কেন বাবা?—প্রশ্নটা করে ছেলের কাছে উত্তরের আশা করেনি হাসুনি বুড়ি। তবে ছেলের কণ্ঠে দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়—তুমি তো আমার বিলের জলের উড়াল মাছ বাপজান। দেখা যায় কিন্তু ধরা বড় কঠিন।
উত্তরে কী বলবে ছেলে এবার? আজহার চুপ করে শোনে।তুমি ভালো থাকো, সুখে থাকো; সব সময় সেই দোয়া করি। এবার হাসুনির কণ্ঠে ঘড়ঘড়ে দীর্ঘশ্বাস। সেই যে বাড়ি থেক্যা বাহির হল্যা আর ফিরলা না। কেন গাঁয়ের মানুষগুলা মানুষ না? এদের ডাক্তার লাগে না? টাকা পয়সাই সব?
উত্তরে মাকে কী বলবে আজহার? প্রতিবার দেখা হলে এ প্রসঙ্গ মা তুলবেনই একবার। আগে মাকে অনেকভাবে বোঝানোর চেষ্টা করত আজহার। এখন আর করে না। চুপ করে থাকে। প্রসঙ্গ পাল্টাতে সে বলে, তুমি তো আমাকে কখনো ফোন করো না। ওই তো আমিই করি।
তুমি যে কামে থাকো। ফুন করি কেমনে কহ? তুমার মন চাহিলে তুমিই ফুন দিবা। হাসুনির তো সাত রাজার ধন এই একজনই। রাত-দিন তো ওই ছেলের কথাই ভাবেন। ছেলে তার নামিদামি ডাক্তার, সব সময় ব্যস্ত। ফোন করে বিরক্ত করা চলে? তার সময়ের কত দাম!
সত্যি আজহার অনেক ব্যস্ত ডাক্তার। সকাল সাতটা থেকে চেম্বারে রোগীর ভিড় শুরু হয়। দশটা পর্যন্ত রোগী দেখে। তারপর সরকারি হাসপাতালে ঢু মেরে বিকেলে আবার চেম্বারে রাত এগারোটা পর্যন্ত চলে রোগী দেখা। এরই মধ্যে সময় করে প্রতিদিন সন্ধ্যা বেলায় মায়ের সঙ্গে দুই-চার মিনিট কথা বলে। মাগরিবের নামাজ পড়ে হাসুনি ফোনের সামনে প্রতিদিন বসে থাকে। কখন ছেলের ফোন আসে! প্রতিদিনই ফোন করে আজহার। কিন্তু মাঝে মাঝে কাজের চাপে পেরে ওঠে না। সেদিন হাসুনির ভালো ঘুম হয় না। বুকের ভেতরটা আনচান করে। ভালো আছে তো যাদু? কোনো অসুখ করেনি তো? একদিনের কথা, আজহার দুদিন ধরে ফোন করেনি। হাসুনির আর ঘুম আসে না। ছেলের বাপ গায়েবি থেকে বললেন, দেখ না দেখি একবার ফুন করে আজহারের হলটা কী? আজাহারকে ফোন করতেই সে ফোন ধরে বলল, মা, তুমি আবার এত রাতে ফোন করেছ কেন? একজন রোগী মরামরা অবস্থা, তাকে নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত আছি। খাবার সময় পর্যন্ত পাইনি। রাখছি।
হাসুনি বলতে চেয়েছিলেন, রোগীর দেখভাল করছিস ভালো কথা, নিজের খাওয়াটার দিকে নজর তো দিবি। কিন্তু বলা হলো না। ফোন রেখে দিয়েছে আজহার। আজহারের সেদিনের কথায় উষ্মা ছিল। হাসুনি বুড়ির ভালো লাগেনি।
মা তুমি আমার কথার উত্তর দিলা না?—আজহার বলে।
কুন কথার রে?
ওই তো আমার সঙ্গে ঢাকায় যাবা কি না?
না রে বাবা। বার বার তোর ওই এক কথা।
কেন?
