাঠ করার জন্য প্রস্তুত, তাঁদের এই বন্ধনী অংশটুকু না পড়ে সরাসরি বন্দী অংশের পর থেকে পড়লেই হবে। কিন্তু এর ব্যত্যয় ঘটলেই এই বন্ধনীবিদ্ধ অংশটুকু পড়ার দরকার হবে। এখানে একটি কবিতা পাঠ করার জন্য দেওয়া হলো—
পৃথিবীতে মানুষের স্পর্শ আর স্পর্শভোজী মাছ
আগুনের গায়ে আগুন লাগবে যেদিন
ফুরফুরে বাতাসের গায়ে বাতাস
হতাশ আর কোনোদিন হতাশ হবে না তবে
এসো, আমাদের প্রাণ পাতা থাকল
তোমাদের পায়ের ছাপ মাখবে বলে
স্পর্শভোজী কিছু মাছ জন্ম নিয়েছে আমাদের এই নদীতে। নদীতে মানুষ সিগারেটের খোসা ফেলে, ব্যবহৃত কনডম, শ্যাম্পুর প্যাকেট, বিস্কুট, চানাচুরের পলিথিন, বয়াম।এসব উপকরণে মানুষের যেসব স্পর্শ লেগে থাকে সেগুলো স্পর্শভোজী মাছেরা চেটে চেটে খেয়ে বেঁচে থাকে।
গল্পটি একটু বেশি মনোযোগ কামনা করে তাই এই সময়টুকু নেয়া গেল। চারটাদিক আমাদের সমস্ত কিছুকে এমনভাবে চেপেচুপে ধরে আছে যে, ব্যক্তিগতভাবে কোনো কিছুতে একটু বিশেষ মনোযোগ দেব, তা আর হয়ে ওঠে না। জীবনের ভেতর না থেকেও বেঁচে থাকি। মৃত্যু না বুঝেই মৃত্যুর ভেতর ঢুকে পড়ি অন্যের বাড়িতে বিনা অনুমতিতে ঢুকে পড়ার মতো। এই কবিতাটি আমাদের ‘চারদিক’ থেকে ফিরিয়ে এনে গল্পটিতে মনোযোগী হওয়ার সময় দান করবে।
এটা করা গেল, কারণ, পড়ার ক্ষেত্রে দেখা যায়, পড়তে শুরু করার কিছুক্ষণ পর পুরোপুরি মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হয়, প্রথমে কিছু অংশ অমনোযোগী হয়েই পার হয়ে যায়। কিন্তু মনে হয়েছে, এ গল্পের ক্ষেত্রে এমনটি হলে হবে না। কবিতাটি এ গল্পের জন্য দরকারি নয়, কিছু সময় নেওয়া ছাড়া। হ্যাঁ, যদি আমরা ফাঁকা অংশটুকুতে কিছু লেখা আছে ধরে নিয়ে, ধীরে ধীরে পড়ছি, এমনভাবে এগুতে এগুতে বন্ধনীর বাইরে পৌঁছতে পারতাম, যদি এখানে পৌঁছতে যতটুকু সময় লাগল, বন্ধনীরুদ্ধ না থাকলেও ততটুকু সময় লাগত, তবে বন্ধনীধর্ষিত এ স্পেসটুকু ফাঁকা রাখলেও চলত।]
গল্প
১২ টা ২৬ মিনিট পার হয়ে গেলেও খবরটা লোকজন বিশ্বাস করেনি। কারণ প্রত্যেকের মধ্যে তাঁকে নিয়ে একটা বর্তমানতা কাজ করছিল। ধর্ম শিক্ষকের কাছে থেকে শোনার পর অন্য শিক্ষকদের মধ্যে, অন্য শিক্ষক থেকে ছাত্রদের মধ্যে এবং ছাত্রদের থেকে বাইরের মানুষদের মধ্যে ছড়িয়ে গেলেও কেউ-ই নিশ্চিতভাবে অন্যজনকে জানায়নি বা নিশ্চিতভাবে জিজ্ঞাসাও করেনি। সবাই প্রশ্নভাব প্রকাশ করেছে ‘না- কি’ দিয়ে। তথ্যভাব জ্ঞাপন করেছে ‘না-কি’ দিয়ে। প্রথমে কয়েকজন লোক এই প্রশ্ন এবং তথ্য মাখা বাক্যটি নিয়ে মিছিলের মতো করে যাচ্ছিল আর পথে যাদের পাচ্ছিল তাদেরও প্রশ্নটি করে তথ্যটি জানাচ্ছিল এবং উত্তর জানতে চাইছিল। এ প্রশ্নটির প্রথম শিকার বা প্রাপক হয় আজু পাগলা। প্রশ্নটি আজু পাগলা তথ্য হিসেবে