একবার চিকিৎসার জন্য মাকে জোর করে নিয়ে গেছিল আজহার। আজহার আর তার বউ ডাক্তার নিক্তা সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। একমাত্র মেয়ে সেও জার্মানিতে পড়াশোনা করছে। বাড়ি একেবারে ফাঁকা। সারাদিন একা একা থাকতে থাকতে কদিনেই হাঁপিয়ে উঠেছিলেন হাসুনি বুড়ি। সেই দুমাসের কথা মনে করলে এখনো হাসুনির বুক কাঁপে। গ্রামে একা থাকলে কী হবে—এখানকার আকাশ, বাতাস, নদী-বিলের জল, আশেপাশের মানুষজন সবাই তার আপনজন। হাসুনি এবার অন্য কথা পাড়ে, তুমি আসব্যা শুইন্যা আইজ সক্কাল থ্যাইক্যা বিলে ছিপ ফেল্যা বস্যাছিলাম। মরার মাছগুইলা একটাও ধরা দিল ন্যা। ঢাকায় কী সব পচাসড়া মাছ খাও! মুড়িবাচা, তিন কাঁটা, বাঁশপাতা মাছগুলা তুমার কত পছন্দের। আহারে! বাপ হামার খেতে পায় ন্যা!
কিসের তোমার এত টান এই গাঁয়ের ওপর? নিজের ছেলের কাছে থাকতে চাও না?
এখানে হামার সংসার আছে না?
তুমি তো এখানে একা!
হামাদের ছয় জনের সংসার সঙ্গে আছে তোর বাপ। সে তো আছে বাঁশ ঝাড়ের নিচে। মানুষ মরলেই কি তার লেনদেনা সব শেষ হয়ে যায় বাপ?
ছয় জনের সংসার? তোমার কথার ভেদ বুঝি না।
হামি আর হামার তিনটা মুরগী আর দুটা মোরগ। ওরা হামার কেউ না?
ওরা আমার চেয়ে আপন?
হাসুনি ডাক দিয়ে ওঠে, আজাহার।
উঠোনে রাখা খুল্লার ঘুটঘুটে অন্ধকার থেকে আজাহার ডাক দিয়ে ওঠে, কক্কোরাস, কক্কোরাস।
হাসুনির কথায় ছেলে আজহার বিরক্ত হয়ে বলে, তুমি তোমার মোরগের নাম আজহার রেখেছ?
আজহার নারে আজাহার।
ওই হলো।
আরো আছে শুনবি? আজহারের উত্তরের আশা না করে ডাকতে থাকে, হাসুনি, মকবুল, আমেনা, আবেদা! ডাকে সবাই সাড়া দেয়।
টাকা পাঠাতে চাই, তাও নিতে চাও না।
তোর বাপের তো খোরাক লাগে ন্যা। আর হামরা ছয় জনের দুকোটা চাল হলেই চলে যায়। আজহারের বাবা আবু ছিলেন আচরণে, কর্মে মাটির মানুষ। তার শরীর জুড়ে থাকত সোঁদা মাটির গন্ধ। আজহার বাঁশঝাড়ের নিচে বাবার কবরের পাশে দাঁড়ালে আজও সে গন্ধ টের পায়। নিজের জমি নিজে চাষবাস করতেন তিনি। বড়ই ভালো লোক ছিলেন। কিন্তু একটা দোষ ছিল তার। তার কথা-কাজে ছটরফটর ভাব ছিল। সব কিছুতে যেন ধড়ফড়ানি। আর সন্ধ্যা হলে সাঁওতাল পাইটদের সঙ্গে তাড়ি নিয়ে বসে যেতেন। আজহারের মা স্বামীর ওপর এসবের কারণে মাঝে মাঝে রাগ করতেন—তুই মরলে হামি শান্তি পাই।
বাবা আবু বলতেন, মোর্যাও তোকে জ্বালাবরে। ভূত হয়ে তোকে ভয় দেখ্যাব। আঁচল ধরে টাইন দিব। চুলের খোপা খুলে দিব। হা হা হা। দশ বছর হলো তিনি গত হয়েছেন। কিন্তু আজও নাকি তিনি আজহারের মায়ের পেছন ছাড়েননি। গায়েবি মানুষটা এসে হাজির হন যখন-তখন। আজহারের মা হাসুনি এমনই তো বলেন।
কেন যে বোঝো না তুমি; এ বয়সে তোমার যত্নআত্তি দরকার। গাঁয়ে ভালো ডাক্তার নাই।