নেয়। আজু পাগলা জানায়, তাকে সে এখান দিয়ে হেঁটে যেতে দেখেছে কিছুক্ষণ আগে এবং তখন বাচ্চারা চারকোণা ঘর করে ‘অলার গাছে কলার ঢুম, তাক ঢুম তাক ঢুম’ খেলছিল। মেছেদের মেয়েটা যখন ছড়া শেষ করে এবং আরও একটা ঘর দখল করে তখন এখান দিয়ে সে লম্বা পায়ে হেঁটে গেছে এবং সে সময় পাশের বেগুনক্ষেতে একটা টুনটুনি একটা ভেজা দোয়েল মার্কা টাকার নোট শুকাচ্ছিল। লোকেরা আজু পাগলা যে পাগলা নয় তেমনভাবে, এ কথা জানলেও তার কথার মধ্যে এমন কিছু থাকে, যেন তাকে পাগলা মনে না করে পারে না। এরপর তার কথার প্রমাণ হিসেবে সে ধুলোর রাস্তায় অসংখ্য পদচাপের ভেতর মাস্টারের পদচাপ খোঁজে। একটা পদচাপ খুঁজে পায় এবং সেটাকে মাস্টারের পদচাপ বলে মতো জানায়। কেউ কেউ এই পদচাপ ঝুঁকে দেখার চেষ্টা করে এবং আজু পাগলা যখন মাস্টারের পায়ের ছাপ শুঁকে দেখে এবং হাত দিয়ে তাপ পরীক্ষা করার মতো করে বলে ‘দেখ, পায়ের ছাপ দিয়ে এখনো ভাপ উঠছে’ তখন লোকেরা আর সেখানে দাঁড়ায় না। চলে যায়।
মিছিল স্মম্ভিত ভাবটা সঙ্গে করে নিয়ে হাঁটে এবং একে ওকে ‘না-কি’ দিয়ে প্রশ্ন করে মাস্টারের ব্যাপারে। যাদের জিজ্ঞাসা করা হচ্ছিল, তারা সবাই, এই প্রথম শুনে ব্যাপারটা তথ্য এবং প্রশ্ন এই বাক্যের ভেতর। তাদের মধ্যে একজন বলে, মাস্টার যখন এখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল, তখন আমি কুয়োপাড়ে জল তোলার জন্য কেবল ঝুঁকেছি এবং মাস্টারের প্রশ্নের উত্তরে ‘ভালো আছি’ বলতে গেলে আমার মুখ থেকে কিছু থুথু কুয়োর মধ্যে পড়ে যায়। তারপরে মাস্টারের দিকে এগিয়ে গেলে মাস্টার তার হ্যান্ডশেক ইচ্ছের হাত বাড়িয়ে দেয়। যার উষ্ণতা এখনো আছে’ বলে পরখ করার জন্য হাত এগিয়ে দেয় লোকটি। তখন মানুষেরা তাকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করে যেমনভাবে তারা আজু পাগলার দিকে চেয়েছিল। সে লোকটির কাছ থেকেও লোকজন হাঁটা শুরু করলে আরও একটা লোক এগিয়ে এসে তার চোখের কোণার কাছের একটা আঁচড় দেখায়, আঁচড়ের স্থান এখনও নীলাভ হয়ে আছে এবং সে বলে—‘মাস্টার বড় মসজিদ যখন পার হচ্ছিল, তখন ‘স্কুলে পৌঁছানোর শেষ সময়’ শুরু হতে বেশি দেরি ছিল না এবং তখন পর্যন্ত সে তার হাতের কালো ছাতাটি ফুটোয়নি। আমার সঙ্গে কথা বলে মাস্টার চলে যাওয়ার সময় হঠাৎ করে ছাতা ফুটোয় এবং ছাতার একটা কোণা আমার চোখের কাছে লেগে গিয়ে এমন নীলাভ আঁচড় পড়েছে।’ সে তার চোখের কোণের কাছে ছাতার গুঁতোয় তৈরি হওয়া নীলাভ দাগটি দেখিয়ে আরও বলে—এবং মাস্টার এমন বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যায় যে, সে কিভাবে ভুল স্বীকার করবে বুঝতে পারে না। স্কুলের সময় তখন পার হয়ে গেছিল। ছাতার গুঁতোতে তৈরি হওয়া সামান্য আঁচড় নিয়ে চিন্তা না করতে বলে প্রায় জোর করে বিদায় করি। মাফ চাইতে-চাইতে তার মুখে ফেনা উঠে গেছিল এবং তার কিছু কিছু আমার মুখেও ছিটকে এসে পড়েছিল, সেগুলো সম্ভবত এখনও শুকোয়নি।’ তখন লোকজন তার কাছ থেকে আবার স্কুলের দিকে হাঁটতে থাকে। লোকটাও তাদের সঙ্গ নেয়।