ক্যানেরে তোর পরিতোষ কাকা আছে না? ও কি কম বড় ডাক্তার! বৃটিশ আমলের পাস ডাক্তার। গাঁয়ের মানুষগ্যালারে যত্নআত্তি করেছে এ্যাতদিন। কত মরা মানুষ ওর বড়িতে জিন্দা হলো! তোর বেনু কাকা! তার গল্প তো জানিস, নিরাক পড়া ভাদ্রের পোহাতে মাঠে কাম করছিল। বহুর সাথে কাইজ্জা কর্যাছিল ওদিন। রাগ কর্যা বহু আর লাহারি পাঠাইনি মাঠে। দুপ্পহারে সূর্য্য যখন মাথায় উঠল গোড়া পঁচা তালগাছের মতন বেনু ধপ্পাস কর্যা পড়ল লাঙ্গল খাওয়া ফরফরা মাটির ওপরে। আশপাশের জমিতে তখন চাষারা কাম কইরছিল। দেখে দৌড়িয়ে আইল। দেখে, বেনুর ধড়ে যান নাই। তোর পরিতোষ কাকার কাছে লিয়ে গেল। কী একটা বড়ি দিল মরা মানুষ জিন্দা হয়ে খাড়াল। তোর বেনু কাকার বহু বিলকিসের আহাজারি যুদি দেখতিস সেদিন। হামাকে মাফ কর্যা দাও। তুমি মরে গেলে হামার কী হতো? ওই কহে না বনের বাঘে না, মনের বাঘে খায়। গুস্সা হইল মনের বাঘ।
মায়ের কাছে এ গল্প অনেকবার শুনেছে আজহার। তাই এই গল্পে কোনো আগ্রহ নেই তার। পরিতোষ বাবু ব্রিটিশ আমলে পশুচিকিৎসার ওপর রাজশাহীতে কিছুদিন পড়াশোনা করে একটা ডিপ্লোমার সার্টিফিকেট জোগাড় করেছিলেন। তারপর গ্রামে এসে খুলে বসেছেন পশুচিকিৎসালয়। কিন্তু গ্রামের হাভাতে মানুষগুলো পালিত পশুগুলোর বদলে নিজেদের চিকিৎসা করতেই তার কাছে আসা শুরু করে। প্রথম প্রথম পরিতোষ বাবু না না করতেন, আরে হামি কি মানুষের ডাক্তার? হাভাতেরা বলত, কী যে কহ! পশু আর হামাদের মধ্যে পার্থক্য কতটুকু কহ? না না করলেও এক সময় আর পারেন না পরিতোষ বাবু। কারণ এক বছরে একটা গরু ছাগলও কেউ চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসে না তার কাছে। পাশের কাঁঠাল গাছটার পাতা খেতে প্রতিদিন দুচারটে গরুছাগল ঠিকই আসত। ওদের দিকে ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে থাকতেন পরিতোষ বাবু। কত যে রোগ বাসা বেঁধেছে ওদের শরীরে, দূর থেকে দেখেই বুঝতে পারতেন, কিন্তু ওদের মালিক যদি না চায়, তিনি কী করতে পারেন? গ্রামের মানুষের ওই তো এক কথা—গরু-ছাগলের চিকিৎসার দরকার কী? পারলে মানুষের বাঁচাও। পরিতোষ শুরু করেন পশুর বদলে মানুষের চিকিৎসা।
শৈশবে আজহার পরিতোষ কাকাকে ঘিরে তার বাবা-মায়ের মাঝে অনেকবার ঝামেলা হতে দেখেছে। সে ডাক্তার এখনো বেঁচে আছেন! আজহার প্রশ্ন করে।
কেন রে হামি বেঁচে আছি না? তোর পরিতোষ কাকা হামার চেয়ে বছর তিনেক বড় হবে। হাসুনি বুড়ির স্মৃতি চাঙ্গা হয়ে ওঠে। তিনি পরিতোষের সঙ্গে শৈশবে কত খেলাধুলা করেছেন! হাসুনির বিয়েশাদি হয়ে গেল তারপর না গাঁটছাড়া হয়েছে দুজনের। হাসুনির শরীর খারাপ হলে এখনো কাঁপা কাঁপা হতে লাঠি নিয়ে পরিতোষ ডাক্তারের কাছে গিয়ে বলেন, পরিতোষ দা, একটা বড়ি দ্যাও তো দেখি। শরীরটা ভালো য্যাচ্ছে না।
পরিতোষ ডাক্তার কাঁপা কাঁপা হাতে কাগজের বুকে ঘচাঘচ ওষুধের নাম লিখতে লিখতে বলেন, কেনেরে হাসু? তুই এত বড় ডাক্তারের মা! আমার হাতের ওষুধ খাবি?