পরে মাঝের লোকগুলোর মধ্যে থেকে কয়েকজন একসঙ্গে হুরমতির প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্নমাখা উত্তর করে—‘মাস্টার না কি স্কুলে মারা গেছে? তখন হুরমতি পাগলি বলে—এটা হতেই পারে না কারণ মাস্টার স্কুল যাবার পথে প্রতিদিন আমার কুঁড়েতে যায়। কিছুক্ষণের জন্য সে আমার স্বামী হয়। এটা সে করে তার বউটা অসুস্থ হয়ে যাবার পর থেকে। আজও গেছিল এবং সে বের হবার কিছুক্ষণ পরে আমি গামছা নিয়ে বের হয়েছি, নদী যাচিছ গোসল করব বলে এবং আমার এটার ভেতর (বলে সে তার গুপ্তাঙ্গ নির্দেশ করে তর্জনি দিয়ে) এখনও তার শিশ্নকলজলগুলো লটপট করছে।
আজু পাগলা এবং কুয়োর কাছের লোকটাও সঙ্গ নিয়েছিল। এভাবে অনেকেই মিছিলটার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছিল। মিছিলটা ধীরে ধীরে বড় হতেই ছিল। লাহারপুরের গনেশজননী মন্দিরের কাছে পৌঁছানোর কদম কয়েক আগে আরও কিছু মানুষ এতে যুক্ত হয়। এসময় হুরমতি পাগলি গোসল করার জন্য গামছাটাকে ওড়নার মতো করে শাড়ির ওপর দিয়ে, বুকের ওপর রেখে হেঁটে আসছিল। সমপদে হাঁটা লোকজনের দৃষ্টি তার দিকে যায় এবং কয়েক সেকেন্ডের জন্য হলেও তারা ‘কেন এবং কোনদিকে হেঁটে যাচ্ছে’ সে ব্যাপারটি ভুলে যায় কিন্তু চলা থামায় না। সকলের দৃষ্টি আর মনোযোগ চলে যায় হুরমতির দিকে। হুরমতির গামছওয়ালা বুকের দিকে সবকটি মানুষ তাকায় একই সঙ্গে এবং তারা সকলেই বুঝতে পারে হুরমতি নিচে ব্লাউজ পরে নাই। বুকদুটোর দোলন ছিল স্পষ্ট। এতগুলো মানুষ একসঙ্গে কোথায় হেঁটে যাচ্ছে সেটা জানার ইচ্ছে জাগে হুরমতির এবং অবাকমাখা একটা স্বর তৈরি করে সে প্রস্তুত হয় তার প্রশ্নটি নিয়ে। হাঁটার দল তার কাছাকাছি এলে সে প্রশ্নটি করে ফেলে। তার প্রশ্নটি শুনে লোকজনের মনে পড়ে তারা ‘কেন যাচ্ছে এবং কোনদিকে যাচ্ছে’। ‘কেন যাচ্ছে এবং কোনদিকে যাচ্ছে’ একথা ভুলে যাওয়ার পর হঠাৎ মনে পড়ার ধাক্কা সামলাতে সামলাতে সামনের মানুষগুলো হুরমতির প্রশ্নের উত্তর না করে, তাকে ছেড়ে আরও কিছুটা এগিয়ে যায়। পরে মাঝের লোকগুলোর মধ্যে থেকে কয়েকজন একসঙ্গে হুরমতির প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্নমাখা উত্তর করে—‘মাস্টার না কি স্কুলে মারা গেছে? তখন হুরমতি পাগলি বলে—এটা হতেই পারে না কারণ মাস্টার স্কুল যাবার পথে প্রতিদিন আমার কুঁড়েতে যায়। কিছুক্ষণের জন্য সে আমার স্বামী হয়। এটা সে করে তার বউটা অসুস্থ হয়ে যাবার পর থেকে। আজও গেছিল এবং সে বের হবার কিছুক্ষণ পরে আমি গামছা নিয়ে বের হয়েছি, নদী যাচিছ গোসল করব বলে এবং আমার এটার ভেতর (বলে সে তার গুপ্তাঙ্গ নির্দেশ করে তর্জনি দিয়ে) এখনও তার শিশ্নকলজলগুলো লটপট করছে। তার কথা শুনে যাদের পা একটু শিথিল হয়েছিল তারা দ্রুত হাঁটতে থাকে। প্রশ্নবহনকারী মিছিলটিতে সকলেই একসাথে আছে কিন্তু প্রত্যেকের মাথা আলাদা আলাদা করে হুরমতি পাগলির ‘শিশ্নকলজল’ শব্দটির জাদুতে ঢুকে পড়ে। নদীর দিকে যাওয়া বাদ দিয়ে হুরমতিও স্কুলের দিকে অগ্রসরমান মাস্টার দেখা মিছিলের সঙ্গে হাঁটতে থাকে।
স্কুল ক্যাম্পাসে পৌঁছে তারা স্কুলের টেবিলে মাস্টারের লাশটিকে শোয়ানো অবস্থায় দেখতে পায় এবং তার ব্যাপারে যা শুনতে পায় তা হলো—ধর্মের মাস্টার প্রথমে ইতিহাসের মাস্টারকে ভূগোলের মাস্টার মরে গেছে না কি? প্রশ্নটি করলে, ইতিহাসের মাস্টার ভূগোলকটির দিকে ইঙ্গিত করে। সেটি তখন ঘুরছিল। কারণ ক্লাসে যাওয়ার পূর্বে ভূগোলকটি সামনে নিয়ে কিছুক্ষণের জন্য বসেছিল ভূগোলের মাস্টার এবং ভূগোলকটি আস্তে-আস্তে তর্জনি দিয়ে ঘোরাচ্ছিল চুপচাপ চেয়ারে হেলান দিয়ে। বোঝা যাচ্ছিল না, অন্য মাস্টারেরা যেসব গল্প করছিল, তা সে শুনছে কি না। কিন্তু ধর্ম মাস্টার ভূগোল মাস্টারের দিকে নজর দিয়েই ছিল। একসময় ভূগোল মাস্টারের হাতটি থেমে যায় কিন্তু গোলকটি তখনও ঘুরছিল। ঠিক এ সময়টাতেই ধর্ম ইতিহাসের দিকে ইঙ্গিত করে বলে—ভূগোল বুঝি মরে গেছে। এমনভাবে সে চেয়ারের ওপর এলিয়ে পড়েছে। ইতিহাস অর্থাৎ ইতিহাসের মাস্টার সেই সময়টাতেই নিজ অক্ষে ঘুর্ণায়মান ভূগোলকটিকে দেখায়, যা তখনও ঘুরছিল এবং তা ঘুরছিল ভুগোলের মাস্টারের শক্তির সাহায্যেই। নিজ অক্ষে ঘুর্ণায়মান ভূগোলকটির দিকে ইতিহাস ইঙ্গিত করে বোঝাতে চাইছিল, সে বেঁচে আছে। তারপরেও তাকে অর্থনীতির মাস্টার—এই মাস্টার তুমি মরে গেছ নাকি? বলে নাড়াতে গেলে বুঝতে পারে সে, সে মারা গেছে এবং তখনও নিজ অক্ষে ভূগোলকটি ঘুরছিল। ভূগোলটি ঘুরলেও অর্থনীতি বুঝতে পারে—এই মাস্টার তুমি মরে গেছ নাকি? এই প্রশ্নটি একজন মৃত মানুষকেই করা হয়েছে। আর এ ব্যাপারগুলো খুবই অল্পসময়ের মধ্যেই সম্পন্ন হয়। এ কথাগুলো স্কুলে এসে শোনার পর লোকজন মাস্টারের মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চিত হয় এবং বুঝতে পারে তার মৃত্যুর ব্যাপারে শোনা প্রশ্নসংবাদটি আসলে উত্তরসংবাদ ছিল। তখন লোকজন মাস্টারের লাশ স্কুলের টেবিলের ওপর থেকে একটা দড়ির খাটে নেয়। মাস্টারের বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে মাস্টারের লাশযুক্ত মিছিল। শিশ্নকলজলযুক্তা হুরমতি পাগলি নদীর পথ ধরে। মাস্টারের মৃত্যুতে একধরনের বিষণ্নতা অনুভব করে গোটা গ্রামের মানুষ।