হাসুনি উত্তরে কিছু বলেন না। শুধু পরিতোষ ডাক্তারের চোখের দিকে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে থাকেন। ওষুধের নাম লেখা কাগজটা আঁচলে বেঁধে হাসুনি বুড়ি বাড়ি ফেরেন কিন্তু বটতলার ‘মায়ের দোয়া ফার্মেসি’ থেকে ওষুধ আর কেনা হয়ে ওঠে না।
মা, তুমি বাঁচবে আরও অনেক দিন—আজহার হঠাৎ বলে ওঠে।
ছেলের কথা শুনে আনন্দে মায়ের মুখের বালিরেখা আরও গভীর হয়। ছেলে তার বড্ড ভালো মানুষ। পাঁচ পাঁচটা বাচ্চা মরার পরে আজহার এলো হাসুনির কোলজুড়ে। তার ভাঙা ঘরে চাঁদের আলো। সে মানিক নিজের চেষ্টায় কত বড় ডাক্তার হয়েছে। কত খ্যাতি, নামডাক তার। গাঁয়ের লোকে হাসুনিকে ‘ডাক্তারের মা’, ‘ডাক্তারের মা’ বলে ডাকে। হাসুনির কত ভালো লাগে শুনতে। তিনি বলেন, বাবা একটু ঘুমা। ভোরে উঠে তো রওনা হবি।
রাজশাহীতে বিশ্বপ্রবীণ দিবস উপলক্ষে একটি সেমিনারে বক্তৃতা দিতে এসেছিল ডাক্তার আজহার। সেমিনারের বিষয় ছিল ‘প্রবীণ নাগরিকের জন্য বিশেষ যত্ন’। সেমিনারে বক্তৃতা দিতে গিয়ে আজহারের বুকটা দুরু দুরু কাঁপছিল। তার মা একা একা গ্রামে থাকে, ভালো যত্ন হয় না। প্রবীণদের শারীরিক যত্নের সঙ্গেসঙ্গে মানসিক যত্নটাও অনেক জরুরি। সে সেমিনার শেষে ড্রাইভারকে ছুটি দিয়ে নিজে ড্রাইভ করে চাটাইডুবি এসেছে। ড্রাইভার, চাকর, অফিসের পিয়নদের সঙ্গে প্রাইভেসি মেনটেন করে চলে আজহার। ওরা সুযোগ পেলেই গালগল্প বানিয়ে রাষ্ট্র করে বেড়ায়। এবার সে ঠিক করেছিল, কিছু দিনের জন্য হলেও মাকে নিয়ে যাবে সঙ্গে করে। কিন্তু মা কোনোভাবেই রাজি হচ্ছেন না।
হাসুনি বুড়ি বক বক করেই চলেছেন, দুপ্পহারে স্কুল থেক্যা এ্যাসা সেদিন বারহিয়ে গেলি। আর খবর নাই। খবর নাই তো না-ই। সন্ধ্যা হয়্যা যায় বাড়ি আইলি না। হামি আর তোর বাপ এই বাড়ি যাই, ঐ বাড়ি যাই, তোর খবর নাই। তোর নেউটা বন্ধু আলামিন। ওর বাড়িও গেলাম। আলামিন কহল, হামরা তো চাতালে খেলছিলাম তারপর তো হামি বাড়ি চলে আইনু। আলামিনও বারহাল তোর খোঁজে। শেষে মিনহাজ হাজির চাতালে যেয়্যা দেখি মানুষের জটলা। হামাকে দেখে একজন কহল, তোমার বেটা একটুর জন্য মরছল! এই বাউল ওরে বাঁচাইছে। তুই চাতালের হাউজে পড়্যা ডুইবা গেছিলি। বাউল ফকিরটা ওখান দিয়ে য্যাবার সময় দেখে একটা লুঙ্গি ভাসছে হাউজের পানিতে। লুঙ্গি ধরে টানতে যেয়্যা উঠে আইলি তুই! জ্ঞান ছিল না তোর। হামি ঐদিন সকালে ঐ বাউলটারে গ্যাল দিয়ে তাড়িয়েছিলাম। গোসল কর্যা উঠানে ভিজা কাপড় মেলছি, ও কি কর্যাছে চাইল চাহিতে বাড়িতে ঢুকে গেছে! জুয়ান, মরদ লোক! আর তোর বাপ ক্ষেতে গেছে। বাড়িতে বেটা ছেলা কেহু নাই। কেমন হুস বুদ্ধি কহা লোকটার? খুব গ্যাল দিয়্যাছিলাম বাউলটাকে। সেই লোকটা কি না হামার ধনের যানকে বাঁচাল। হায়! আল্লাহ। জোরে জোরে শ্বাস নেন হাসুনি বুড়ি।
এই গল্প আজহার তার মার কাছ থেকে কমপক্ষে পাঁচশ বার শুনেছে। আর বার বার শোনার কারণে তার স্মৃতিতেও সেটা স্পষ্ট। আজহার বলে, আচ্ছা মা, আলামিন গলার দড়ি দিল কেন?
আহা জানিস ন্যা। হল্যান্ডা আলুতে ওর জীবন লিল।
আজহার অবাক হয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর মায়ের দিকে তাকায়।
ওবার আলামিন নিজের জমিতে, মানুষের জমি লিজ লিয়ে হল্যান্ডের আলু চাষ কর্যাছিল। আগের বছর জমিতে হল্যান্ডের আলুর চাষ করে সবাই ভালো লাভ কর্যাছিল। এবার বেশি লাভের ল্যাগ্যা পরের জমিও লিজ লিল। আলু হলোও ভালো কিন্তু আলুর দাম কম্যা গেল। দুটাকা কর্যা কেজি। গানু মিয়ার কোল্ড স্টোরেজে রাখল। সিজিন শেষে দাম বাড়লে বিক্রি করবে। কিন্তু দাম বাড়লো না। এদিকে স্টোরেজের ভাড়া আলুর দরের চেয়ে দ্বিগুণ হলো! কী করবে ছেল্যাটা? গলা পর্যন্ত দেনা! এখান দিয়ে গেলে, চাচি চাচি বলে বাড়িতে উঠত তোর খবর লিত।
টিনের ঘরে স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে আজহারের ঘুম আসে না। একটু চোখ বন্ধ না করতে পারলে সকালে ড্রাইভ করবে কিভাবে? মাকে সে অনেকবার বলেছে, এখানে একটা পাকা বাড়ি করে দেই? তা মা শুনবেন না। মাটির বাড়িতে নাকি বেশি সুখ। অবশ্য যার যেখানে অভ্যাস। নয় কী? আজহার প্রশ্নটা ছুড়ে দেয় নিজের বিবেকের কাছে।
ভোরে মোরগের ডাকে আজহারের ঘুম ভাঙে। ঘরের দরজাটা হা করে খোলা। এক চিলতে নীল আলো ঘরের দরজায় পর্দার মতো ঝুলছে। আজহারের মা নেই ঘরে। নিশ্চয় চুলোয় কালায়ের রুটি সেঁকছেন। তারই মৃদু ঘ্রাণ আজহারের শৈশবের স্মৃতির মতো ছুটে বেড়াচ্ছে ঘরজুড়ে। শত ব্যস্ততার মাঝে ছুটি নিয়ে বছরে তিন চারবার বাড়িতে আসে আজহার। আর ফেরার সময় এভাবেই ঘুমটা ভাঙে তার। জীবন মনে হয় এমনই একটা চক্র। বার বার ফিরে আসে সম্পর্কের সূত্রগুলো নিজের জীবনে—অতপর এক জীবন থেকে আরেক জীবনে। আর চরিত্র! তারা বদলায় না শুধু চরিত্রের ভূমিকা বদলায়। মোরগ মুরগীগুলো উঠোনে লুটোপুটি করছে। হাসুনি বুড়ির ছিটিয়ে দেওয়া দানাগুলো টুঙে টুঙে খাচ্ছে ওরা। আজহারকে দেখে ওরা ভয় পেয়ে দ্রুত সরে গেল না। কোন মোরগটার নাম আজাহার তা বোঝার চেষ্টা করে সে। মায়ের কাছে এসে দাঁড়ায় আজহার। মায়ের চোখ দিয়ে জল ঝরছে—হয়ত চুলোর ধোঁয়ার কারণে। আঁচল দিয়ে সেটা আড়াল করেন মা। রাতে চোখে ভালো দেখেন না। তবে দিনে ভালোই দেখতে পান।
ডা. আজহারের প্রাডোটা চাটায়ডুবি ছাড়িয়ে যখন বড় রাস্তাটায় উঠেছে হঠাৎ তার মনে হলো কী যেন বাড়িতে ভুলে ফেলে এসেছে। মোবাইলের চার্জার? চশমা? স্টেথোস্কোপ? স্ফিগ্মোমানোমিটার? রাতে মোবাইলে চার্জ দেওয়ার জন্য চার্জারটা বের করেছিল। চশমাটা সে শুধু পড়ার জন্য ব্যবহার করে। রাতে একবার মায়ের পালস্ চেক করেছিল। প্রেসারটাও মেপেছিল। সব কি ব্যগে আছে, না ভুলে ফেলে এসেছে কিছু? ইদানিং বড্ড ভুলোমনা হয়েছে সে। গাড়িতে ব্রেক কষে মাকে ফোন করে আজহার, হ্যালো মা, দেখতো কিছু ঘরে ফেলে এসেছি না কি?
ফোনের ওপার থেকে হাসুনি বুড়ি কাঁপা-কাঁপা কণ্ঠে বলেন, কী জানি বাপ! ভালো কর্যা মনে কর্যা দেখ; কী ফেল্যা গেছ?